‘ঘোড়েল’ শেষ পর্ব

মুসা আলি
মুসা আলি
26 মিনিটে পড়ুন

একটা ক্ষুদ্র সভার প্রতিক্রিয়ায় থানার ওসি যে এভাবে বিরূপ হয়ে উঠবেন, সুবিমল তা ভাবতেই পারছেন না। তাঁকে দেখে আগে যেভাবে তঠস্ত হয়ে থাকতেন, তা আর নেই বরং উদাসীনতা দিয়ে রোজ রোজ সুবিমলকে নতুন করে মাপতে শুরু করেছেন। পুলিশি চরিত্রের সবচেয়ে বড়ো গুণ সন্দেহের আলো ফেলে মূল সত্য বের করে আনা। থানার ওসি সেই সূত্রে ঢুকে পড়েছেন, অনেক প্রশ্ন তাঁর মনে, তাহলে কী সুবিমল সত্যি সত্যি হাসপাতাল থেকে শিশু পাচারের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন? ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জীকে থানায় ডেকে জিজ্ঞাসা করা হলে মূল সত্য বের হয়ে আসতে পারে। সুবিমল যে জয়ন্ত দেবনাথের খুনের পিছনে থাকতে পারেন, সেরকম একটা সন্দেহ বড়বাবুর মধ্যে দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে, ভাবছেন,রাজিবুল এবং প্রদীপকে থানায় ডেকে আরও তথ্য সংগ্রহ করতে পারলে কিংবা তাদের দিয়ে ডায়েরি করিয়ে নিতে পারলে সুবিমলের বিরুদ্ধে কেস স্টার্ট করা সম্ভব হতে পারে। রাজনীতি করেন বলেই যা খুশি করবেন তা মেনে নেওয়া যায় না।
পরের সপ্তাহে সোমবার। থানার ওসি রাজিবুল ও প্রদীপকে ডেকে পাঠালেন। সন্ধের মধ্যে দেখা করার জন্যে বিনীত অনুরোধ।
রাজিবুল ফোন সংযোগে জানালেন, সন্ধের সময় যাচ্ছি। প্রথমে আপনার সঙ্গে কথা বলব, পরে বাজারের দরকার সামলে বাড়িতে ফিরব।
তাহলে তাই আসুন, প্রদীপ কী সঙ্গে আসছে?
ওকে খবর পাঠিয়েছি, যাওয়ার প্রসঙ্গে সম্মতি দিয়েছে।
সুবিমলকে জাপটে ধরার জন্যে ওসির নেশা এত তীব্রতর হয়ে উঠেছে যে, সন্ধের শুরুতে ভিতরে ভিতরে বেশ চনমনে হয়ে উঠলেন। একটু পরে রাজিবুল আসবেন, হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেন— যদিও প্রদীপ তখনও সাকার হয়ে উঠতে পারে নি। চেম্বারে বসে বড়বাবু ছক কষছেন কীভাবে কথার যাদু দিয়ে দুজনের কাছ থেকে মূল অভিযোগের বাস্তবতা বের করে আনতে পারবেন।
সন্ধে সাতটা, রাজিবুল ওসির ঘরে ঢুকে বললেন, স্যার, মিনিট দশেকের মধ্যে প্রদীপ চলে আসছে।
ততক্ষণ কী দুজনে নিরিবিলি কথা বলতে পারি?
তা অবশ্যই পারি।
শুনেছি, সুবিমল আপনার ক্লাসমেট।
ঠিক শুনেছেন।
লোকটার এত অবনতি হল কী করে?
সে অনেক কথা বড়বাবু। আপনি সবে এসেছেন, হয়তো ওর সম্পর্কে সবটা শুনে উঠতে পারেন নি। যে গুরুর হাতে ওর রাজনীতির হাতেখড়ি, তাঁর নিষ্ঠা আর সততার পরিচয় পেলে আপনিও অবাক হয়ে যাবেন, সুবিমল তাঁর সদগুণগুলো আয়ত্ত করতে পারে নি, বরং গুরুর মৃত্যুর পরে সম্পূর্ণ বিপরীত পথে যাত্রা শুরু করেছিল, আজও তা চলছে। ওর অধঃপতনের শেষ নেই। অবৈধভাবে নারী জীবন ভোগ, অন্যায় পথে অর্থ রোজগার, দুর্বৃত্তদের সঙ্গে মেলামেশা, হাসপাতাল থেকে শিশুপাচার সব কিছুতে হাত পাকাতে পাকাতে নিজেকে একেবারে কলুষিত করে তুলেছে।
আপনার কী মনে হয়, জয়ন্ত দেবনাথের মার্ডারের সঙ্গে পরোক্ষভাবে সুবিমল জড়িয়ে ছিলেন?
স্যার, ‘পরোক্ষ’ শব্দটা তুলে নিলে নিজের মন্তব্য প্রকাশ করতে পারি।
তাহলে তুলে নিলাম।
একেবারে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। যাকে ধরে মার্ডার করিয়েছেন, তাকেও আপনার সামনে উপস্থিত করাতে পারি, তবে একটা বিশেষ শর্তে।
কী বলুন?
এত বড়ো সত্যি স্বীকারের পরে তার দিকটা আপনাকে ভাবতেই হবে।
ছেলেটা কী রাজসাক্ষী হতে পারবে?
আপনি বললেই রাজি হয়ে যাবে।
তাহলে কবে ওকে থানায় আনতে পারবেন বলুন?
প্রদীপ এলে নির্দিষ্ট দিন বলে দিতে পারব।
শিশুপাচার নিয়ে কী সব বলছিলেন?
হাসপাতালের শিশুপাচার নিয়ে সুবিমল ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জীর সঙ্গে যুক্ত। লেডি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলে আপনি সবকিছু জানতে পারবেন অথচ আপনিই তপতীকে সেভ করার জন্যে সন্ধের পরে হাসপাতাল চত্বরে পুলিশি প্রহরার ব্যবস্থা করেছিলেন। সকালে নিজেই হাসপাতালে গিয়েছিলাম খোঁজখবর নিতে। সুবিমলের কথা শুনে আমাকে থানায় ডেকে থ্রেটও করেছেন আপনিই। একটা শোনা প্রসঙ্গ আপনাকে অবগত করাই। চাপ দিয়ে তপতী চ্যাটার্জীর কাছ থেকে সুবিমল কয়েক লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ওই লেডি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বললে প্রসঙ্গটা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রদীপ ওসির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, স্যার, আসতে পারি কী?
অবশ্যই।
বলুন, কেন ডেকে পাঠিয়েছেন?
সরাসরি বলো, সুবিমল কী জয়ন্ত দেবনাথের খুনের সঙ্গে জড়িত?
রাজিবুলদা কী বলেছেন?
প্রিয় ক্লাসমেটের তো তো মন্তব্য, সুবিমল এত নীচে নামতে পারে না।
প্রথমেই বলি, রাজিবুলদা এভাবে মিথ্যা কথা বলতে পারেন না। যদি বলে থাকেন, সেই মন্তব্যের সঙ্গে আমি একমত নই।
এত জোর দিয়ে বলছ?
যে খুন করেছে, সে এখন সুবিমলের গ্রিপে নেই, তাকে জিজ্ঞাসা করলেই বাস্তব তথ্য পেয়ে যেতে পারেন।
ওসি খুক খুক করে হেসে উঠলেন।
মিথ্যে বলি নি স্যার।
দুজনের কথা হুবহু মিলে গেল বলেই এভাবে হাসলাম। রাজিবুলবাবু, তপতী চ্যাটার্জীর ফোন নম্বরটা জানা আছে কী?
হাসপাতালের কমন নম্বর থানার ডায়েরিতে রয়েছে, ওতেই ফোন করলে তপতীকে পেয়ে যাবেন।
তাহলে রাজিবুলবাবু, এখন আসতে পারেন, প্রদীপ, তুমিও। তপতীকে ট্রাই করে দেখতেই হচ্ছে। বড়বাবু ফোন করে বললেন, থানা থেকে বলছি।
বলুন স্যার।
কে কথা বলছেন?
হাসপাতালের সুপার সাইফুল আলম বলছি।
প্রসূতি বিভাগের প্রধান তপতী চ্যাটার্জীর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
উনি ওয়ার্ড পরিদর্শনে গিয়েছেন।
কতক্ষণ পরে ফোন করলে পাব?
মিনিট চল্লিশ পরে ফোন করুন।
অপেক্ষায় থাকা ছাড়া ওসির সামনে দ্বিতীয় পথ ছিল না। বসে বসে সময় গুণছেন। আগে কোনো লেডি ডাক্তারের বিরুদ্ধে এত বড়ো অভিযোগ ওঠে নি।
তাহলে কী সুবিমলের প্ররোচনায় সাহস পেয়ে এই পথে নেমেছেন? হাত ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলেন, একঘন্টা পার হয়ে গেছে চিন্তা স্রোতের মধ্যে, আবার ফোন করলেন, হ্যালো মথুরাপুর হাসপাতাল।
বলছি।
ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জীকে দেওয়া যাবে কী?
প্রসূতি বিভাগের প্রধানকে চাচ্ছেন?
হাসপাতালে একাধিক তপতী আছেন নাকি?
মেডিসিন বিভাগে আকেরজন একই নামে লেডি ডাক্তার আছেন।
ধন্যবাদ প্রসঙ্গটা পরিষ্কার করে দেওয়ার জন্যে।
Kindly ধরুন, উনি আসছেন।
তপতী চ্যাটার্জীর মধ্যে কম্পন শুরু হয়েছে। কী বলবেন, সেই মতলবেই ব্যস্ত। রিসিভার ধরে বললেন, থানার বড়বাবু বলছেন?
ইয়েস।
বলুন স্যার।
আজ কী একবার থানায় আসতে পারবেন?
খুব জরুরি?
সেজন্যেই ফোন করতে হল।
আধঘন্টার মধ্যে যাচ্ছি।
ওসি মনে মনে জট খুলতে ব্যস্ত। ছ’মাস আগে দায়িত্ব পেলেও সুবিমল তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেন নি, বার বার বিরুদ্ধ প্রশ্ন তুলে থামিয়ে দিয়েছেন।
মিষ্টি কথার আড়ালে নিজস্ব হুমকি ধরে রাখার নাম সুবিমল রায়। ওসির দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, সুযোগ এসেছে যখন, সুবিমলকে ঘায়েল না করে ছাড়বেন না। থানার উপর তম্বি দেখানোর উনি কে?
চিন্তার গলিপথ শেষ না হতেই ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জী এসে চেম্বারের সামনে দাঁড়ালেন।
বললেন তো আধঘন্টা পরে আসবেন।
আগে এসে কী ভুল করলাম?
সরি সরি, আমার এ প্রশ্ন তোলা ঠিক হয় নি।
কেন ডেকেছেন বলুন?
সংকোচ বোধ করছি কিন্তু প্রশাসনের তাগিদে বলতেই হচ্ছে।
মন খুলে বলতে পারেন।
আপনি কী হাসপাতাল থেকে শিশু পাচার কাণ্ডে সুবিমলের সঙ্গে জড়িত আছেন?
এ তথ্য ঠিক নয় স্যার।
তাহলে কী রাজিবুলবাবু ভুল বললেন?
উনি ঠিক বলেন নি।
কুমারী মালতির পুত্র সন্তান সম্পর্কে আপনার কী জানা আছে?
মালতির সন্তানকে সুবিমলবাবু সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, প্রশাসনের চাপে বাধ্য হয়ে আমাকে সেই কাজ করতে হয়েছিল। এটা কী শিশু পাচারের মধ্যে পড়ে? আপনি সুবিমলকে সাহায্য করতে সন্ধের পরে হাসপাতাল চত্বরে পুলিশ পিকেটিং-এর ব্যবস্থা করেছিলেন। এ কাজের জন্য সুবিমলবাবু আমার হাতে পঞ্চাশ হাজার টাকা তুলে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হই নি। পরে শুনেছিলাম,সেই টাকা সুবিমলবাবু আপনাকেই দিয়েছেন।
ওসি ভাবতে পারেন নি যে ঘটনার গতিপথ এভাবে বিপরীতমুখি হয়ে উঠতে পারে। নতুন করে এগোতে গেলে আগে নিজের পজিশন রক্ষা নিয়ে ভাবতে হবে, তপতীকে অকারণে সামনে আনতে গেলে নিজেই জড়িয়ে যেতে পারেন। মন্ত্রী মহলে সুবিমলের যথেষ্ট দহরম-মহরম রয়েছে, উপর আমলাদের অনেকেই সুবিমলকে প্রেফার করে। সব দিক মাথায় রেখে বললেন, আপনাকে ধন্যবাদ এত নিখুঁত তথ্য দেওয়ার জন্যে, তবুও একটা প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, সুবিমল সম্পর্কে আপনার শেষ সিদ্ধান্ত কী?
কঠোর শাস্তি দাবি করছি।
অপরিসীম ধন্যবাদ।
ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জী হাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে যেমন এসেছিলেন তেমনি চলেও গেলেন। ওসির ভাবনা ভিন্ন খাতে বইতে শুরু করল। মালতিকে ডেকে জিজ্ঞাসা করা একান্ত প্রয়োজন কিন্তু তাকে কীভাবে পাওয়া সম্ভব, তা মাথায় নিতে পারলেন না। একবার ভাবলেন, রাজিবুল পেশায় শিক্ষক, আন্তরিকভাবে সাহায্য করতে পারেন, আবার ভাবলেন, প্রদীপের সঙ্গে মালতির বিয়ের নাটকটা শেষ পর্যন্ত কী পরিণতি পেল, তা জানা যেতে পারে প্রদীপকে ডাকলে। অনেক ভাবনার পরে সিদ্ধান্ত নিলেন, রাজিবুলের হেল্প নেওয়া সর্বোত্তম হবে, ফোনও করলেন।
হ্যাঁ স্যার বলুন।
সময় করে একটু থানায় আসতে পারবেন।
নতুন কোনো দরকার?
এলে দুজনে মিলে আলোচনা করা যেতে পারে। এখন মনে হচ্ছে, আপনি একটু বাড়তি সাহায্য করলে সুবিমলকে আইনের জালে জড়িয়ে দিতে পারব। ভদ্রলোক এতই খারাপ স্বভাবের।
জীবনের তলানিতে পড়ে থাকা একজন মানুষ।
তাহলে কখন আসছেন বলুন?
সন্ধের দিকে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে সামনে চেয়ে দেখলেন, সুবিমলবাবু চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ওসির সাদর আপ্যায়ন— আসুন সুবিমলবাবু।
বলতে কষ্ট হল না তো?
এভাবে ভাবছেন কেন?
আজকাল আপনাকে অন্য মুডে দেখি।
ভিতরে এসে বসুন, কথা বলতে বলতে চা খাই। সকাল থেকে একবারও সেই সুযোগ হয়নি, লোকজনের ঝড়ঝপাটা সামলাতে সামলাতে এতটা সময় পার হয়ে গেছে।
সুবিমল হাসি মুখে ওসির ঘরে ঢুকলেন।
আনমনে ওসি বলতে শুরু করলেন, আসলে কী জানেন, চারদিক থেকে যেভাবে আপনার নামে চাপ তৈরি হচ্ছে, তাতেই অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছি। আসার পর থেকে সব ক্ষেত্রে আপনিই আমার সঙ্গে থেকেছেন, এখন দেখছি সেই অবস্থা আলগা হতে শুরু করেছে।
অভিযোগগুলো শুনতে পেলে তো কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারতুম।
কাল থেকে আমিও ভাবছি, আপনাকে একবার সবকিছু খুলে বলা দরকার। সরকারি দলের নেতৃত্ব বাদ দিয়ে তো প্রশাসন চলে না। আপনি একবার আমাকে বলেছিলেন, দেবশ্রী স্ত্রী হিসেবে রঘুর পক্ষে লিখিত দিলে কারুর কিছু বলার থাকবে না। সেই তথ্যের সত্যতা এখন বুঝতে পারছি কিন্তু আপনার পক্ষে থাকা রঘু এখন এতই বিবাগী হয়ে উঠেছে যে থানায় এসে আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারে। এমন কী রাজসাক্ষী হতেও রাজি। আপনি কী সত্যি সত্যি রঘুকে দিয়ে দেবনাথবাবুকে—।
চমকে উঠলেন সুবিমল, তবুও ভারিক্কি ধরে রেখে বললেন, এসব কী বলছেন,যে কেউ নাম জড়িয়ে দিতে পারে, তাতে প্রমাণ হয় না যে আমরা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে নিজের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে কাউকে খুন করতে পারি। সুন্দরবনের কূটনীতি তো আপনি বোঝেন। সুযোগের সদব্যবহার করতে পাশবিক শক্তিগুলো পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে— সেদিক থেকে এদিক, এদিক থেকে সেদিক, তবুও তাদের উপর নির্ভর করে আমাদের কূটনীতি চালাতে হয়, মানুষকে সঙ্গে নিয়ে চলতে হয়, আপনাদের প্রশাসন চালাতে হয়।
তা অবশ্য ঠিক বলেছেন কিন্তু মুসকিল হল, প্রদীপ রাজিবুলের অভিযোগগুলো নিয়ে খবরের কাগজে যেভাবে আপনার বিরুদ্ধে পর্যালোচনা বের হয়েছে, তা সত্যি সত্যি ভয়ঙ্কর। এতে যে আমমানুষ আপনার বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তা বেশ অনুমান করতে পারছি। আরেকটা প্রসঙ্গ আপনার বিরুদ্ধে পেন্ডুলামের মতো দুলছে।
কী বলুন তো?
ডাক্তার তপতী চ্যাটার্জীর মাধ্যমে মালতির ছেলেকে আপনি পাচার করে দিয়েছেন।
এত ডাহা মিথ্যে অভিযোগ শুনছেন কেন?
আমরা থানায় চাকরি করি, কেউ অভিযোগ জানাতে এলে তা শুনতে হবে, যাচাইও করতে হবে। মালতির ছেলে এখন কোথায় আছে জানেন?
এ অবাস্তব প্রশ্নের উত্তর কী আমাকে দিতে হবে?
সে আপনার ব্যাপার, দিতে পারেন, নাও দিতে পারেন।
সমস্যা হল, ডাক্তার তপতী এসে বলে গিয়েছেন, প্রশাসন চাইলে যে ভদ্রলোক মালতির ছেলেকে দত্তক নিয়েছেন তাঁকেও থানায় উপস্থিত করাতে পারবেন।
যত সব ভোগাস প্রসঙ্গ।
আরও গুরুতর অভিযোগ হল, আপনি নাকি ওই অবৈধ পুত্র সন্তানের পিতা।
সুবিমল কোনোরকম প্রত্যুত্তর না দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
আরে শুনুন শুনুন, কথাগুলো তো আমার নয়, ডক্টর তপতী আর মালতি থানায় এসে সব তথ্য দিয়ে গেছে।
সুবিমল জানে, কূটনৈতিক হুমকি তাঁর মূল অস্ত্র, এতদিন সেই ধারলো অস্ত্র প্রয়োগ করে ওসি ও প্রতিপক্ষের সকলকে পরাজিত করতে পেরেছেন। এসব কথায় কান না দিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পারলে সহজে নতুন ওসির মুখ বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব। তাঁর সঙ্গে রয়েছে কয়েক গন্ডা বড়ো বড়ো আমলা, যাঁদের অঙ্গুলি হেলনে দার্জিলিং-এ ট্রান্সফার করে দিলে এ ওসির কিছুই করার থাকবে না। তখন বুঝবেন, কত ধানে কত চাল।
বাড়িতে ফিরেই জয়কে ডেকে নিলেন, দুজনের পরামর্শ চলল অনেকটা সময় ধরে। সুবিমল জয়কে বললেন, তুই কী বলছিস?
আমিও আপনার সঙ্গে একমত, কাল পরশু থেকে এলাকায় এলাকায় মিটিং মিছিল বাড়াতে হবে, তাতেই ওসি টের পাবেন, গণশক্তি দিয়ে আমরাও পারি থানার প্রশাসনকে রুখে দিতে।
সন্ধে সাতটার পরে রাজিবুল থানায় এসে উপস্থিত হলেন। ওসির সাদর আমন্ত্রণ, আসুন আসুন।
চেয়ারে বসতে বসতে রাজিবুলের প্রশ্ন, কীজন্যে ডেকেছেন বলুন?
শিশু পাচারের সঙ্গে যদি সুবিমলকে জড়াতেই হয়, তাহলে মালতির সাক্ষাৎকার নেওয়া একান্ত প্রয়োজন, সেই ব্যবস্থা কী করা সম্ভব?
তা সম্ভব।
কী করে বলুন।
রাজিবুল ওসির ঘরের বাইরে এসে ফোন করলেন প্রদীপকে, সবকিছু বুঝিয়ে বললেন, উত্তরে প্রদীপ বলল, মালতিকে থানায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
ক’দিনের মধ্যে?
দু’তিন দিনের মধ্যে।
সেকথা কী ওসিকে জানাবো?
তা জানাতে পারেন।
ওসির ঘরে ঢুকে রাজিবুল বললেন, মালতি দু’তিনদিনের মধ্যে এসে দেখা করে যাবে।
আরেকটা বিষয়ে আপনার মতামত চাই।
বলুন।
সুবিমল যে জয়ন্ত দেবনাথের খুনের সঙ্গে জড়িত, তা প্রমাণ করতে রঘু কী পারবে থানায় এসে নিজের জবানবন্দী দিতে?
এ্যারেস্ট করবেন না তো?
বললাম তো, ওকে রাজসাক্ষী হতে হবে। তাহলে কবে থানায় নিয়ে আসছেন?
রাজিবুল কিন্তু কিন্তু করতে লাগলেন।
এভাবে সংকোচ করবেন না, আগে সুবিমলকে টেনে উপরে তুলতে প্রতি মুহূর্তে আপনাদের পথ আটকে দিয়েছি, আজ থেকে সুবিমলকে আটকাতে আপনাদেরকেই টেনে উপরে তুলতে চাচ্ছি। তাহলে রাজি তো?
বাড়িতে ফিরে গিয়ে প্রদীপের সঙ্গে আলোচনা সেরে নিয়ে আপনাকে জানাবো।
আমার কাছে খবর আছে, রঘু এখন আপনাদের গ্রিপে রয়েছে। জনসভার দিনেও রঘু দলবল নিয়ে উপস্থিত ছিল।
রঘু মস্ত বড়ো ক্রিমিনাল।
তাও জানি।
ওরা সুবিধা পেতেই এদল সেদল করে।
তা জানি।
একটু চাপ দিলেই ও রাজি না হয়ে পারবে না। নতুবা ওকে এ্যারেস্ট করতে হবে।
রাজিবুল চমকে উঠলেন, ওসি ফাঁদ পেতে বসে থাকলেন ঘোড়েল মানসিকতা নিয়ে, বুঝে গেলেন রঘুকে বাদ দিয়ে রাজিবুলরা চলতেই পারবে না, তাই রঘুকে হাজির করাতে বাধ্য হবেন। অন্যদিকে সুবিমল সাংগঠনিক শক্তিকে আরও জোরদার করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। ওসি যীশু পাঁজা চেষ্টার কসুর করছেন না সুবিমলের দুর্বলতার উপর যুক্তি ও বুদ্ধির প্রলেপ দিতে। দু-একদিন পরে বাজারে দেখা হতেই ওসির সহাস্য জিজ্ঞাসা, কয়েকদিনের মধ্যে বিষ্ণুপুরে নাকি বড়ো সভা করতে চলেছেন? তার জন্যে তো পারমিশন লাগবে।
জেলা নেতৃত্ব দায়িত্ব নিয়ে এসডিও থেকে সরাসরি পারমিশন করিয়ে দেবেন। ওসি বুঝলেন, তাঁকে বাদ দিয়েই সুবিমল ঘুঁটি সাজাতে চাচ্ছেন। তার উপর যে যথেষ্ট রুষ্ট, সেই প্রমাণও পেয়ে গেলেন। আবার ঘুরিয়ে প্রশ্ন করলেন, এলাকায় যে ছেলেটা নতুন করে রাজনীতিতে নেমেছে, ওর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে?
প্রদীপের কথা বলছেন?
ইয়েস, কদিন আগে থানার পাশে স্কুল মাঠে বেশ তো জমিয়ে বক্তব্য রাখল। অবশ্য সবই আপনার বিরুদ্ধে। কিন্তু আজও আপনি ওর বিরুদ্ধে আমার কাছে একটাও অভিযোগ জানাতে পারলেন না। কেমন যেন রহস্যময় লাগছে।
সুবিমল আনমনা হয়ে উত্তর এড়িয়ে গেলেন।
ওসি আবার উস্কে দিয়ে বললেন, এভাবে আনমনা হয়ে পড়েলেন কেন? ছেলেটা কেন যে আপনার বিরোধিতায় নেমেছে, তা মাথায় ঢুকছে না।
সংগঠন করার অধিকার সকলের আছে।
তাই বলে এত অন্ধ বিরোধিতা।
এভাবে ভাবছেন কেন?
সেদিনের বক্তব্য শুনে আমার তাই মনে হয়েছে। রঘু কী এখন আর আপনার সঙ্গে নেই?
সব কিছু এত লেট করে জানছেন?
ছেলেটা এভাবে ছেড়ে যেতে পারল?
সুবিমল ভিতরে ভিতরে চমকে না উঠে পারলেন না। কোনো উত্তর না দিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন, বুঝতে পারলেন, ওসির আন্তরিকতা নামান্তরে প্রচন্ড বিরোধিতা।
চেয়ারে বসে ভাবনার ঘুরপথে ওসি নতুন ধন্দে পড়ে গেলেন, জল মাপা শেষ হয় নি বলেই সুবিমলকে নতুন করে বুঝে নিতে চাচ্ছেন। এক সপ্তাহ পরে আবার চিঠি লিখলেন,
সুবিমলবাবু,
আপনার অনুপস্থিতিতে অনেক চেষ্টা করেও ঝামেলাটা সমাধানে আনতে পারলুম না, প্রদীপ রাজনীতিতে নতুন এলেও আলোচনার আসরে বসে যে বোধগম্যতার পরিচয় দিল, তা প্রশংসা করতেই হবে যদিও তা শেষ পর্যন্ত কোনো কাজেই এল না। আমার মনে হয়েছে, একমাত্র আপনিই পারেন উদ্ভূত সমস্যার গভীরে প্রবেশ করে একটা সুষ্ঠু সমাধান করে দিতে। আলোচনার আসরে বসে রঘু বলছিল, আপনি চাইলে সে দলবল নিয়ে আপনাকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতে পারে। আমার অনুরোধ, একটা দিনক্ষণ স্থির করে জানালে তা উভয়পক্ষকে জানিয়ে দিতে পারি। প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ সমস্যা ফেলে রাখতে চাচ্ছি নে, বরং আপনার সাহায্য নিয়ে সমাধান করে দেওয়াকেই বড়ো দায়িত্ব হিসেবে ভাবছি।
পত্র হাতে পেয়েই সুবিমল বুঝলেন, ওসি তাঁর উপরে আরও চাপ বাড়াতে চাচ্ছেন। প্রদীপকে সামনে এনে, রঘুর প্রসঙ্গ তুলে তাঁকে বাজিয়ে দেখতে চাচ্ছেন। রঘুর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কহীনতার প্রসঙ্গ জেনেও তা প্রকাশ করছেন না। এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন রঘু তাঁকে সর্বতোভাবে সাহায্য করতেও প্রস্তুত। আসলে রঘুকে সামনে এনে চাপ বজায় রেখে বুঝিয়ে দিতে চাচ্ছেন যে থানার উপর চাপ বাড়াতে চাইলে এভাবেই তাঁর উপর চাপের মাত্রা ক্রমেই বাড়বে। সুবিমল নিজস্ব মোড়লগিরি দেখিয়ে মাত্র একটি বাক্যে প্রত্যুত্তরে লিখেলেন, বড়বাবু, পাঠানো পত্রে আপনার মতামত জেনে গর্বিত হয়েছি, কিন্তু সাংগঠনিক ব্যস্ততার কারণে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারছি নে, আশা করছি, সামনের সপ্তাহে আপনার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।
সুবিমলের মূল কৌশল হল সময় চেয়ে নিয়ে সভাসমিতির মাধ্যমে নিজের ওজন বাড়িয়ে তোলা। ওসির চোখে তা পড়বেই। সেজন্যে প্রকাশ্য স্থানে কর্মীসভার জন্য জয়ের মাধ্যমে থানার পারমিশন পেয়েও কোনো বিশেষ বাড়ির উঠোনে বসে তা সেরে ফেলছেন। রঘুর নাগাল এড়িয়ে যে এসব করছেন, তা ওসিকে বুঝতে দিচ্ছেন না। পরের সপ্তাহে রবিবার কুল্পী হাইস্কুল মাঠে সাড়া জাগানো সভা।
কয়েকজন মন্ত্রী আসবেন। ইতিমধ্যে হ্যান্ডবিল ছাপানো হয়ে গেছে। জয়কে দিয়ে সেগুলো ওসির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। মাইক লাগিয়ে বাজারে ও স্টেশনে প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। ওসি অবাক হয়ে দেখলেন, বক্তাদের তালিকায় মন্ত্রীদের সঙ্গে সুবিমলের নাম রয়েছে।
গত পরশু মালতি এসেছিল থানাতে, জানিয়ে দিয়েছে তার জীবন নিয়ে সুবিমলের ছিনিমিনি খেলার সবিস্তার তথ্য। কী করে তার জীবিত পুত্র সন্তানকে সুবিমল সুকৌশলে পাচার করে দিয়েছিল তারও বর্ণনা দিয়ে গেছে। ওসি খুব সযত্নে সে সব নথি ফাইলে রেখে দিয়েছেন, জাল গুটিয়ে আনার একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। মজার ব্যাপার, রঘু তখনও ওসির সঙ্গে দেখা করতে আসে নি। রাজিবুল সেই প্রসঙ্গ নিয়ে জানিয়েছেন, রঘুর খুব ইচ্ছা একটা এ্যাকশন সেরে নিয়ে তবে ওসির সঙ্গে মিট করতে চায়।
ওসির সাফ প্রশ্ন, রঘু আবার কার বিরুদ্ধে এ্যাকশনে যেতে চাচ্ছে?
সেকথা আমাকে ভেঙে বলেনি স্যার।
বিশেষ চিন্তায় পড়ে থাকা ছাড়া ওসির সামনে দ্বিতীয় পথ ছিল না। জয়ন্ত দেবনাথের মার্ডার হওয়া নিয়ে ইতিমধ্যে রঘুর বিরুদ্ধে গুরুতর কেস স্টার্ট হয়েছে। ছেলেটা আবার নতুন করে কী এ্যাকশন চাচ্ছে, তা ওসির মাথায় এল না।
পরের দিন কুল্পীর জনসভায় সুবিমল এমন সুন্দর বক্তব্য রাখলেন যে দু-তিনজন মন্ত্রীর বক্তব্য ফিকে হয়ে গেল। লোকজন বাড়িতে ফিরল সুবিমলের প্রশংসা করতে করতে। ওসি সেসব শুনে ভাবতে বাধ্য হলেন যে লোকটার সত্যি ক্যারিশমা আছে, সময়ের প্রতিকূলতা ঢেকে দেওয়ার এক যাদুকরের নাম সুবিমল।
রাত আটটায় সভা শেষ হতেই সুবিমল ট্রেনে মথুরাপুর স্টেশনে নামলেন। রিক্সা রেডি হয়েই ছিল। গত দু-তিন বছর ধরে নিজের খরচে সেই ব্যবস্থা করেছেন সুবিমল নিজেই, কয়েক পা সামনে এসে বললেন, হ্যাঁরে ফটিক, কতক্ষণ আগে এসেছিস?
মিনিট দশেক হবে।
কোনো অসুবিধা নেই তো?
ফটিক সুবিমলের কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিস্ ফিস্ শব্দে যা বলল, তাতেই রায়বাবুর মুখ শুকিয়ে তুলসি পাতা হয়ে গেল। ঘুরিয়ে সুবিমলের প্রশ্ন, ওকে কতক্ষণ আগে দেখেছিস?
আটটার সময়, বোধ হয় আপনার আসার খরব জানতে পেরেই…।
সঙ্গে আর কেউ ছিল?
কেল্টে, ভোল্টে, আরেকজনকে ঠিক চিনতে পারলুম না।
ঠিক দেখেছিস তো?
কী যে বলেন।
ওরা এখন কোথায়?
তা জানি নে, তখন মিলের ভিতরে ঢুকতে দেখেছি।
ভয়ের কিছু আছে বলে কী ভাবছিস?
ওকে দিয়ে কিছুই বিশ্বাস নেই।
তা বলেছিস ঠিক, তোকে কী কিছু বলল?
একপলক দেখে নিল মাত্র।
সুবিমল আনমনা হলেন, মাথার ভিতরে ঘুরছে সংকোচের ঘূর্ণিঝড়। কোনো খারাপ ফন্দি নিয়ে ওরা যে এখানে এসেছে, তা নিয়ে সুবিমলের মধ্যে কোনো সন্দেহ থাকল না। ভাবনার গতিপথ আরও খরতর হল, আনমনে এক ঝলক ভেবে নিয়ে বললেন, চল দেখছি।
রিস্ক হয়ে যাচ্ছে না তো?
এখন কিছুই করার নেই। ওরা অন্য দরকারে তো আসতে পারে।
তাও পারে, ফটিক আর প্রসঙ্গ বাড়ালো না, রিক্সা নিয়ে এগিয়ে চলল।
শীতের রাত, পথে তেমন লোকজন ছিল না। একটু আগে থেকেই দোকানে দোকানে ঝাঁপ পড়া শুরু হয়েছে। সন্ধের কুয়াশা এত থিকথিকে যে দশ হাত দূরের কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। সুবিমলের রিক্সা রেল-ক্রসিং এর সামনে এসে উপস্থিত হল।
রঘু রিক্সার সামনে এসে দাঁড়ালো, মুখে সলজ্জ হাসি, ভালো আছেন সুবিমলদা?
দুশ্চিন্তার স্রোত মনের গভীরে, তবুও মুখে শুষ্ক হাসি এনে বললেন, তুই কেমন আছিস?
সবে তো সেরে উঠলুম, তত ভালো নেই।
সুবিমলের দুচোখের সামনে ভাসছে কালিতলার বাগানবাড়িতে রঘুর উপর পুলিশি আক্রমণের দৃশ্য। মানুষের অবচেতন অবস্থান বড়ো বেশি রহস্যময়। সামাজিক স্তরে অস্বীকার করতে পারা গেলেও অবচেতন স্তরে তা বেঁচে থাকে দীঘর্কাল। সুবিমল সেই ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে গেলেন। রঘু তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে, দুপাশে কেল্টে আর ভোল্টে।
রঘুর তিযর্ক মন্তব্য, দাদা, একদম ভয় পাবেন না, ছোটো ভাই হিসেবে আজও আপনার সঙ্গে থাকতে চাই, সেই অনুরোধ জানাতে এসেছি।
সুবিমল দুচোখ বড়ো বড়ো করে চেয়ে থাকলেন রঘুর দিকে।
আমার সঙ্গে একটু যেতে হবে দাদা, কাইন্ডলি না বলবেন না।
বিহ্বল কণ্ঠে সুবিমলের প্রশ্ন, কোথায়? কেন?
বেশি দূরে নয়, পূবের ওই মাঠে?
এত রাতে?
ছোটোভাইকে অকপটে বিশ্বাস করতে পারেন।
যা খুশি তাই বলছিস?
আমি তো যা খুশি তাই করতেও পারি। রঘু লাফ দিয়ে সুবিমলকে টেনে রিক্সা থেকে নামিয়ে নিল। কথা বাড়াবেন না, বাড়াবাড়ি করলে এখানেই….
সুবিমল রঘুর সঙ্গে যেতে বাধ্য হলেন।
অন্ধকার রাতে শীতের ভ্রূকুটি, ঘন কুয়াশা জমে উঠেছে সারা মাঠ জুড়ে। যে দুচারটে দোকান তখনও বন্ধ হয় নি, খবর পেয়েই দুড়দাড় ঝাঁপ ফেলতে শুরু করল। রিক্সাচালক সর্বশক্তি প্রয়োগ করে থানার দিকে এগিয়ে চলেছে। অভূতপূর্ব পরিস্থিতি, একটু পরে হাঁপাতে হাঁপাতে ওসির ঘরে ঢুকে বলল, স্যার, সুবিমলদাকে বাঁচান, হয়তো এতক্ষণ….
কী হয়েছে বলবে তো?
রঘু সুবিমলকে ধরে নিয়ে রেলগেটের পূর্ব মাঠে….।
ওসি যা বোঝার বুঝে গেলেন, একটা বড়ো টিম সঙ্গে নিয়ে বের হয়ে পড়লেন।
মাত্র কয়েক মিনিটের রাস্তা, রেলগেটে পৌঁছেও কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেন না, অন্ধকার ঠেলে মাঠে নেমে এগোনোও ভীষণ রিস্কের।
বিস্তীর্ণ মাঠের মধ্যে রঘু সুবিমলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। দুজনের দর কষাকষি চলছে। সুবিমলের সেই পুরনো দম্ভ, মনে রাখিস রঘু, আমি তোকে কম উপকার করি নি।
সুবিমলদা, আমি কী তা কোনোদিন অস্বীকার করেছি?
আমার জন্যেই তুই ঘোষাল বাড়ির মেয়েকে বউ হিসেবে কাছে পেয়েছিস।
সেকথা আজও মনে আছে।
থানার জুলুম থেকে তোকে রক্ষা করেছি।
তাও স্বীকার করছি।
তাহলে কেন তুই আমাকে এভাবে এখানে…। ভাবগম্ভীর সুবিমল রঘুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।
রঘুর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠছে, আপনাকে মেরে ফেলার জন্যে এখানে ডাকি নি সুবিমলদা। জয়ন্ত দেবনাথের মৃত্যুর পরে নিশ্চয় ভেবেছিলেন, ঘোষাল বাড়ির মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। সেই উদ্দেশ্য পুরণে ঘোষালপাড়াতে গিয়ে যথেষ্ট উস্কানিও দিয়েছিলেন কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
সুবিমল বুঝলেন, দেবশ্রীর ভালোবাসায় রঘুর নরম মনটা তখনও মরে যায় নি, গলার স্বর নামিয়ে বললেন, ভালোবাসার অলৌকিকতায় তোর জীবন ভরে উঠুক, ছেলের অন্নপ্রাশনে ডাকলে অবশ্যই যাব, প্লিজ রঘু, আমার কোনো ক্ষতি করিস নে।
ওসি আর ধৈর্য ধরতে পারছেন না। সুবিমলকে রক্ষা করা তাঁর প্রশাসনিক দায়িত্ব, রঘুকে জীবন্ত অবস্থায় ধরে থানায় নিয়ে যাওয়াও আশু প্রয়োজন। সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন, গুলি করতে করতে মাঠের ভিতরে প্রবেশ করো, প্রয়োজন হলে রঘুকে ঝাঁঝরা করে দিতে কুণ্ঠাবোধ করবে না।
কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকার রাত, গুলির শব্দে বাতাস দ্রুত ভারী হয়ে উঠছে। রঘুকে শেষ কাজটা সেরে ফেলতেই হবে। বলল, আপনাকে প্রাণে মারব না দাদা, দেবশ্রীও সেকথাই বলে দিয়েছে। কাগজে শুধু একটা সই করে দিন।
কী লেখা আছে ওতে?
সেসব না হয় পরে জানলেন।
ভিতরের তাগিদে বিরোধিতার তীক্ষ্ণতা থাকলেও বাঁচার তাগিদে সুবিমল বাড়ানো কাগজে সই করে দিয়ে বললেন, খুশি হয়েছিস তো? এটা নিয়ে কী করবি বল্ তো?
কোর্ট কেস থেকে মুক্তি পেতে চাই সুবিমলদা। তারপর ছোটো ভাই হিসেবে আপনার কাছে থেকেও যেতে পারি।
সুবিমল আর কথা না বাড়িয়ে পিছন ফিরে চলতে শুরু করলেন। রঘুর হাতের পিস্তল গর্জে উঠল, একটা বিপন্ন জীবনের অকস্মাৎ চিৎকারে সারা মাঠ ফালা ফালা হতে থাকল, মৃদু গোঙানির শব্দ মিশে যাচ্ছে ছন্দহীন বাতাসে।
ওসির কণ্ঠস্বর ভেসে এল কানে, ফায়ার ফায়ার, দ্রুত এগিয়ে চলো।
আধদৌড়ে সামনে চলতে চলতে টর্চ মেরেই এক কনস্টেবলের আর্ত চিৎকার, এই তো স্যার এখানে।
ওসি ছুটলেন সেদিকে, পর পর অনেকগুলো টর্চের আলো পড়ল অকুস্থলে। রক্তে ভেসে যাচ্ছেন সুবিমল রায়। নিথর দেহ পড়ে রয়েছে মাঠের মধ্যে। সুন্দবরনের একটা স্মরণীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি। মৃত সুবিমলের মুখের উপর গুঁজে দেওয়া কাগজটা তুলে নিয়ে ওসি টর্চের আলোয় পড়তে শুরু করলেন।
—আজ স্বেচ্ছায় স্বীকার করছি, রাজি না থাকলেও রঘুকে প্ররোচিত করেই জয়ন্ত দেবনাথের মার্ডার সম্পন্ন করেছি আমি। প্রদীপের বুক থেকে সুচরিকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যেই গণশালিসিতে বসে সুকৌশলে প্রদীপের সঙ্গে মালতিকে বিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম, যদিও সেই বিয়ে টেকে নি। স্বীকার করছি, মালতি হাসাতালের বেডে শুয়ে যে পুত্র জন্ম দিয়েছিল তা ছিল আমার অবৈধ সন্তান। কালিতলার পোড়ো বাগানবাড়িতে লুকিয়ে থাকা রঘুকে মেরে ফেলার ছক্ ছিল আমার মস্তিষ্কপ্রসূত। শুধু একটা পরিকল্পনায় ব্যর্থ হয়েছি। স্ত্রী বজির্ত জীবনে সুচরিকে নিয়ে রোজ রোজ স্বপ্ন দেখলেও ভোগ করার স্বপ্ন শেষ পর্যন্ত অধরাই থেকে গেছে।
ইতি
৩রা পৌষ, সোমবার সুবিমল রায়।

ওসি চমকে না উঠে পারলেন না। সমগ্র সুন্দরবনের একটা নির্মম জীবনসত্য বিস্তীর্ণ অন্ধকার মাঠে দ্রুততালে গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে। পাশবিকতা নির্ভর নেতৃত্বের হাতবদল এখানে নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু সুন্দরবনের মানুষ যে গণতন্ত্র আর স্বাধীকার বোধ চায়, সেই শুভ সকাল আসবে কবে? জীবনবোধের সেই মহাশূন্যতা দোল খাচ্ছে অন্ধকার মাঠের সর্বত্র যা আবহমানকাল ধরে সমগ্র সুন্দরবনের জীবন যন্ত্রণার প্রতিরূপ ছাড়া কিছুই নয়।

সমাপ্ত

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মুসা আলি
শিক্ষক জীবনের ৫৫ বছরে এসে সাহিত্যচর্চা শুরু। ইতিমধ্যে পঞ্চাশের বেশি উপন্যাসের মনসবদার। গল্প উপন্যাস লেখার ক্ষেত্রে দীর্ঘ জীবন পরিক্রমায় কঠোর বিশ্বাসী। এখন বিদগ্ধ পাঠক শুধুমাত্র কাহিনি বা চরিত্র খোঁজেন না বরং তার ভিতরে লেখক এর নিজস্ব গভীর মনন আবিষ্কার করতে চান। ঔপন্যাসিক মুসা আলি দীর্ঘ জীবন পরিক্রমার জাদুতে তার নিজস্ব মনন দিয়ে বাঙালি পাঠককে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করে তুলতে বদ্ধপরিকর।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!