ভালোবাসা কারে কয়

কামাল কাদের
কামাল কাদের
11 মিনিটে পড়ুন

রাজধানী ঢাকা শহরের অণিতদূরে ছোট্ট মফস্বল শহর ভৈরব। ভৈরব রেল স্টেশনে দিপু (দীপালি ঘোষ) এসেছে সন্ধ্যা পাঁচটার ঢাকাগামী ট্রেন ধরার জন্য। এদিকে হিমু (হিমাদ্রী গোমেজ) তার বন্ধু বান্দবদের সাথে দু দিন আড্ডা মেরে ঢাকায় ফিরবে বলে সেও সেই ঢাকাগামী পাঁচটার ট্রেন ধরার জন্য স্টেশনে এসে পৌঁচেছে। ওমা, স্টেশনে পৌঁছে ওরা জানতে পারলো, ট্রেন ছাড়তে বিলম্ব হবে। কখন ছাড়বে তার কোন হদিশ নেই। অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া বিশেষ কোন উপায় রইলোনা। 
মাঘ মাসের মাঝা মাঝি। বেশ কিছুদিন ধরে শীতটা জেঁকে বসেছে।কয়েক দিন ধরেই তাপমাত্রা ৬ -৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠানামা করছে। তারসাথে ঘন কুয়াশার ফলে সন্ধ্যে বেলার সময়টাও ভরা রাত্রি মনে হয়। শীতের তীব্রতায় স্টেশনে বিশেষ কোন লোকজন নেই। কেমন যেন থমথেমে ভাব। দিপুর মনে ভয়ে কিছুটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। ভাগ্যিস স্টেশন মাস্টারের রুমটা খোলা আছে। প্লাটফর্মের ল্যাম্পপোস্টের সামনে একটা খালি বেঞ্চে সে বসে পড়লো। এরই মধ্যে দিপু তার মা-বাবাকে ফোন করে জানিয়ে দিলো, তার বাসায় ফিরতে দেরি হবে। কিন্তু বাবা-মার্ মন তো, যতক্ষন পর্যন্ত সন্তান বাড়ীতে না পৌঁছায়, ততক্ষন পর্যন্ত তাদের মনে স্বস্তি থাকেনা। দিপু এখানে এসেছিলো একটা স্কুলের ইংলিশ টিচারের চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য। সে ইংলিশে এম, এ। ইন্টারভিউ ভালোই হয়েছে। আকারে -ইঙ্গিতে গভর্নিংবডির চেয়ারম্যান জানিয়েছেন যে, দিপুকে তাদের পছন্দ হয়েছে। এখন শুধু প্রচলিত প্রথানুযায়ী কাজ কর্ম গুলি সেরে তাকে নির্বাচন করার কথা জানাবে। 
হিমু একাকী দিপুকে দূরের ওই বেঞ্চে বসে থাকতে দেখে তার সামনে এগিয়ে আসলো। দিপুকে সামনে দেখেই তার সৌন্দের্য্যে একেবারে “থ” হয়ে গেলো, তার মনে প্রশ্ন জাগলো, “ভগবান, মানুষকে এতো সুন্দর করে বানাতে পারে?” এরকম রূপবতী মেয়ে সে কমই দেখেছে, সাক্ষাৎ যেন দূর্গা! কি ভাবে যে সে তার সাথে কথা শুরু করবে ভাবতে পারছেনা, পাছে তাকে লম্পট ছেলে না ভেবে ফেলে। কিন্তু এ সময়ে তার মন, মানসিকতা এমন এক রূপবতী মেয়ের সান্নিধ্য পেতে উদগ্রীব হয়ে উঠলো। তারপর কিছুটা সাহস সঞ্চয় করে সে দিপুকে জিজ্ঞাসা করলো, “আপনাকে কিছুটা চিন্তিত মনে হচ্ছে! আপনিও কি আমার মতো ঢাকাগামী ট্রেনের অপেক্ষায় আছেন?”

– সেটা জানা কি আপনার বিশেষ দরকার?

– তা নয়, তবুও মনে হলো, যদি আমি আপনার তেমন কোনো উপকারে আসতে পারি, তাই…

-আমাকে উপকার করে কি হিন্দী ছবির নায়কের মতো “হিরো” হতে চান?
– যদি মনে করেন তাই, তাহলে সেটাই ধরে নিতে পারেন। সত্যি বলতে কি, ভগবান, আপনাকে এতো সৌন্দর্য দিয়ে বানিয়েছেন যে, তাতে যে কোনো ছেলেই “হিরো”হওয়ার লোভ সামলাতে পারবেনা। আমি তো ছাড় এক সাধারণ মানুষ। মুনি -ঋষিরা আপনার এই রূপে মুগ্ধ হয়ে আপনার প্রেমে পড়ে যাবে। 

– আপনি করেনটা কি? মানে এই মেয়েদের পিছনে লাগানো কি আপনার কাজ?

একটু হেসে হিমু বললো, “সমাজের অন্যাণ্য লোকের মতো আমার ও একটা পেশা আছে। এবং 

সে পেশাটি অনেক মূল্যবান এবং জনহিতকর কাজ”। 
– সেটা কেমন? 

– এই লোকজনের শরীর নিয়ে কাটা-ছিঁড়া করা। 

– হে ভগবান! আপনি সন্ত্রাসী। আপনাকে দেখে তো তা মনে হয় না। 

– ঘাবড়াবেন না। আমি মোটেই সন্ত্রাসী নই। 

-তাহলে? 

– আপনাকে দেখে শিক্ষিত মনে হয়। ইংরেজিতে এই কথাটি কখনো শুনেছেন ? “sometimes you have to be cruel, to be kind” অর্থাৎ মানব জীবনে কখনো দয়ালু হতে হলে প্রথমে নির্দয় হতে হয়। 

– মানে? 
– আমি একজন ডাক্তার, সার্জেন! অসুস্থ মানুষকে “অপারেশন” করে সুস্থ করা আমাদের কাজ।অপারেশন করার সময় আমাদেরকে নির্দয়ের মতো প্রয়োজন অনুযায়ী শরীরের নানা জায়গায় কাটা ছিঁড়া করতে হয়, পরিণামে অসুস্থ মানুষটি সুস্থ হয়ে উঠে। তার মানে রোগীকে বাঁচাবার জন্য, বেদনার কষ্ট থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য আমাদেরকে নির্দয় হতে হয়। 
– আচ্ছা, তাই বলুন। আপনি তো আমাকে একেবারে ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। 

এরপর দুজনের হাসির দমকা ঝড় বয়ে গেলো এবং একজন আরেকজনকে কে খুব সহজ ভাবে গ্রহণ করে নিলো। এমনি করে একজন আরেকজনের প্রতি শ্রদ্ধাভাজন হয়ে দাঁড়ালো। 
বেশ কিছুক্ষন পর ঢাকাগামী ট্রেন আসার ঘোষণা দেয়া হলো। ট্রেন প্লাটফর্মে ভিড়ল। একই কম্পার্টমেন্টে দুজনে যথা সম্ভব দূরত্ব রেখে পাশাপাশি বসলো। গভীর রাতে ট্রেনটি ঢাকার কমলাপুর রেল স্টেশনে পৌঁছালো। হিমুদের ড্রাইভার আগে থেকেই স্টেশনে বসে আছে হিমুকে বাসায় নিয়ে যাবার জন্য। এদিকে দিপু একটা ট্যাক্সি ভাড়া করার জন্য চেষ্টা করছে। দিপুর অবস্থা দেখে হিমু তাদের গাড়ীতে আসার জন্য তাকে আহব্বান জানালো এই বলে যে, সে দিপুকে এই মাঝরাতে একা একটা ট্যাক্সিতে ছেড়ে দিতে পারেনা। দিপু একান্ত অনিচ্ছাসত্বে হিমুর আহ্ববানে সাড়া না দিয়ে পারলোনা। হিমুরা গেণ্ডারিয়াতে থাকে। তাই যাত্রা পথে দিপুকে তাদের গোপীবাগের বাসায় ড্রপ করতে কোনো অতিরিক্ত সময় ব্যায় করতে হলোনা। 

তারপরের ঘটনা অতি সংক্ষিপ্ত। 
হিমাদ্রী তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। বাবা সরকারি এগ্রিকালচারাল এন্ড ফিশারিজ অফিসের চেয়ারম্যান। মা শিক্ষা বোর্ডের জয়েন্ট সেক্রেটারি। স্বভাবতই দেশের এবং সমাজের রীতি অনুযায়ী “হাই সোসাইটির” লোক। কিন্তু তাদের দোষ হলো তারা অতিরিক্ত লোভী এবং ভীষণ স্বার্থবাদী। তারা চায়, তাদের ছেলে যেন এক বিরাট ধনী লোকের মেয়েকে বিয়ে করে। অর্থাৎ রাজকন্যা এবং রাজত্ব দুটোয় পায়। যেদিন হিমু তার বাবা-মাকে জানালো যে, সে একজন অবসর প্রাপ্ত অধ্যাপকের মেয়েকে বিয়ে করতে চায়, তখন তাদের মাথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত পড়লো। 
মেয়েটি আর কেউ নয়, সে হলো দীপালি ঘোষ, হিমুর ধ্যান-ধারণার নিত্য সঙ্গী। একমাত্র সন্তানের মুখের দিকের তাকিয়ে নিরুপায় হয়ে হিমুর মা-বাবা, দিপুর বাবা -মার্ কাছে হিমুর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হলো। দিপুর বাবা প্রস্তাবটি শুনে বললেন, “এটা খুবই সুখবর, তবে এ মুহূর্তে মেয়েকে বিয়ে দিতে পারছিনা, তার কারণটা হলো, মাত্র কয়েক মাস হলো দিপুর বড় বোনকে বিয়ে দিয়েছি। প্রচুর টাকা পয়সা খরচ হয়ে গিয়েছে, জমানো টাকা বাদেও ব্যাঙ্ক থেকে বড় অংকের ধার নিয়েছি। দু পক্ষেই পরিকল্পনা করে বিয়েটা হয়েছে। শুধু মাত্র জামাইকে ২০ লক্ষ টাকা নগদ দেয়া হয়েছে ব্যবসা করার জন্য, বাকি অন্যান্য খরচ তো হয়েছে, তা তো বুঝতেই পারছেন”। 
– কোথাও থেকে আরো ধার করে ছোট মেয়ের বিয়েটা সেরে ফেলুন, আমাদের ছেলের মতন 

ছেলে কোথাও পাবেন বলে মনে হয় না। আর হ্যা, আমাদের ছেলেকেও ২০ লক্ষ টাকা নগদ দিতে হয়ে, সেটা আগে থেকে জানিয়ে দিলাম। 
– আমাদের ক্ষমা করবেন, আমাদের দ্বারা আপনাদের এই দাবী পূরণ করা সম্ভব হবে না। 

ঘটনাটি জানার পর হিমু তার বাবা -মায়ের অযাচিত আচরণে ভীষণ ক্ষিপ্ত এবং দিপু তার সম্বন্ধে কি ভাবছে তা ভেবে সে নিজেকে মনে মনে ধিক্কার দিচ্ছে। পরদিন সে দিপুদের বাসায় যেয়ে তার বাবা-মায়ের পক্ষ হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিলো। সে এও জানালো যে, যত তাড়াতাড়ী সম্ভব কোনো যৌতুক বা বরপণ ছাড়াই এবং অতি সাধারণ ভাবে যত কম খরচে দিপুকে বিয়ে করা যায় তাতে সে রাজী। প্রথমে দিপুর মা-বাবা এ ভাবে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলোনা। কিন্তু হিমুর কথা বার্তায় দৃড়তা দেখে অবশেষে তারা এ বিয়েতে মত প্রকাশ করলো। কিছু নিকট আত্নীয় স্বজন নিয়ে পরিচিত এক পুরোহিত ডেকে বিয়ে পরানো হলো। একমাত্র ছেলের জেদে হিমুর বাবা-মা এ বিয়েতে অংশ গ্রহণ করতে বাধ্য হলো। 
দিপু শশুর বাড়ীতে যেয়ে বুঝতে পারলো সে তার শশুর -শাশুড়ির কাছে কতটা অবাঞ্ছিত। যতক্ষণ সে বাসায় থাকে একটা মুহূর্ত ও তারা তাকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। প্রতি পদে পদে তাকে অকারণে নানা ছুতায় অত্যাচার, অবিচার করে চলছে। প্রথম দিকে সে ভাবছিলো, আস্তে আস্তে উনারা তাদের ভোল পাল্টাবে এবং তাকে পরিবারের একজন করে নেবেন। কিন্তু দিনকে দিন তার উপর আক্রোশটা বেড়েই চললো। যখন ব্যাপার খানি সহ্যের বাইরে চলে গেলো, তখন হিমুকে তার কষ্টের কথা জানাতে বাধ্য হলো। প্রথমে হিমু ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয়নি।যখন হিমুকে তার মা-বাবার সম্বন্ধে ঘন ঘন অভিযোগ করেও কোনো ফল পেলোনা, তখন দিপু বললো, “অনেক মানিয়ে চললাম, আর পারছিনা, চলো আমরা একটা বাসা ভাড়া করে অন্য কোথাও চলে যাই”। হিমুর সাফ জবাব, “আমি আমার মা-বাবার একমাত্র ছেলে, আমি আমার মা -বাবাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবোনা”। 
নিরুপায় হয়ে দিপু তার সংসারের করুন অবস্থা বাবা-মাকে জানাতে বাধ্য হলো। মেয়ের দুঁখের কথা শুনে স্বভাবতই তারা অনেক কষ্ট পেলো, মেয়েকে বোঝাতে চেষ্টা করলো “স্বামীর ঘর হলো মেয়েদের আসল ঘর, দেখে শুনে সামাল দিয়ে চলতে হয়”। কিন্তু ব্যাপারখানি এমন পর্যায়ে চলে গেছে যে আর পিছনে ফেরা যায় না। দিপু বাধ্যহয়ে ডিভোর্সের জন্য কোর্টে আবেদন করলো। হিমু করজোড়ে দিপুকে অনুরোধ করলো ডিভোর্স প্রত্যাহার করতে। সে দিপুকে জানালো তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না। দিপুর এক কথা, “হয় আমাকে, নয় তোমার বাবা-মাকে বেছে নিতে হবে, তোমার মা-বাবার অত্যাচারে আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে আমি এখন কোনঠাসা হয়ে পড়িছি”। 
হিমুর আর কিছুই করার রইলোনা। যথাসময়ে হিমাদ্রী গোমেজ এবং দীপালি ঘোষের দেশের প্রচিলিত আইন অনুযায়ি ডিভোর্স হয়ে গেলো। 
ডিভোর্স নেয়ার পর দিপু প্রখর উদ্দমহীনতায় ভুগতে লাগলো মানে acute depression তাকে পেয়ে বসলো। তার কিছুই ভালো লাগেনা।চরম বিষণ্ণতায় পেয়ে বসেছে দিপুকে। তাদের ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার কয়েক সপ্তাহ পর দিপু জানতে পারলো হিমু আত্মহত্যা করেছে। ঢাকার ওয়ারী সলংগ্ন হাটখোলা রোডের কাছে খৃস্টান কবরস্তানে হিমুকে সমাধিস্ত করা হয়েছে। শীতকাল চলছে। একদিন কাউকে না জানিয়ে সে হিমুর কবরের পাশে এসে দাঁড়ালো। অশ্রুতে ভিজা চোখ দুটি বন্ধ করে তাদের প্রথম পরিচয়ের দিনটি স্মরণ করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলো। দিপুর গায়ের শালটি হিমুর সমাধির উপর ছড়িয়ে দিয়ে বললো, “লক্ষীটি, এই শীতের রাতে তোমার গায়ে যেন ঠান্ডা না লাগে তাই তো আমার এই শালটি তোমার কাছে রেখে গেলাম”। সমগ্র দেশে শারদীয়া দূর্গা পূজার প্রস্তুতি চলছে। দূরের “মাইক” থেকে ইথারে ভেসে আসছে, শ্যামল মিত্র্রের সেই কালজয়ী গান, “তোমার সমাধি ফুলে ফুলে ঢাকা, কে বলে তুমি নাই, তুমি আছ মন বলে তাই”। 
মানুষের শোকের আয়ু কত সময়ের জন্য তা অজানাই রয়ে যায়।

✍️এই নিবন্ধটি সাময়িকীর সুন্দর এবং সহজ জমা ফর্ম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে। আপনার লেখা জমাদিন!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!