‘চন্দন রোশনি’ পর্ব – পাঁচ

মোহিত কামাল
মোহিত কামাল
16 মিনিটে পড়ুন

পর্ব – পাঁচ: জোছনাঢেউয়ের মতো ইন্দ্রিয়ঢেউ

সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিল অর্ণব। আঁধারে গভীর ঘুমের সঙ্গে আলোয় জেগে থেকে ঘুমানোর তুলনা চলে না। কিন্তু অর্ণব তুলনা করতে লাগল। এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে জেগেও ঘুমাচ্ছে ও। আর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন নিজে জলদেশের অতলে চলে এসেছে―বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি বারবার নড়ে উঠছে। জেগে ঘুমানো অবস্থার মধ্যে বিদ্যুৎ বেগে ছুটোছুটি করছে বাস্তব তরঙ্গ। এ মুহূর্তের আরও মনে হলো সেরা বাস্তব আরেক জগতের কথা- সে-জগতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ‘অ…র্ণ…ব’ ধ্বনি।
বেপরোয়াভাবে উঠে বসল ও। দোতলা গোলাকার বিছানা থেকে নামতে গিয়ে দেখল নিচের বেডে জড়াজড়ি করে শুয়ে আছে আদিম ত্বকে জড়ানো দুই প্রাণিদেহ। এখানেও জড়াজড়ি! এখানেও শুয়ে থাকা! বাস্তবের শেকড়ে টান পড়তে লাগল। নিজের দেহের ভেতর থেকেও নড়ে উঠল আদিম সত্তা।
ওরা কারা? ঘুমানোর আগে তো বিছানাটা ছিল শূন্য। এখন ওরা কোথা থেকে এসেছে? নিশ্চুপ, তাকে বিরক্ত না করে, এমন মধুর ঢংয়ে শুয়ে আছে কেন? অতল জলরাশির মধ্যে এক ফালি মিঠে চাঁদ গহিন জলে লুকোনো আঁধার ফানাফানা করে দিচ্ছে দেখে ও আদিম গন্ধের ঝাঁঝ পেল রোমকূপে; রুপোলি রোশনি নয়, শান্তির পালক স্পর্শ নয়, হিংস্র নখরের ঘা খেল চোখ। জীবনের খণ্ডিত অংশ দাপড়াতে লাগল বন্য অনুভবের ঘোরে। তুলতুলে মৃত্তিকায় পা-স্পর্শের মধ্যেও উষ্ণ উত্তাপ পেল না আর। বরং তাপ কমতে লাগল প্রাণিযুগলের মাথার দিকে তাকিয়ে।
ওরা সাপ প্রজাতির নয়, তিমি প্রজাতির জলজ দানবও নয়, অনেকটা হাঙরের মতো দেখতে, মাথাটা হাঙরের মতো নয়; অন্যরকম। ব্রেনের তথ্যভাণ্ডারে এ রকম স্মৃতিকণা নেই। অন্তত এ মুহূর্তে স্মৃতির উদ্ভাস ঘটল না। স্মৃতিতে পুরোনো তথ্য না থাকায় মূল্যায়ন করতে পারছে না, তবে ওদেরকে মানব-মানবীর প্রতিচ্ছায়া মনে হতে লাগল। নিজের ভেতরে জমানো বাসর রাতের মধুময় স্মৃতির প্রক্ষেপনে অবচেতন মনের দ্বার খুলে বেরিয়ে এসেছে গোপন থাকা উর্বর দৃশ্যটি।
উদিত চাঁদের রঙ লালচে আগুনের মতো বদলে যেতে লাগল- ‘লাল’ মানেই উষ্ণ নয়, খারাপ নয়, উষ্ণ-উত্তাপ, হিংস্র নখর কোনো কিছুই বাদ যায় না―সব দৃশ্যচিত্র উপহার দিতে লাগল নতুন জীবনের ভিন্ন রকম দীপশিখা।
ওদের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে বোঝার চেষ্টা করল অর্ণব। পূর্ণ মানবমানবীর ফলন্ত যুগল শরীরের মধ্য থেকে ছুটে বেরুনো জোছনাঢেউয়ের মতো ইন্দ্রিয়ঢেউ বেরোতে লাগল। লোভ সামলাতে পারল না, কাছে দাঁড়িয়ে স্পর্শ করার জন্য যেই হাত বাড়াল, সঙ্গে সঙ্গে ফোঁটা ফোঁটা বুদবুদ উঠতে লাগল, বুরবুর করে যুগল প্রাণিদেহ মিলিয়ে যেতে লাগল জলজ রাজ্যের এই অনিন্দ্যসুন্দর বিছানা থেকে।
হাত সরিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল অর্ণব।
ওদের মিলিয়ে যাওয়া দেখে নিজের দিকে তাকাল। না, নিজের দেহ থেকে বুদবুদ বেরুচ্ছে না। দেহে বিদ্যুৎতরঙ্গ খেলে গেল। এই তরঙ্গের টানে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।
জলের তলে জলরাশির নীল স্তর তো বটেই, সবুজ জলজ উদ্ভিদেরও রঙ পাল্টে গেছে; সতর্ক চোখের ঘূর্ণির বলয়ে অতি সতর্কতার প্রমাণচিহ্ন নেই এখন। নরম মৃত্তিকার ঢেউগুলো আরও ছোট হয়ে গেছে। পাটি বিছানো সমতলের মতো ঢেউগুলো পাটিতে শৈল্পিক স্কেচের মতো ফুটে আছে। প্রতিটি রেখাচিত্রে ভেসে উঠেছে নীলজলের আনন্দধারা, লাল সূর্যের স্পন্দন ছাড়াও ঘুমের পর ভোরের লাল আভার পরশ পেয়ে চেতনায় ভেসে উঠল আপন জগতের যতিচিহ্নমালা। স্পষ্ট শুনল হৃদয়বিদীর্ণ করা ডাক ‘অ…র্ণ…ব…’ কিছুক্ষণ পর অর্ণব আবার দেখল মিলিয়ে যাওয়া বুদবুদ আবার এসে শুলো মানব মানবীর রূপ ধরে। এবার খুশি হলো তার মন।
মায়াময় জগতের হাহাকারের চিতায় দাউ দাউ জ্বলে উঠল প্রায় অনুভূতিহীন অর্ণবের বোধের অন্তর্জগৎ। উর্বশীর ডাকের প্রাণ উজাড় করা জবাব দিতে চাইল। অস্তিত্ব আর অনুভবের পতনধ্বনিই কেবল বোবা কান্নার মতো বেরিয়ে এসে আক্রমণ করল ওকে। বিচ্ছিন্নতাবোধে গোলার মতো জ্বলে উঠল আগুন। আগুনবুকে সে তাকাল পায়ের দিকে― আশ্চর্য অনুভবে দেখল লাল কাঁকড়া এখনো আঁকড়ে ধরে বসে আছে। তাকিয়ে আছে তার দিকে। চোখাচোখি হওয়া মাত্রই থ্রিজি স্ক্রিনের বিশাল পর্দা প্রসারিত হতে লাগল দৃষ্টিসীমানায়। ত্রিমাত্রিক ছবির দৃশ্যপটের মতো অর্ণবের চোখে ভেসে উঠল উর্বশী- চিৎকার করে মাকে বলছে, ‘না। তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব না। কখন ফিরব তাও জানি না। সারাক্ষণ পেছনে লেগে থেকো না। তাহলে ঘরেই ফিরব না।’
দমে গেলেন উর্বশীর মা। অসহায়ভাবে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের গমন পথের দিকে। চোখ বুজে একবার তিনি মনে করতে লাগলেন উর্বশী আর অর্ণবের বিয়ের দিনের কথা, মধুচন্দ্রিমার যাওয়ার দিনটির কথা, অর্ণবের তিরোধান হওয়ার সময়ক্ষণের কথা। হিসাব করে চমকে উঠলেন। তিন মাস পেরিয়ে গেছে! তিন মাসের ব্যবধানে এত পরিবর্তন হয়ে গেছে মেয়ের! সময় এত দ্রুত ছুটে পালাল!
উর্বশীর মায়ের ভাবনাজগতের শাব্দিক মূর্তরূপ ভেসে উঠল থ্রিজি স্ক্রিনে। একই সঙ্গে অর্ণব দেখল পুরো ঘটনা : উর্বশী বেপরোয়া ড্রেস পরে বেরিয়ে যাচ্ছে। সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে বেপরোয়া হয়ে গেছে ও। আর সবচেয়ে বড় ভাবনাটা তিরের ফলার মতো এসে বিঁধল বুকে- তিন মাস পেরিয়ে গেছে! তিরোধান হয়ে গেছে নিজেই! মধুচন্দ্রিমা করতে গিয়েছিল তারা সাগরসৈকতে! আর সেই সৈকতের কড়া রোদ, সূর্যের আলোঝলমলে জগৎ থেকে পানিরাজ্যে গায়েব হয়ে বসে আছে নিজেই!
আবেগ মোচড় দিয়ে উঠছে। অর্ণব এক ঝলক দেখেছে উর্বশীকে। দেখেছে তার মায়ের ডাক অমান্য করার রূঢ় জিদ। অথচ স্বামীকে হারিয়ে বেদনার্ত থাকার কথা, কষ্টে মুষড়ে থাকার কথা তার। উল্টোটা কেন দেখল! সব কিছু তাহলে বদলে যায়, সময়ের সাথে মন-দেহ কাঠামো, সব। স্বামী হারিয়ে হতাশায় সহিংস মনোভাব দেখাচ্ছে সে- এমনও মনে হলো অর্ণবের।
মনে পড়ল কিছুক্ষণ আগে ঘুমাতে গিয়েছিল ও। অল্প ঘুম সেরে বেরিয়ে এসেছে সাগরজলের আশ্চর্য বাড়িটির ভেতর থেকে। এক ঘুমে কি তবে তিন মাস পেরিয়ে গেছে! নতুন যতিচিহ্নটি মাথায় নিয়ে আবার ও ফিরে এলো সাজানো বাড়ির ভেতর। চোখ গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। অল্পক্ষণ আগে দেখে যাওয়া জৈবিক অস্তিত্বের জড়াজড়ি শুয়ে থাকার দৃশ্যচিত্রে বুদবুদ উঠছে। মুক্তোদানা নয়, কার্বন-ডাই অক্সাইডের বুদবুদ বেরুচ্ছে, রক্তদানার মতো খই ফুটে উপরে উঠে যাচ্ছে বাড়ির ছাদ গলিয়ে। সেই বুদবুদ-যাত্রা বাধা পাচ্ছে না। সহজেই উঠে যাচ্ছে উপরের দিকে। জীবন-বুদবুদ নাকি মৃত-বুদ দেখছে ও, ভেবে কিছুটা ভড়কে গিয়ে বোবার মতো বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। কীভাবে বুদবুদ ছাদ গলিয়ে বেরিয়ে যায়, হাইড্রোজেন সালফাইডের ছোঁয়ায় কি গলে গেল ছাদ?
ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। অথই সাগরতলে শঙ্কামুক্ত নয় কেউ, বিপদ ধেয়ে বেড়ায় সর্বত্র। এক প্রাণির জন্য আরেক প্রাণি বিপজ্জনক। একজন খাদক আরেকজন খাদ্য। খাদক ও খাদ্যের মধ্যে সংগ্রাম, লুকোচুরি, একজন আরেকজনকে খেয়ে বাঁচে। এই প্রাকৃতিক চক্রে নিজের ভূমিকা খুঁজে না পেয়ে ক্ষুধা এবং তৃষ্ণা অনুভবের চেষ্টা করল অর্ণব। না, খিদা নেই, তৃষ্ণাও নেই। বুকের ভেতর থেকে ঢেউ ঠেলে বেরিয়ে এলো জলমগ্ন সাগরের জলে, বুদবুদ ওপরে উঠছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে ঢেউ হয়ে। স্পর্শ করে যাচ্ছে সাগরতলের বিস্ময়কর জগৎটাকে। খাদ্য আর খাদকের চিন্তা আবার উঁকি দিল মনে। চোখ গেল আবার পায়ের দিকে। কাঁকড়া নয়, মনে হচ্ছে থ্রিজি ভিডিও ক্যামেরার চোখ বসে আছে পায়ে। স্ক্রিনে দেখছে উর্বশীকে, মোটর বাইকে উঠে বসেছে সে- দুহাতে পেছন থেকে এক তরুণকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে উর্বশী। অত্যাধুনিক মোটর বাইক দুরন্ত গতিতে ছুটছে। মাথায় হেলমেট পরা ওই যুবক কে? নিজেকে আবিষ্কার করল অর্ণব। নিজেই চালাচ্ছে বাইক। এ কি করে সম্ভব? সাগরতলে চলে এসেছে ও, আবার মোটর সাইকেল চালাচ্ছে কীভাবে? কীভাবে গেল উর্বশীর কাছে? দেহের অণু কি তবে বুদবুদ হয়ে বেরিয়ে গেছে? মানবরূপে মর্ত্যলোকে আপন মহিমায় ফুটে উঠেছে? বাইক চালাচ্ছে?
এসব প্রশ্নের খই ফুটছে মস্তিষ্কে। ফুটন্ত খইয়ের এলোমেলো দাপাদাপি নেই, রয়েছে সুশৃঙ্খল কর্মযজ্ঞ। লাইন ধরে বেরুচ্ছে চিন্তার খই। একশ পঞ্চাশ মাইল বেগে ছুটন্ত মোটর বাইকটি হঠাৎ থেমে গেল। আচমকা স্টার্ট! আকস্মিক থেমে যাওয়া! শুরু এবং শেষে কোনো কম্পন নেই। পেছনে ধাক্কা দিল না, সামনেও উড়াল গতি তৈরি হয়নি- হঠাৎ শূন্যমাত্রায় থেমে যাওয়ায় গতির সূত্রগুলো গুঁড়িয়ে গেল। দৈব কোনো শক্তি কি ব্যাপক বিধ্বংসী পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছে চারপাশে, ভাবল অর্ণব।
মোটর বাইক থেকে সহজে নেমে দাঁড়িয়েছে উর্বশী। মাথার হেলমেট খুলে ফেলেছে তরুণটি। এ কি! নিজেকে দেখতে পাচ্ছে না অর্ণব। ওই তরুণটিকে ভেবেছিল নিজের অস্তিত্বের প্রতিমূর্তি, নিজের সত্তার বাস্তবরূপ। এ যে অন্য তরুণ। সুদর্শন! উর্বশীকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে। সামনে রয়েছে সমুদ্র। কিছুদূর যাওয়ার পর বুঝল সমুদ্র নয়। সামনে পাহাড়। পাহাড় বেয়ে উঠছে ওরা। হাসছে দুজনে। তরুণটি গভীর সান্নিধ্যে ধরে আছে উর্বশীর হাত।
সে কি, কষ্ট হচ্ছে তো। সাগরতলের তুলোর মতো মৃত্তিকাগর্ভে ঢেউ উঠছে, কাঁপন উঠছে। বুকের ঝড় বাইরেও ঝড় তুলছে। পায়ের তলের মাটিতে কাঁপন জাগছে। সমুদ্রের তলদেশের মাটি ঠেলে ওপরে উঠে যাচ্ছে। নিম্নচাপের উৎপত্তি ঘটেছে মনে হচ্ছে। নিম্নচাপের প্রভাবে পৃথিবীর সকল বাতাস ছুটে আসে চাপের কেন্দ্রে। আর তখন লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় নরম প্রকৃতি, ঘরবাড়ি, মানুষ সব।
আহ! আহ! এই অনুুভব জাগছে কেন, কেন চাপ তৈরি হচ্ছে। কেন উঠে যাচ্ছে ভূমিতল? ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার পায়ের তলের মাটি তো স্থির আছে। চারপাশের তুলতুলে তলদেশ ওপরে উঠে যাচ্ছে। নিজেই যেন দাঁড়িয়ে রয়েছে নিম্নচাপের কেন্দ্রে, উৎস বিন্দুতে। এই বিন্দুতে ঘটে যাচ্ছে যেন প্রলয়ংকরী বিস্ফোরণ। ছিন্নভিন্ন হয়ে উড়ে যাচ্ছে আপন অস্তিত্ব।
ভাবনার আড়ালে কোনো এক গুপ্তঘাতকের দোর্দণ্ডপ্রতাপে নিজ অস্তিত্ব ভরশূন্য হয়ে গেল মুহূর্তে। অর্ণব দেখছে উর্বশী আর অচেনা তরুণটিকে। বাঁ হাতে উর্বশীকে ধরে উঠে যাচ্ছে তরুণটি দুর্গম পাহাড় বেয়ে। মনে হলো তারা পাহাড়ে নয়, নিজের হৃৎপিণ্ডের কন্দরে থরে থরে সাজানো পুষ্পদল পিষে উঠছে ওপরে। মাঝে মাঝে ওদের মাথায় মাথায় ঠোকাঠুকি হচ্ছে, নাকে নাকে বাড়ি খাচ্ছে। মনে হচ্ছে গলে যাচ্ছে ও। দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা দুটি নিউক্লিয়াস পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে লক্ষগুণ উচ্চ তাপমাত্রার উদগীরণ ঘটায়, উৎসারিত তেমনি তাপে গলে যাচ্ছে নিজের কোষের নিউক্লিয়াসের অভ্যন্তরে বাসা বাঁধা প্রোটন-নিউট্রন। গ্লুয়ান দিয়ে জোটবাঁধা কোয়ার্ক যেমন নিউট্রন আর প্রোটনের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি করে কোয়ার্ক গ্লুয়ান প্লাজমা নামক তরল পদার্থ, তেমনি তরলে পরিণত হতে লাগল অর্ণব। নিস্তরঙ্গ জলদেশের নরম মৃত্তিকার মধ্যে আবারও এলো দুরন্ত ঢেউ। এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগ সময়ের ব্যবধানে নিজের কোষের তরল সত্তায় ঢেউ উঠলেও হাহাকারে ভেসে গেল না অর্ণব। এই ভেবে তৃপ্তি পেল যে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির পরেই এক সেকেন্ডের এক লক্ষ ভাগ সময়ে এই কোয়ার্ক গ্লুয়ান প্লাজমা দিয়েই তৈরি হয়েছিল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড- নিজের অস্তিত্বে বাস্তব আর পরাবাস্তব অণুর ভরে তেমনি সহস্র বিলিয়ন ব্রহ্মাণ্ড আবিষ্কার করতে পেরে আলোর জগতের বাইরেও যে ব্রহ্মাণ্ডের একচতুর্থাংশ ভরই অন্ধকার, সেই গভীরতম অন্ধকারে ভিন্ন জগতে থেকেও আলোর ঝকমক দেখার স্পন্দন পেল অর্ণব। খুশি হলো এই ভেবে যে, পৃথিবীর কেউ সেই অন্ধকার দেখার সুযোগ পাবে না। কারণ সেই ‘ভর’ দ্বারা গড়ে ওঠেনি পৃথিবীর চেনাজানা পদার্থ, উর্বশী আলোর জগতের হিগ্স বোসন কণার স্বাদ পেয়েছিল। আড়ালেও যে অন্ধকার জগতের হিগ্স বোসন কণার ‘ভর’ থাকতে পারে, পৃথিবীর কেউ না দেখলেও নতুন চোখের আলোর সেই ‘কালো’ হিগ্স বোসন কণা আবিষ্কার করে অবচেতন স্তর থেকে চেতন স্তরে খেলে গেল পরিস্থিতি মানিয়ে নেওয়ার দুর্দান্ত এক শক্তি। এই শক্তি ব্রেনে সঞ্চালন ঘটাল সুপার কনডাক্টিভিটির নবতর প্রযুক্তির বিপুল আর বিস্ময়কর জাগরণ। শূন্য সেকেন্ডের মধ্যেই পাহাড়সমান অনুভব আর নতুন বোধের জোটবাঁধা স্বীয় অস্তিত্ব অত্যাধুনিক গ্রিড কম্পিউটিং প্রযুক্তির সুপারসনিক তথ্য সঞ্চালন ঘটাতে পারে এমন মহাশক্তিধর এলএইচসিএর দীর্ঘ বৃত্তাকার টানেলের ভেতর ঢুকে অলৌকিক শক্তি অর্জন করে আলোকতরঙ্গের কণারূপে অর্ণবের অস্তিত্ব হাজির হলো সেই পাহাড়ের চূড়ায়―যেটি বেয়ে ওপরে উঠে আসছে উর্বশী আর সেই তরুণ। অর্ণবের আলোর জগতের হিগ্স বোসন আর অন্ধকার জগতের হিগ্স বোসনের মধ্যে ঘটে গেল বিস্ময়কর সংযোগ। অন্ধকার আর আলোর এ মায়াময় লৌকিক মিশ্রণে তৈরি হওয়া নতুন অর্ণব অপেক্ষা করছে এখন পাহাড় চূড়ায়…
চূড়ার কাছাকাছি উঠে উর্বশীর সঙ্গে আসা তরুণটি বলল, ‘উপরে বিপদ! আর এগোনো ঠিক হবে না।’
বিপদের কথা শুনে থমকে গেল উর্বশীও। পাহাড়চূড়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘বিপদ দেখলে কোথায়?’
‘ওই যে দেখো, একটা আলোর মশাল, ঠিক মানুষের আকৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে- মানব আকৃতির মশালের এক পাশ থেকে লম্বালম্বি বিকিরণ ঘটছে আলোর, আর এক পাশ ঘূর্ণি তুলে বিকিরণ ঘটাচ্ছে আঁধার। আলো-আঁধারে মোড়া এই অদৃশ্য মানব নিশ্চয়ই অশরীরী কোনো শক্তি, ভূত-প্রেত হতে পারে। চলো নেমে যাই।’ বলতে বলতে ভয়ে কুঁকড়ে যেতে লাগল তরুণটি। থরথর কাঁপতে লাগল তার দেহ। সামনে নয়, পেছনে ফেলল সামনে আগুয়ান পা।
উর্বশী ভয় পেল না। কাঁপল না। বরং সোল্লাসে লাফিয়ে বলল, ‘দূর বোকা! দেখো ওটা মানবআকৃতির আলোর ধনু, ধনুর মতো বাঁকানো। রংধনুটির এক প্রান্ত দেখো ছুঁয়ে আছে পাহাড় চূড়া, আরেক প্রান্ত ডুবে গেছে ওই যে, দূরে সাগরের জলে!’
উর্বশীর কথা অনুসরণ করে সেদিকে তাকাল তরুণটি।
‘না। নাই। রংধনু নেই। ‘কালো’ আর ‘আলো’ দেখো কেমন দাঁড়িয়ে আছে মিলেমিশে। ওটা নিশ্চয় মানব-দানব। পালাও উর্বশী।’
‘না। পালাব না। এগোব সামনে। রংধনুটি ছুঁয়ে দেখব। উঠো, ওপরে উঠো। শক্তি সঞ্চয় করো।’
থমকে দাঁড়িয়ে গেল তরুণটি।
এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে উর্বশী উঠতে লাগল উপরে। উদ্ধত পদক্ষেপে দুর্বিনীত ভঙ্গিতে মাথা উঁচু করে উঠতে লাগল ও। কয়েক ধাপ পেছনে এসে তরুণটি থমকে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল উর্বশীকে। আকস্মিক চোখ ধাঁধিয়ে গেল যুবকের। উর্বশীর দেহও লম্বালম্বি দু ভাগ হয়ে গেছে। একভাগে ছুটোছুটি করছে আলোর ঢেউ, আর এক ভাগে ঘূর্ণি তুলছে কালোঢেউ। ‘আলো’ আর ‘কালো’র মধ্যে থেকে ফুটে বেরুচ্ছে এক রহস্যময়ী নারীমূর্তি।
আতঙ্কের ঝড়ো বাতাসের ঝাপটা খেল তরুণটি। চোখ বুজে ফেলল; খোলার সাহস পেল না সহসা। দীর্ঘক্ষণ পর চোখ খুলে প্রথমে তাকাল নিজের দৃশ্যমান দেহের দিকে। সে আবিষ্কার করল দীর্ঘ বৃত্তাকার টানেলের চারিদিকে সাঁই সাঁই করে ঘুরছে নিজ দেহের ‘ভর’। এই ‘ভর’-এ আলোর কণা নেই। রয়েছে আঁধার কণার ব্যাপক ঘূর্ণি। অনেকটা হিগ্স বোসন কণা খুঁজে বেড়ানো এলএইচসি টানেলের মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করার মতো ঘটনায় তার চমকে ওঠার কথা, কিন্তু চমকাল না। চমকশূন্য বা আবেগশূন্য হয়ে দেখল ওর আঁধার জগৎ। এ আঁধারকণা এলো কোত্থেকে! চক্রাকারে ঘুরতে থাকা টানেল আকস্মিক থেমে গেছে। ক্ষণস্থায়ী আঁধারকণার অস্তিত্ব কী জানান দিয়ে গেল? নিজের দিকে তাকিয়ে যুবক দেখল এক আঁধার মানবকে। এই মানব কি তবে লুকিয়ে থাকে আলোর আড়ালে, আড়ালে-অগোচরে কি চালায় মানবসৃষ্টিকে। ভাবনার জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে তরুণটি আবার তাকাল উপরে, চূড়ার দিকে। দেখল আলো-আঁধারের এক মিশ্র মানবী সরাসরি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আলো-আঁধারে মিশ্র আরেক মানবের সামনে। কী এই রহস্য?
রহস্যের গিঁট খুলল না। তরুণটির বিস্ময় বাড়তে লাগল গাণিতিক হারে। দেখল মানবমূর্তির কালো অংশ থেকেও আলো বেরুচ্ছে নারীমূর্তির আলো বিম থেকে আলোর ছোঁয়া পেয়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে গেল দুই ভাগে বিভক্ত আলো-আঁধার- কেবল আলো ফুটছে, এক কলামে আলো বেরুচ্ছে… আলোর জগতে নাচন উঠছে।
একবার ডাক দেওয়ার চেষ্টা করল তরুণটি। ‘উর্বশী’ শব্দটা বেরুল না তার কণ্ঠ থেকে। নিজের মধ্যে হঠাৎ ফিরে এলো ও। আবিষ্কার করল নিজের পায়ের তলার পাহাড়ি মাটি। আর অনুভব করল উর্বশীর তিন মাসের শূন্যতার গভীরতা। স্বামী হারিয়ে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল উর্বশীর নিউরনের গ্রাহকযন্ত্রের বদ্ধ দরজায়, সহজেই ঢুকে গিয়েছিল ও সমব্যথী হয়ে, লুটে নিয়েছিল তার আবেগ। এখন আবার আলোয় ভরে উঠছে সেই শূন্য রিসেপ্টরের গোপন সব কুঠুরি, পূর্ণতার মগ্ন রিসেপ্টরের ঐশ্বর্যময় দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না, অন্তত আপাতত তার প্রবেশাধিকার রুদ্ধ হয়ে গেছে, নিশ্চিত তরুণটি। তবু দাঁড়িয়ে রইল উর্বশীর প্রতীক্ষায়। আবার যদি তৈরি হয় শূন্যতা, চট করে সেই ফাঁকে ঢুকে যাবে ও। আবার বগলদাবা করে মোটর বাইকে চড়ে ছুটে যাবে আদিম জগতের চোরাগলিতে…। এ ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে রইল ছেলেটি।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
কথাসাহিত্যিক মোহিত কামালের জন্ম ১৯৬০ সালের ০২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায়। তাঁর বাবার নাম আসাদুল হক এবং মায়ের নাম মাসুদা খাতুন। তাঁর শৈশব-কৈশোর কেটেছে আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম ও খালিশপুর, খুলনায়। বর্তমান নিবাস ধানমন্ডি, ঢাকা। স্ত্রী মাহফুজা আখতার মিলি, সন্তান মাহবুব ময়ূখ রিশাদ, পুত্রবধূ ইফফাত ইসলাম খান রুম্পা ও জিদনি ময়ূখ স্বচ্ছকে নিয়ে তাঁর সংসার। চার ভাই এক বোনের মধ্যে চতুর্থ সন্তান তিনি। তাঁর অ্যাফিডেভিট করা লেখক-নাম মোহিত কামাল। তিনি সম্পাদনা করছেন শুদ্ধ শব্দের নান্দনিক গৃহ, সাহিত্য-সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর। তাঁর লেখালেখির মুখ্য বিষয় : উপন্যাস ও গল্প; শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণাধর্মী রচনা। লেখকের উড়াল বালক কিশোর উপন্যাসটি স্কলাস্টিকা স্কুলের গ্রেড সেভেনের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে; ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্যও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচি (ঝঊছঅঊচ) কর্তৃকও নির্বাচিত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রকাশিত কথাসাহিত্য ৩৭ (উপন্যাস ২৪, গল্পগ্রন্থ ১৩)। এ ছাড়া কিশোর উপন্যাস (১১টি) ও অন্যান্য গ্রন্থ মিলে বইয়ের সংখ্যা ৫৫। জাতীয় পুরস্কার: কথাসাহিত্যে অবদান রাখার জন্য তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার (২০১৮), অগ্রণী ব্যাংক-শিশু একাডেমি শিশুসাহিত্য পুরস্কার ১৪১৮ বঙ্গাব্দ (২০১২) অর্জন করেছেন। তাঁর ঝুলিতে রয়েছে অন্যান্য পুরস্কারও; হ্যাঁ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০২০) উপন্যাসটি পেয়েছে সমরেশ বসু সাহিত্য পুরস্কার (২০২০)। পথভ্রষ্ট ঘূর্ণির কৃষ্ণগহ্বর (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১৪) উপন্যাসটি পেয়েছে সিটি আনন্দ আলো সাহিত্য পুরস্কার (২০১৪)। সুখপাখি আগুনডানা (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৮) উপন্যাসটি পেয়েছে এ-ওয়ান টেলিমিডিয়া স্বাধীনতা অ্যাওয়ার্ড ২০০৮ এবং বেগম রোকেয়া সম্মাননা পদক ২০০৮―সাপ্তাহিক দি নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস-প্রদত্ত। না (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০০৯) উপন্যাসটি পেয়েছে স্বাধীনতা সংসদ নববর্ষ পুরস্কার ১৪১৫। চেনা বন্ধু অচেনা পথ (বিদ্যাপ্রকাশ, ২০১০) উপন্যাসটি পেয়েছে ময়মনসিংহ সংস্কৃতি পুরস্কার ১৪১৬। কিশোর উপন্যাস উড়াল বালক (রোদেলা প্রকাশনী, ২০১২; অনিন্দ্য প্রকাশ, ২০১৬) গ্রন্থটি ২০১২ সালে পেয়েছে এম নুরুল কাদের ফাউন্ডেশন শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০১২)। তিনি মনোচিকিৎসা বিদ্যার একজন অধ্যাপক, সাবেক পরিচালক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ,ঢাকা
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!