রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিন্তু বিজ্ঞানই, বাংলাদেশও বাংলাদেশ, কেবল আদিবাসীরাই আদিবাসী না…

অপূর্ব দাস
অপূর্ব দাস
5 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

একটা গল্প দিয়ে শুরু করি! বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এক দাদা নাকি বলতেন, ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি এই সাবজেক্টগুলির পর সায়েন্স কথাটা যুক্ত করার দরকার হয় না! আমরা এগুলিকে বাংলায় বলি পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান এবং জীব বিজ্ঞান! শুধুমাত্র পলিক্যাল সায়েন্সকেই নিজেকেই জানান দিতে হয় যে রাষ্ট্র বিজ্ঞান আসলে বিজ্ঞান! দাদা দর্শনের ছাত্র ছিলেন! থিয়েটার করা মানুষ! মজা করেই বলতেন! তবে দাদার কথাকে ধার করেই বলতে হয়, আমাদের পূর্ব পুরুষেরা অনেক বিচক্ষণ ছিলেন! তারা জানতেন, এই দেশের চেহারা একদিন এমন হবে যে এটা যে একটা দেশ, সেইটা আর তার কাজে বোঝা যাবে না! তাই তারা দেশটার নামের শেষে যুক্ত করে দিয়ে গেছেন খোদ দেশ শব্দটাকেই! আমাদের দেশের নাম বাংলাদেশ! আমাদের কবিতা, গান, গল্পে দেশ নিয়ে দারুণ মাতামাতি! কিন্তু উপলব্ধিতে কতটুকু সেটা নিয়ে প্রশ্ন না করাটায় বরং আজকের দিনে দেশদ্রোহিতা! আমাদের জাতীয় সংগীতের একটা লাইন আছে, মা তো বদনখানি মলিন হলে, আমি নয়ন জলে ভাসি! দেশ তো আক্ষরিক অর্থেই নিজস্ব কোনো সত্ত্বা নয়, দেশ মানে মাটি, দেশ মানে মানুষ, দেশ মানে এদেশের প্রাণ-প্রকৃতি! যদি একটু উদার মনে ভাবি, তাহলে দেশ মানে কি নয়? এগুলির মলিন দশা দেখে কি আমাদের প্রাণ কাঁদে? সেই আলোচনায় আজ নাইবা গেলাম! শুরুতেই যে প্রসঙ্গের অবতারণা করেছিলাম, সেই প্রসঙ্গে ফিরে আসি!

আগামী আগস্ট মাসের ৯ তারিখ আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস! দিনটি উদযাপন উপলক্ষ্যে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে প্রায় প্রতিবছরই আমাদের দেশেও নানা কর্মসূচি পালিত হয়! রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভিসহ অনেক বেসরকারি টেলিভিশনেও টক শো সহ নানা কর্মসূচি সম্প্রচারিত হয়! এ বছর দিনটি উদযাপনের আগেই সরকারের তরফ থেকে একটা প্রজ্ঞাপন জারি করে বলা হয়েছে, এসব কর্মসুচিতে, বিশেষ করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত, প্রচারিত কর্মসূচি কিংবা সংবাদে যাতে আদিবাসী শব্দটা ব্যবহার করা না হয়! যারা টেলিভিশনে টক শো তে যাবেন, এমন শ্রেণিভুক্ত মানুষদের কথা উল্লেখ করেই এই নির্দেশনা জারি করা হয়েছে! দাদার কথা ধরেই বলি, এদেশে যে আদিবাসী নাই, সেটা শুধু সরকার ঘোষণা দিয়েই মানুষকে বিশ্বাস করাতে পাছেন না, কথিত নাগরিকদেরকে দিয়ে বলিয়ে, নাগরিকদের একাংশকে আদিবাসী শব্দ উচ্চারণে বিরত রেখেই অন্যদেরকে বিশ্বাস করাতে হচ্ছে এদেশে আসলে আদিবাসী নাই! এই হল, আমাদের দেশ, এই হল আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা! বাংলাদেশে নিজদেরকে আদিবাসী হিসাবে নিজদেরকে দাবী করা মানুষেরা বলছেন, ২০০৯ সাল পর্যন্ত এদেশে আদিবাসী ছিল, সরকারি ভাষ্য অনুযায়ীই ছিল, কারণ ২০০৯ সালে সরকার প্রধান আদিবাসী দিবসে, দেশের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে ২০০৯ সালের পরে কি আদিবাসী সম্প্রদায় দেশ থেকে গুম হয়ে গেল? কে করল তাদের গুম? রাষ্ট্র ছাড়া কি একটা সম্প্রদায়কে গুম করে ফেলতে পারে কেউ? কথাগুলি তারা তাদের অসহায়ত্ব থেকে, ক্ষোভ থেকে বলছেন!

র রাষ্ট্রবিজ্ঞান কিন্তু বিজ্ঞানই, বাংলাদেশও বাংলাদেশ, কেবল আদিবাসীরাই আদিবাসী না…
ছবি: সংগৃহীত।

আমরা জানি, প্রকৃত ঘটনা কি! তারা গোটা সম্প্রদায় ধরে গুম হয়ে যান নাই! যদি গুম, খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন তাদের জীবনে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা! আসলে ২০০৯ সালে বিশ্ব আদিবাসী দিবসে সরকার প্রধান যে বাণী প্রদান করেন, সেই বাণীতেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশে হাজং, কোচ, ত্রিপুরা, বানাই, মারমা, চাকমা, গারো, সাঁওতাল ওঁরাও, মুন্ডা, খাসিয়া, মণিপুরী, খুমি, খিয়াং, লুসাই, বম, ম্রো ও রাজবংশী… বাংলাদেশে মোট ৪৫টি জাতিসত্ত্বার প্রায় ৩০ লাখ নৃতাত্ত্বিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী বসবাস করে! তারা তাদের স্বকীয়তা, বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি, সমৃদ্ধ মূল্যবোধ ও ঐতিহ্য দিয়ে আমাদের দেশকে সমৃদ্ধ করেছে! আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এইসব আদিবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল অবদান! ওই বাণীতে আরো বলা হয়েছে, আদিবাসীরা যাতে নিজদের স্বকীয়তা বজায় রেখে সবার মত সমান মর্যাদার সাথে জীবন নির্বাহ করতে পারে, সেটা নিশ্চিত সরকার বদ্ধ পরিকর! প্রসঙ্গে ১৯৯৭ সালের সম্পাদিত পার্বত্য শান্তিচুক্তির কথাও উল্লেখ করা হয়! দুঃখজনকভাবে একই বছর, সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি জাতিসংঘে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নাই! একটা রাষ্ট্র যখন এতবড় মিথ্যাচার করে, তখন তো যাদেরকে নিয়ে মিথ্যাচার, তাদেরকে জোর করেই বোঝাতে হয়, এই রাষ্ট্র কিন্তু সত্যিই একটা দেশ! তোমরা কিন্তু অন্য সবার মত এই দেশের নাগরিক, তোমাদের দেখভাল করার জন্যই, তোমাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই তো আমাদের জলপাই রঙের পোশাক পরা ভাইয়েরা সদাজাগ্রত তোমাদের দোরগোড়ায়! তোমরা আসলেই ভাল, তাই তো আমরা আমাদের পুলিশ, প্রশাসন এবং সরকারি নানা দফতরের অসৎ, দুর্নীতিবাজ অফিসারদের তোমাদের কাছে পাঠাই সংশোধিত হতে! বিচিত্র এই দেশ!

আর সমতলের আদিবাসীদের কথা কিইবা বলব! তাদের দেখভালের দায়িত্ব আর রাষ্ট্রকে নিতে হয় নাই! তাঁদের দেখভাল, খেদমত বাঙ্গালি হিন্দু এবং মুসলমান ভাইয়েরা এমনভাবে করেছেন যে, এখন সেই ভাইদের ক্ষেতে খামারে কামলা খাটাই তাদের কপাল হয়ে দাঁড়িয়েছে! তাহলে কি দাঁড়ালো হিসাবটা? একটা স্বাধীন দেশে একটা সম্প্রদায় তাদের নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বসবাস করতে পারবে না? রাতারাতি তাদের পরিচয় বদলে যাবে এবং সেই বদলে ভুমিকা রাখবে স্বয়ং রাষ্ট্র এবং সেই রাষ্ট্রই তাকে দিয়ে বলাবে, এইটা একটা স্বাধীন দেশ, আর তোমরা সেই দেশের স্বাধীন নাগরিক! এর চেয়ে বড় রসিকতা আর কি হতে পারে?

তারপরও আমরা বলি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান যেমন, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ কিন্তু তেমনি দেশ, কিন্তু আদিবাসীরা আদিবাসী না!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তিনি একজন মানবাধিকার কর্মী। জন্ম এবং বেড়ে ওঠা যশোর জেলায়। লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মানবাধিকার, নারীর মানবাধিকার, জেন্ডার এবং নারীর ভূমির অধিকার নিয়ে তিনি কাজ করেছেন একাধিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনে। এছাড়াও যুক্ত আছেন লেখালেখি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথেও। কর্মসূত্রে বর্তমানে বসবাস করছেন ঢাকাতে!
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!