‘বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস’ আজ
তামাকমুক্ত দেশ গড়ায় ‘ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান’ নয়

রেজাউর রহমান রিজভী
রেজাউর রহমান রিজভী
7 মিনিটে পড়ুন
রেজাউর রহমান রিজভী

আজ ৩১ মে ‘বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস’। প্রতি বছরের মতো এবছরও বাংলাদেশে দিনটি যথাযথভাবে পালিত হচ্ছে। তবে করোনার মহামারীর জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সতর্কতার সাথে সরকারী ও বেসরকারী বিভিন্ন তামাকবিরোধী প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালন করছে। এবারের ‘বিশ্ব তামাক মুক্ত দিবস-২০২১’ এর প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘কমিট টু কুইট’ (Commit to quit)। যার বাংলা ভাবার্থ করা হয়েছে- ‘আসুন আমরা প্রতিজ্ঞা করি, জীবন বাঁচাতে তামাক ছাড়ি।”

তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বিপুল জনসংখ্যা, দারিদ্রতা, শিক্ষা ও সচেতনতার অভাবের কারণে বিশ্বের সর্বোচ্চ তামাকজাত পণ্য ব্যবহারকারী দশটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বাংলাদেশে ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩)’ থাকলেও তামাক কোম্পানীগুলো এই আইনের কিছু দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে তরুণ প্রজন্মকে তামাকজাত পণ্যের প্রতি আকৃষ্ট করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। যা তামাক ও ধূমপানমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার অন্তরায়।

ধূমপায়ী ব্যক্তি কেবল নিজের ক্ষতি করেন তা নয়। তার দ্বারা পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির শিকার হয় অন্যরা। উদাহরণস্বরূপ- পরিবার নিয়ে আপনি হয়তো রেস্টুরেন্টে গিয়েছেন। হঠাৎ খেয়াল করলেন রেস্টুরেন্টের ভেতরেই ধুমপানের জন্য একটি ‘নির্ধারিত স্থান’ হিসেবে একটি আবদ্ধ কক্ষ রাখা রয়েছে। সেখানে রেস্টুরেন্টে আগত ধূমপায়ীরা ধূমপান করেন ও আড্ডা দেন। অনেকের অধূমপায়ী বন্ধু বা আত্মীয়-স্বজন এই কক্ষে গল্প-গুজব করেন। তবে ধূমপানের জন্য স্থানটি নির্ধারিত হলেও ধূমপানের ধোঁয়া ও গন্ধ পুরো রেস্টুরেন্ট জুুড়েই পাওয়া যায়। কারণ যখনই কেউ সেই কক্ষে প্রবেশ করেন বা বের হন, তার সঙ্গে ধূমপানের ধোঁয়া ও গন্ধও বের হয়। বিষয়টা যারা ধূমপান করেন না তাদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। আর পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির বিষয় তো রয়েছেই।

পরোক্ষ ধূমপানজনিত ক্ষতি হতে অধূমপায়ীদের রক্ষার্থে ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩)-এ ‘পাবলিক প্লেস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা-সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত অফিস ও বেসরকারি অফিস, গ্রন্থাগার, লিফট, আচ্ছাদিত কর্মক্ষেত্র (ইনডোর ওয়ার্ক প্লেস), হাসপাতাল ও ক্লিনিক ভবন, আদালত ভবন, বিমানবন্দর ভবন, সমুদ্রবন্দর ভবন, নৌ-বন্দর ভবন, রেলওয়ে স্টেশন ভবন, বাস টার্নিমাল ভবন, প্রেক্ষাগৃহ, প্রদর্শনী কেন্দ্র, থিয়েটার হল, বিপণী ভবন, চতুর্দিকে দেয়াল দ্বারা আবদ্ধ রেস্টুরেন্ট, পাবলিক টয়লেট, শিশুপার্ক, মেলা বা পাবলিক পরিবহনে আরোহণের জন্য যাত্রীদের অপেক্ষার জন্য নির্দিষ্ট সারি, জনসাধারণ কর্তৃক সম্মিলিতভাবে ব্যবহার্য অন্য কোন স্থান অথবা সরকার বা স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক, সাধারণ বা বিশেষ আদেশ দ্বারা, সময় সময় ঘোষিত অন্য যে কোন বা সকল স্থান এবং এ সমস্ত স্থানে ধূমপান নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

এই আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ করলেও ঐসব এলাকায় ‘ধূমপান এলাকা’ রাখার বিধান করা হয়েছে। ‘ধূমপান এলাকা’ হিসেবে আইনে বলা হয়েছে, কোন পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্টকৃত কোন এলাকাই হলো ‘ধূমপান এলাকা’।

২০১৩ সালে সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে রেস্তোরাঁকে পাবলিক প্লেস হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এক কক্ষ বিশিষ্ট নয় এমন রেস্তোঁরাসহ হসপিটালিটি সেক্টরের অন্যান্য ক্ষেত্রে ‘ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান’ (ডেজিগনেটেড স্মোকিং এড়িয়া বা সংক্ষেপে ডিএসএ) রাখার বিধান রয়েছে। ফলে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হচ্ছেন। আর এতে মানুষের বিভ্রান্তির সুযোগ নিয়ে সুযোগ-সন্ধানী রেস্টুরেস্ট মালিকরা তাদের রেস্টুরেন্টে ‘ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান’ (ডিএসএ) রাখেন। যা রেস্টুরেন্টে আগত অধূমপায়ীদেরকে ধূমপানের পরোক্ষ ক্ষতির মুখে ফেলছে।

অনেক সময়ই দেখা যায়, ধূমপান করার জন্য নির্দিষ্ট স্থানটি পুরোপুরি সুরক্ষিত নয়। ফলে ধূমপানের ধোঁয়া ধূমপান মুক্ত এলাকাতেও চলে যায়। যার ফলে অন্যরাও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির হিসাব মতে, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজারেরও বেশি রেস্তোরাঁ আছে। আর গ্যাটস ২০১৭ এর তথ্য মতে, ৫০% মানুষ শুধুমাত্র রেস্তোরাঁয় পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। এছাড়া হসপিটালিটি সেক্টরের অন্যান্য ক্ষেত্রেও অধূমপায়ীরা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। অন্যদিকে তামাক কোম্পানী বিভিন্ন রেস্তোঁরা, হোটেল, রিসোর্টে প্রচার-প্রচারণা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন করছে।

গ্লোবাল এডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস)-এর রিপোর্ট মোতাবেক, তামাক ব্যবহারকারীর প্রায় অর্ধেক মারা যান তামাকের কারণে। আর বিশ্ব জুড়ে প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যুর প্রধান আটটি কারণের ৬টির সাথেই তামাক জড়িত। তামাক ব্যবহারকারীদের তামাকজনিত রোগ যেমন হৃদরোগ, স্ট্রোক, সিওপিডি বা ফুসফুসের ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ৫৭% বেশি এবং তামাকজনিত অন্যান্য ক্যান্সার হবার ঝুঁকি ১০৯% বেশি। একারণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লক্ষ ৬১ হাজারেরও বেশি মানুষ তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার জনিত রোগে মৃত্যুবরণ করেন।

প্রাপ্তবয়স্কের মধ্যে ৩৫% তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করেন। সংখ্যার হিসেবে যা সাড়ে তিন কোটিরও বেশি। আবার ১৩ থেকে ১৫ বছরের অপ্রাপ্তবয়স্করাও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার থেকে পিছিয়ে নেই। শতকরার হিসেবে সেটিও প্রায় ৬.৯%।
যারা ধূমপান করেন না, কিন্তু পরোক্ষভাবে ধূমপানের ক্ষতির শিকার হন, এমন মানুষের সংখ্যা সামগ্রিক ভাবে মোট ধূমপায়ীর সংখ্যার চেয়েও বেশি। সংখ্যার হিসেবে তা প্রায় ৪ কোটি মানুষ, যা প্রত্যক্ষ ধূমপায়ীর চেয়ে বেশি। অথচ এটি নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন ততটা নই যতটা হওয়া উচিত ছিল।

যিনি ধূমপান করেন না তার অধিকার আছে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য। অথচ পরোক্ষ ধূমপানে ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যাই বেশি। যেহেতু ধূমপানের ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সেজন্য রেস্টুরেন্ট সহ সব ধরনের পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ রেস্টুরেন্টে অনেকেই পরিবারসহ যান। এখন কোন ধূমপায়ীরাই অধিকার নেই অন্য যে বা যারা ধূমপান করেন না তাদেরকে পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতির শিকার করা। ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান থাকলে এতে যে কোন অধূমপায়ী পরিবারের সদস্যরাও ক্ষতির শিকার হতে পারে। কারণ ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে নির্গত ধোঁয়া শুধু যে পরিবেশেরই ক্ষতি করে তা নয়, বরং বাতাসে মিশে তা পরোক্ষ ধূমপানেরও ক্ষতির মূল উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে।

কানাডা, স্পেন, নেপালসহ বিশ্বের ৬৩টি দেশে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত জায়গা নিষিদ্ধ করে আইন রয়েছে। অথচ আমাদের দেশের আইনে পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত এলাকা, চার দেয়ালে আবদ্ধ এক কক্ষ বিশিষ্ট নয় এমন রেস্টুরেন্ট, একাধিক কক্ষবিশিষ্ট গণপরিবহনে (ট্রেন, লঞ্চ) ও অযান্ত্রিক পাবলিক পরিবহনে ধূমপানের স্থান রাখা যাবে। অথচ হওয়া উচিত তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা ৭ সংশোধন করে সব ধরনের পাবলিক প্লেসে ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান নিষিদ্ধ করা এবং ধূমপানসহ যেকোন ধরনের তামাক ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।

ফলে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে রেস্টুরেন্টগুলোতে ধূমপানের জন্য নির্দিষ্ট স্থান রাখার বিধান বাতিল করলে জনস্বাস্থ্যর জন্য যা অশেষ উপকারী হবে বলেই সংশ্লিষ্টগণ মনে করেন। কারণ এখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোন দেশ তামাকমুক্ত হওয়ার নির্দিষ্ট কোন সময়ের ঘোষণা দিতে পারেনি, যেটা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিয়েছেন। তিনি ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার ঘোষণা দিয়েছেন। এজন্য বর্তমান তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের যে ফাঁক রয়েছে সেগুলোর সংশোধন হলে এদেশের মানুষদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের প্রকোপ আরো কমবে বলে আশা করা যায়।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
রেজাউর রহমান রিজভী: মিডিয়া ম্যানেজার, তামাক নিয়ন্ত্রণ প্রকল্প, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!