‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – সতেরো

মোহিত কামাল
মোহিত কামাল
4 মিনিটে পড়ুন

পর্ব – সতেরো: বাস্তবের সড়কে কেন এত মোড়?

চন্দনাকে উদ্ধারকারী পুলিশসদস্য হাসপাতালের ভিড় ঠেলে পৌঁছে গেলেন রোগিণীর পাশে। সিভিল ড্রেসে আসায় অনেকে তাকে চিনতে না পারলেও উপস্থিত চেনা সাংবাদিকরা তাকে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। রোগিণীর পাশে দাঁড়ানো উর্বশীর উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিই রোগিণীর বোন, ম্যাডাম?’
প্রশ্ন শুনে পাশে ঘেঁষে দাঁড়ানো সাংবাদিকদের একাংশ সরে যেতে লাগল পেছনের দিকে।
এখনও উত্তর দেয়নি উর্বশী। উত্তরের জন্য অপেক্ষাও করলেন না পুলিশ সদস্য। খোঁজ করতে লাগলেন কর্তব্যরত চিকিৎসকের।
পাশে দাঁড়ানো নার্স বলল, ‘জরুরি ব্যবস্থাপত্র ট্রিটমেন্ট সিটে লিখে উনি রোগিণীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় রেফার করেছেন। ডিউটি রুমেই আছেন তিনি।’
‘ফাইলে ‘পুলিশ কেস’ সিল দিয়েছেন?’ নার্সের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করলেন তিনি।
‘জি। দেওয়া হয়েছে। কাগজপত্রও তৈরি করে রেখেছি আমরা।’
আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন প্রায় বেরিয়েই গিয়েছিল কণ্ঠ থেকে। তাৎক্ষণিক নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে পাশে দাঁড়ানো মহিলার দিকে আঙুল তুলে উর্বশীর উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘উনি কি মা?’
‘জি।’
‘আসুন। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে নিই আমরা।’
ভিড় হটিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনি। একজন রিপোর্টার পুলিশের কাছ ঘেঁষে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করলেন, ‘রোগিণী কলগার্ল নয়? লোকাল পত্রিকায় তো তাকে সেভাবেই লেবেল করেছে।’
পুলিশ সদস্য বললেন, ‘আমিই নির্যাতিতা ভিকটিমকে উদ্ধার করেছি, আমাকে তো কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। পত্রিকা অফিসে কে জানাল যে সে কলগার্ল?’
প্রশ্ন শুনে দমে গেল রিপোর্টার। ধীরে ধীরে দূরে সরে যেতে লাগল উর্বশীর সামনে থেকে।
কর্তব্যরত চিকিৎসক রোগিণীর অবস্থা বর্ণনা করে ওদের বললেন, ‘জরুরি চিকিৎসা পুরোপুরি দিতে পেরেছি, বলব না। মনে হচ্ছে উঁচু জায়গা থেকে জঙ্গলের খাদে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, দেহাভ্যন্তরে কিংবা মস্তিষ্কে কোনো রক্তপাত হয়েছে কিনা নিশ্চিত নই আমরা। ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। উন্নত পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য তাকে ঢাকায় পাঠানো দরকার মনে করেছি। কাগজপত্রও করে রেখেছি আমরা। উপযুক্ত অভিভাবক কিংবা আপনাদের মাধ্যমে তাকে ঢাকায় পাঠানো উচিত।’
অন্ধকারে ঢেকে যেতে লাগল উর্বশীর চোখের আলো। কোরালপ্রাচীরের শক্ত তলে চাপা খেতে লাগল বুক। চাপা শ্বাস ঠেলে বেরিয়ে এলো তীক্ষ্ণ প্রশ্ন, ‘ওকে কি রেপ করা হয়েছে?’
‘পুরোপুরি রেপড হয়েছেন বলা যাবে না, তবে শারীরিক জখম আছে তার শরীরে। গলা ঠেসে ধরে শ্বাসরোধ করার প্রমাণচিহ্ন আছে। চেষ্টা হয়েছিল ধর্ষণের। সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ভিকটিম সম্ভবত তা প্রতিরোধ করতে পেরেছেন।’
পুলিশ সদস্য কথাটার শেষাংশ লুফে নিয়ে বললেন, ‘ধর্ষণের চেষ্টাও ধর্ষণের আওতায় পড়ে। তবে সর্বোচ্চ পরিণতি থেকে সম্ভবত নিজেকে রক্ষা করতে পেরেছেন ভিকটিম।’
ওদের কথা থেকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুমান করতে পেরে ভীত হলেও, জিভ ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হতে লাগলেও আকস্মিক চোখের আঁধার ফুঁড়ে প্রসব ঘটল নক্ষত্রের। আলোর কামড় খেল চেপে ধরা বুকের পাটাতন। দীর্ঘশ্বাসের পাশাপাশি পায়ের তলেও পরিষ্কার সন্ধান পেয়ে গেল শক্ত মাটির। বুঝল কেবল ক্ষণস্থায়ী বালির বাঁধে উঠে আসেনি ও, মাটি ফেটেও বেরুচ্ছে সবুজ গুল্মরাশি। আর তখন ঘটল আত্মবিশ্বাসের বিস্ময়কর উদ্ভাস। প্রত্যয়ী কণ্ঠে উর্বশী বলল, ‘ভিকটিমকে ঢাকা নিয়ে যাব। সব ব্যবস্থা করে দিন প্লিজ।’
সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। চিকিৎসক ও পুলিশ সহায়তা করলেন। সব প্রস্তুতি শেষে পুলিশটি বললেন, ‘আমি এ থানার এএসআই- জলিল। আমার নম্বর স্টোর করে রাখুন। যেহেতু এখানেই ধর্ষণ চেষ্টা হয়েছে তাই মামলা চলবে এ থানা থেকে। আমার সর্বোচ্চ সহায়তা পাবেন আপনারা।’

অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে যাচ্ছে। জীবনের ভিন্ন সড়কে উঠে গেল উর্বশী। বাস্তবের সড়কে এত মোড়! এত বাঁক খেতে হয়! আর কত বাঁক খেতে হবে? আলোর কণারূপে প্রশ্নগুলো ছড়াতে লাগল বিশ্বলয়ে। তখনই মনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কাজী নজরুল ইসলামের ত্রিতালের ভৈরবী ভজন :
খেলিছ এ বিশ্ব ল’য়ে বিরাট শিশু আনমনে।
প্রলয়-সৃষ্টি তব পুতুল খেলা
নিরজনে প্রভু নিরজনে॥
শূন্যে মহা আকাশে
তুমি মগ্ন লীলা-বিলাসে;
ভাঙিছ গড়িছ নিতি ক্ষণে ক্ষণে॥

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫। জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬। কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)। তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!