প্রবহমান: পর্ব- পনেরো

হোসনে আরা মণি
হোসনে আরা মণি
7 মিনিটে পড়ুন
প্রবহমান

‘আল্লা যহন দেয়, তহন কোছা ভরেই দেয়’ – কথাটার সত্যতা মেলে শরাফতের জীবনে। বছর-দু’বছর করে পর পর সাত কইন্যার পিতা হয়ে যায় সে মাত্র দশ বছরেই। সবগুলো অবশ্য বাঁচেনি। কোনটা আঁতুরে আর কোনটা ক’মাস পালা-পোষার পর কী সব ব্যাধিতে ক’দিন ভুগে ভুগে মরেছে। তা মরে-ঝরে এখন হিরণের কোলে মোটে তিনডে মায়্যে। শ্বশুরবাড়ি থাকা আলতারে ধরে শরাফতের চার কইন্যা।

ওদিকে আলতার সাড়ে বারোতেই কোলে পরথম ছেলে। তারপর বছর-দেড় বছরে একটা করে জন্ম দিয়ে এখন সে চার সন্তানের গরবিনী জননী। শোনা যাচ্ছে সে আবারো পোয়াতি এবং এবার একসাথে এক জোড়া না জন্মায়!

হিরণের শরীর-মন ইদানীং বড় কাহিল। যখন-তখন মাথা ঘুরায়ে দৃষ্টি আন্ধার। বছর দুয়েক আগে একদিন চৈতালীর মওসুমে কানে ঢুকেছিল বিষ-পিঁপড়ে। বহু চেষ্টায় পিঁপড়ে বের করা গেলেও কী যে হলো – সেই থেকে তার কানের ভেতর সারাক্ষণ কী এক বিজবিজ! ব্যাপারটা শরাফতকে বললে প্রথম দিকে তেমন গা না করলেও শেষে এনে দেয় এক কবিরাজের পড়া তেল আর গাছ। গাছটা কানে দুলের মতো পরে থাকতে হয় আর তেলটা দিতে হয় দু’ফোঁটা করে কানে, ঠিক ঘুমের আগে।

কিন্তু তাতে কাজ তো কিছুই হয়নি। ইদানীং সে মনে হয় কানটায় তেমন শুনতেও পায় না। এরই মধ্যে একদিন তার মনে হয় সে বুঝি আবারও…। হায় আল্লা! আর কত! ফের শুরু হবে সবার মুখে সেই পুরনো কথা, আল্লা আল্লা অরো। আল্লার দরবারে হাত তুলে কান্দাকাটি করে চাও। তিনি চালি কী না হবার পারে। এট্টা কানা-খোঁড়া পুত্তুরও যদি অয় তো ভিটেয় চেরাগ জ্বলবি।

ভিটেয় চেরাগ! সত্যিই কি তা হবি! সেই কপাল কি হিরণের?

আপন মনে পেটে একবার হাত বুলোয় হিরণ। না, এখনো তলপেটে তার অস্তিত্ব ফুটে ওঠেনি। তাই কেউ জানেও না খবরটা। থাক, যদ্দিন মানুষ না জানে না বুঝতে পারে, তদ্দিনই ভালো। এই বুড়ো বয়সে এ এমন কী খবর যা জানায়ে তার আহ্লাদ বাড়বি? পরথম পুয়াতি আর নয় নম্বর পুয়াতিতে যে কত ফারাক!

ওদিকে আলতার শরীর এবার বড় কাহিল। পর পর এতগুলো বাচ্চা হওয়ার ধকলের সাথে আছে সংসারের কাজের চাপ। আলতার শ্বশুর আমির শেখ এ্যাদ্দিনে সত্যিকারেই যেন আমির। তার লায়েক পুত্তুরেরা সব পাক্কা লাঠিয়াল সর্দার। ওদিকে ভাতুরিয়ার মিঞারা তার কুটুম্ব সম্পর্কের হওয়ায় মিঞা বংশের সুনাম-সুখ্যাতির সেও খানিক ভাগীদার। এসব খ্যাতির জোরেই হোক কি রমিজ মিঞার মতো পাকা বুদ্ধির মানুষের পরামর্শেই হোক, আমির শেখের চাষে এখন বিস্তর জমি-জমা। আর ভাতুরিয়া-বালিদিয়ায় জমি তো নয়, যেন সোনার খনি।

পলি-দোআঁশ মাটির উর্বর ক্ষেতগুলো সব তিন-ফসলি। ফসল যখন ওঠে তখন বাড়ির উঠোন-পালান সব ছোট-বড় নানা আকারের পালায় ভরে যায়। ধানের বতর শেষে কার খ্যাড়ের পালা কত বড় তা দেখে গিরস্থের অবস্থা বোঝা যায়। আমির শেখের খ্যাড়ের পালা বড় হতে হতে গত দুই-তিন সন হয় বালিদিয়া গ্রামের সব পালার মাথা ছাড়ায়ে গেছে।

গোলা ভরা ধান আর পুকুর ভরা মাছে তুষ্ট গ্রামীণ গার্হস্থ্য জীবনে আলতা নিশ্চয় সুখে আছে; ঠিক যেমন সুখ ভোগ করেছে হিরণ। কিন্তু ভরপেট মাছ-ভাত খাওয়া সুখী জীবনেও কোত্থেকে যে একটা হু-হু বাতাস বুকের ভেতর দিয়ে বয়ে যায়! থেকে থেকে হিরণের মনে হয়, তার জীবনে কী যেন নেই! আর যা তার জীবনে নেই, তা তার মেয়েদের জীবনেও নেই, থাকবেও না।

আচ্ছা, তার মেয়েদের মেয়েরা কেমন হবে? কেমন জীবন কাটাবে তারা? সেই যে কোইলকাতাত্তে আইছিল শরাবান তহুরা যে কী এক ইংরেজি ইশকুলে পড়তো – তার মতন কি হতি পারবি তার নাতনীগার কেউ? থেকে থেকে কী যে হয় হিরণের – মনের মাঝে ডালপালা মেলে রাজ্যের যত আজগুবি কল্পনা। যা হয়নি, হবে কিনা তার ঠিক নেই, অথচ হলে কেমন হতো বা হবে, সেই ভাবনায় সে বিভোর থাকতে পারে বহুক্ষণ। ঘরের কাজ করতে করতে আনমনা থেকে সে ভেবে চলে কত কিছু! তার আনমনা ভাব টের পেয়ে শাশুড়ি তারে কতই না বকেছে এককালে! তখন দাদী-শাশুড়ি বেঁচে ছিল। তার ¯স্নেহের ছায়ায় কারো কটূ কথাই তার গায়ে তত লাগতে পারতো না।

ইদানীং শাশুড়ির শরীরও হয়ে পড়েছে ঢিলে। আগের সেই তেজ আর নেই। তবু হিরণ তারে সমঝে চলে। না চলে উপায় কী! যা একখান চণ্ডাল পুত্তুর তিনি গর্ভে ধরছেন তাতেই তার হাতির পাঁচ-পা। মায়ের বাধ্য সন্তান নাকি জান্নাতবাসী হয় – সেই হিসাবে শরাফত মিঞাও জান্নাতে যাবে নিশ্চয়। কিন্তু তার ওপারে জান্নাতের ব্যবস্থা হতে গিয়ে যে হিরণের এপারের জীবনটাই জাহান্নাম!

খলাটে চৈতালি ফসল নাড়াচাড়া করতে করতে আনমনা হয়ে পড়া হিরণ আচমকা উপুড় হয়ে পড়ে ঝুড়িভরা ফসলের উপরে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হিরণের পিঠ রক্তাক্ত। ক্ষত-বিক্ষত পিঠের পরেও সপাসপ পড়তে থাকে গরু তাড়াবার পাঁচন। ভিন গাঁয়ের এক পথগেয়ে মুরব্বী হাহা করে ছুটে এসে না ঠেকালে বৌয়ের পিঠের চামড়া দূরে থাক, মাংস আর হাড্ডিও আজ থেঁতলা করে ফেলতো শরাফত মিঞা। কত বড় সাহস নির্লজ্জ মাগীর! হাটবারের দিন ভাটেল বেলায় সে হালটে আইছে কোলোই উড়োতি! আইছে তো আইছে, আবার দ্যাহ গতরের কাপুড় ঠিক আছে কিনা সে দিকি মন না দিয়ে গালে হাত দিয়ে বসে কী ভাবা হইচ্ছে!

যাও বৌমা, বাড়ির ভিতর যাও। গিরস্থ ঘরের বৌ হাটবেলায় হালটে কাম না অরাই ভালো। ভিন গাঁয়ের মুরব্বী পরামর্শ দিয়ে তার পথে চলে যায়। পাঁচন কুড়ায়ে নিয়ে গালাগাল করতে করতে শরাফত মিঞা বাড়ির ভেতর যায়। এদিকে কাঁদতে কাঁদতে হাচড়ে-পাচড়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করে হিরণ। শরীর টলে, চোখ ঝাপসা দেখে, তবু তার মাঝেই সে গোছাতে চেষ্টা করে ছড়িয়ে থাকা কলাই। আবার ওরই মাঝে টেনেটুনে ঠিক রাখতে চেষ্টা করে শরীরের কাপড়ও। মেয়েমানুষের শরীর – আট হাত কাপড়ে মুড়ে রাখতে হয় মাথা থেকে পায়ের গোড়ালি তক।

গার্হস্থ্য কাজ-কামের ফাঁকে কখন যে শরীরের কোন অংশের কাপড় সরে বেরিয়ে পড়ে সোনার ঝিলিক দেয়া চামড়ার কোন অংশ, তা কে অত খেয়াল রাখতে পারে? আর গিরস্থ বৌয়ের হালটে কাজ? বৌয়েরা যদি হালট-খলাটে কাজ না করে স্বামী-শ্বশুরের সম্মান রাখতে ঘরের ভেতর পায়ে পা তুলে বসে থাকতো, তবে বুঝি এই সব ফসল এমনিতেই ঝাড়-পোচ হয়ে গোলায় উঠতো? আজ সকাল থেকে আকাশটা একটু দম ধরে ছিল।

দুপরের দিকে দক্ষিণে বাতাস বইতে শুরু করলে হিরণ ভেবেছিল যে হাটুরেরা হাটযাত্রা শুরু করার আগেই সে কলাইগুলো বাতাসে ঝাড়াই করে নেবে। আর শরাফতের মাঠ থেকে ফেরার আগেই যে কাজটা করতে হবে তা তো সে জানতোই। কিন্তু দুর্বল শরীরটা ভাবনা মতো চটপট কাজ এগোতে পারছিল না। কপালে দুর্গতি লেখা, না হলে কি এমন হয়! যার সোয়ামির এমন চণ্ডাল রাগ সে কিনা কাজের ঘোরে হয় আনমনা!

কোনমতে কলাইগুলো গুছিয়ে তুলে বাড়ির ভেতরে ঢুকে হিরণ ভারী ধামাটা নামিয়ে রাখে বড়ঘরের হাতনের এক কোনে। তারপর মাথাটা কেমন চক্কর দেয়। তারপর হয়তো হিরণ জ্ঞান হারায়।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম - মাগুরা জেলার মহম্মদপুর থানার ওমেদপুর গ্রামে নানা বাড়িতে জন্মতারিখ- প্রকৃত: ২৭ জুন ১৯৭৭, সনদীয়: ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯ পিতা- মোঃ আব্দুল গফ্ফার মোল্লা মাতা- সালেহা ইয়াসমিন সংসারসঙ্গী- মোঃ দেলোয়ার হোসেন (মাহমুদ) তিন কন্যা- আদৃতা, অঙ্কিতা ও দীপিতা বর্তমান অবস্থান: রাজশাহী। পেশা: সরকারী চাকরি [উপপরিচালক (ভারপ্রাপ্ত), জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর, বিভাগীয় কার্যালয়, রাজশাহী] প্রকাশিত গ্রন্থঃ ৭টি (৬টি গল্পগ্রন্থ, ১টি উপন্যাস) প্রথম: অপরাজিতা (সময় প্রকাশন) দ্বিতীয়: জীবনের পেয়ালায় ছোট্ট চুমুক (ইত্যাদি গ্রন্থপ্রকাশ) তৃতীয়: নদীও নারীর মত কথা কয় (বটেশ্বর বর্ণন) চতুর্থ: মহাকালে প্রান্তরে (পরিবার পাবলিকেশন্স) পঞ্চম: লিলুয়া জীবনের নারীগণ (বটেশ্বর বর্ণন) ষষ্ঠ: বিবিক্তা (বটেশ্বর বর্ণন) – উপন্যাস সপ্তম: তামসী (বইঘর)
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!