মে দিবসে কলম পেষা মজদুরদের ভাবনা..!

আবদুস সোবহান বাচ্চু
আবদুস সোবহান বাচ্চু
8 মিনিটে পড়ুন

আজ পহেলা মে। মহান মে দিবস। ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এই অগ্নিঝড়া শ্লোগান শুনেই বেড়ে ওঠা, বড় হওয়া। পুঁজিবাদী সমাজে শিক্ষা যখন পণ্য, তখন শিক্ষকও কলম পেষা মজদুর। ভাবনার এটুকু ভিন্নতা নিয়ে কোন বিতর্কে জড়াতে চাইনা।

তবে আধুনিকতার নামে এখন এই করপোরেট লাইফে স্যার বাদ দিয়ে টিচার বা মিস সম্বোধন, থ্রোইং টোন, বডি ‌ল্যাঙ্গুয়েজ আমলে নিলে শিক্ষকতা পেশাটি যে আগের সেই শ্রদ্ধা-সম্মান-ভক্তি-ভালোবাসার স্থানে আর নেই তা টের পাওয়া যায়। যদিও এতে শিশুদের তেমন কোন দোষ দেখিনা আমি। কেননা পৃথিবীর সব শিশুদের মত আমাদের শিশুরাও ৭৪% বিষয় দেখে শেখে।

করপোরেট জায়ান্টরা শিক্ষাকে শুধু পণ্য বানিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি, শিক্ষককে সে পন্য উৎপাদনের শ্রমিক বানিয়ে ছেড়েছেন। শ্রমিক মজদুরদের প্রতি তাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি, শিক্ষকদের প্রতি তারচেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। আবার এই শিক্ষকদেরও বিভিন্ন দলাদলিতে জড়িয়ে শ্রেণিশত্রুর মত একে অপরের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে আত্মকলহের বীজ সযত্নে বুনে রেখেছেন এবং আজ এই শিক্ষকদের মধ্যে সবচেয়ে অবহেলিত, অসম্মানিত অংশ হচ্ছে বেসরকারি বা ব্যক্তি উদযোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত স্কুল তথা কিন্ডারগার্টেনে কর্মরত শিক্ষকেরা। যাদের আপন বলতে কেউ থাকতে নেই।

সারা দুনিয়াব্যাপী এই যে অতিমারী কোভিড-১৯ এর কারনে আমাদের দেশে লাগাতার ১৮ মাস সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (মাদরাসা বাদে) বন্ধ ছিল। তখন এই শিক্ষকদের পাশে দাঁড়াবার মত সরকারি-বেসরকারি বা সাংগঠনিক কারও কোন উদ্যোগ দেখা যায়নি। সারা দেশে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি কিন্ডারগার্টেন এবং সমমানের স্কুলে কর্মরত লক্ষ লক্ষ শিক্ষক-কর্মচারি রয়েছেন, যাদের ৮০ শতাংশই মহিলা। তারা বেঁচে আছে কিনা তার খোঁজ রাখেনি কেউ। কেবল প্রতিষ্ঠান নয়, জীবন বাঁচাতে এ সময়ে এই শিক্ষকেরা তরকারি বিক্রি, পুরুষ শিক্ষকেরা ভ্যান-রিকশা চালানো, দিনমজুর এমনকি করোনায় মারা যাওয়া মানুষের মৃতদেহ গোসল সৎকারের মত কাজ করেও বেঁচে থেকে আবার ফিরেছে নিজ পেশায় নিজের দেবত্ব সম্পত্তি তথা জ্ঞান-বুদ্ধি-দর্শন নিয়ে জাতি গঠনের মানসে।

এদেশে এখনও ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো কিছু স্বপ্নভূক মানুষ স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে, সমাজ বিনির্মানের প্রথম ধাপ শিশু শিক্ষায় আত্মনিবেদিত হয়ে কিন্ডারগার্টেনের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রায় ৭০ বছর ধরে।

১৯৫২ সালে ভিকারুন্নেসা নূন স্কুলের মাধ্যমে এদেশে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। আর বরিশালে ১৯৭৬ সালে নূরিয়া কিন্ডারগার্টেনের মাধ্যমে। এখন কতটি কিন্ডারগার্টেন আছে বাংলাদেশে? এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবার মত কোন সংস্থা নেই, এটা আমাদের দুর্ভাগ্য। তবে এটুকু নিশ্চিত, এ সংখ্যা অর্ধ লক্ষাধিক।

বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৭,৬৭২টি। জেনে দেখবেন, এর মধ্যে ৩৫ হাজারেরও বেশি স্কুল স্বাধীনতাপূর্বকালে স্থাপিত। বিদ্যালয় বিহীন এলাকায় নতুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৬৩৪টি। আর ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত নতুন জাতীয়করনকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ২৫,২৪০টি। যা আপনার আমার মত কেউ না কেউ প্রতিষ্ঠা করে, খেয়ে না খেয়ে বহুদিন সচল রেখেছিল। অব্যাহত রেখেছিল দেশের প্রাথমিক শিক্ষার ধারা। প্রত্যেকটি সংখ্যাই বর্তমান কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যার চেয়ে কম। কাজেই কিন্ডারগার্টেন শিক্ষক নামের এই কলম পেষা মজদুরদের অবদান দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় কতটুকু তা বোধ করি আর বলে দেবার দরকার নেই।

সুযোগ পেলেই বলি, আজও বলছি- আমার অত্যন্ত প্রিয় মানুষ, দীর্ঘ দিনের সাংগঠনিক বড়ভাই, দেশের নন্দিত ছড়াকার অধ্যাপক দীপঙ্কর চক্রবর্তীর একটি ছড়া-
“দেড়’শ টাকা পাবার কথা ইশকুলেতে মাইনে,
পঁচিশ/ত্রিশ পাই রেগুলার আর বাকিটা পাইনে।
পকেট থেকে খরচ করি, মিথ্যে আশার প্রাসাদ গড়ি,
একদিন সব পাবার আশায়, অন্য কোথাও যাইনে..।”

এত শ্রম, এত স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে আমাদের কি সত্যি কোথাও যাবার সুযোগ আছে? যদি না থাকে, তবে ধৈর্য্য ধরে, মাটি কামড়ে অপেক্ষা করুন। একা না থেকে সংগঠিত থাকুন। কেবল পেশাগতভাবে সংগঠিত থাকলেই শ্রেণি সংগ্রামে অগ্রসর সহজ হয়, অভিষ্ঠ লক্ষে পৌঁছুনো যায়। তবে সে সংগঠিত থাকাটা মরীচিকার পিছনে নয়, মুদ্রার এপিঠ থেকে ওপিঠে নয়।

সংগঠিত থেকেই নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানের পরিবর্তন যে কতটা সম্ভব এ সম্পর্কে একটি উদাহরণ দিয়ে আজকের লেখা শেষ করতে চাই। তবে তার আগে বিনয়ের সাথে বলে নিচ্ছি, এটা কেবলই ইতিহাস বলা। কোনো পেশাকে হেয় করা নয়। কারো কাছে এটি অজানা থাকলে, এ অবাধ তথ্য প্রযুক্তির সময়ে কিছুটা পড়াশুনা করলেই জেনে যাওয়া সম্ভব।

s মে দিবসে কলম পেষা মজদুরদের ভাবনা..!
আবদুস সোবহান বাচ্চু

বর্তমান সময়ে যে ক’টি পেশার মানুষ সমাজে খুব সমাদৃত ও অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল। প্রয়োজন ও মর্যাদার বিবেচনায় উচ্চাসনে উপবিষ্ট। তাদের মধ্যে ডাক্তার অন্যতম। অথচ ইতিহাস বলছে এই ডাক্তারদের উৎপত্তি হয়েছিল কৃতদাস থেকে। কৃষিকাজ ও পশুপালন ছাড়া আরো যে ৫টি ‘অড জব’ (odd jobs) কৃতদাসদের দিয়ে করানো হ’ত সেগুলো হচ্ছে, ধোপা, নাপিত, মুচি, মেথর ও ডাক্তার এর কাজ। বাংলা ও বিশ্ব সাহিত্যে এ নিয়ে বহু ব্যাঙ্গাত্মক উপকরণ আছে যা নিয়ে এখানে আলোচনা করাটা সমীচীন মনে করছি না। শুধু ইতিহাসের দু/একটা নির্মম সত্য তুলে দিচ্ছি-

ব্যাবিলন সভ্যতায় ডাক্তারেরা সার্জারীতে ভুল করলে দেশের আইন অনুযায়ী তাদের হাতের কব্জি কেটে নেয়া হত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও ইউরোপের অনেক দেশে ডাক্তারদের ঘরে ঢুকতে দিত না, বারান্দায় রেখে প্রয়ো্জনীয় কথা বলতেন মানুষ। কেননা তখন এদেরকে অর্ধ শিক্ষিত মনে করা হ’ত। আমাদের এই ভারতবর্ষেও একটা সময়ে ডাক্তারেরা বাড়ির সদর দরজা দিয়ে ঢুকতে পারতেন না। তাদের ঢুকতে হ’ত পেছনের বিশেষ দরজা দিয়ে, যেখান থেকে মেথরেরা বাড়ির বর্জ্য নিয়ে যেতেন। কেননা তখনও ভারতবর্ষে ডাক্তারদের অশুচি মনে করা হ’ত। এটুকু পড়ে আমার ডাক্তার বন্ধুরা বা আমার যে সকল স্টুডেন্ট এখন ডাক্তারী পেশায় সম্পৃক্ত তারা রুষ্ঠ হবেন না। ইতিহাস পড়ে নিলেই সব জেনে নিতে পারবেন। তবুও এই বিব্রতকর উদাহরণ উপস্থাপন করার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমি কেবল বোঝাতে চেয়েছি যে, এত কিছুর পরেও কিন্তু পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে দৃঢ় ঐক্যের কারনেই ডাক্তারেরা নিজেদের অবস্থানকে সুসংহত রাখতে পেরেছেন।

সৃষ্টির শুরু থেকেই শিক্ষকের কোন মর্যাদার ঘাটতি ছিলনা। গুহামানব যাদেরকে শিক্ষকের মর্যাদা দিতেন তাদেরকে সমাজের উঁচু স্থানের লোক বোঝাতে গুহার ভেতরে মাচা বানিয়ে সেখানে রাখতেন। এক সময়ে আমাদের সিলেবাসেও শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে সুখপাঠ্য টেক্সট ছিল। সমাজ-সংসারে ছোটখাটো বিবাদ-বিসম্বাদে স্থানীয় শালিস-বিচারে মতানৈক্য দেখা দিলে উভয় পক্ষকে শিক্ষকের রায়কেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেয়ার দৃষ্টান্ত আছে ভুরি ভুরি। এগুলো শিক্ষকের প্রতি তাদের ভক্তি-শ্রদ্ধা-সম্মান আর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ।

সেই মহান পেশাকে দলাদলি, অন্ধভাবে রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি, অনৈক্য, অবিশ্বাস, পেশাগত অস্বচ্ছতার কারনে আজ এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে এসেছি যেন, “আপন মাংসে হরিণ বৈরী।” এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার। এ অবস্থার পরিবর্তন আমাদের হাতেই। আমরা সমস্ত প্রলোভন, প্ররোচনাকে উপেক্ষা করে কেবল আদর্শের ভিত্তিতে পেশাগতভাবে ঐক্যবদ্ধ হতে পারলেই আমাদের অবস্থান, সম্মান ও সমৃদ্ধি হবে কাঙ্খিত দৃশ্যমান। ঐক্যের কোন বিকল্প নাই। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকেরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে অধিকার আদায়ের দাবিতে পথে নেমেছিল বলেই আজ মজদুরের শ্রমের মূল্যায়ন হচ্ছে। সারা বিশ্বে আজ মে দিবস পালিত হচ্ছে। লেখার শুরুতেই বলেছি, মুনাফালোভি, পুঁজিবাদি সমাজ ব্যবস্থায়, করপোরেট কালচারের দৃষ্টিতে আমরা শিক্ষকেরা এখন কলম পেষা মজদুর। দুনিয়ার মজদুর, এক হও।

একটি বিষয় মনে রাখবেন, অর্ধ লক্ষাধিক কিন্ডারগার্টেনের শিক্ষার্থীদের রাতারাতি অন্য কোন বিকল্পে স্থানানন্তরিত করা যায় না। কিন্তু এর উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন প্রলোভনে পথভ্রষ্ট করা যায়। রাজনৈতিক রং লাগিয়ে শত বিভাজন তৈরি করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় “যে একা সেই ক্ষুদ্র, সামান্য। যাহার ঐক্য নাই সেই তুচ্ছ।” অনৈক্যের কারনে আর নিজেদেরকে তুচ্ছ করে রাখা নয়। ঐক্যবদ্ধ হোন নিজের বোধ-বুদ্ধিতে ভর করে। ঐক্যবদ্ধ হয়েই পথ চলুন। পেশাগতভাবে নিজেদেরকে আরো দক্ষ করে তুলুন। অপেক্ষা করুন সুদিনের। ঐক্যের কাছে সুদিন আসতে বাধ্য। জানি এ অপেক্ষার প্রহর বড্ড নিষ্ঠুর, গহীন অন্ধকারাচ্ছন্ন। তবুও এটাই এখন পথ। হয়তো সহসাই ভোরের আলো ফুটবে। এ প্রত্যাশায়, সবাইকে মে দিবসের শুভেচ্ছা।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
শিক্ষক ও সংগঠক। সেক্রেটারি জেনারেল, বরিশাল কিন্ডারগার্টেন ফোরাম। admin@nipobon.net
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!