আজ ‘মে দিবস’- মেহনতি জনতার আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগ্রামের স্মৃতিস্মারক দিবস

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
7 মিনিটে পড়ুন

আজ পয়লা মে। মহান মে দিবস। খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার আদায়ের রক্তঝরা দিন।

আগে শ্রমিকদের প্রতিদিন কাজ করতে হতো একটানা ১২ ঘণ্টা। তারই প্রতিবাদে ১৮৮২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আমেরিকার বিভিন্ন কলকারখানার প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক তাঁদের অধিকার নিশ্চিতের দাবিতে নিউইয়র্ক শহরে প্রথম সমাবেশের মধ্যে দিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা করেছিল, তাতেই সাড়া দিয়ে ১৮৮৬ সালের ১ মে আমেরিকার শিকাগাে শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা দৈনিক আট ঘণ্টার কাজ এবং ন্যায্য মজুরির দাবিতে ধর্মঘট শুরু করে।

তাদের ব্যাপক আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ নেয় ৩ মে। তাদের আন্দোলন যাতে আর বেশি দূর ছড়িয়ে পড়তে না পারে এবং আরও বেশি শ্রমিক যাতে সেখানে জড়ো হতে না পারে সে জন্য পুরো জমায়েতটাকে ঘিরে ফেলেছিল পুলিশ

ঠিক তখনই জমায়েত থেকে কোনও এক আন্দোলনকারী, কারও কারও মতে, ওই ভিড়ে মিশে থাকা মালিকপক্ষের ভাড়া করা কোনও এক দুষ্কৃতী পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা ছোড়ে। আহত হয় এক পুলিশ। তখনই পুলিশ প্রচণ্ড ক্ষেপে গিয়ে শ্রমিকদের ওপরে নির্বিচারে গুলি চালাতে শুরু করে। মুহূর্তের মধ্যে পুরো জায়গাটা হয়ে ওঠে রণক্ষেত্র। প্রাণ হারান ৬ জন শ্রমিক। এর ফলে পর দিন, মানে ৪ মে বিভিন্ন জায়গা থেকে হে মার্কেটে হাজার হাজার শ্রমিক এসে জড়ো হতে শুরু করেন। স্লোগান ওঠে— আট ঘণ্টার শ্রম, আট ঘণ্টার ঘুম এবং আট ঘণ্টার বিনােদন।

সেই প্রতিবাদ সভায় আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে কারখানার মালিকদের ভাড়া করা গুন্ডারা বোমা ছোড়ে এবং তাতে আরও ৪ জন শ্রমিক মারা যান। সেই সঙ্গে আহত হন জমায়েতে আসা বহু লোক। আহত হয় বেশ কিছু পুলিশও। গ্রেফতার হন অগণিত আন্দোলনকারী। পরে গ্রেফতার হওয়া শ্রমিকদের মধ্যে থেকে ধর্মঘট সংঘটিত করার দায়ে অগাস্ট স্পাইস নামে এক শ্রমিক নেতা-সহ মোট ৬ জনের ফাঁসি হয়। জেলখানায় বন্দি থাকা অবস্থায় আত্মহনন করেন এক শ্রমিক নেতা।

এই ঘটনার প্রায় তিন বছর পর, ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সমাবেশে ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তাব করেন রেমন্ড লেভিন এবং তার পরের বছর থেকেই সারা বিশ্ব জুড়ে এই দিনটি পালিত হচ্ছে।

এখন দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের নির্ধারিত সময় পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই স্বীকৃত। এশিয়া, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, লাতিন আমেরিকা-সহ ছােট-বড় সমস্ত দেশেই পালিত হয় ‘মহান মে দিবস’।

মে দিবসের অর্থ— শ্রমজীবী মানুষের উৎসবের দিন, জাগরণের গান, শােষণ-মুক্তির অঙ্গীকার, ধনকুবেরের-ত্রাস আর সংগ্রাম ঐক্য ও গভীর প্রেরণায় দিন বদলের দৃপ্ত শপথ নেওয়ার দিন। এই পয়লা মে দিনটিকে মর্যাদা দিতে ভারত-বাংলাদেশ-সহ বিশ্বের প্রায় ৯০টি দেশে সরকারিভাবে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং এ দিনটি তাদের কাছে জাতীয় ছুটির দিন।

১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে আমস্টারডাম শহরে সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একটি প্রস্তাবে পয়লা মে তারিখে মিছিল ও শোভাযাত্রা আয়োজন করার জন্য সমস্ত সমাজবাদী গণতান্ত্রিক দল এবং শ্রমিক সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এই সম্মেলনেই বিশ্ব জুড়ে সমস্ত শ্রমিক সংগঠন মে মাসের ১ তারিখে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না-করার’ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

অনেক দেশে শ্রমজীবী জনতা মে মাসের ১ তারিখটিকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালন করার দাবি জানায় এবং অনেক দেশেই এটা কার্যকর হয়। বহু দিন আগে থেকেই সমাজতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট এবং কিছু কট্টর সংগঠন তাদের দাবি জানানোর জন্য এই মে দিবসটিকেই মুখ্য দিন হিসাবে বেছে নিয়েছে।

কোনও কোনও জায়গায় শিকাগোর হে মার্কেটের আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মরণে এ দিন আগুনও জ্বালানো হয়।
পূর্বতন সোভিয়েত রাষ্ট্র, চিন, কিউবা-সহ বিশ্বের অনেক দেশেই মে দিবস হল একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সে সব দেশে এ দিন সামরিক কুচকাওয়াজেরও আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ এবং ভারতেও এই দিনটি যথাযথভাবে পালিত হয়ে আসছে। ভারতে প্রথম মে দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে।

আমেরিকা ও কানাডায় অবশ্য মে মাসে নয়, সেপ্টেম্বর মাসে শ্রম দিবস পালিত হয়। ১৮৯৪ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জন স্পারও ডেভিড থমসন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবারটিকে কানাডায় সরকারি শ্রমিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন।

কানাডার এই দিনটিকেই আমেরিকার কেন্দ্রীয় শ্রমিক ইউনিয়ন এবং শ্রমের নাইটও শ্রম দিবস হিসেবে পালন করার উদ্যোগ নিয়েছিল। হে মার্কেটের হত্যাকাণ্ডের পর আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড মনে করেছিলেন, পয়লা মে তারিখে যে কোনও সমাবেশই হানাহানিতে পর্যবসিত হতে পারে। সে জন্য ১৮৮৭ সালেই তিনি নাইটের সমর্থিত শ্রম দিবস পালনের প্রতি ঝুঁকে পড়েন।

আর্জেন্টিনায় ১৮৯০ সালে প্রথম শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। এ দিনটিতে সাধারণ ছুটি থাকে এবং সরকারিভাবে উদ্‌যাপন করা হয়। প্রধান শহরগুলোতে রাস্তায় শ্রমিকেরা শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ১৯৩০ সালে এ দিনটিকে সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়।

ব্রাজিলেও শ্রমিক দিবস সাধারণ ছুটি হিসেবে পালিত হয়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলো সারা দিন ধরে আলোচনা-অনুষ্ঠানের আয়জন করে। এ দিন ঐতিহ্যগতভাবে অধিকাংশ পেশাদার বিভাগের ন্যূনতম বেতনকাঠামো পুনঃনির্ধারণ করা হয়।

১৯৬২ সাল থেকে আলজেরিয়ায় পয়লা মে জাতীয় শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ দেশে পয়লা মে সবেতন ছুটির দিন।
বলিভিয়ায় পয়লা মে তারিখটিকে শ্রমিক দিবস এবং সাধারণ ছুটি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রায় সব শ্রমিকই এই দিনটিকে ভীষণভাবে সম্মান করে।

বাংলাদেশেও মে দিবসে সরকারি ছুটি। এই উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দিয়ে থাকেন। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠন দিনটি পালন করতে শোভাযাত্রা, শ্রমিক সমাবেশ, আলোচনা সভা, সেমিনার, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান-সহ নানা কর্মসূচি নিয়ে থাকে।

মে দিবসে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রমিক ফেডারেশন-সহ বিভিন্ন সংগঠন পৃথক কর্মসূচি পালন করে। প্রতি বছর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে মে দিবস উদ্‌যাপন করা হয়। গত বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল— মালিক-শ্রমিক নির্বিশেষ মুজিববর্ষে গড়ব দেশ।

শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে মে দিবস এক স্মরণীয় অধ্যায়। মে দিবস আজ হাজার হাজার শ্রমিকের পায়ে চলা মিছিলের কথা, আপসহীন সংগ্রামের কথা বলে। মে দিবস হল দুনিয়ার শ্রমিকদের এক হওয়ার ব্রত। আন্তর্জাতিক সংগ্রাম আর সৌভ্রাতৃত্বের দিন। প্রকৃতপক্ষে, মে দিবস বলতে বােঝায় শ্রমিকদের কাজের সময় হাস ও তাদের মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনমুখর একটি ঐতিহাসিক দিন।

এই দিনটিকে মে দিবস ছাড়াও বলা হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস। আন্তর্জাতিক শ্রমিক হত্যা দিবস, লেবার ডে, ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কার ডে। মেহনতি জনতার আন্তর্জাতিক সংহতি ও সংগ্রামের স্মৃতিস্মারক দিবস। তবে সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা হল, ১ মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের উৎপত্তি হলেও আমেরিকায় কিন্তু শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!