একটি কথা আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলাকালীন খুব শুনতাম। কথাটা বলতেন আমাদের দেশের অন্যতম প্রধান একটা রাজনৈতিক দলের নেতারা। কথাটা হল, আমরাও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাই, কিন্তু…। মূলত এই কিন্তু’র পরে যে বক্তব্য থাকত তাতে বোঝা যেত, উনারা আসলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সত্যিই চাইতেন কিনা। প্রথম আলো’র সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামসকে প্রথমে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে পরে তার নামে মামলা দেখিয়ে তাকে গ্রেফতারের পর, আমরা আবারও শুনছি সেই একই কথা একটু ভিন্ন সুরে। আমরাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, কিন্তু… যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যে রাজনৈতিক দল এবং দলের নেতারা এই কথা বলেছিলেন, তাদের এই কথা বলার পিছনে নিজস্ব স্বার্থ ছিল। যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-ই ইসলাম সেই দলের ক্ষমতায় যাবার সহায়ক শক্তি ছিল। সেই দলের প্রতিষ্ঠাতা একজন মুক্তিযোদ্ধা হওয়াতে তারা প্রকাশ্যে এই কথা বলতে কিছুটা দ্বিধাবোধ করেছেন কিন্তু বলেছেন বিচ্ছিন্নভাবে। কিন্তু সাংবাদিক শামস গ্রেফতারের পর এই কথা কারা বলছেন? বলছেন অনেকেই। কিন্তু এই কথা বেশি শোনা যাচ্ছে, আমাদের কথিত প্রথিতযশা সাংবাদিকদের একাংশের মুখে এবং সেটা তারা বলছেন সাংগঠনিকভাবেই। সেই সাংবাদিকদের কেউ কেউ তো আরো একধাপ এগিয়ে বলছেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা বলে আসলে আলাদা কোন বিষয় নাই, একজন নাগরিক হিসাবে এই দেশে আমার যে অধিকার, একটি সংবাদপত্র তার চেয়ে বেশি কিছু দাবী করতে পারে না। কিন্তু আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার অধ্যায়ে অনুচ্ছেদ ৩৯-এ চিন্তার, বিবেকের এবং বলার স্বাধীনতার শিরোনামে আলাদাভাবে বলা হয়েছে–
৩৯। (১) প্রত্যেক ব্যক্তির চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করা হল
(২) (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বলার ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হল
(২) (খ) সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতার নিশচয়তা প্রদান করা হল
(২) (ক) এবং (খ) উভয় ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, তবে শর্ত হল রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতা রক্ষার স্বার্থে বা আদালত অবমাননা, মানহানি বা কোনো অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা দিতে পারে এসব ক্ষেত্রে অধিকারগুলোর উপর আইন অনুসারে যুক্তিসঙ্গত বাধা-নিষেধ আরোপ করা যাবে।
আক্ষরিক অর্থে একজন নাগরিক এবং একটি সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা একই। কিন্তু সংবাদপত্রকে বলা হয় সমাজের দর্পণ। সংবাদপত্রে যারা কাজ করবেন তাদের সত্যিকার অর্থে চিন্তা থাকতে হবে, বিবেক থাকতে হবে, নইলে তারা কিভাবে সংবাদপত্রকে আমাদের কাছে দর্পণ করে তুলবেন? স্বাধীনতার অর্ধশত বছর পার হয়ে যাবার পরও কেন এত বৈষম্য থাকবে আমাদের সমাজে? আমরা যেমন স্বাধীনতাকে উদযাপন করব, সেই সাথে আমাদেরকে ফিরে দেখতে হবে বিগত পঞ্চাশ বছরে আমাদের অর্জন কি? সেইটা কিন্ত উড়াল সেতু, সুউচ্চ ভবন কিংবা রাজধানীর রাস্তায় বিলাসবহুল গাড়ি দেখে বোঝা যাবে না। এগুলি উপর কাঠামো। ভেতর কাঠামো হল খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, চিত্তবিনোদনের ব্যবস্থার উন্নয়ন কতটুকু ঘটল। সেই প্রশ্ন সামনে আনাই তো গণমাধ্যমের কাজ। একজনও নাগরিক যদি মনে করেন যে এই সমাজ কোনো সমতার সমাজ না, সেটা তো তুলে ধরতে হবে। সাংবাদিক শামস তো সেই কাজটিই করেছেন। নাগরিকের বক্তব্য আমগো মাছ, মাংস এবং চাউলের স্বাধীনতা লাগবো।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব-পশ্চিম উপন্যাস্যের একটা চরিত্র প্রতাপ যার যার পৈত্রিক ভিটা ছিল, পূর্ববঙ্গে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যার পিতাকে স্বপরিবারে ইন্ডিয়াতে চলে যেতে হয়। প্রতাপ ওপারে গিয়ে লেখাপড়া শিখে বিচারক হিসাবে কর্মে নিযুক্ত হন। ভারতের স্বাধীনতা দিবসে তিনি পরিবারসহ তার এক বন্ধুর বাড়িতে যান, সেখানে বন্ধুর বাড়ির সাথে লাগোয়া বাগান, পুকুর দেখে প্রতাপের মনে হয় ভারতের স্বাধীনতাই প্রতাপদের বাগান, পুকর সব কেড়ে নিয়েছে। এখন এই যে মনের ভাব, এটা তো বাস্তবতা। এই বাস্তবতা প্রকাশ যদি মানুষ না করতে পারে, তাহলে মানুষ তো আর মানুষ থাকে না, কখনো নাগরিক হয়ে উঠতে পারে না। প্রজাই থেকেই যায়। যেমনটি আমাদের শিক্ষক, সাংবাদিক বুদ্ধিজীবীদের একাংশ রয়ে গেছেন। রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য রাজার প্রতি প্রজার সামিল। কেউ সংবিধান প্রদত্ত অধিকার বলে, ভিন্নভাবে চিন্তা করলে, প্রকাশ করলে সেটা তারা মানতে পারেন না।
কেন তারা উল্টোভাবে বলতে পারলেন না, যে দেশের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমতত্ত্বের প্রতি আমরা পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল এবং একইসাথে গণমাধ্যম হিসাবে আমরা জনতার কাছে দ্বায়বদ্ধ। কেন বলতে পারলেন না, সরকারকে ক্ষে্ত্র বিশেষে বাধা নিষেধ আরোপের অধিকার দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সাংবাদিককে রাতের আধারে তুলে নিয়ে গিয়ে নয়। আপনারা আছেন ফটোকার্ড এর বিভ্রান্তি নিয়ে। মূল আলোচনাকে পার্শ্ব আলচনায় পরিণত করে আসল জায়গা থেকে আপনারা সরে যাচ্ছেন। আর সেক্ষেত্রে আপনার একটাই সহায়ক বাক্য আমরাও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা চাই, কিন্তু…। জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট থাকাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক তাঁর সাথে করেছিলেন অন্য এক অধ্যাপককে চাকুরিচ্যুত করার জন্য। কথিত আছে, প্রেসিডেন্ট জিয়া সেই শিক্ষককে ডেকে বলেছিলেন, প্রফেসর সাহেব, শুনেছি কাকের মাংস কাকে খায় না, কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাংস তো দেখলাম শিক্ষকেরা খান। সাংবাদিক শামসুজ্জামানের শামস এর ক্ষেত্রে এবার সেটাই ঘটেছে। প্রিন্ট মিডিয়ার কথিত উদ্দেশ্য প্রণোদিত সংবাদভাষ্যের পেছনের খবর সামনে আনবার দায়িত্ব নিলেন অন্য একটি ইলেকট্রনিক মিডিয়া। একই ঘটনা কিন্তু আমরা নারায়ণগঞ্জের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে নিগ্রহের ঘটনায়ও দেখেছিলাম। এডিটরস গিল্ড, প্রেসক্লাব নানা কথা বলছেন কিন্তু তাদের সার কথা হল, আমরা গণমাধ্যমকর্মী, আমরা অবশ্যই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, কিন্তু…আজকে স্বাধীনতা দিবসে পুস্পস্তবক অর্পণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের বেদীর সামনেই দুই-পক্ষের সংঘর্ষ, শহীদ মিনার পরিচ্ছন্নতার নামে একজন বিশেষ ব্যক্তির জন্মদিন পালন এগুলি আমাদের অনুভূতিকে তেমন স্পর্শ করে না। কিন্তু ভূল স্বীকার করার পরও প্রথম আলো রেহাই পায় না। সাংবাদিক শামসুজ্জামান এর জামিন পেতে অনেক কাটখড় পোড়াতে হয়।
সংবিধান তো সরকারকে বিশেষ ক্ষেত্রে বিধি-নিষেধ আরোপের সুযোগ দিয়েই রেখেছে। তাহলে সরকার কেন সেই পথে হাঁটল না? অনেকেই দেখলাম এই নিউজের সাথে বঙ্গবন্ধুর সময়ের বাসন্তীর ঘটনা’র কথা উল্লেখ করেছেন। আমি বাসন্তী’র ঘটনা বিস্তারিত জানিনা। কিন্তু আমি জানি ভাত দে হারামজাদা কবিতাও কিন্তু ১৯৭৪ সালেই লেখা হয়েছিল। সেই কবিতার শেষের অংশটুকু এরকম…
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবোঃ গাছপালা, নদীনালা
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাত, নর্দমার জলের প্রপাত
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব প্রধান নারী
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ী
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ
ভাত দে হারামজাদা,
তা না হলে মানচিত্র খাবো।
জানিনা এই কবিতার জন্য রফিক আজাদকে সেই সময় কেমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়েছিল। কিন্তু কবিতার শেষ দুই লাইন আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। শামস এর তাৎক্ষণিক পরিণতি আমরা দেখতে পাচ্ছি কিন্তু সেই সাথে এটাও দেখতে পাচ্ছি, শামস এর তুলে আনা বক্তব্য কিন্তু মানুষের মনে রয়ে যাবে, মুখে উচ্চারিত হবে বহুদিন পর্যন্ত। আপনারা রবীন্দ্রনাথের সেই কিন্তুওয়ালা প্রবন্ধের কিন্তুওয়ালাই রয়ে যাবেন।#