দাসপ্রথার ইতিহাস অতীত থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতি এবং ধর্মজুড়ে বিস্তৃত। অবশ্য দাসদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং বৈধ অবস্থান বিভিন্ন সমাজে এবং বিভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ছিল। আদিম সমাজে দাসপ্রথার প্রচলন বিরল ছিল কারণ এই প্রথা সামাজিক শ্রেণীবিভাগের কারণে তৈরি হয়। দাসপ্রথার অস্তিত্ব মেসোপটেমিয়াতে প্রায় ৩৫০০ খৃস্টপূর্বে প্রথম দেখতে পাওয়া যায়।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 38 দাসপ্রথার ইতিহাস ১৩ শতকের আফ্রিকা - প্রধান বাণিজ্য রুট, রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের মানচিত্র।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/African_slave_trade.png)
অন্ধকার যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত ইউরোপে অধিকাংশ এলাকাতেই দাসপ্রথার প্রচলন ছিল। ইউরোপে বাইজেন্টাইন-উসমানিদের যুদ্ধ এবং উসমানিদের যুদ্ধের ফলশ্রুতিতে অনেক খৃস্টান কৃতদাসে পরিণত হয়। ওলন্দাজ, ফরাসি, স্পেনিশ, পর্তুগিজ, ব্রিটিশ, আরব এবং কিছু পশ্চিম আফ্রিকান রাজ্যের লোকেরা আটলান্টিক দাস বাণিজ্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিল। ডেভিড ফোর্সথি লেখেন, “ঊনিশ শতকের শুরুর দিকে আনুমানিক প্রায় তিন চতুর্থাংশ লোকেরাই দাসপ্রথার বন্ধনে আবদ্ধ ছিল।” ইউরোপের মধ্যে সর্বপ্রথম ১৪১৬ সালে রাগুসা নামক দেশ দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করে। আধুনিক যুগে নরওয়ে এবং ডেনমার্ক সর্বপ্রথম ১৮০২ সালে দাসদের বাণিজ্য বন্ধ করে।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 39 রুভুমা নদীর তীরে আরব দাস ব্যবসায়ী এবং তাদের বন্দী (আজকের তানজানিয়া এবং মোজাম্বিকে), ডেভিড লিভিংস্টোনের ১৯ শতকের আঁকা।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/Slaves_ruvuma.jpg)
দাসপ্রথা একটি অনুমোদিত সামাজিক ও আইনানুগ ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় বাজারে মানুষের আনুষ্ঠানিক বেচা-কেনা চলত এবং ক্রীত ব্যক্তি ক্রেতার ব্যক্তিগত সম্পত্তি রূপে কাজ করতে বাধ্য থাকত। প্রাচীন ও মধ্যযুগের প্রায় সব শাসন ব্যবস্থাতেই দাস প্রথার প্রচলন ছিল। গবাদিপশুর ন্যায় মানুষেরও কেনা বেচা চলত। অন্যান্য প্রায় সকল দেশের মতো বাংলায়ও প্রাচীনকাল হতেই দাস প্রথা প্রচলিত হয়ে আসছিল। শুধু আইন পুস্তক ও প্রশাসনিক গ্রন্থেই নয়, এ প্রথা সব ধর্মেও স্বীকৃতি ছিল। মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেন যে, পাটলিপুত্রের রাজার নিরাপত্তার দায়িত্ব ক্রীতদাসীদের ওপর ন্যস্ত ছিল। সব ধর্মীয় পুস্তকেই ক্রীত দাসদাসীদের সাথে সদ্ব্যবহারের উপদেশ দেওয়া আছে।
দাস প্রথার ওপর প্রাপ্ত নথিপত্রে প্রমাণ মেলে যে, বনেদি সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো ও গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে এ প্রথা সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিল। বাজারে মুক্ত শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর থাকায় সমাজের শক্তিশালী শ্রেণি তাদের উৎপাদন ও প্রাধান্য অব্যাহত রাখতে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বলতর শ্রেণির লোককে দাসে রূপান্তর করত।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 40 ইয়েমেনে ১৩ শতকের ক্রীতদাস বাজার](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/Slaves_Zadib_Yemen_13th_century_BNF_Paris.jpg)
অভিজাত শাসকশ্রেণি, তাদের পারিবারিক ও অন্যান্য সামাজিক-রাজনৈতিক পদমর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে, সুবৃহৎ কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন অনুভব করে। গণপূর্ত কাজ, যেমন সরকারি ভবন, বাঁধ, সেতু, সড়ক ও প্রধান পথের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাষ্ট্রের এক বিশাল শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। সৈন্য চলাচল ও তাদের রসদ সরবরাহের জন্যও শ্রমশক্তির প্রয়োজন ছিল। দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ ও শ্রেণিভেদ প্রথা যাদেরকে গুরুত্বহীন করে তুলেছিল প্রধানত তারাই দাস প্রথার বলি হতো।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 41 রাশিয়ার ইতিহাসে পূর্ব স্লাভ অঞ্চলের একটি দাসের বাজার। সের্গেই ইভানভের অঙ্কিত চিত্র।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/S._V._Ivanov._Trade_negotiations_in_the_country_of_Eastern_Slavs._Pictures_of_Russian_history._1909-1024x725.jpg?v=1681651066)
অভাবগ্রস্ত, নিঃস্ব ও বিধবাদের অনেকেরই শেষ গন্তব্য ছিল ক্রীতদাস বাজার। দাস বাজারের অনেক ঠগ ও অপরাধী বিক্রি করার জন্য শিশুদের অপহরণ করত। আইনত ও প্রথাগতভাবে, ক্রীতদাস-দাসীরা ও তাদের সন্তান-সন্ততিরা তাদের মালিকের সম্পত্তি রূপে পরিগণিত হতো। ক্রীতদাস-দাসী হস্তান্তরযোগ্য পণ্য ছিল। তাই, অনেক মালিক তাদের উদ্বৃত্ত বা অপ্রয়োজনীয় দাস-দাসীদের বাজারে বিক্রি করে দিত। দাস-দাসীদের আমদানি ও রপ্তানি দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 42 ইউরোপ এবং আমেরিকায় ক্রীতদাস পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ক্রীতদাস জাহাজের দৃষ্টান্ত](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/Barconegrero-876x1024.jpg?v=1681650849)
বাংলার সুলতানগণ আফ্রিকা, তুরস্ক, পারস্য ও চীনদেশ হতে দাস-দাসী আমদানি করতেন বলে জানা যায়। এ ধরনের কিছু ক্রীতদাসকে মুক্তি দেওয়ার পর মন্ত্রী, প্রশাসক, এমন কি সেনাপতির পদেও উন্নীত করা হয়েছিল। পনেরো শতকের শেষদিকে আবিসিনীয় বংশোদ্ভূত দাসগণ স্বল্প কালের জন্য বাংলায় তাদের নিজস্ব শাসন ব্যবস্থাও কায়েম করেছিল।
বাংলার বাজারে ১৮৩০ সাল পর্যন্তও হাবশী ও কাফ্রী নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস-দাসী আমদানি করা হতো। বাংলায় সাধারণত ধনী সম্ভ্রান্ত ব্যাক্তিগণ, এবং মুসলিম ও ইউরোপীয় বণিকগণ কঠোর পরিশ্রমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত হাবশীদেরকে দাস হিসেবে রাখত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পরিবহন ও কারখানা প্রহরার জন্য নিয়মিত শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত। ইউরোপীয় অধিবাসীদের মধ্যে ক্রীতদাস রাখার এমনই রেওয়াজ হয়ে গিয়েছিল যে, স্যার উইলিয়ম জোনস এর ন্যয় একজন মানবতাবাদী, আইনজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরও চারজন ক্রীতদাস ছিল।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 43 দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের হায়দ্রাবাদে তোলা ১৯০৪ সালের এই ছবিতে, আফ্রিকান রক্ষীদের একটি রাজকীয় শোভাযাত্রাকে এসকর্ট করতে দেখা যায়।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/deendayal-938x1024.jpeg?v=1681651400)
ক্রীতদাসদের মধ্যে সবচেয়ে দামি হাবশী দাসগণ খানসামা, পাচক (বাবুর্চি), গায়ক, নাপিত, গৃহ প্রহরী ইত্যাদি হিসেবে তাদের প্রভুদের সেবায় নিয়োজিত হতো। দাসদের মধ্যে তাদের মর্যাদা এত উচুঁ ছিল যে, তাদের মালিকগণ তাদের ব্যবসা সংক্রান্ত ও গৃহ পরিচালনা বিষয়ে এবং রাজনৈতিক ব্যাপারেও তাদের সাথে পরামর্শ করতেন। অভিজাত সম্প্রদায়ের হারেমে নিয়োজিত খোজাদের মধ্যে হাবশী দাসদের সংখ্যাই সর্বাধিক ছিল।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 44 আফ্রিকানরাও তাদের সঙ্গীত ভারতে নিয়ে এসেছে। ১৬৪০-১৬৬০ তারিখের এই শিল্পকর্মটি আফ্রিকান গানের একজন বাদককে দেখায়।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/5africa-938x1024.jpeg?v=1681651874)
আঠারো ও ঊনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলার বাজারের জন্য কেবল আফ্রিকাই নয়, বরং আরব, চীন, মালয়, আরাকান ও আসাম হতেও ক্রীতদাস আমদানি করা হতো। আরব দেশ থেকে আনীত দাসদের অধিকাংশই হতো খোজা। বাংলার বাজার হতে ক্রীতদাস রপ্তানিও হতো। ইউরোপীয় বৈদেশিক উপনিবেশগুলির জন্য বাগান শ্রমিক হিসেবে বঙ্গীয় বংশোদ্ভূত দাসদের চাহিদা ছিল।
দাস মুখ্যত দু’ধরনের ছিল, গার্হস্থ্য ও কৃষিকার্যাধীন। একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে গুটি কয়েক দাস থাকবে সেটাই ছিল সামাজিক প্রত্যাশা। তারা পদ ও মর্যাদার প্রতীক ছিল এবং তা কেবল সম্ভ্রান্ত জমিদারের ক্ষেত্রেই নয়, মধ্যবিত্ত ও ধনী কৃষকদের বেলায়ও ছিল। হিন্দু মালিকগণ দাস গ্রহণের সময় তাদের গোত্রের বাছবিচার করতেন। ঐ বিবেচনায় কায়স্থ, গোয়ালা, চাষা, বৈদ্য প্রভৃতি গোত্রের দাসদের শুদ্ধ (পবিত্র) এবং শূদ্র, তাঁতি, তেলি, ডোম, বাগ্দি, কৈবর্ত, জোলা, চন্ডাল প্রভৃতিদের অশুদ্ধ (অপবিত্র) বলে মনে করা হতো। কোনো ব্রাহ্মণকে দাসে পরিণত করা ধর্মে নিষিদ্ধ ছিল। শুদ্ধ গোত্রের দাসদের ঘরের ভেতরের কাজে এবং অশুদ্ধদের বাইরের কাজে লাগানো হতো।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 45 এই চিত্রকর্মটি ১৭ শতকে একজন আবিসিনিয়ান নপুংসক দ্বারা নির্মিত একটি জলাধার দেখায়](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/tajbaoli.jpeg)
হিন্দু সমাজে দাসদের ক্রীতদাস বা শুধু দাস এবং যারা স্ত্রীলোক তাদেরকে দাসী বলা হতো। মুসলমান সমাজে পুরুষ দাসদের বলা হতো গোলাম বা নফর এবং স্ত্রীলোকদের বান্দি বা লৌন্ডি। লৌন্ডিরা সুদর্শনা হতো এবং তাদেরকে বাজার থেকে কেনা হতো। তাদের প্রয়োজন ছিল গার্হস্থ্য শ্রমিক রূপে নয়, বরং প্রধানত উপ-পত্নী রূপে। হিন্দু ও মুসলিম, উভয় আইন মোতাবেক, যৌন পরিতৃপ্তির জন্য ক্রীতদাসীরা ব্যবহূত হতে পারত। তাদের সন্তান সন্ততিগণও দাস-দাসী হতো, তবে হিন্দু ও মুসলিম আইন অনুযায়ী, তারা মালিকের জমিজমায় নামমাত্র কিছু অধিকার অর্জন করত। কৃষি কার্যাধীন দাসের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। বাজার হতে মুক্তশ্রমিক প্রাপ্তি সম্ভবপর না হওয়ায় সম্ভ্রান্ত স্তরের ও ধনী কৃষক শ্রেণির কৃষিকাজে ক্রীতদাস ব্যবহারের কোনো বিকল্প ছিল না।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 46 ব্রাজিলের সান্তা আনা স্কোয়ারে জনসাধারণের শাস্তি। জোহান মরিটজ রুজেন্ডাস দ্বারা অঙ্কন।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/Johann_Moritz_Rugendas_in_Brazil_2-1024x751.jpg?v=1681650054)
অতীতকাল থেকে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত বাংলায় কৃষি কর্মোপযোগী দাস বা দাসখত লেখা শ্রমিক ব্যবহারের ব্যাপক রেওয়াজ ছিল। কেউ সম্পদবিহীন হয়ে স্বাধীন জীবন ধারণে অক্ষম হলে, ইচ্ছুক সম্পদশালী কোনো পরিবারের নিকট নিজেকে বিক্রি করত। এসব পরিবার এ ধরনের অভাগাদের কিনে তাদের ক্ষেতের কাজে লাগাত। তারা সব ধরনের কৃষিকাজ করত যথা, মাটি খনন, পানি সেচ, গো-চারণ, মাছ ধরা, নির্মাণ কাজ ইত্যাদি।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 47 africa দাসপ্রথার ইতিহাস](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/africa.jpeg)
শ্রমের বিনিময়ে তারা তাদের প্রভুদের কাছ থেকে খাদ্য, বাসস্থান, বস্ত্র এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে বৃদ্ধ বয়সের ভরণপোষণও পেত। অনেক ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি মহাজনদের কাছে তাদেরকে বিক্রি করে দিয়ে তাদের দেনার দায় পরিশোধ করত। দেনার কারণে দাসত্ব, আজীবন অথবা জীবনের খানিক অংশের জন্য, হতে পারত। যেসব জেলায় বিশেষভাবে কৃষিনির্ভর দাস প্রথার প্রচলন ছিল সেগুলি হচ্ছে সিলেট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম ও ঢাকা।
আইন কমিশনের (১৮৩৯) প্রতিবেদনে দেখা যায়, এসব জেলায় প্রতি পাঁচ জনের একজনই ছিল দাস। সাধারণ দাস বাজার থেকে ক্রয় না করে সরাসরি সামাজিক উৎস হতে কৃষিনির্ভর দাস সংগ্রহের রেওয়াজ ছিল। অভাব, দুর্ভিক্ষ, নদী ভাঙন, পরিবারের উপার্জনকারী সদস্যের মৃত্যু প্রভৃতি দুর্যোগ কবলিত ব্যক্তিদের বেঁচে থাকার তাগিদে স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করতে হতো। তাদের বেলায় বংশপরম্পরায় গার্হস্থ্য শ্রমিক হিসেবে থেকে যাওয়াই অবধারিত ছিল। তাদের বয়স, শারীরিক গঠন, লিঙ্গ, গোত্র, জাতি, এবং সর্বোপরি দেশের চলতি অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় তাদের মূল্য নির্ধারিত হতো।
উনিশ শতকের প্রথম দিকে শিশু ও বৃদ্ধদের বাজার দর ছিল পাঁচ থেকে সাত টাকা। স্বাস্থ্যবান তরুণ দাসদের মূল্য হতো কুড়ি থেকে পঞ্চাশ টাকা। অভাব ও দুর্ভিক্ষ হলে বাজার দাসে ছেয়ে যেত এবং তখন দাম পড়ে যেত।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 48 ভারতীয় ক্রীতদাস শিকারীদের দ্বারা বন্দী একটি গুরানি পরিবার। জিন ব্যাপটিস্ট ডেব্রেটের আঁকা](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/Indian_Soldiers_from_the_Coritiba_Province_Escorting_Native_Prisoners.jpg)
আঠারো শতকের শেষের দিকে ইউরোপে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাস প্রথার অবলুপ্তি ঘটে। দাস প্রথাধীন শ্রমিক ব্যবস্থা শিল্পায়ন ও শিল্প-বিপ্লবোদ্ভূত মানবিক নব মূল্যবোধের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ প্রতীয়মান হয়। দাস শ্রমের চেয়েও মুক্ত শ্রম অবশ্যই অধিকতর উৎপাদনমূখী ছিল। শিল্পবিপ্লবহীন বাংলার অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা তখনও দাস শ্রম ও দাস শোষণ প্রথা আঁকড়ে ছিল। তাই, সহজে দাস শ্রমের বদলে মুক্ত শ্রমের প্রবর্তন সম্ভবপর হয় নি। দাস প্রথার সমর্থনে উপনিবেশিক শাসকগণের আর একটি যুক্তি ছিল যে, হিন্দু ও মুসলিম উভয় ধর্মে এর সমর্থন রয়েছে।
কিন্তু, ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে, উনিশ শতকের গোড়া থেকে, এবং গুরুতর ভাবে ১৮২০ সাল হতে, ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করে। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট দ্বারা যথাসম্ভব দ্রুত সব ধরনের দাস প্রথা অবলুপ্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে কলকাতার সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
![দাসপ্রথার ইতিহাস 49 ১৫৯০ সালের এই চিত্রটিতে একজন ভারতীয় রাজপুত্রকে ইথিওপিয়ান (হাবশি) বা পূর্ব আফ্রিকানদের (জাঙ্গিস) দেশে খাওয়া দেখানো হয়েছে।](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/04/2africa-938x1024.jpeg?v=1681651731)
ধাপে ধাপে দাস প্রথার অবলুপ্তির জন্য ১৮৪৩ এর ‘অ্যাক্ট ফাইভ’ প্রণীত হয়। এ আইনের আওতায় দাস রাখা অপরাধমূলক ছিল না, এতে কেবল মুক্ত ব্যক্তি ও দাসের মধ্যে আইনগত পার্থক্যের অবসান ঘটানো হয়েছিল। আইনে বিধান রাখা হলো যে, কোনো আদালত কোনো দাসের ওপর কারও দাবি গ্রাহ্য করবে না। এ আইন সব দাসদের মুক্ত বলে ঘোষণা করে নি। বরং আইনে বলা হলো যে, কোনো দাস ইচ্ছে করলে তার মালিককে পরিত্যাগ করে স্বাধীনভাবে বাস করতে পারবে। দাস আমদানি ও রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তবে, বাস্তবক্ষেত্রে দাসপ্রথা হঠাৎ করে থেমে যায় নি।
দাসপ্রথা সামাজিকভাবে ঘৃণ্য ও পরিত্যাজ্য বিবেচিত হতে আরও কয়েক দশক লেগে যায়। মুক্ত শ্রমের ব্যবহার বৃদ্ধি, শিল্পায়নে ক্রমিক অগ্রগতি, এবং উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ হতে মানবতাবাদী আন্দোলনসমূহ দাস প্রথাকে ধীরে ধীরে জনগণের নিকট অপ্রিয় ও সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা দাস প্রথা হতে মুক্ত হয়।