তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি

ফারুক আহমেদ
ফারুক আহমেদ
9 মিনিটে পড়ুন

মুর্শিদাবাদ জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে আসা একটি লড়াকু প্রতিভা। তথ্যচিত্র নির্মাণে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে তিনি এক ও অদ্বিতীয় মুখ এই রাজ্যে। মনীষীদের নিয়ে কমবেশি তিনি ইতিমধ্যে ৪০ টিরও বেশি তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন। সম্প্রতি তাঁর তথ্যচিত্র ‘নজরুল জীবন-পরিক্রমা’ পাড়ি দিয়েছিল লন্ডনে। বহু মানুষের মনে গভীর রেখাপাত করে তথ্যচিত্রটি। বিলেত ফেরত পরিচালকের একটি সাক্ষাৎকার পাঠকদরবারে তুলে ধরেছেন সাংবাদিক ফারুক আহমেদ।

1 1 তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি
তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমান (ডানে)

ফারুক আহমেদ: প্রথমে আপনার কাছে জানতে চাইব সিনেমা জগতে এলেন কিভাবে?
মুজিবর রহমান: ছোট বেলা থেকেই সংস্কৃতি চর্চার প্রতি আমার একটা ঝোঁক ছিল। স্কুলের অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি, নাটকে অভিনয় করা ইত্যাদি করতে ভালো লাগত। সেই সময় থেকেই আমার মনের মধ্যে একটা বড় খিধে ছিল, কিছু একটা করার। তারপর আস্তে আস্তে এই পরিচালনার কাজ শুরু করি।

ফারুক আহমেদ: যখন ছোট বেলার কথা এলো পড়াশোনা বা ছোট বেলাটা কেমন ছিল আপনার?
মুজিবর রহমান: আমার বাড়িট সীমান্ত জেলা মুর্শিদাবাদের শক্তিপুর গ্রামে একটি কৃষক পরিবার। গ্রামের স্কুল শক্তিপুর কুমার মহীমচন্দ্র ইনস্টিটিউট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলকাতার বঙ্গবাসী কলেজ ভর্তি হই। আর কারমাইকেল হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। ১৯৯৫ সালে ইংরাজিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে থিয়েটারে যোগ দিই। পাশাপাশি সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করতে থাকি। এমন সময় ‘নন্দনে’ সিনেমা নিয়ে একটি স্বল্প-সময়ের কোর্স করার সুযোগ পাই। একটা কথা বলা দরকার আমি তখনও কিন্তু থিয়েটারে কাজ করতে থাকি কিন্তু কোথাও যেন মনের চাহিদাটা পুরণ হচ্ছিলো না। আরও বড় কিছু করার তীব্র বাসনা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল।

ফারুক আহমেদ: বাড়ির লোকজন কীভাবে বিষয়টিকে নিয়েছিলেন?
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, বাড়ির লোকজন বলতে আব্বা আমার কাছে জানতে চান আমি কি করতে চাই। তো আমি বলেছিলাম সিনেমা করব। প্রত্যেক বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছেলে পড়াশোনা করে সরকারি চাকরি করবে আমার ক্ষেত্রেও তাই তাছাড়া আমাদের পরিবারে প্রথম স্নাতক বলতে আমিই। চাপ ছিলই। এমন সময় আব্বার সাথে মনোমালিন্য দেখা দেয়। রাগ করে মুম্বাইয়ে পাড়ি দিই। ওটা ৯৭ সালের ডিসেম্বর মাস নাগাদ।

2 তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি
তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি 42

ফারুক আহমেদ: তারপর মুম্বাইয়ে কীভাবে নিজেকে তৈরি করলেন?
মুজিবর রহমান: প্রথমে একটি মশলা আমদানি রপ্তানি কোম্পানিতে ছোট একটা ম্যনেজার পদে কাজে যোগদান করি। হাতে না আছে টাকা না আছে চেনাপরিচিত এমন সময় এটা ছাড়া কিছুই করার ছিল না। অবশেষে একটি টিভি সিরিয়ালে চতুর্থ সহকারী পরিচালকের কাজ পাই। আস্তে আস্তে নিম্বাস টিভি, বালাজি টিভি, সাহারা টিভি প্রভৃতি টিভি চ্যানেলের বিভিন্ন সিরিয়ালে স্ক্রিপ্ট তৈরি ও সংলাপ রচনার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করি। এবং সহকারি পরিচালক থেকে পরিচালক হিসেবে উঠে আসা।

ফারুক আহমেদ: বাংলায় কবে থেকে কাজ শুরু করলেন?
মুজিবর রহমান: এক্ষণে বলা ভালো মুম্বাই-তে কাজ করার সময়েই বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি আমার মন প্রাণকে বারবার টানতো এই বাংলায়। এমন সময় অর্থাৎ ২০০২ সালে কলকাতার একটি টিভি সিরিয়ালে চিত্রনাট্য ও সংলাপ রচনার কাজের ডাক পাই। তারপর চলে আসি।

4 1 তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি
তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি 43

ফারুক আহমেদ: কোথাও কি মুসলিম বলে বাংলা সিনেমা জগতে জায়গা তৈরি করতে সমস্যা হয়েছিল?
মুজিবর রহমান: আসলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সমাজের প্রতিনিধিত্বের অভাব আছে। সাংবাদিকতা, নাটক সিনেমা ইত্যাদির ক্ষেতে তো খুবই বিরল। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। সব সম্প্রদায়ের মানুষ আমাকে আপন করে নিয়েছেন। মানুষের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা না থাকলে এই জায়গায় পৌঁছতে পারতাম না ।

ফারুক আহমেদ: এবার আসি লন্ডন প্রসঙ্গে, যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নজরুল কলম ধরেছেন তারা কীভাবে দেখল নজরুল কে?
মুজিবর রহমান: তথ্যচিত্রের নজরুল কে নিয়ে মহাসমারোহ দেখলাম লন্ডনে। আমি আপ্লুত ও অভিভূত। ওখানকার দর্শকদের নজর কাড়তে পেরেছি বলেই মানুষ আগ্রহের সাথে বিভিন্ন প্রদর্শনীতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে অংশ নিয়েছেন। তাছাড়া ছবিটি দেখার পর ওখানকার অধ্যাপক, কবি, সাহিত্যিকরা তাদের প্রিয় কবি রবার্ট বার্নসের সঙ্গে নজরুল ইসলামের তুলনা করেছেন। এটা আমার কাছে খুব প্রেরণা দায়ক।

ফারুক আহমেদ: কোথায় কোথায় তথ্যচিত্রের প্রদর্শনী গুলি হয়েছিল?
মুজিবর রহমান: মোট পাঁচটি শো বিভিন্ন স্থানে হয়েছিল যেমন, গত সেপ্টেম্বর মাসের ৯ তারিখ লন্ডনের Brady Art Centre এ প্রথম প্রিমিয়ার শো হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রাণপুরুষ অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়েদ। ১৪ তারিখ স্কটল্যান্ডের এডিনবোরায়। এখানে ভারতের সম্মানীয় কনস্যুলেট জেনারেল অঞ্জু রঞ্জন স্বাগত ভাষণ দেন এবং এডিনবোরা নেপিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা বাসবী ফ্রেজার আমার সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন। এখানে সেদেশের অন্যতম কবি ড. মারিও রালিস ও লেডি জয়েস কাপলান প্রদর্শনীর শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।
পরবর্তী শো হয় লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাউথ এশিয়া ইন্সটিটিউটে সেপ্টেম্বর মাসের ২২ তারিখ। এই বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক এডওয়ার্ড সিম্পসন প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন এবং অধ্যাপিকা সংযুক্তা ঘোষ এই চলচ্চিত্রের উপর আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। এই প্রদর্শনীর বিশেষ একটি ঘটনা না বললে নয়। এখানে পশ্চিমবঙ্গের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের একটি ভিডিও কনফারেন্স হয় তাতে আমার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পরিচয় করানো হয়। এবং আমার চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর খবর উনাকে দেওয়া হয়। এবং ২৪ তারিখ টেগর সেন্টারে ছবিটি দেখানো হয়। লন্ডন সফরের শেষ শো টি হয় ২৭ তারিখ ইস্ট লন্ডনের আইডিয়া স্টোরে। আয়োজন করে লন্ডনের বাংলা টাউনে অবস্থিত ব্রিক লেন সার্কেল।

ফারুক আহমেদ: আপনি এর আগেও তো লন্ডনে গিয়েছিলেন, কেমন লাগলো এবারের যাত্রা?
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, আমি এর আগেও লন্ডনে গিয়েছিলাম। ওটা ২০১২ সাল নাগাদ। তখন অবশ্য রবীন্দ্রনাথের উপর একটি তথ্যচিত্রটি নিয়ে গিয়েছিলাম। যেটি দেখে দর্শকদের ভালো সাড়া পেয়েছিলাম। সেই থেকেই এই ছবির অনুপ্রেরণা বলতে পারেন। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কাজ করতে গিয়েই নজরুল জীবনের অজানা বিষয় তুলে ধরতে ছবির কাজ শুরু করি। প্রথমবার যাত্রার একটা উত্তেজনা তো ছিলই এবার একটা বাড়তি চাপ অনুভব করছিলাম কেমন লাগবে ছবিটি। তবে দর্শকদের রেসপন্স থেকে বুঝতে পেরেছি তাদের ভালো লেগেছে।

3 1 তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি
তথ্যচিত্র নির্মিতা মুজিবর রহমানের মুখোমুখি 44

ফারুক আহমেদ: বিশেষ কোন ঘটনা বা অভিজ্ঞতা পাঠকদের জন্য?
মুজিবর রহমান: হ্যাঁ, অনেক অভিজ্ঞতা যেগুলো না বললে নয় যেমন- টেগর সেন্টার ইউকে-র পক্ষ থেকে চেয়ারম্যান ড. অমল চৌধুরী আমাকে একটি মানপত্র দিয়ে সম্মানিত করেছেন। এবং মহাকবি শেক্সপিয়ারের স্মৃতি বিজড়িত গ্লোব থিয়েটারে রাজা কিংলিয়ার নাটকের প্রদর্শনী দেখার সুযোগ পাই। পাশাপাশি নাটকের কলা-কুশলীদের সঙ্গে পরিচিত হই তারাও আমাকে স্বস্নেহে আপন করে নেন। আরেকটা ব্যাপার ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার প্রাপক লেখক অধ্যাপক ওরহান পামুকের সাথে আমার সাক্ষাত হয়। পামুক নজরুলের ইসলাম সম্পর্কে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন এবং একজন কবির জীবনের উপর তথ্যচিত্র করার জন্য আমাকে ধন্যবাদ জানান।
তাছাড়া বেতার বাংলা নামের একটি রেডিও চ্যানেল আমাকে নিয়ে এক ঘন্টার একটি বিশেষ সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠান লাইভ সম্প্রচারিত করে । এবং এনটিভি ইউরোপ নামের জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলে সেলিব্রিটিদের নিয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান Talking point – এ আমার সাক্ষাৎকার লাইভ টেলিকাস্ট হয়।

ফারুক আহমেদ: নজরুল ইসলাম ছাড়া আর কোন কোন মনীষীদের নিয়ে ছবি করেছেন?
মুজিবর রহমান: ছবি বলতে মুন্সী প্রেমচাঁদ, বেগম রোকেয়া, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, উস্তাদ আলি আকবর খান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ভীনসেন যোসী প্রমুখ ।

ফারুক আহমেদ: এই কাজে বিশেষ সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন এমন কারো নাম?
মুজিবর রহমান: আমার এইসব তথ্যচিত্র গুলির নির্মাণের জন্য এমন কিছু মহান মানুষ আছেন যাদের কথা না বললে নয় বিশেষ করে বিশিষ্ট সমাজসেবী ও নজরুল প্রেমী পতাকা গোষ্ঠীর মোস্তাক হোসেন, মরহুম হাজী সুলতান আহমেদ, সমাজসেবী মহ খলিল, প্রাবন্ধিক আবদুর রাউফ, আল আমীন মিশন। এছাড়াও বহু মানুষের সহযোগিতা আছে।

ফারুক আহমেদ: ‘নজরুল’ কে আমরা কবে দেখতে পাবো?
মুজিবর রহমান: আগামী নভেম্বর মাসে কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসবে নন্দনে প্রথম দেখানো হচ্ছে তারপর ডিসেম্বর মাস নাগাদ সকলেই দেখতে পাবে বলে আশা করছি।

ফারুক আহমেদ: ভবিষ্যতে আর কি কি কাজ করতে চান?
মুজিবর রহমান: আমি আপাতত হাজী মহম্মদ মহসিনের ও স্বামী বিবেকানন্দের উপর কাজ করতে যাচ্ছি। আসলে বিভিন্ন মনীষীদের জীবন নিয়ে কাজ করার সাথে সাথে সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে মানুষের কাছে ইসলামের শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা পৌঁছে দিতে চাই ।

ফারুক আহমেদ: সমাজ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
মুজিবর রহমান: সমাজে পিছিয়ে পড়া মানুষকে মূলস্রোতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে এবং তাদেরকে শিক্ষিত সমাজ রূপে গড়ে তুলতে হবে। সাহিত্য ও সমাজ বিকাশে আমাদের আরও এগিয়ে আসতে হবে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক উদার আকাশ। পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা, ভারত।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!