যে আরএসএস দলটি গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসের জন্মদিন পালন করে, তাঁর মূর্তি স্থাপন করে, ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে গুজরাটে ১৮২ মিটার উঁচু, মানে প্রায় ৬০ তলা বাড়ির সমান এমন মূর্তি তৈরি করে যে, মহাকাশ থেকেও দেখা যায়, যারা ইতিমধ্যেই রামের মূর্তি তৈরি করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে, সেই আরএসএস যে দলটির নীতি নির্ধারণ করে, সেই বিজেপির জোট সরকার ত্রিপুরার আগরতলায় এত দিন ধরে স্বমহিমায় থাকা বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে বানানো স্মৃতিসৌধ এই ভাবে ভেঙে দিল!
আমরা সবাই জানি এবং বাংলাদেশের লোকজন প্রতিনিয়ত স্বীকার করেন যে, ভারত তথা ত্রিপুরার মানুষদের বিশাল সমর্থন বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
যে ভূখণ্ডটিকে মুক্তির স্বাদ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সমস্ত রকম সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল আপামর ভারতবাসী, ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের অত্যন্ত জনপ্রিয় গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
লিখে ফেলেছিলেন সেই ঐতিহাসিক দেশাত্মবোধক গান—
শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।
সেই সবুজের বুক চেরা মেঠোপথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছে
হায়রে এমন সোনার খনি।।
বিশ্বকবির ‘সোনার বাংলা’
নজরুলের ‘বাংলাদেশ’
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।
‘জয় বাংলা’ বলতে মনরে আমার
এখনো কেন ভাব, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
অন্ধকারে পুব আকাশে
উঠবে আবার দিনমণি।।
মাত্র এই একটি গান লিখেই বাংলাদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি, যার ফলে স্বাধীনতা পেয়েছিল ওখানকার মানুষজন, পূর্ব পাকিস্তানের একটি অংশ বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশ, সেই বাংলাদেশের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ভারতের অন্যান্য জায়গার মতো আগরতলার কেন্দ্রস্থল পোস্ট অফিস চৌমুহনিতেও নির্মিত হয়েছিল চল্লিশ ফুট উঁচু একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। গত শনিবার সেটা হঠাৎ করে ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া হল!
শুধু তাইই নয়, আগরতলার ওই একই জায়গায় শোভা পাচ্ছিল, বাংলাদেশের বিজয় চিহ্ন হিসেবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা মার্কিন প্যাটন ট্যাংক এবং একটি মার্কিন কামান। গত বছর নভেম্বর মাসে সেটাও সরিয়ে ফেলা হয়।
ফলে অনেক ত্রিপুরাবাসীর মতো আহত হয়েছেন বাংলাদেশের প্রকৃত স্বাধীনচেতা বিদগ্ধজনেরাও। বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নাটক-চলচ্চিত্র নির্মাতা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের রক্তরঞ্জিত সম্পর্কের ইতিহাস জড়িত স্মৃতিস্তম্ভটি সরিয়ে ফেলায় আমরা ব্যথিত বোধ করছি। আমরা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে স্মৃতিস্তম্ভটি যথাস্থানে স্বমহিমায় পুনঃস্থাপনের অনুরোধ জানাই এবং দুই দেশের মানুষের সম্পর্কের প্রকৃতি স্মারকসমূহ যথাযথ সংরক্ষণের প্রয়োজন বোধ করি।
ওই আবেদনে সাড়া দিয়ে স্বাক্ষর করেছেন লেখক ও ভাষাসংগ্রামী আব্দুল গাফফার চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক, অধ্যাপক ও প্রাবন্ধিক অনুপম সেন, নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম, সাংবাদিক আবেদ খান, মুক্তিযোদ্ধা ও অভিনেত্রী লায়লা হাসান, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অধ্যাপক আবদুস সেলিম, মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল্লাহ খান বাদল, বীরপ্রতীক হাবীবুল আলম, লেখক ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, মুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম ‘৭১-এর কার্যনির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ নুরুল আলম, মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হারুন হাবীব, ইতিহাসবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক, ইতিহাসবিদ ও প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মেসবাহ কামাল এবং সংসদ সদস্য ও নাট্যব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর।
এই কুড়ি জন বিশিষ্ট নাগরিকের মতো বাংলাদেশের সাধারণ, অতি সাধারণ মানুষদেরও এখন একটাই দাবি, অত্যন্ত ন্যায্য দাবি, আগরতলার কেন্দ্রস্থল পোস্ট অফিস চৌমুহনির যেখানটায় ওই স্মৃতিসৌধ ছিল সেটা আবার নতুন করে গড়ে দেওয়া হোক এবং যে জায়গায় ছিল, সেখানেই ফিরিয়ে আনা হোক পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে দখল করা মার্কিন প্যাটন ট্যাংক এবং মার্কিন কামান।
না হলে শুধু যে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা প্রিয় মানুষদেরই অপমান করা হবে তাইই নয়, অপমান করা হবে গোটা বিশ্বের স্বাধীনতা প্রিয় সমস্ত মানুষকেও।
যারা অন্যদের আবেগকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে পারে, আবেগে গড়ে তোলা তাদের আরাধ্যদের ওই সব মূর্তি এবং জন্মদিন পালন করাটাকেও জনগণ কিন্তু তা হলে সন্দেহের চোখে দেখবে এবং তারা যখন ক্ষমতায় থাকবে না অন্য আর এক দল এসে ওগুলোকে ধুলিস্যাৎ করে দেবে।
আশা করি, পরবর্তী অপ্রীতিকর ঘটনা রোধ করার জন্য ত্রিপুরার জোট সরকার সচেষ্ট হবেন এবং এই কলঙ্কের বোঝা নিজেদের মাথায় তুলে নেবেন না। এবং যত দ্রুত সম্ভব, তারা নিজেদের এই মারাত্মক ভুল শুধরে নেবেন। না হলে তাদের জন্য শুধু বরাদ্দ থাকবে একটাই শব্দ— ধিক্কার।