আমি বহু দিন ধরে একটা কথা বলে আসছি— ‘কবিতা এমন একটা শিল্প, হলে একশো, না হলে শূন্য।’
কিন্তু কাকে কবিতা বলব? কবিতার নানান ছন্দ, রীতিনীতি, নিয়ম থাকলেও কবিতা মূলত দু’টি ধারার।
একটি ধারা হল, সোজাসাপটা। সরাসরি। যেগুলোর মধ্যে একটা চমক থাকে। একটা নাটকীয়তা থাকে। একটা কাহিনি থাকে। যেগুলো বাচিকশিল্পীরা একদম লুফে নেন আবৃত্তি করার জন্য।
যেগুলোকে অনেকেই এখন ‘আবৃত্তিযোগ্য কবিতা’ বলেন। বিভিন্ন কবির যে কবিতাগুলোকে নিয়ে এক ধরনের অতি সস্তা দরের পাতি সংকলন তৈরি করা হয়, যেগুলো বিভিন্ন আবৃত্তির স্কুল এবং বাচিকশিল্পীরা তাঁদের ছাত্রছাত্রীদের শেখানোর জন্য হাতের কাছে রাখেন, চটজলদি জনপ্রিয় হওয়ার জন্য বেশ কিছু কবি যে ধরনের কবিতা লেখেন, সেই কবিতাগুলো হল এই ধারার কবিতা।
এগুলোকে কতটা কবিতা বলব, কতটা না-কবিতা বলব কিংবা আদৌ কবিতা বলব কি না, সে নিয়ে আমার নিজেরই যথেষ্ট দ্বন্দ্ব আছে।
আর একটি ধারা হল, মূলধারার কবিতা। কবিতার সৃষ্টি মুহূর্ত থেকে আবহমানকাল ধরে যে কবিতাগুলো পাঠককে নিভৃতে পড়িয়ে নিয়েছে, যে কবিতাগুলো মানুষকে বারবার ছুঁয়ে গেছে, যে কবিতাগুলো যত বারই পড়া হোক না কেন, প্রতিবারই নতুন কিছু দিয়ে যায়, সে ছন্দের কবিতাই হোক বা টানা গদ্যের, সেগুলোই হল মূল ধারার কবিতা।
প্রথমে যে ধারাটির কথা বললাম, সেটাকে কবিতা বলি বা না বলি, দ্বিতীয়টাকে কিন্তু কবিতা বলতেই হবে। কিন্তু শুধু কবিতা বললেই তো হল না, সেটা কতখানি কবিতা হয়ে উঠেছে, সেটাও একটা বড় ব্যাপার।
কারণ, ভাবনা থেকে শুরু করে শব্দ প্রয়োগ, বিষয় অনুযায়ী গঠনশৈলী, এমনকী একদম প্রথম শব্দ থেকে শেষ শব্দের মধ্যে কারুকার্যখচিত যে পথ, সেই পথটা এতটাই পিচ্ছিল যে, সামান্য ত্রুটি হলেই যে কোনও জায়গা থেকে পা পিছলে অনেকটাই দূরে সরে যেতে পারে কবিতা।
ফলে কবিতা রচনার সময় প্রতি পদে পদে কবিতা না হয়ে ওঠার একটা প্রবল সম্ভাবনা থাকে। সেই সম্ভাবনাগুলো অতি সন্তর্পণে পাশ কাটিয়ে কাটিয়ে যে লেখাটি অবশেষে সম্পূর্ণ কবিতা হয়ে ওঠে, সেটাই কবিতা।
আর নির্মিত হতে হতে যদি কোনও কবিতার সামান্যতমও পদস্খলন ঘটে, তা হলে সেটা আর যাই হোক না কেন, যত ভালই শুনতে লাগুক না কেন, সেটা আর কবিতা হয়ে ওঠে না।
কবিতা একেবারে অঙ্কের মতো। মাঝামাঝি কিছু হয় না। হলে একশো, না হলে শূন্য।