সমাজ এবং রাষ্ট্রের পশ্চাৎ যাত্রা

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
6 মিনিটে পড়ুন

কথিত আছে মহাত্মা গান্ধী একবার শান্তিনিকেতনে গিয়ে ফুলবাগানের আধিক্য দেখে কবিগুরুকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন, ফুলের গাছ উপড়িয়ে ফেলে সেখানে আলুর চাষ করতে। কারণ হিসাবে বলেছিলেন, দেশের এখন যা অবস্থা, তাতে ফুলের চেয়ে আলুর প্রয়োজন বেশি। বাংলাদেশে সামাজিকভাবে কথিত ধর্মের চাষাবাদ যেভাবে হচ্ছে, সেখানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। বরং কথিত ধর্মচর্চার নামে নাগরিক বিড়ম্বনা সৃষ্টি, দখলি মানসিকতা এবং ভিন্ন ধর্মের অনুসারীদের কিংবা কোনো ধর্মের অনুসারী নুন এমন মানুষদের প্রতি বিসোদ্গার বন্ধে দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। কিন্ত আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র এবং সরকার হাঁটছে ঠিক উল্টোপথে।

বাংলাদেশ আজ নিজেকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে দাবী করতে যাচ্ছে, কিন্তু খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনের মত মৌলিক অধিকারগুলি এখনও এদেশে মৌলিক চাহিদা হিসাবে রয়ে গেছে, মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি পায় নাই। সেই দেশে হাজার, হাজার কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত হচ্ছে ৫৬৪ টি মডেল মসজিদ। আমার কাছে সুনির্দিস্ট তথ্য-উপাত্ত নাই, কিন্তু অনেকেই বলেন, এটা নাকি পদ্মাসেতুর পর, দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রকল্প। কেউ কেউ বলেন, এই টাকা তো আর রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে যাচ্ছে না, এই টাকা হল অনুদানের টাকা। যেই দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামীপন্থী শিক্ষকেরা ফেইসবুকে স্টাটাস দিয়ে বলেন, তিনি বা তারা বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করেন না, কেন সরকার বিবর্তনবাদ পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত করল, সেই দেশে সরকারি ব্যায়েই হোক, আর বিদেশি অনুদানেই হোক, মসজিদ এর চেয়ে লাইব্রেরী, সাংস্কৃতিক চর্চা কেন্দ্র, খেলার মাঠ এগুলি অনেক বেশি জরুরী। মসজিদ হচ্ছে সামাজিকভাবে হোক না, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা কেন লাগবে?

আর সামাজিকভাবে যে মসজিদগুলি তৈরি হচ্ছে, সেগুলির ব্যাপারেও ন্যুনতম মনিটরিং জরুরী। এই তো বছর দুয়েক আগের কথা ধানমন্ডি আট নম্বর ব্রিজ পশ্চিম পাশে ডিঙ্গি রেস্তরা সংলগ্ন লেক এরিয়ার মধ্যে হঠাতই দেখি একটা অস্থায়ী মসজিদ। অথচ, ঠিক ওই জায়গাটা থেকে এক কিলোমটারের মধ্যে তিনদিকে তিনটা বিশাল মসজিদ। লেক এলাকার যে নকশা, সেই নকশা ভঙ্গ করে যথাযথ কত্রিপক্ষের অনুমোদন ছাড়ায় এই মসজিদ গড়ে তোলা হয়েছিল। হয়েছিল বলছি, কারণ পরবর্তীতে সিটি কর্পোরেশন এই মসজিদ গুড়িয়ে দিয়েছে। নিশ্চয় অনুমোদন থাকলে, আইনি ভিত্তি থাকলে, যারা গড়ে তুলেছিলেন, তারা লড়াই চালিয়ে যেতেন আল্লাহর ঘর রক্ষায়। যেহেতু এটা নিয়ে তারা আইনি পদক্ষেপে যান নাই, তার মানে ধরে নিতে পারি, তাদের সেই নৈতিক এবং আইনি ভিত্তি ছিল না।

এখন কথা হল, তাহলে কিসের ভিত্তিতে ওই স্থাপনা তারা গড়ে তুলেছিলেন? তুলেছিলেন, এই মানসিক চিন্তায় যে, মসজিদ একবার উঠে গেলে, কেউ সেটা ভাঙ্গতে সাহস করবে না কিংবা ভাঙ্গতে এলে আমরা প্রতিবাদ করলে, অন্যদের সমর্থন পাব। এই মানসিকতা তো আর একদিনে গড়ে উঠেনি। এই মানসিকতা গড়ে উঠতে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্র সহায়তা করেছে। ধানমন্ডি এলাকা বলেই হয়ত এই অবৈধ স্থাপনা অপসারণ সম্ভব হয়েছে। অন্য এলাকা হলে কস্টসাধ্য হত। এই যে দখলি মানসিকতা, জুম্মার নামাজের দিন মসজিদ সংলগ্ন পুরো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া, মসজিদের মাইক থেকে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বিসোদ্গার এগুলির প্রতি রাষ্ট্রের ন্যুনতম নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। কিন্তু সরকার সেই ব্যাপারে উদাসীন। কিন্তু কেন?

এখানে একটা বিষয় কাজ করে, প্রত্যেক সরকারই প্রমাণ করতে চায়, যে তারা দেশের ধর্মীয় সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষের সাথে আছেন। তাদের অনুভূতির সাথে আছেন। কিন্তু তাই বলে ন্যুনতম নীতির চর্চা থাকবে না, সাধারণ জ্ঞান এবং সংবেদনশীলতার চর্চা থাকবে না?

তবে আজকের আলোচয় বিষয় এইটা না, আজকে কথা বলতে চাই, সরকারের প্রায়োরিটি কোন জায়গায়? মধ্যম আয়ের দেশ হব, অথচ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা চিত্তবিনোদন আমাদের কাছে মৌলিক চাহিদাই রয়ে যাবে, মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃতি পাবে না, তা কি করে হয়? এমনিতেই ঢাকাকে বলা হয় মসজিদের নগরী। বাংলাদেশে এখন প্রায় প্রত্যেক গ্রামে কাঁচাবাড়ি পাবেন অনেক কিন্তু কাঁচা মসজিদের দেখা মেলা ভার। আর লাইব্রেরী যদি খুঁজতে যান, তাহলে হারিকেনের আলোর সাহায্য নিতে হবে। উপজেলা পর্যায়েও যেগুলি আছে, সেগুলি টিমটিমে আলোর মত কোনো রকম টিকে আছে। খোদ ঢাকা শহরেই দিন-দুপুরে খেলার মাঠগুলি দখল হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষেত্রে তো সরকারি প্রতিষ্ঠানই দখলে অংশ নিয়েছে। করোনাকালীন হাসপাতালে সিট সংকটের কথা আমরা এখনো ভুলি নাই।

আমাদের ঢাকা শহরেই এখনও পাড়ায়, পাড়ায় ভাল মানের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নাই। আর চিত্তবিনোদনের কথা না হয় বাদই দিলাম। এ তো গেল, মৌলিক অধিকার এবং মানসিক উতকর্স বিষয়ক কথা। আমরা বই-এ পড়ে এসেছি, গর্ব করে বলিও কেউ কেউ, আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। ভরা মৌসুমে কৃষক ধানের ন্যায্য দাম পান না, আলুর ন্যায্য দাম পান না, সব্জির দাম পান না। সংরক্ষণেরও যথাযথ ব্যবস্থা নাই। অথচ বাংলাদেশে কমপক্ষে উপজেলা পর্যায়ে যাবতীয় কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য ন্যুনতম একটা করেও সংরক্ষণাগার আমরা গড়ে তুলতে পারি নাই।

রাষ্ট্রীয় দর্শনের উপর সমাজের চরিত্র নির্ভর করে। তাই রাষ্ট্র কাছে যখন, ধর্মীয় পৃষ্ঠপোষকতা গুরুত্বলাভ করে, তখন কৃষকের কাছেও নিয়তি নির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। কথিত ধর্মের প্রতি অনুরক্ততা বাড়ে। ফলাফল যা হবার তাই হয়, সমাজ এবং রাষ্ট্রে ধর্ম পালনের চেয়ে কথিত ধর্মের চর্চার প্রতিযোগিতা বাড়ে। বাংলাদেশেও তাই হচ্ছে। কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল অন্য লক্ষ্যে। আমরা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে আবার সেই পুরাতন নিগড়ের উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা শুরু করেছি। একে বলে পশ্চাৎ যাত্রা। ভয়াবহ কথা হল সমাজ এবং রাষ্ট্র সেটা অনুভব করতে পারছে না, আমলে নিচ্ছে না।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!