বাঙালি জাতির নায়ক: ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
6 মিনিটে পড়ুন

আমরা বাঙালিরা আজ যাকে নায়ক বানাই, তার ভিলেন হতে কিংবা তাকে ভিলেন বানাতে আমাদের সময় লাগে না। কিন্তু আমাদের এমন একজন নায়ক আছেন। যাকে কেউ নায়ক করেনি, বরং তাকে খল নায়ক বানাতে, প্রাণে মারতে তাঁর সময়ে লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু তিনি তাঁর কর্মের দ্বারা, তাঁর মনীষা এবং সাহসের জন্য নায়ক হয়ে ওঠেছেন। সেই মহান নায়কের আজ জন্মদিন। বলছি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা।

১৮২০ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাঙ্গালি যে, দু-কলম লেখাপড়া করে দুটো করে-কর্মে খাচ্ছে সেজন্য বাঙালির তাঁর কাছে অশেষ ঋণ। কিন্তু বলা হয়ে থাকে পাপের ভারে রত্নাকর দস্যুর অবস্থা এমন হয়েছিল যে, তাকে রামনাম উচ্চারণের আদেশ দেওয়া হলেও সেই মুখে আর রামনাম উচ্চারিত হচ্ছিল না। রত্নাকর যখন চেষ্টা করেন, তখন তার মুখ দিয়ে মরা মরা শব্দ উচ্চারিত হতে থাক। বিদ্যসাগর সম্পর্কেও বাঙালির একই অবস্থা। যে লোকটা তাঁর জীবনভর একটা জাতির উন্নতির জন্য কাজ করে গেলেন, প্রাণপাত করে গেলেন, সেই লোকটা আজ বিস্মৃত। কেউ হয়ত বলতে পারেন, তিনি এবং তাঁর কাজ সমকালীন প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ। আজ হয়ত তিনি আর সেভাবে প্রাসঙ্গিক নন। তাই হয়ত তিনি বিস্মৃত হতে চলেছেন। একথা অনেক মনীষীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও বিদ্যাসাগরের ক্ষেত্রে নয়। কারণ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক এবং আইনি সংস্কার কোন জায়গাতে তিনি প্রাসঙ্গিক নন?

শিক্ষার ক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রামীণ বাঙালি এবং নারী শিক্ষার উন্নয়নে তাঁর যে অবদান, সেই ফিরিস্তি হাজির করতে হলে কয়েক পৃষ্ঠায় তা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। খোদ ইংরেজ শাসনামলে বাংলার কথিত বাবু সমাজ যখন ইংরেজি আদব-কেতা রপ্ত করতে প্রাণপাত করছেন, ঠিক সেই সময় ইংরেজ সরকারের দায়িত্বশীল পদে থেকেও পোশাকে, আচার-আচরণে এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে তিনি শতভাগ এদেশীয় সংস্কৃতিকে আঁকড়ে থেকেছেন এবং সেটা খোদ কলকাতার বুকেই, সাহেবদের পাশাপাশি চলেই। ঠিক একইভাবে তিনি সরাসরি রাজনীতি না করলেও, দেশের এবং দেশের কল্যাণের জন্য তিনি রাজনীতিকে কাজে লাগিয়েছেন, শাসকগোষ্ঠীকে ব্যবহার করেছেন। বিধবা বিবাহ আইন প্রবর্তন এবং প্রচলন তার সচেয়ে বড় উদহারণ। কিন্তু তিনি কখনো রাজনীতিবিদ কিংবা শাসকগোষ্ঠী কারো কাছে মাথা নোয়াননি। বরং পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রীকে তিনি একবার বলেছিলেন যে ভারতবর্ষে এমন কোনো রাজা-মহারাজা নেই যার নাকের ডগায় তিনি তাঁর চটিজুতো সমেত ঠক করে একটা লাথাই মারতে না পারেন। শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর এক লেখায় বলেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের এই কথা তাঁর একটুও অবিশ্বাস হয় নাই। সেটাই স্বাভাবিক, তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তাই বলতেন, তাই করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এদেশের মানুষের, এদেশের মেয়েদের মুক্তি মিলবে শিক্ষার প্রসারের মাধমেই। তাই তো তিনি শিক্ষার জন্য তাঁর প্রাণপাত করেছেন। আর এই শিক্ষা যেমন তাঁকে ইংরেজ সাহেবদের কাছ থেকে অধিকার আদায়ে, তাঁদেরকে উচিৎ শিক্ষা দিতে সহায়তা করেছে, তেমনি তাঁকে করেছে বিনয়ী। একদিন সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এসেছেন, বিদ্যাসাগরের সাথে দেখা করতে। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন বিদ্যাসাগর নিজে। তিনি পরমহংস দেবকে সাদরে গ্রহণ করে নিয়ে গিয়ে বসালেন ঘরে। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বললেন, এতদিন শুধু খালে-বিলে ঘুরেছি, আজ একেবারে সাগরে এসে পড়েছি।

বিদ্যাসাগর বললেন, সাগরে যখন এসেছেন, লোনা জল কিছু নিয়ে যান।
লোনা জল কি হে, তুমি তো ক্ষীর সমুদ্র। তুমি সিদ্ধ হে।
সিদ্ধ? আমি তো কখনো মঠে মন্দিরে যাই নাই। কখনো সাধনা করি নাই। আমি কিভাবে সিদ্ধ হলাম?
আলু-পটল সিদ্ধ হলে কি হয়? নরম হয়…মানুষের দুঃখে তোমার মন দ্রবীভূত হয়েছে, নরম হয়েছে। তুমি সিদ্ধ হয়েছ।

এই পরস্পরের কথোপকথন, এই যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, যা বাঙালি সমাজে এখন বড়ই বিরল। আমাদের সমাজে কথিত পন্ডিতদের অভাব নাই। কিন্তু অভাব হল সংবেদনশীলতার, শ্রদ্ধাবোধের। জীবনের এমন কোনো ক্ষেত্র নাই যেখানে আজ থেকে দু’শো বছর আগে জন্মগ্রহণ করা একজন মানুষ অনুসরণীয়, অনুকরণীয় নয়।

তাঁর দয়া দাক্ষিণ্যের জন্য তাঁকে বলা হয় দয়ার সাগর। কিন্তু এই দয়া দাক্ষিণ্যের বাইরে সচেতনভাবে, বাঙালি সমাজ তথা দেশের প্রয়োজনে, দেশের কল্যাণে এবং উন্নতিতে তিনি যাঁদেরকে আর্থিক সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের মধ্যে মাইকেল মধুসুদন দত্ত অন্যতম। তিনি বন্ধুর দুর্দিনে শুধু বন্ধু হিসাবে হাত বাড়িয়েছিলেন, তা নয়। তিনি জনতেন, মাইকেল মধুসুদন বাঙালির সম্পদ। এই যে একের পর এক গ্রামেগঞ্জে স্কুল প্রতিষ্ঠা, দয়া-দাক্ষিণ্য, বন্ধুদেরকে ধার দেয়া এগুলির অর্থসংস্থানের জন্য তাঁকে আর্থিকভাবে সংগতি বজায় রাখতে হত। সেই সংগতি যে সব সময় থাকত, তা নয়। কিন্তু তিনি কখনো এসব কাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেননি। অক্লান্ত পরিশ্রম তো ছিলই, তিনি ধারও করেছেন, অন্যকে ধার দেবার জন্য। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কর্মদক্ষতা ইংরেজদের মত, মনীষা ঋষিদের মত আর হৃদয় বাঙালি জননীর মতো।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পর্কে এ রকম হাজারো ঘটনা, কথা বলা যাবে। কিন্তু বলে কি হবে? আমাদের বর্তমান প্রজন্ম কি তাকে চেনে? নানা ধারায় বিভক্ত আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের একাংশ হয়ত বিদ্যাসাগরে নামই শোনে নাই। কাজেই যা হবার তাই হচ্ছে, ডিগ্রীধারীর সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু কমছে দেশপ্রেম, কমছে মাতৃভাষার প্রতি টান। বরং ভাষার প্রতি অবহেলা এবং তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যই এখন অনেক শিক্ষার্থী তো বটেই অভিভাবকের কাছে ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্ত আমাদের সামনে উদহারণ ছিল, মাতৃভাষায় শিক্ষলাভ করে, দেশীয় কায়দায় জীবন-যাপন করেও বিশ্বজনীন মানুষ হয়ে ওঠা যায়। বলতে পারেন, বিশ্বায়নের এই যুগে সেটা কতটা সম্ভব? হ্যাঁ, সে বিষয়ে দ্বিমত করছি না। কিন্তু আমরা যদি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে আমাদের নায়ক হিসাবে প্রজন্ম পরম্পরায় পরিচিত করাতে পারতাম, তাহলে হয়ত বাঙালির একেবারে উলটোপথে যে যাত্রা, সেটা রুখে দেওয়া যেত। বিদ্যাসাগরের কীর্তি যদি আমরা আমাদের শিশুদের মনে গেঁথে দিতে পারতাম, তাহলে এই নামটি উচ্চারোণের সাথে সাথেই মায়ের প্রতি, মাতৃভাষার প্রতি এবং মাতৃভূমির প্রতি ভালবাসার কথা অবচেতনে আমাদের মানসপটে ভেসে উঠত।

সময় অনেক পেরিয়ে গেছে বটে, কিন্তু শেষ হয়ে গেছে বলে আমি মনে করি না। আমাদের এরকম আরো একাধিক নায়ক আছেন। কিন্ত রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বিশ্বমানব হবি যদি, কায়মনে বাঙালি হ…সেই কায়মনে বাঙালি হওয়ার জন্য এবং বাঙালি হয়ে বিশ্বমানব হওয়ার জন্য বিদ্যাসাগরকে স্মরণে রাখা, চেতনায় ধারণ এবং অনুসরণের বিকল্প কে হতে পারেন?

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!