অধিকারের প্রশ্নে নারী সম্পর্কে সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গির বদল প্রয়োজন

মহম্মদ মফিজুল ইসলাম
মহম্মদ মফিজুল ইসলাম
8 মিনিটে পড়ুন

নর ও নারী। পুরুষ ও প্রকৃতি। জীবন-নাট্যের দুই প্রধান কুশীলব। একের বিপরীতে আর এক। তাদের পারস্পরিক নির্ভরতায় সৃষ্টির বৈচিত্র্য। সহযোগিতায় সমৃদ্ধি। বিরোধে সর্বনাশ। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় যুদ্ধের মহড়া হয়ে গিয়েছে মূলত নারীকে কেন্দ্র করে। সেখানে কত রক্তপাত। কত সাম্রাজ্যের পতন। নারী ছাড়া পুরুষ অসমাপ্ত। পুরুষ ছাড়া নারীও অসম্পূর্ণ। নর আর নারীকে নিয়েই কত ছবি। কত রঙ। কত কাব্য। কত উপন্যাসের জন্ম।

নারী শুধু পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী নয়। নয় নম্র সহচরী। নয় একমাত্র বিনোদন সঙ্গিনী। নারী পুরুষের কাছে কখনও জননী। কখনও জায়া। কখনও দুহিতা। নারী কল্যাণরূপে ঐশ্বর্যময়ী। মোহিনীরূপে সর্বনাশী। কালের শাশ্বত নিয়মে সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন। আর সেই পরিবর্তনে নারীও বুদ্ধির খেলায় মেতে উঠেছে পুরুষের সঙ্গে। টেক্কাও দিচ্ছে বারবার। দুঃসাহসিক অভিযানে সঙ্গ দিচ্ছে পুরুষের সঙ্গে। নারী পুরুষের সহধর্মিনী। রাজনীতিতে পুরুষের সহযাত্রিনী। দেশের কাজে আত্মদানের গৌরবে গরবিণী। ধর্ম ও সমাজ সংস্কারে তার ভূমিকা অনন্য। সাহিত্যবিজ্ঞানে তার বিশ্বজয়ের স্বীকৃতি। মহাকাশ অভিযানে অপ্রতিরোধ্য। রাজনীতিতেও নির্ভরশীলা। ক্রীড়া ক্ষেত্রেও দেশের সম্মান রক্ষাকারিণী।

একসময় মাতৃতান্ত্রিক সমাজে ছিল নারীর প্রাধান্য। আর এখন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর শুধু অধিকার হারানোর পালা। প্রাচীন ভারতীয় নারীর মর্যাদা স্বীকৃত। বেদ-উপনিষদ-পুরাণও নারীকে সম্মানের আসনে বসিয়েছে। প্রাচীন ভারতে তপোবনের স্নিগ্ধ, শান্ত, কোলাহলমুক্ত পরিবেশে নারী ও পুরুষ শিক্ষাগুরুর কাছে জ্ঞান অর্জন করেছে নির্দ্বিধায়। পাঠ নিয়েছে নব জীবনের। সভা-সমাবেশে পুরুষের সঙ্গে বিনা বাধায় অংশগ্রহণ করেছে নারীও। আলোচনায় ব্যক্ত করেছে নিজস্ব মতামত। কিন্তু সেই সমাজও নারীর কাছ থেকে অনেক অধিকার কেড়ে নিয়েছে ধীরে ধীরে।

তারপর এল মুসলমান শাসন। রুদ্ধ হল প্রাচীন শিক্ষার ধারা। নারী আশ্রয় নিল অন্তঃপুরের বন্দিশালায়। বলা ভাল, আশ্রয় নিতে বাধ্য করা হল। শুরু হল পর্দা প্রথা। নারী শিক্ষার ধারা একেবারে গেল শুকিয়ে। পর্যায়ক্রমে এল কৌলিন্য প্রথা, বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহের অভিশাপ। নারী পরিণত হল বিকিকিনির পণ্যে। ধর্মের মোড়কে শুরু হল নারী নির্যাতনের বীভৎস বিলাস। নারীরা অসহায় বোধ করতে লাগল নিজেদের। মুখ বুঁজে সহ্য করল সব পীড়ন ও অত্যাচার। তাই সে যুগেও নারী স্বাধীনতা ছিল দূর অস্ত।

শুধু প্রাচীন বা মধ্যযুগের কথাই বলি কেন? আধুনিক যুগেও নারীরা সত্যিকারের স্বাধীনতা পেয়েছে কী? পায় নি। এই অভাগা দেশে নারী এখনও ‘দ্বিতীয় শ্রেণির’ নাগরিক। দেশের বহু রাজ্যে এখনও সতী মাহাত্ম্য প্রচারিত হয়। অসহায় বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে মারা হয় ডাইনি সন্দেহে। পণপ্রথা নামক লাভজনক ব্যবসা আজও সমাজে বদ্ধমূল। আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কন্যাভ্রুণ হত্যা তো একদম সাধারণ ঘটনা। নারী নির্যাতন, শ্লীলতাহানি, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি, প্রকাশ্যে গণধর্ষণ, এমন কী ধর্ষণজনিত কারণে প্রমাণ লোপাটের জন্য খুন এখনকার রোজনামচা। দিল্লি ধর্ষণ-কাণ্ডের দগগগে স্মৃতি উসকে দিয়ে পাঠক মনকে আর না-ই বা ভারাক্রান্ত করলাম।

নারী নির্যাতনে অভিযুক্তরাও আজ কেউ মন্ত্রী। কেউ বা সংসদ। আবার কেউ রাতারাতি বুদ্ধিজীবী। সমাজ সংস্কারক। কেউ বা বিখ্যাত লেখক। সত্যি, আজকে নারী নিয়ে একটা বিরাট ফলাও ব্যবসা ফাঁদা হয়েছে।
মহাভারতের যুগ থেকে নারীর যত বস্ত্রহরণ, যত অপমান, যত লাঞ্ছনা তত তা লোকের মুখে মুখে ফিরবে। তাই মাঝে মাঝে প্রশ্ন জাগে, নারীর স্বাধীনতা সত্যিই আছে তো? কান পাতলেই শোনা যায়, নারীরা যতটুকু স্বাধীনতা পেয়েছে তা তাদের পোশাকে। ইংরেজি কথা বলায় এবং অবশ্য পশ্চিমী অনুকরণে। নারীরা যদি সম্পূর্ণভাবে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না পায়, তাহলে এই মেকি পোশাকি স্বাধীনতার কি আদৌ কোনও দরকার আছে?

সভা-সমাবেশে বলা হচ্ছে, আমাদের দেশের নারীরা না কি অতীতের চেয়ে এখন চেতনায় অনেকটা আধুনিক। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, সমাজে এখনও তারা সার্বিক অধিকার পায় নি। কেন পায় নি? সে প্রশ্নও উঠছে বারবার। কিন্তু কোনও সদুত্তর মিলছে না। আর এই না মেলা উত্তর নিয়ে নারীদের ‘এগিয়ে’ যেতে হচ্ছে। তাতে সমাজের সামগ্রিক অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। একজনকে পিছিয়ে রেখে আর একজন এগিয়ে যেতে পারে না। নারী ও পুরুষ একত্রে বসবাস করছে সমাজে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রগতির শপথ নিচ্ছে তারা। অথচ অধিকারের প্রশ্নে নারী আজও ‘সমানাধিকার’ থেকে বঞ্চিত।

শিক্ষার প্রসারে মানুষের ব্যক্তির স্বাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা পায়। সেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের হাত ধরে আসে যুক্তিবাদ। আর তারই ফলশ্রুতি হল মানবাধিকার। এই অধিকার বলেই মানুষ তার নিজের মর্যাদা ও অধিকারবোধ সম্বন্ধে অবহিত হয়। দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে অধিকাংশ নারী আজও সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত।

রাষ্ট্র সংঘের সনদের বিভিন্ন ধারায় মানব অধিকারের সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের জন্য ভাষা, বর্ণ, পুরুষ, ধর্ম ও স্বাধীনতার উপর গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। অথচ নারীর অধিকারের প্রশ্নে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসেনি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সচেতনতার অভাবে। ভারতে যতই ঘটা করে ‘মহিলা সংরক্ষণ’ চালু হোক না কেন, মধ্যযুগীয় কুসংস্কারের নাগপাশ থেকে নারীকে মুক্তিদানের ব্যাপারে ভারতবর্ষ বিশ্বের উন্নতশীল দেশগুলির চেয়ে এখনও ঢের পিছিয়ে।

তাই নারীর অধিকারের প্রশ্নে প্রথমে যেটা করা দরকার তা হল— নারী ও পুরুষের প্রতিযোগিতার মনোভাব সম্পূর্ণ বর্জন করা। নারী বড় না পুরুষ বড়, ছেলেবেলা না মেয়েবেলা, এসব তর্ক-বিতর্ক অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। তাই, চাই উদার সংস্কারমুক্ত মানসিকতা। চাই আপামর নারীর শিক্ষা। কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারের নারী উচ্চ শিক্ষা অর্জন করে তার যাবতীয় অধিকার ভোগ করল আর সমাজের একটা বড় অংশ সম্পূর্ণ অন্ধকারে রইল। আর যা-ই হোক একে প্রগতি বলা যায় না। রাষ্ট্রের উচিত নারীর অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সুনিশ্চিত বন্দোবস্ত করা। নারীর অধিকার রক্ষায় আজকের পুরুষদেরও অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে। সর্বোপরি, নারীদেরও পরগাছা মনোবৃত্তি ত্যাগ করতে হবে।

সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আজকের নারী অনেক বেশি আধুনিক মনষ্ক হয়ে উঠেছে। শিক্ষিত হচ্ছে। মিডিয়ার কল্যাণে ক্রমশ কূপমন্ডুকতা ত্যাগ করে নারী ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে আমজনতার দরবারে। দেরিতে হলেও রাষ্ট্রব্যবস্থা নারীকে সামাজিক মর্যাদা দেওয়ার জন্য ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। পুরুষরাও তাদের সেকেলে ধ্যানধারণার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে। ভালো লক্ষণ। এভাবে চলতে থাকলে আগামী দিনে নারীর অধিকার যে অনেকটাই সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, তা আশা করা যেতেই পারে।

তবে একথা অনস্বীকার্য, নারী সমাজের বঞ্চনা ও উপেক্ষা দূর করার জন্য কেবলমাত্র ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’, ‘কন্যাবর্ষ’, ‘কন্যাশ্রী’, বা ‘রূপশ্রী’ বা ওই জাতীয় আনুষ্ঠানিক কিছু পালন করলে বা কিছু অর্থ সাহায্য করলে হয়তো কিছুটা আর্থিক সুরাহা হবে। কিন্তু মূল সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, অকারণ অর্থ ব্যয় এবং অযথা সময়ের অপচয় এ জাতীয় বহু পরিকল্পনা বিনষ্ট হয়ে গিয়েছে।

তাই কন্যা সন্তান ও নারী সমাজ সম্পর্কে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর প্রয়োজন। এজন্য সবার আগে প্রয়োজন সমাজের প্রতিটি মানুষের নারী সম্পর্কে হীন সংস্কারগুলি একেবারে মন থেকে মুছে ফেলা। আর সেইসঙ্গে নারীদেরও স্বত:প্রণোদিত হয়ে যাবতীয় অন্যায় ও সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রতিবাদে গর্জে উঠতে হবে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধেও। বলতে হবে—- আগে নিজের পায়ে দাঁড়াব। তারপর অন্য একজনের সঙ্গে দাঁড়াব।

একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, নারী মুক্তি মানে তো শুধু নারীর মুক্তি নয়। তার মধ্যে দিয়ে পুরুষদেরও মুক্তি। পাখি যেমন একটা ডানায় ভর করে উড়তে পারে না, তার দুটো ডানাতেই সমান জোর থাকা দরকার। তেমনি নারী ও পুরুষ উভয়ের উন্নতি ছাড়া সমাজের প্রগতি একেবারেই অসম্ভব। সভ্য সমাজে নারী ও পুরুষ যদি সামাজিক দিক থেকে স্বীকৃত না হয়, তাহলে নারী স্বাধীনতাই মিথ্যে হয়ে যাবে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙড়ের মাছিভাঙা গ্রামে। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি একজন সাংবাদিক, গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, কবি ও চিত্রকর এবং গ্রাফোলজিস্ট।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!