- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – এক
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – দুই
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – তিন
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – চার
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – পাঁচ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – ছয়
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – সাত
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – আট
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – নয়
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – দশ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – এগারো
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – বারো
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – তেরো
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – চৌদ্দ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – পনেরো
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – ষোল
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – সতেরো
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – আঠারো
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – উনিশ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – কুড়ি
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – একুশ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – বাইশ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – তেইশ
- ‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – চব্বিশ
- ‘চন্দন রোশনি’ শেষ পর্ব
পর্ব – কুড়ি: আপনারা প্রফেশনাল কলগার্ল নন?
ভোরে পত্রিকা পড়া হয়নি। হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে হঠাৎ উর্বশীর চোখ পড়ল টেবিলে রাখা তৃতীয় পৃষ্ঠায় একটা শিরোনামে- ‘চন্দনার অবস্থার উন্নতি হয়েছে। তদন্তে বেরিয়ে আসছে অন্ধকার জগতের অজানা কথা’। শিরোনামটি পড়ার পর খুশির বদলে চট করে খামচে ধরল বুক, দুর্ভাবনার কামড় খেয়ে চোখ কুঁচকে পড়তে লাগল খবরটি। সঙ্গে সঙ্গে উদ্দীপ্ত হয়ে গেল কর্নিয়ার মধ্যে লুকোনো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আলোককণার চিপটি। সংযোগ ঘটে গেল অর্ণবের সঙ্গে। উর্বশীর পঠিত কথাগুলো পড়ার সময় একইভাবে ঢুকে যেতে লাগল অর্ণবের সত্তায়। উর্বশীর বিস্ময় আর হতবিহ্বলতা স্পর্শ করল সাগরজলে আশ্রয় পাওয়া অর্ণবকেও। বোধের জগতে বিষাদ ছড়িয়ে যেতে লাগল- বিষের তাড়না স্নায়ুতরঙ্গরূপে ছুটে গিয়ে আক্রমণ করতে লাগল মস্তিষ্কের গতিসঞ্চারী মোটর এলাকা। অসাড় হয়ে যাওয়ার কথা এমন বিষাক্ত খবরের ছোবলে। না, অবশ হলো না উর্বশী। মনোবলের প্রতিআক্রমণের মুখে পড়ল বিষতরঙ্গ। অর্ণবের পাঠানো নতুন সাংকেতিক বার্তার পাল্টা বাধায় বিষতরঙ্গ পরিণত হয়ে গেল নিউট্রাল ইলেকট্রিক সিগনালে। প্রতিরোধী এ সংকেত আরও প্রত্যয়দীপ্ত করে তুলল উর্বশীকে। মাথা ঠান্ডা রেখে পুরো খবরটি পড়ে হতবাক হলো। বুঝল পেছনের শত্রু ভয়াবহ। এমন খবরের পেছনে নিশ্চয়ই অপরাধী চক্রের হাত রয়েছে। সাংবাদিককে চড় মারার বিষয়টি উড়িয়ে দিল না। রিপোর্টারদের সঙ্গে আরও সংযত আচরণ করতে হবে- এমন বোধও নাড়া খেল ভেতরে।
ভেবেছিল হাসপাতালে গিয়ে আন্টিকে পাঠিয়ে দেবে বাসায়। রাতে তিনি চন্দনার সঙ্গে থেকেছেন। দিনে বিশ্রাম না পেলে আজ রাতে আরও কষ্ট পাবেন। এ ধারণা থেকে পরিকল্পনা তৈরি করে রাখলেও, এখন পরিকল্পনা বদলাল ও। মেডিকেল রিপোর্টের বিষয়ে আলাপ করতে হবে। মামলার বিষয়টি গতিশীল করতে হবে। ওয়ান স্টেপ সেন্টারের প্রধান ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করতে হবে। শুনেছিল সিস্টেমের মধ্যে সব হয়ে যাবে। দৌড়ঝাপের প্রয়োজন হবে না। এখন মনে হচ্ছে নিজে নিজে কিছুই হবে না। দৌড়ঝাপ না করলে মামলা এগোবে না। আর জনপ্রিয় একটি পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা ওয়ান স্টেপ সেন্টারের কর্মকর্তাদের মনে নেগেটিভ ইমপালস ঢুকিয়ে দিবে কিনা সেটিও ভাবল। তারপর একসময় দ্বিধা ঝেড়ে বাসা থেকে বের হলো ও।
উর্বশী এখন বাসায় থাকছে। ভাড়া ফ্ল্যাট তালা দিয়ে রেখেছে। একা ফ্ল্যাটে থাকার সাহস থাকলেও আপাতত চলে এসেছে বাসায়। স্বাধীনভাবে নিজেকে দাঁড় করানোর শুরুতেই হোঁচট খেতে হলো দেখে কিছুটা দমে গেলেও হতোদ্যম হলো না। চন্দনার একরোখা অতি উৎসাহী অতি বিশ্বাসী পদক্ষেপ যে ভুল ছিল, ভুল থেকে বিষের ছোবল খেয়ে ও-ই ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে- এ বিষয়ে এখন তাকে দোষারোপ করা যাবে না। পরবর্তী সময়ে ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে শুধরে চলতে হবে সামনের দিন। ভাবনাতরঙ্গে দুলে উঠল চোখের মধ্যে স্থান পাওয়া মাইক্রোচিপটি। দুলে উঠার সঙ্গে সঙ্গে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ পৌঁছে গেল অর্ণবের মস্তিষ্কে। সংকেতের মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে গেল দুটি চিপ। খবরের কাগজে প্রকাশিত বিকৃত সংবাদের ঝাঁঝ আরো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য মনের দৃঢ় প্রস্তুতি বাড়িয়ে দিল। নিঃশ্বাস ছেড়ে এবার তাকাল বাইরে- দেখল খোলা আকাশ। ঝলমলে রোদ আর শীতবাতাসের ছোঁয়ায় পেতে লাগল ধৈর্য আর সাহসের প্রেরণা।
ওয়ান স্টেপ সার্ভিস সেন্টারের সমন্বয়ক চমকে উঠে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনিই উর্বশী, চন্দনার সহচরী?’
‘জি। আমিই উর্বশী। চন্দনার বান্ধবী।’
শীতল কণ্ঠে জবাব দিয়ে সরাসরি সমন্বয়কের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল উর্বশী।
চোখ নামিয়ে নিলেন না, চোখাচোখি তাকিয়ে সমন্বয়ক বললেন, ‘যা ঘটেছে চন্দনার জীবনে, তাকে রেপ বলা মুশকিল, প্রাপ্তবয়স্ক কেউ নিজের সম্মতিতে ওই ধরনের কাজে জড়ালে ধর্ষণ ঘটেছে বলা যায় না। তবে শারীরিক নির্যাতনের জন্য মামলা চলতে পারে।’
সাপের শীতল চোখের চেয়েও বিষধর ঠান্ডা হয়ে স্থির হয়ে রইল উর্বশীর চোখ। চোখ না সরিয়ে ও পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘নিজের সম্মতি বলতে কী বোঝাচ্ছেন?’
‘কিছু বোঝাচ্ছি না। যা ঘটেছে, শুনেছি, পড়েছি পত্রিকায়, সেটাই বলছি। প্রফেশনাল কলগার্ল হিসেবে লেনদেনের বৈষয়িক বিষয়ে অ্যাসল্টেড হয়েছেন তিনি। এ ধরনের মামলা যাবে ভিন্ন ধারায়- ধর্ষণ মামলা হিসেবে টিকবে না এ মামলার মেরিট।’
‘ওঃ। আচ্ছা! আচ্ছা! তাহলে ওয়ান স্টেপ সার্ভিস সেন্টারের সমন্বয়ক সাহেব মামলার তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহ করেন নিউজ পেপার পড়ে, তাই না?’
‘প্রাথমিকভাবে প্রকাশিত নিউজ সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রভাব ফেলে। আপনাদের ক্ষেত্রেও ইতোমধ্যে ক্ষতিকর পরিণতি ঘটে গেছে। আপনিও তো একজন প্রফেশনাল কলগার্ল- সে বিষয়টিও চাউর হয়ে গেছে। ছড়িয়ে পড়া এ খবর তো উড়িয়ে দিতে পারেন না, আপনি। কী বলেন, পারেন?’
কী জবাব হতে পারে এই ভয়াবহ প্রশ্নের! আগুন বেরুতে লাগল উর্বশীর চোখ ফেটে। সেই তাপে উত্তপ্ত হয়ে উঠল মাইক্রোচিপ। তাপে-উত্তাপে গরম হয়ে উঠা চিপের ভেতরই হঠাৎ ঘূর্ণি তুলল ঠান্ডা ঝড়। আলোর সংকেত অর্ণবের মস্তিষ্ক থেকে উড়ে এ সময় স্থান নিয়েছে উর্বশীর চোখে। শীতল চোখের চাউনি দেখে সমন্বয়ক সাহেব ভয় পেলেন। ভীত কণ্ঠে এড়িয়ে যাওয়া প্রশ্নের জবাব দিতে বাধ্য হলেন, ‘নিউজ পেপার থেকে মামলার তথ্য প্রমাণ সংগ্রহ করি না আমরা।’
‘তা হলে পত্রিকার রেফারেন্স দিয়ে কথা বললেন কেন?’
‘সত্য-মিথ্যার বিচারে রেফারেন্স টানিনি। এ মুহূর্তে সত্য-মিথ্যা বড় বিষয় নয়। আপনাদের জন্য কাজ করতে গেলে নিজের গায়েও কালির ছিটা লাগতে পারে, কলগার্লদের পক্ষে কাজ করে সুবিধা নিচ্ছি বলে দুয়ো আসতে পারে।’
‘মনের জোর নেই আপনার বা আপনার টিম মেম্বারদের? নিরীহ দুই সংগ্রামী মেয়ের গায়ে কলগার্লের তকমা সেঁটে দেবে অপরাধীমহল, সেটা বিশ্বাস করে বসে থাকবেন, নিজের বিবেকবোধ জলাঞ্জলি দেবেন- বিষয়টিতে কালিমা লেপন হবে না? কেউ কি আঙুল তুলে বলবে না, ওই যে, ওরা ধর্ষক বা ঘাতকের পক্ষে কাজ করছে- বদনাম ঘাড়ে চাপতে পারে না?’
ঝাঁঝাঁল প্রশ্নটি এমন হুল ফোটাল যে সমন্বয়ক সাহেব মুহূর্তের জন্য হয়ে গেলেন ‘আউট অব ওয়ার্ল্ড’। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই কেটে গেল তার বিমূঢ়তা। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে বসলেন, ‘মানে কী? আপনারা প্রফেশনাল কলগার্ল নন? ভুল সংবাদের শিকারে পরিণত হয়েছেন?’
প্রশ্নের ভেতর থেকেই নতুন প্রশ্ন জেগে উঠল। ঝিকমিক আলোকদ্যুতি ছড়াতে ছড়াতে প্রশ্নের ঝড় যুক্ত হয়ে গেল বাতাসশক্তির সঙ্গে, তরঙ্গশক্তির নিস্তরঙ্গ স্তরেও বয়ে যেতে লাগল বুনো ঝড়, জোয়ার-ভাটার প্রাকৃতিক শক্তির সঙ্গেও মিশে যেতে লাগল প্রশ্নের অনুকণা- সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর বিন্দুতে পরিণত হয়ে তরঙ্গায়িত হলো কণাস্রোতে। উর্বশীর চোখের মণি ছুঁয়ে সেই স্রোত উৎকীর্ণ হতে লাগল অর্ণবের নতুন সত্তায়। সাগরতলেও উল্লাস জেগে উঠল- সি-বেডে বালু রাজ্যে কোটি কোটি তারকারাজির মতো জ্বলতে লাগল ফসফরাস, পলিমেটালিক সালফাইড, ম্যাগনেসিয়াম ও ম্যাঙ্গানিজ নডিউল, এভাপোরাইটসহ কোটি কোটি খনিজ আকরিক।
এসব দেখে শুদ্ধ রসায়নের আলোয় ভরে উঠল অর্ণবের দেহতরঙ্গ- ছুঁয়ে দিল উর্বশীকেও। উর্বশীর মাধ্যমে ঢুকে গেল সমন্বয়কের চোখে, মস্তিষ্কে। নতুন রূপে জেগে উঠে তিনি উর্বশীর উদ্দেশে বললেন, ‘সঠিক বিচারের জন্য যা যা করার দরকার, করব আমরা। নিশ্চিত থাকুন আপনি।’
চলবে…