ধ্বংসাত্মক মতবাদ ফ্যাসিবাদের গতি ও প্রকৃতি

তপন ভট্টাচার্য
তপন ভট্টাচার্য
5 মিনিটে পড়ুন
ছবি সংগৃহীত।

দেশের প্রতিটি নাগরিকের তাদের একটি নিজস্ব দর্শন আছে। সেই দর্শনের নিরিখে আমরা প্রত্যেকে নিজের দেশকে গড়তে চাই নিজের মতো করে। নিজস্ব সেই দর্শন আবার রাজনীতির ঊর্ধ্বে নয়।। বিভিন্ন মতবাদের বিচার বিবেচনা করে আমরা স্থির করি কোন মতবাদটিকে গ্রহণ করবো। যত মত তত পথ হতেই পারে। কিন্তু একবার যদি কোন কারণে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি তাহলেই ঘটবে সর্বনাশ।

পৃথিবীতে যত মতবাদ আছে তার মধ্যে “ফ্যাসিবাদ” হচ্ছে মানব সমাজের পক্ষে সবচাইতে বিপজ্জনক এবং ধ্বংসাত্মক মতবাদ। এখন বিষয় হচ্ছে কিভাবে ফ্যাসিবাদকে চিনবো! যে কোনো শাসককে চেনার তিনটি মাপকাঠি হলো:- রাজনৈতিক প্রকৃতি, সামাজিক প্রকৃতি ও অর্থনৈতিক প্রকৃতি। এই তিনটি প্রকৃতি ‘ফ্যাসিস্ট’ শাসন ব্যবস্থায় কেমন হয় সেটা জানলেই আমরা “ফ্যাসিস্ট” শক্তি বা শাসককে চিনতে পারব। সেই আলোচনা করা এবং মানুষকে সতর্ক করার জন্যই এই লেখার অবতারণা।

রাজনৈতিক প্রকৃতি: উগ্র জাতীয়তাবাদের পেশী আস্ফালন করা এবং দেশের শত্রুর বিরুদ্ধে এই পেশী আস্ফালন করতে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করতে হয়, বাহিনীর প্রযুক্তিকে ব্যাবহার করতে হয়। দেশের বাইরের শত্রু ও ভেতরের শত্রুর নক্সা এমন ভাবে তৈরী করে প্রচার করা হয় যাতে মানুষকে সহজেই বিশ্বাস করানো যায় যে অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশত্রু আমাদের জাতীয়তাবাদকে দুর্বল করার জন্য চক্রান্ত করছে। এই নক্সা একসাথে দুটি পাখি মারার কৌশল হিসেবে দেশের ভেতরে দমননীতি চালানোকে বৈধতা দেওয়া এবং বহিঃশত্রুদের বিরুদ্ধে নিজেকে বড় করে জাহির করা।

এই দুটো নক্সা উত্তেজক ওষুধের মতো জনগণের মধ্যে কাজ করে এবং জনগণকে বাধ্য করে নেশা আবিষ্টের মতো ফ্যাসিস্ট নেতাকে অনুসরণ করতে। দেশের মানুষকে বোঝানো হয় যে দেশে এখন যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। এই সময়ে বেকার সমস্যা, মুদ্রাস্ফীতি এমনকি বড় ধরণের ব্যাংক জালিয়াতির মত ছোট খাটো সমস্যার কথা তুলে ক্ষোভ বিক্ষোভ এবং আন্দোলন করা উচিত নয়। কোথাও যুদ্ধের পরিস্থিতি না থাকলেও ফ্যাসিস্ট নেতারা দেশের ভেতরে যুদ্ধের মতো আবহাওয়া তৈরী করেন। এমনকি নকল খণ্ড যুদ্ধের মাধ্যমে শহীদ হওয়া বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রশংসা জ্ঞাপন করাই এখন জাতির একমাত্র কর্তব্য বলে প্রচার চালায়।
.
সামাজিক প্রকৃতি: সামাজিক প্রকৃতির ক্ষেত্রে সরকার ও রাষ্ট্র একটি মাত্র সংস্থা হিসেবে কাজ করে এবং প্রচার করে যে, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সমগ্র রাজনীতির অপরিহার্য অঙ্গ। জাতীয় নিরাপত্তার নামে যুদ্ধের কৃত্রিম আবহাওয়া তৈরী করে অঘোষিত জরুরী অবস্থা জারি করা হয়। এর সাথে প্রচার করা হয় বহিঃশত্রু এবং অভ্যন্তরীণ শত্রুর বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ করাটাই দেশপ্রেমিকদের একমাত্র কর্তব্য। যারা সমাজকর্মী এবং মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য লড়াই করছে, তাদের গায়ে দেশদ্রোহীতার লেবেল সেঁটে দেওয়া হয়। ফ্যাসিস্ট প্রবণতা দ্রুততার সাথে যাতে বৃদ্ধি পায় তার জন্য কোনো সংখ্যলঘু সম্প্রদায় ও নিজেদের ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ বাদে অন্য ধর্মের মানুষ ও রিফিউজিদের দেশের অভ্যন্তরিণ শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। যারা সমগ্র জাতিকে একত্রিত করার কাজে লিপ্ত থাকে তাদের প্রতি ঘৃণা ছড়ানো এবং সরকার পোষিত দ্বারা সন্ত্রাস করা হয়।

ফ্যাসিস্ট নেতারা প্রচার করতে থাকেন যে পুরাকালে আমাদের বিজ্ঞান বর্তমানের চাইতেও অনেক বেশী উন্নত ছিল। সবচাইতে মারাত্মক বিষয় হলো তারা নিজেদের সরকার আরোপিত অঘোষিত সেন্সরের মাধ্যমে নিজেদের পক্ষে সংবাদ উৎপাদন ও পরিবেশন করতে থাকে। এইসমস্ত খবরে কখনই দেশের প্রকৃত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থার কথা মানুষের সামনে তুলে ধরা হয় না। যেমন বেকার সমস্যা, কৃষকের দূরবস্থা এবং অর্থনীতির দৈন্য দশার কথা কখনই সামনে আনা হয় না। উপরন্তু বর্ণ বিদ্বেষ এবং জাতের নামে মানুষ হত্যর মাধ্যমে সামাজিক বাতাবরণকে বিষিয়ে তোলা হয় ও উগ্র জাতীয়তাবাদের পক্ষে মানুষকে একত্রিত করার চেষ্টা চালানো হয়।

অর্থনৈতিক প্রকৃতি: ফ্যাসিস্ট শাসক সবক্ষেত্রেই নকল যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে থাকে। এই ক্ষেত্রেও সেই একই অজুহাত তৈরী করে রাষ্ট্রকে আরও শক্তিশালী করতে হবে তাই এই সময়ে বিরুদ্ধ মতকে নির্দয়ভাবে দমন করে থাকে। বিরুদ্ধ মতকে দমন করার জন্য এবং ফ্যাসিস্ট মতবাদকে মানুষের মনে আরও দৃঢ় ভাবে প্রথিত করতে বিশেষ পদ্ধতির প্রয়োগ করে। এই বিশেষ পদ্ধতি হলো, বিচার ব্যবস্হা, শিক্ষা ব্যবস্হা, স্বশাসিত সংস্হা, প্রচার মাধ্যম এবং সর্বপরি সংসদকে নুইয়ে ফেলে অঘোষিত একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়। এত দমননীতির পরেও অনিবার্য অর্থনৈতিক সঙ্কট চাপা দিতে ব্যর্থ হয়। এমতাবস্হায় জনগণের উপর অতিরিক্ত কর চাপালে ফ্যাসিস্ট সরকারের Populist ভাবমূর্তিতে ধাক্কা খাওয়ার ভয় থাকে। সেই কারণে তাঁরা বড় ব্যবসায়ীদের বিশেষ অর্থনৈতিক সূযোগ সুবিধা দিতে থাকে। বড় ব্যবসায়ীরা এমনিতেই শক্তিশালী শাসকের সঙ্গে থাকে তাদের নিজেদের স্বার্থে।

ফ্যাসিস্ট শাসক তখন গরীবদের ছোটখাটো সুবিধা দেয় এবং গরীবদের পক্ষে থাকার বক্তৃতাবাজী চালিয়ে যায়। এর আড়ালে বড় ব্যবসায়ীদের সম্ভাব্য সূযোগ প্রদান ও সস্তায় প্রাকৃতিক সম্পদের উৎস তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য ব্যবসায়ীদের লাভজনক চুক্তিতে বশ করে রাখে।বড় ব্যবসায়ী যাতে আরও বড় হয় তার ব্যবস্হা করে। ব্যবসায়ীরা সরকারের হাতের মুঠোয় থাকে। তখন ব্যবসায়ীরা সরকারকে প্রতিদান স্বরূপ মানুষকে বোঝাতে থাকে যে দেশের অর্থনীতি খুব শক্তিশালী হয়েছে। এছাড়াও যেহেতু ফ্যসিস্ট শাসক বড় ব্যবসায়ীদের সূযোগ সুবিধা দেয় তাই তাঁরাও সরকারকে বিশেষ আর্থিক ও অন্যান্য সুবিধা দিয়ে থাকে।#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
পশ্চিমবঙ্গের বারাকপুরের বাসিন্দা। মূলতঃ রাজনীতি ও সামাজিক বিষয়ের উপরে লেখালেখি করেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!