প্রবহমান: পর্ব – দশ

হোসনে আরা মণি
হোসনে আরা মণি
8 মিনিটে পড়ুন
প্রবহমান

আলতার দাঁত নড়ে – ছোট্ট, খুদে দুধদাঁত। যখন-তখন সন্দেশ-পাটালি গুড় খাওয়ার দরুণ পোকা ধরা কালো কালো সব দাঁত। আকিমন নাতিনেরে দাঁত নড়ানো শেখায়। নড়ানোর অছিলায় আচমকা টান মেরে পোকায় ফোঁপরা দাঁত তুলে আনে। প্রথম তোলা দাঁত বড় আহ্লাদ করে ইঁদুররে উপহার দেয়। ইঁদুরের গর্তে দাঁত রেখে ছড়া কেটে নাতিনেরে শেখায়, ইন্দুর ভাই, ইন্দুর ভাই, আমার দাঁত তুই নে, তোর দাঁত আমারে দে। কও বুজি, কও।
নাতিন প্রশ্ন করে, ইন্দুরের গাঁড়িতি দাঁত দিলি কী অয় দাদী?
দাঁতগুলোন ইন্দুরের মতন চিকুন চিকুন আর মজবুত অয়।
ইন্দুরির দাঁত বুঝি খুব মজবুত?
হয়। দ্যাহো না আমাগের ধানের ডোল, গাছের সুপোরী-নারকেল, ঘরের বিছেন-ক্যাথাও কেমন কাইটে-কুটে দেয়?
আমিও কি ধানের ডোল, বিছেন-ক্যাথা এসব কাটবো?
কী যে কও বুজি! তুমি ক্যান ওসব কাটবা? তুমি তো সুন্দর সাদা সাদা দাঁত বাইর করে খলখলায়ে হাসবা আর একশ বচ্ছর বয়স তামাইৎ নওলা মাছের মাথা চাবায়ে খাবা।
একশ বচ্ছর! এহন আমার বয়স কত দাদী?
এই যে আইজকে তুমার পেত্থম দাঁত পইড়লো, তার মানে তুমার বয়স এহন সাত চলে।
তুমার বয়স কত দাদী?
আমার! আকিমন এবার একটু ভাবনায় পড়ে। সত্যি তার বয়স এখন কত? কখনো কি সে তার বয়স নিয়ে ভেবেছে? সেই কোন এগারো-বারো বছর বয়সে তার বিয়ে হয়েছিল। বাড়ন্ত গঠনের হওয়ায় এরা ভাবতো পনেরো-ষোলো। তারপর কত বছর কেটে গেল এ বাড়ি। বিয়ের সাত বছর পর শরাফত হলো। অত বড় বৌ, বিয়ের বছর না ঘুরতেই বাচ্চা হবে বলে যারা খোঁটা দিত তারা বাঁজা বৌ বলে খোঁটা দিতে শুরু করেছিলো। তারপর খোদাতালার অসীম রহমতে মামুদপুরের পীরের পানিপড়া খেয়ে শরাফত এলো কোল জুড়ে। সেও আজ কত বছর! আচ্ছা, শরাফতের জন্মের দিন-সন না রমিজ মিঞা লেখে রাখছিল কোন এক খাতায়? সেই খাতা কি এখনো রাখা আছে ঘরে? যদি থাকে তো রমিজ মিঞার কাছ থেকে শরাফতের বয়সের হিসেব পাওয়া যাবে। আর তা পাওয়া গেলে আকিমনের বয়সের হিসেবটাও তো মেলে।
রাতে ঘুমানোর আগে শাউড়ি ও সোয়ামির জন্য পান ছেঁচে দিতে দিতে আকিমন কথাটা তোলে। পানের বোঁটায় চুন নিতে নিতে রমিজ মিঞা সংক্ষেপে শুধু বলে, বয়সের হিসেবে কী হবি। যার যা বয়স তা তো হইছেই। আকিমন একমত হয় না। বয়স যার যাই হোক তা তার জানা থাকাও উচিৎ বলে কেন যেন তার এতদিনে মনে হয়। এই যে তার শাউড়ি আধা পঙ্গু, আধা অন্ধ হয়ে এখনো বেঁচে আছে। কত তার বয়স তা জানার উপায় নেই। যেকোন দিন সে মারা যাবে। কেউ জানবে না যে কত গুলোন বছর সে এই দুনিয়ায় দুনিয়াদারী করার নসীব পেল। মানুষের তো একটাই জীবন। সেই জীবনের হিসেবটাও সে জানবে না? আবার তার স্বামী রমিজ মিঞা, লোকটা চিরকালই কেমন বুড়োটে ভাবের – দেখনে, কথনে, চাল-চলনে কোনকালেই তার মাঝে যৌবনের তরতাজা পুরুষ্টভাব ছিল না। অল্প বয়সেই তার চুল পাকলো, দাঁতও পড়লো। তা কোন বয়সে যে সেসব হলো তাও কি আর ঠিকমত জানে কেউ? আকিমনের আজো শক্ত-সমর্থ শরীর। এখনো তার চুল কেবল কানের কাছে দু-চারটা পেকেছে। এখনো সে গরুর সিনার হাড্ডি চাবায়ে খেতে পারে। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় কোমরের ব্যথাটা বাড়া ছাড়া তার শরীরে রোগ-বালাই বলতে গেলে নেই। তা খোদাতালার এই নেয়ামত শরীরটা কত কাল এমন নিরুপদ্রব সুস্থ থাকে, তাও কি জানা দরকার না?
তয় বয়স না জানা নিয়ে জীবনে তত সমস্যা না হলেও বয়স জানাতে যে সমস্যা হতে পারে তা তো জানাই গেল রমিজ মিয়ার মামাতো ভাই সলিম হাজির কাণ্ড দেখে।
মস্ত ধনী না হলেও বেশ অবস্থাপন্ন সংসার সলিম হাজীর। সলিম হাজীর দাদার বাপ ভুলু শেখ তো ছিল বেশ বড় মাপের তালুকদার। ভিন গাঁয়ের ছোটখাটো জমিদারেরাও তাকে সম্মান করতো। তা তিনপুরুষ ধরে ভাগ হয়েও তালুক-মুলুক এখন সলিম হাজীর ভাগে যা আছে তাতে তাকে ‘বড়লোক’ বলে খাতির করে চলে আশ-পাশের পাঁচগাঁয়ের মানুষ। সেই খাতিরের খাতিরেই কিনা, সলিম হাজী মাঝ বয়সে পৌঁছার আগেই করে এলো হজ্ব। সে বছর, যে বছরে পোরথম আসমানী জাহাজ আসমানে উড়লো আর হাজার হাজার মানুষ নাকি তা দেখলো! পানি-জাহাজে চেপে সলিম হাজি গেছিল আরব মুলুকে। জাহাজবাসের কালেই নাকি সে খবরটা শুনেছিল কার কাছে। আসমানে ওড়া জাহাজ! খোদাতালার ইচ্ছেয় মানুষের কী কেরামতি! তা যুদ্ধ-বিগ্রহ লাগার ক’বছর যেন আগের ঘটনা সেটা। আর সেই যুদ্ধ কত বছর চলে শেষও হলো এই কয় বছর। একটা-দুটো চুল তখন পাকছে কি পাকেনি যে হাজীর, তার মাথায় এখন কদমফুলের রোয়ার মতো কিছু চুল। মুখের সামনের দিকে কটা দাঁত ঝুলতে থাকলেও ভেতরের দাঁত পড়ে-ঝরে এখন তার চোয়াল বসা চেহারা। এখন হাজীর সংসার চিন্তা ছেড়ে পরকালের চিন্তা শুরু করার বয়স। কিন্তু না, একদিন কী এক কারণে গিন্নীর সাথে তীব্র মতান্তর-মনান্তর হওয়ায় গিন্নী তারে ‘বুড়ো’ বলে দিল গাল। অমনি তা পৌরুষের গালে চড় হয়ে পড়ল হাজীর ব্যাটা হাজীর নাতি হাজীর। আর যায় কোথায়! কোথায় লুকায়ে থাকা কোন কুষ্ঠি বের করে হিসেব কষে হাজী ঠিক বের করে ফেললো যে তার বয়স আসলে মোটে ছাপ্পান্ন বছর আটমাস চোদ্দ দিন। অর্থাৎ কিনা সাতান্ন বছর বয়স হওয়ারও আগে তারে খোটা শুনতে হলো ‘বুড়ো’ বলে! এই বয়সে আল্লার নবী… তওবা, তওবা, নবীর সাথে নাকি তার তুলনা! তবে কারো সাথে তুলনা করতে নয়, বরং নিজেরে ‘প্রমাণ’ করতেই যেন সে হঠাৎ ঘটায়ে ফেললো ঘটনা। পাশের গাঁয়ের গেদু সর্দারের ডবকা যুবতী বেওয়া মেয়েটারে নিকেহ্ করে এনে তুললো ঘরে।
থাউক। বয়স জানার কাম নাই। মনে মনে এমন ভাবনা ভেবে আকিমন সাংসারিক বিষয়ে কথা পাড়ে। রমিজ মিয়া নিতান্তই ‘হুঁ-হাঁ’ জবাবের মানুষ, আর আকিমনও নয় অমিতভাষী, তাই কোন বিষয়েই তাদের কথা লম্বা হওয়ার অবকাশ পায় না। ধান-পাট-চৈতালী ফসল আর গরু-বাছুরের প্রাসঙ্গিক আলাপ থেকে রমিজ মিয়া হঠাৎ ভিন্ন এক প্রসঙ্গে কথা তোলে।
আলতার বিয়ের পরস্তাব!
আকিমনের মনটা হঠাৎ কেমন হয়ে যায়। আবার কেমন এক খুশি-খুশি ভাবও যেন মনে ছোঁয়া দেয়। তা বিয়ে-সাদী ব্যাপারটাই তো অমন। এর প্রসঙ্গ মাত্রে মনে একটু হাসি-খুশির ঝিলিক খেলে না যায়, এমন বেরসিক আছে নাকি জগতে! তবে কিনা সময়-অসময়ের ব্যাপার আছে। আছে উপযুক্ততার ভাবনাও। আর আছে অনিশ্চয়তার আশঙ্কা যা জন্ম দেয় এক প্রবল দ্বিধা। সেই দ্বিধার ভারে ভারাক্রান্ত মনে আকিমন নিজের মাঝে কথাটা খানিকক্ষণ নাড়াচাড়া করে, ভাবে, একটু দুশ্চিন্তিতও হয়। এই কদিনইবা আগের কথা! আলতার মা শরাফতের ভয়ে…
কিন্তু রমিজ মিয়ার যুক্তি অন্যরকম। দাম্পত্য প্রেমে যুগলের বয়সের ফারাক যে বিড়ম্বনা ডেকে আনে সে বোধ যেন তার নেই। আসলে সে ইতিহাস যে তার জীবনে নেই। তার জীবনে বরং উল্টোটা আছে। সোমত্থ বৌ ঘরে আনলে তারে বশ করে তাবে রেখে চলা যে পুরুষের পক্ষে কত কঠিন তাই সে শুধু জানে। কিন্তু সেসব কথা উল্লেখ না করে সংক্ষিপ্ত কথায় তার মন্তব্য, সময়ে সব ঠিক হয়ে যায়।
হ্যাঁ, সময়ে সব ঠিক হয় বৈকি। কিন্তু যদ্দিন সময় না আসে…
রমিজ মিয়া কথা বাড়ায় না। নাতনির বিয়ের সপক্ষে তার কূটনৈতিক ভাবনা সে এখনই কারো কাছে খোলাসা করতে চায় না। সেটাও সে সময়ে বলবে বা আপনা থেকেই সবাই বুঝতে পারবে।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম - মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার ওমেদপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মতারিখ- প্রকৃত: ২৭ জুন ১৯৭৭, সনদীয়: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ পিতা- মোঃ আব্দুল গফ্ফার মোল্লা মাতা- সালেহা ইয়াসমিন সংসারসঙ্গী- মোঃ দেলোয়ার হোসেন (মাহমুদ) তিন কন্যা- আদৃতা, অঙ্কিতা ও দীপিতা বর্তমান অবস্থান: রাজশাহী। পেশা: সরকারী চাকরি [উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, রাজশাহী] প্রকাশিত গ্রন্থঃ ৭টি (৬টি গল্পগ্রন্থ, ১টি উপন্যাস) প্রথম: অপরাজিতা (সময় প্রকাশন) দ্বিতীয়: জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ) তৃতীয়: নদীও নারীর মত কথা কয় (বটেশ্বর বর্ণন) চতুর্থ: মহাকালে প্রান্তরে (পরিবার পাবলিকেশন্স) পঞ্চম: লিলুয়া জীবনের নারীগণ (বটেশ্বর বর্ণন) ষষ্ঠ: বিবিক্তা (বটেশ্বর বর্ণন) – উপন্যাস সপ্তম: তামসী (বইঘর)
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!