শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে ১৯ই শক্তি, ১৯ই মুক্তি

আবদুস সোবহান বাচ্চু
আবদুস সোবহান বাচ্চু
18 মিনিটে পড়ুন
লেখক আবদুস সোবহান বাচ্চু

১৯তম বারের মত করে আবার একদফা ৩১ জুলাই ২০২১ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হ’ল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি..! অযুহাত করোনা..! প্রকৃত কারণ অজানা..!! প্রকৃত কারণ বলছি বিগত ১৬ মাসের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায়।

বলছি বটে অজানা, আসলেই কি অজানা..? এরশাদ সাহেব টোকাইদের নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন ‘পথকলি।’ তাতে কি তাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়েছিল..? লকডাউন এখন নাম পরিবর্তন করে হয়েছে শার্টডাউন। তাতে কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছাড়া, অবস্থার আর কোন পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন আপনি..?

গার্মেন্টস, শিল্প কারখানা, ব্যা্ংক খোলা থাকবে এ সময়ে। মানুষ সেখানে যাবে কিভাবে..? কাজেই পরিবহণও চলবে। তবে নাম হবে সীমিত পরিসরে আর ভাড়া হবে ইচ্ছে মাফিক। সামাজিক দূরত্বের কথা থোরাই কেয়ার করা পরিবহণ শ্রমিকরা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে গাদাগাদি করে তুলবেন যাত্রীদের। আমরাও উঠবো নানা অযুহাতে।

খেতে হবে তাই চলবে বাজার-ঘাট। ঘেষাঘেষি করে গলদঘর্ম হয়ে বাজার করবেন সবাই। বাজারেই যখন বেড়িয়েছি, তখন বাই প্রোডাক্ট আরো কিছু শপিং চলবে। সারাদিনের একঘেয়েমি কাটাতে একটু বাইরেও বেড়াতে যেতে হবে। রাজনৈতিক কর্মসূচি বা শাসকগোষ্ঠির কোন আয়োজন হলে তো কথাই নেই। করোনার প্রবেশ নিষেধ যেখানে। কাজেই সব জায়েজ সেখানে। এমনটিই দেখে আসছি গত ১৬ মাসে..! তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন..? কোন যুক্তিতে..? কোন বাস্তবতায়..?

বাবা-মা বা উপার্জন ক্ষম ব্যক্তি মাত্রই জীবন জীবিকার প্রয়োজনে প্রতিদিন বাইরে যেতে বাধ্য হবেন। দিন শেষে রাতে এক ছাদের নিচে আপন আপন ছেলেমেয়েদের নিয়ে বসবাস করবো নির্বিঘ্নে-নিশ্চিন্তে..! আমদের যাপিত এ জীবন ধারায় গত ১৬ মাসে কোন শিশুকে কি করোনা আক্রান্ত হবার সংবাদ পেয়েছেন আপনি..? তবে কেন করোনার অযুহাতে লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা..? কার স্বার্থে..? কিসের ভয়ে..? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে আপনাকে মহা পন্ডিত বা প্রাজ্ঞ হবার প্রয়োজন নেই। মুটে, মজুর, রিকশাওয়ালা, চায়ের দোকানি বা বাংলাদেশের যেকোন শ্রমজীবী মানুষকে জিজ্ঞেস করলেও সঠিক ও উপযুক্ত বিশ্লেষণ করে আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। আফসোস, আমাদের শাসকগোষ্ঠী তা বুঝতে ও মানতে নারাজ। এ প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধুর বাবার একটি সরস উক্তি খুব মনে পড়ছে, তা হ’ল- “তুই যে আমাকে বোকা মনে করছিস, সেটি কিন্তু আমি বুঝেছি। আমি যে বুঝেছি, সেটি যে আবার তুই বুঝিস নাই, আমি কিন্তু সেটিও বুঝেছি।”

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় নিজে ডাক্তার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে উল্লেখ করার মত করোনা ছড়ায় না, কোন দেশে ছড়ায়নি.! এ সম্পর্কে তাকে বোঝাবে এমন সাধ্য আছে কার..! তবে এই ১৬ মাসে তার সকল ঘোষণা পর্যবেক্ষণ করলে প্রতীয়মান হয় যে, তার নিজেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে কোন আগ্রহ নেই। তিনি কোন সিদ্ধান্তে বেশিক্ষন স্থির থাকতে পারেন না। ক্ষণে ক্ষণে তার এ সিদ্ধান্তহীনতার ঘোষণায় তার কথাকে গুরুত্বহীন প্রলাপ মনে করেন অনেকেই। আবার অনেকেই প্রতিনিয়ত দিয়ে যাওয়া তার এ অস্পষ্ট, অসংলগ্ন বক্তব্যকে জাতির সাথে ছল কপটকতার সাথেও তুলনা করেন। এবারে শিক্ষামন্ত্রী হয়ে জাতিকে চরম শিক্ষা দিচ্ছেন বলে তাকে নিয়ে ট্রল করেন। এতে আমাদের খারাপ লাগে। আমাদের আফসোস হয় শিক্ষার্থী-শিক্ষক-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়ে রিজিটলি ভাববার মত শিক্ষামন্ত্রী আমরা পেলাম না কেন..!

সম্প্রতি নিজের ডিউটি ও রেসপন্সিবিলিটিস বিচারে আমার কাছে দেশসেরা মনে হয়েছে আমাদের সিইসি কে.এম. নূরুল হুদাকে। তিনি যদি আমাদের শিক্ষামন্ত্রী হতেন তাহলে হয়তো এতদিনে তিনি বলতেন, ‘করোনার চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা বড়’ এবং তিনি কেবল বলেই ক্ষান্ত হতেন না, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেও দেখিয়ে দিতেন। যেভাবে এই করোনাকালে তিনি নির্বিঘ্নে, কোন অতিমারীর তোয়াক্কা না করে হাজারো মানুষকে মাসাধিককাল দিন-রাত দলবদ্ধভাবে গলাগলি করে, কোলাকুলি করে, করমর্দন করে গণসংযোগে ব্যস্ত রেখে, সফলভাবে নির্বাচন করিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। দেশিয় বা আন্তর্জাতিক কোন গণমাধ্যম প্রকাশ করতে পারেনি, এই নির্বাচনি ডামাডোলে অংশ নিতে গিয়ে দেশের কোথাও কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেই শিক্ষার্থী-শিক্ষক-অভিভাবক সব ঝাঁকে ঝাঁকে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার জুজুর ভয় দেখিয়ে ক্রমাগত, লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বৃদ্ধির উদ্দেশ্য কি..? এগুলো কেবল শিক্ষক নয়, অভিভাবক হিসাবে প্রত্যেকের ভাবার যেমন দায় রয়েছে, তেমনি প্রতিবাদ করার, সোচ্চার হবারও দায়িত্ব রয়েছে।

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়কে গণমাধ্যমে প্রচারিত সাংবাদিকদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খুলবে? এমন প্রশ্নে সব সময়েই পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে দেখা গিয়েছে “আচ্ছা, আপনারা বলতে পারবেন করোনা কবে দেশ থেকে যাবে..?” এগুলো যে প্রশ্নকর্তাকে, জাতিকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করার শামিল তা কি তিনি বুঝতে পারেন না..? তিনি কি এও বুঝতে পারেন না যে, করোনা কোনদিনই দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে না। কলেরা-ক্যান্সার-এইডস এর মত করোনাও সহনশীল হয়ে আজীবন আমাদের সাথে সহবাস করবে..! সব খোলা রেখে কেবল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তবে কেন বন্ধ রাখতে মরিয়া এ সরকার..!

সংক্রামনের হার ৫% এর নিচে এলেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার যে অমর বাণী শুনে আসছি, তা যে কতখানি অসার সেটি কি আমরা গত ১৬ মাসে দেখে আসছি না..? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি শেষ হয়ে এলেই বার বার করোনা সংক্রমণ কেন হু হু করে বেড়ে যায়..? কে বা কারা প্রকাশ করেন সে পরিসংখ্যান..? এর ভিত্তি কি গ্রহনযোগ্য বা বিশ্বসযোগ্য..? দেশের মানুষের জীবনাচার সম্পর্কে কি তাদের কোন ধারণা আছে..? এখন যে কোন অসুস্থ্যতাকে বা মৃত্যুকে করোনা নাম দিয়ে প্যানিক সৃষ্টির অপচেষ্টা করা হচ্ছে। যে চাটুকারেরা অহর্নিশ স্তুতি করে বেড়াচ্ছে, তারা কারা..? কি তাদের সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য..? এগুলো ভাববার সময় এসেছে। আজ তা না ভাবলে আগামী হাজার বছর অনাগত প্রজন্ম আমাদের অভিষাপ দেবে।

রাজনীতি ছাড়াও, হাজারো বাণিজ্য ও লুটপাট ঘিরে ধরেছে করোনাকে। শিক্ষা তার মধ্যে অন্যতম একটি খাত। শ্রেফ সরকারি সিদ্ধান্তের উদাসীনতায় দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর শুধুমাত্র লাগাতার বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমি হলপ করে বলছি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বৃদ্ধিকে যারা সব সময়ে সাধুবাদ জানায়, আজ যদি সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত দেয়, তাহলেও এই চাটুকারেরা সাধুবাদ জনাতে থাকবে। আর সংক্রমন শুধু ৫% নয়, .০৫% এ নেবে আসবে। মিলিয়ে দেখবেন, কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি কেবল শিক্ষকদের আয়ের উৎস’র কথা বিবেচনা করেই খোলার দাবি জানাচ্ছে তারা..? নাকি আরো কোন গুরুত্ব লুকিয়ে আছে এ দাবীর অন্তরালে..? একটু সংক্ষেপে বলছি-
১. শিক্ষা কার্যক্রম বহতা নদীর মত। এটাকে দীর্ঘদিন বাঁধ দিয়ে রাখা যায় না।
২. প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে গুরুমূখী ও বুনিয়াদি শিক্ষা। এটাকে তো কোন ভাবেই বন্ধ রাখা যায় না।

দুর্ভাগ্য, এগুলো শাসকগোষ্ঠিকে বুঝিয়ে বলার মত আমাদের কোন ভয়েজ নেই। এগুলোর পক্ষে জনমত তৈরি করার মত আমাদের কোন নেতৃত্ব নেই। এমনকি বুদ্ধিবৃত্তিক দায়বদ্ধতা থেকে এ বিষয়ে নিজের মতামতকে প্রকাশ করার মতও কোন থিংকারের দেখা মেলা ভার এসময়ে।

যদিও এর প্রধানতঃ দু’টি কারণ: ১. পদ-পদবীর লোভে চোখে ঠুলি ও মুখে কুলুপ এটে থাকা এবং ২. এই সময়ে ভিন্নমত প্রকাশ মানেই নিজের বিপদ ডেকে এনে নিজ জীবন ও পরিবারকে বিপন্ন করে তোলা।

তবুও সবার অলক্ষ্যে যে ক্ষতি আমদের হয়ে যাচ্ছে, তার মূল্য চুকাতে পারবো তো..? এ বিষয়েও খুব সংক্ষেপে বলছি-
১. ধরুন যে শিক্ষার্থীরা গত দু’বছর ধরে অটোপাস পেল, তারা কি কোথাও অটো চাকরী বা কর্মসংস্থান তৈরিতে সক্ষম হবে..? তারা বা তাদের অনেক অভিভাবক যারা এখন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন, তারা কি ভেবেছেন অদূর ভবিষ্যতে যখন এই অটোপাশ ছেলেমেয়েরা কোথাও কোন কমপিটিটিভ জায়গায় দাঁড়াতে পারবে না, তখন এদের মানসিক বিপর্যয় ঠেকাবেন কিভাবে..? আজ এখনই আপনার সন্তানের দিকে তাকিয়ে দেখুন, তার যে আচরণগত পরিবর্তন ইতোমধ্যেই হয়েছে তার প্রতিবিধান কি আপনার গ্রীপে আছে..? যারা সিনিয়র সিটিজেন আছেন তারা জানেন, কতগুলো বছর একটি প্রজন্মকে আইয়ুব খান গ্রাজুয়েট অপবাদ মাথায় নিয়ে অপদস্থ হতে হয়েছে, টিকা টিপ্পনি শুনতে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পর্যায়ে।

২. শহরাঞ্চলে কিছু অভিভাবক তাদের ছেলেমেয়েদের বিকল্পভাবে পড়াশুনার চেষ্টা করলেও গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা তো কোন ছাড়, অভিভাকরাই বলছেন, ‘ওরা তো অটোপাশ করবে, তবে কেন শুধু শুধু পড়াশুনার পেছনে টাকা খরচ করবো!’ বুঝতে পারছেন সর্বনাশের বীজ কত গভীরে বপন করা হয়ে গেছে.! এই সব ছেলেমেয়েরা কিভাবে ২১ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে.!

৩. শহরাঞ্চলে যে সব অভিভাবকেরা তাদের ছেলেমেয়েদেরকে নিয়ে বিভিন্ন কোচিং ও টিচারদের বাসায় নিয়ে পড়াচ্ছেন, তারা কি তাদের বংশধরদের জন্যে খুব যুৎসই বা কল্যাণকর কিছু করছেন..? এই ছেলেমেয়েরা এক ক্লাস থেকে অন্য ক্লাসে উঠলেই ভুলে যাবে কি তারা পড়েছিল। আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আমরা কেবল পড়াই, শেখাইনা কিছুই আর আমাদের ছেলেমেয়েরা শেখেও না কিছুই। যদি শিখতো তবে দেশের গুরুত্বপূর্ণ পদে আমরা প্রকৃত শিক্ষিত, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, বিবেকবান ও আলোকিত মানুষদের দেখা পেতাম।

আগেও কোন এক লেখায় বলেছি, শিশুরা ৭৪% জিনিষ দেখে শেখে। আমাদের শিশুরা অহরহ দেখছে তার বাবা-মা, শিক্ষক, আমলা, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, বিচারক, প্রশাসক প্রকাশ্যে মিথ্যা বলছে। হয় নিজে অন্যায় করছেন বা অন্যের অন্যায়কে সমর্থন করছেন বা সহ্য করছেন। এক ধরনের আত্মগরজি মানসিকতায় বেড়ে উঠছে সবাই। অন্যায় বা বেআইনি পথটাকেই তারা সহজ ও নির্বিঘ্ন বলে মনে করছে ও বেছে নিচ্ছে। যে কোন সাধারণ আইন বা ভদ্রতা উপেক্ষা করাটাকেই তারা স্মার্টনেস বলে ধরে নিচ্ছে।

৪. দেশে সরকারি নির্দেশে বন্ধ রয়েছে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যে শিক্ষকরা সে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে প্রতিষ্ঠান চালাচ্ছেন, তারা কি শেখাচ্ছেন সেখানে..! আমার শহরে এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা একটি ওয়েব ক্যামেরা ক্লাসে রেখে দেদারছে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছেন। যাতে করে কোন চাপ এলে তিনি সাফাই গাইতে পারেন যে, ‘অন লাইন ক্লাস হচ্ছে।’ এগুলো প্রত্যক্ষ করে শিশু স্থায়ীভাবে শিখছে কিভাবে অনৈতিক কাজের বৈধতা দিতে হয়। রীতিমত গ্রুমিং হচ্ছে তাদের। ভীষন স্বার্থপর মানসিকতা লালন করে বেড়ে উঠছে তারা। ভবিষ্যতে এদের কাছ থেকে মানবিকতা আশা করাটা রীতিমত পাপ হবে।

এরা একদিন পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের কোন নিয়ম-নিষেধ মানবে না। সময়ের আবর্তে এদরে দায়িত্বে থাকা শিক্ষা-শিল্প-সংস্কৃতি-বিচার-প্রশাসনিক সমগ্র প্রতিষ্ঠানকে মনের আনন্দে ধ্বংস করে দেবে নির্দ্বিধায়। এই গত ২৬ জুন ২০২১ শনিবার শিশিরের আয়োজনে সারা বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে অবস্থান কর্মসূচি পালিত হয়েছিল। অবাক করা বিষয়, এসব প্রতিষ্ঠানের শিশু, শিক্ষক বা অভিভাবকরা তাতে অংশ নিতে আগ্রহী হয়নি। বৈধ ভাবে দাবী আদায় করে প্রকাশ্যে স্কুল করার চেয়ে অবৈধভাবে চুরি চুপকে ক্লাস করাটাকেই তারা শ্রেয় মনে করেছেন। কতখানি মানসিক দৈন্যে মানুষ এমনটা হতে পারে তা ভেবে দেখতে পারেন। অবৈধ, অনৈতিকভাবে শিক্ষা গ্রহণ শেষে তাদের কাছ থেকে নৈতিক আচরণ আশা করাটি কি আম গাছে তাল ফলানোর মত নয়.? সৈয়দ হকের ভাষায়, ‘আম পুঁতলে চিরকাল আম হইয়াছে, জাম পুঁতলে জাম। সময়ের ফলের গাছে অতি মিষ্ট ফল না ধইরা, ধরে কর্মফল।’ আমাদের আজকের হটকারিতার কর্মফল অদূর ভবিষ্যতে আমরা হজম করতে পারবো তো..?

সবার কথা বলতে পারবো না, আমি কাজ করি কিন্ডারগার্টেন নিয়ে। তাদের কিছু কথা বলাই আমার উদ্দেশ্য। বাংলাদেশে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কিন্ডারগার্টেনের সংখ্যা যেমন কম নয়, তেমনি এর সংগঠনের সংখ্যাও বেশুমার। এই সংকটকালে তাদের অনুসারীদের কার কি অবস্থা তা তারাই ভালো জানেন। তবে আমরা বরিশাল কিন্ডারগার্টেন ফোরাম একটু ভিন্নভাবে কাজ করছি শুরু থেকেই।

এই করোনাকালে দেশের কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের সরকারি কোন সহায়তা না পেলেও আমরা ফোরামের পক্ষ থেকে বরিশাল বিভাগের নির্বাচিত প্রত্যেক শিক্ষককে ঈদের সময় পাঁচ হাজার টাকা করে শুভেচ্ছা উপহার দিতে পেরেছিলাম।

কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের তার নিজ নিজ স্কুলে আরো নিবেদিত হতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে নির্বাচিত প্রত্যেক শিক্ষককে বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে প্রতি মাসে মাসিক প্রণোদনা দিয়ে আসছি। যা এই করোনাকালের বন্ধ ১৬ মাসেও বহাল রয়েছে। দিতে পেরে আমরা আনন্দিত হলেও যখন কোন সার্বজনীন কর্মসূচিতে এসব সুবিধাভোগী অনেক প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অনুপস্থিতি দেখি তখন কষ্ট হয় বৈকি।

আমাদের দশা মূলতঃ আপন মাংসে হরিণ বৈরী’র মত। আমাদের অনৈক্য, বহু বিভাজন, আমাদের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। সকল স্তরের শিক্ষকদের আহ্বান জানাচ্ছি, নেতা নয় নীতি ও আদর্শের মিল খুঁজে পেলে সেখানে সখ্যতা ও ঐক্য গড়ে তুলুন। স্কুলিং একটি টিম ওয়ারর্ক। এখানে প্রত্যেকের মতের ও শ্রমের গুরুত্ব অপরিসীম। নিজেদের মধ্যে চেইন অব রিলেশন ঠিক রেখেই সবাইকে নিয়ে সামনের দিকে এগুতে হবে। দলীয় ভাবাদর্শ বা রাজনৈতিক পরিচয়ে গড়ে ওঠা সংগঠন আপাতত এড়িয়ে চলুন। কেননা রাজনৈতিক পরিচয় আমাদের ঐক্য প্রচেষ্টাকে বারংবার বিভাজিত করে, আমাদের অর্জনকে খন্ডিত করে। আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনেই শ্রেণিকক্ষে ফিরে যেতে চাই। কেবলমাত্র এই একটি লক্ষ্য ও আদর্শের ভিত্তিতে শিক্ষক-অভিভাবকদের বৃহত্তর ঐক্য গড়ার চেষ্টা করুন। সম্মিলিতভাবে বৃহত্তর চাপ তৈরি করতে না পারলে আগামি আরো দুই বছরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সম্ভাবনা আছে বলে অনেকে মনে করেন। এবং অবস্থাদৃষ্টে এই মনে করাকে একদম অমূলক বলতে পারছি না। রাজনৈতিক নাম ব্যবহার করে সাময়িকভাবে কোথাও কোন জুলুম জায়েজ করা যায় হয়তো কিন্তু সব ফরিয়াদ কবুল হয়ে যায় না। যদি তেমনটাই হ’ত তবে সেই রাজনৈতিক নামসর্বস্ব সংগঠনের হাত ধরে এখন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা থাকত।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ বৃদ্ধির এই ১৯তম বারে, ১৯এর শক্তিতে ঐক্যবদ্ধ হবার চেষ্টা করুন। ইতিহাস বলে একটি ফলাফল অবশ্যই আসবে। কেননা আমাদের জাতীয় জীবনে ১৯ একাধারে একটি মিসটেরিয়াস ও নির্দেশনামূলক অংক। এই ১৯ এর ব্যবধানে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে আমাদের জাতীয় জীবনে, যা আমরা হয়তো ওভাবে খেয়াল করিনি সবাই। অবাক করা বিষয়, পবিত্র কোরআনও ১৯ ভিত্তিক এক গাণিতিক বন্ধনে আবদ্ধ। যারা এটি নিয়ে গবেষণা করেন তারা জানেন বিষয়টি। এমনকি আমাদের এই অতিমারির অফিসিয়াল নামও কোভিড-১৯

নিকট অতীতে ১৯৫২ সালে মানুষ দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভাষা আন্দেলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এই ভাষা আন্দেলনের পথ ধরেই এর ঠিক ১৯ বছর পর ১৯৭১ সালে ঐক্যবদ্ধ হয়েই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা স্বাধীন হই। তার ঠিক ১৯ বছর পরে আবার ঐক্যবদ্ধ হবার কারনেই ১৯৯০এর গণ আন্দোলন হয়। তার ঠিক ১৯ বছর পরে ২০০৯ সালে পিলখানা হত্যাকান্ডে আমাদের কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে তা অনুধাবন করতে শুরু করেছি ইতোমধ্যেই। এর ১৯ বছর পরে আমাদের জন্যে কি অপেক্ষা করে আছে বা আদৌ আছে কিনা, তা কেবল এক ভবিতব্যই জানে।

যাই হোক, এই ১৯ হতে পারে একটি আশা জাগানিয়া সংকেত। হতে পারে ১৯ই শক্তি, ১৯ই মুক্তি। আমরা সচেষ্ট থাকলে হয়তো এই ১৯তম বারের পর আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছুটি বৃদ্ধি হবে না। এ জন্যে আমাদের ঐক্যের কোন বিকল্প নেই। কর্মসূচির কোন বিকল্প নেই। প্রতিবাদের কোন বিকল্প নেই। সর্বনাশের সকল দুয়ার খোলা রেখে লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সরকারের এ অযৌক্তিক ও আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবী তুলতে হবে। দরকার হলে শিক্ষা ব্যবস্থার কোর্স-কারিকুলাম-ভ্যালু সিস্টম পরিবর্তন এমনকি প্রয়োজনে শিক্ষামন্ত্রী পরিবর্তনেরও গণদাবী তুলতে হবে। ঘরে বসে থেকে রবীন্দ্র সংগীত শুনে নিজেকে নির্বিবাদী শুদ্ধ বা প্রগতিশীল ভাববার সময় নেই আর। পথে নামতে হবে সবাইকে। ‘পথে এবার নামো সাথি, পথেই হবে পথ চেনা।’

যদিও আমাদের দেশে অমন গণদাবীর প্রতি সম্মান জানানোর সংস্কৃতি গড়ে উঠতে দেয়া হয়নি। গড়ে ওঠেনি গণঅসন্তুটিতে স্বেচ্ছা পদত্যাগের সংস্কৃতিও। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী তার জ্বলন্ত উদাহরণ। বরং যে বা যারা অমনটা করার চেষ্টা করবে, হামলা-মামলা-জুলুম-নির্যাতন করে তার জীবন বিপন্ন করে দেয়া, তার চরিত্র হনন করার ঘৃণ্য সংস্কৃতিতে ভাসছে আমাদের এ নষ্ট সময়। তাই বলে কি প্রতিবাদ, প্রতিরোধ হবে না..! নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই হবে না..! বন্ধুরা ‘লড়াইয়ের কোন চূড়ান্ত পরাজয় নেই, সময়ের বাঁকে বাঁকে আশার দীপ জাগে।’

আর এ বৃহত্তর ঐক্যের প্রশ্নে আমাদের ধারণা, আচরণ ও স্বভাবের কিছুটা পরিবর্তন আনাটা জরুরী। অন্তত আমরা যেন একজন আরেকজনকে সম্মান করাটা ভুলে না যাই। একজন অন্যজনের মতকে গুরুত্ব দিতে ভুলে না যাই। এর জন্যে যদি কিছু ছাড় দেয়ার প্রয়োজন হয় হাস্যবদনে দিলাম সবাই। মনে রাখবেন, ‘বড় প্রয়োজন সামনে এসেছে, ছোট প্রয়োজন ছাড়তে হবে, জীবন হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র, ভুল করলে হারতে হবে।’

একটি জাতিকে শিক্ষিত করার দায়িত্ব স্কন্ধে নিয়েছি স্বেচ্ছায় আমরা। যে শিক্ষা আমাদের অনাগত প্রজন্মকে জীবনের মন্ত্রে দীক্ষিত করবে। এর জন্যে শিক্ষকের নৈতিক সততা দরকার। মত প্রকাশের ঋজুতা দরকার। শিক্ষক হবেন মডেল। পৃথিবীর সকল মডেলদের প্রথম সারির পয়লা নম্বরের মডেল হলেন শিক্ষক। তাকে দেখেই শিশু তার জীবনাচার ঢেলে সাজাবে। তাকে দেখেই শিখবে সেই ৭৪% কাঙ্খিত আচার নিষ্ঠতা। পরিস্থিতি যেমনটাই হোক আদর্শিক অবস্থান থেকে শিক্ষক টলবেন না এক চুলও। কাজেই যতক্ষন শ্বাস, ততক্ষন আশ। অদৃষ্ট নয়, আমাদের ক্রমাগত অনুশীলন, প্রচেষ্টা ও পর্যবেক্ষণের ফলই হচ্ছে আমাদের প্রাপ্তি। কবিতায় বলছি, ‘ভগ্নঢাকে যথাসাধ্য, বাজিয়ে যাব জয়ের বাদ্য। ছিন্ন আশার ধ্বজা তুলে, ভিন্ন করবো নীলাকাশ। হাস্যমুখে অদৃষ্টরে করবো মোরা পরিহাস।’

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
শিক্ষক ও সংগঠক। সেক্রেটারি জেনারেল, বরিশাল কিন্ডারগার্টেন ফোরাম। admin@nipobon.net
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!