ল্যাংচা

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
4 মিনিটে পড়ুন

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতি নিয়ে সেই খোঁড়া লোকটাকে বন্দি করে‌ বর্ধমানে নিয়ে আসা হল। কারণ, নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের এক মেয়ের বিয়ে হয়েছিল বর্ধমান রাজার এক ছেলের সঙ্গে।

মেয়েটি যখন সন্তানসম্ভবা, তখন তাঁর পাতে রোজই নিত্যনতুন উপাদেয় খাবার দেওয়া হলেও দেখা যেতে লাগল, সেই খাবার তাঁর মুখে রুচছে না। যে খাবার কয়েক দিন আগেও তিনি চেটেপুটে খেতেন, সেই খাবারও মুখে তুলতে‌ তাঁর যেন‌ অনীহা। কিন্তু কিছুই না খেলে চলবে কী করে! তাই তাঁর শাশুড়ি, বর্ধমানের রানিমা নানান রকম উপাদেয় খাবার পরিপাটি করে সাজিয়ে তাঁর মুখের সামনে দিতে লাগলেন। কিন্তু পুত্রবধূটি কিছুই মুখে তুলতে চান না। বুঝিয়ে-সুঝিয়ে, অনুরোধ করে, এমনকী চোখ বড় বড় করে তাঁকে খাওয়ালেও,‌ তিনি সঙ্গে সঙ্গে তা বমি করে ফেলছেন।

ডাক্তার-কবিরাজ দেখিয়েও কোনও লাভ হল না। তাই একদিন শাশুড়িমা তাঁর বউমাকে বললেন, তুমি তো কিছুই খেতে পারছ না। আচ্ছা, বলো তো মা, তোমার এখন কী খেতে ইচ্ছে করছে?
লজ্জায় চোখ নামিয়ে কী একটু ভেবে নিয়ে‌ একদম নিচু স্বরে রাজবধূটি বললেন, ল্যাংচা।

Screenshot 20210601 213930 2 ল্যাংচা
ল্যাংচা 40

— ল্যাংচা? সেটা আবার কী? শাশুড়িমা একদম অবাক। কারণ, তিনি সমস্ত রকম ভাল ভাল খাবারই খেয়েছেন, কিন্তু এ রকম উদ্ভট নাম এর আগে তিনি কখনও শোনেননি। তাই রানিমা জানতে চাইলেন, সেটা আবার কী রকম খাবার?

বধূটি তখন লজ্জায় একশেষ। কিছুই আর বলতে চান না।

তাঁকে বারবার জিজ্ঞেস করা হল, তিনি ঠিক কী খেতে চাইছেন? তবু‌ তাঁর মুখে কোনও রা নেই। একদম নিশ্চুপ।

শাশুড়িমাকে না বললেও পর দিন সকালে সেই বধূটি তাঁর স্বামীকে বললেন, ‘ল্যাংচা’ কোনও খাবারের নাম নয়। তবে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের প্রাসাদে তিনি একদিন একটা মিষ্টি খেয়েছিলেন। সেই মিষ্টির নামটা তাঁর মনে নেই। তবে যে লোকটা সেই মিষ্টিটা বানিয়েছিলেন, তাঁকে তিনি দেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ল্যাংড়া। মানে তাঁর একটা পা ছিল খোঁড়া।

তাঁর তৈরি ঘিয়ে ভাজা সেই বিশেষ মিষ্টিটাই খাওয়ার সাধ জেগেছে তাঁর।

ছেলের কাছ থেকে সেই খবর শুনে রানিমা সেটা মহারাজকে জানাতেই নড়েচড়ে বসলেন বর্ধমানের রাজা।

সাধের পুত্রবধূর শখ বলে কথা! রাজার নির্দেশে তক্ষুনি এক বিশ্বস্ত কর্মচারীকে নদিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করা হল। সঙ্গে সঙ্গে রাজার জরুরি পত্র নিয়ে ঘোড়া ছোটালেন সেই রাজ কর্মচারী।

Screenshot 20210601 213924 2 1 ল্যাংচা
ল্যাংচা 41

অনেক খোঁজ করে করে অবশেষে পাওয়া গেল সেই খোঁড়া লোকটিকে। জানা গেল, এই লোকটাই সে দিনের সেই মিষ্টিটা বানিয়েছিলেন। তাই রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমতি নিয়েই তাঁকে নিয়ে আসা হল বর্ধমানে।

বর্ধমানের মহারাজ তাঁর মিষ্টি খেয়ে এতটাই আপ্লুত হয়েছিলেন এবং সেই মিষ্টি খাওয়ার সময় পুত্রবধূর মুখে এতটাই তৃপ্তি দেখেছিলেন যে, সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেই খোঁড়া লোকটিকে বর্ধমানের পূর্বে, চার ক্রোশ দূরে বড়শুল গ্রামে অনেকখানি ভূসম্পত্তি দান করলেন। শুধু জমিই দান করলেন না, ঘরও বানিয়ে দিলেন। তাঁর দোকান গড়ে উঠল বাদশাহী সড়কের উপর শক্তিগড় গ্রামে।

প্রত্যেক দিন তাঁর ভিয়েন থেকে এক মণ করে সেই বিচিত্র মিষ্টি সরবরাহ হত বর্ধমান রাজপ্রাসাদে।

যেহেতু পুত্রবধূ ‘ল্যাংচা’ বলেছিলেন, তাই ময়দা, ছানা, খোয়া আর চিনি দিয়ে ‌বানানো ল্যাংড়া ময়রার সেই কালচে বাদামি রঙের মিষ্টিটার নাম হয়ে গেল ল্যাংচা। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল ল্যাংচার নাম।

রাজপরিবারের পছন্দ এই মিষ্টিটি খেতে কেমন? প্রজাদের মধ্যে সাড়া পড়ে গেল। ভিড় উপচে পড়ল সেই দোকানে। চাহিদা বাড়তে লাগল দিনকে দিন। ‌কিন্তু তাঁর একার পক্ষে সেই চাহিদা সামাল দেওয়া সম্ভব ছিল না। তাই তাঁর দেখাদেখি তাঁর আশেপাশে একের পর এক ‌গজিয়ে উঠতে লাগল আরও অনেক ল্যাংচার দোকান।

আজ শক্তিগড়ের দু’নম্বর জাতীয় সড়কের দু’ধারের সার সার ল্যাংচার দোকানগুলোর‌ এতটাই খ্যাতি যে, ওখান থেকে কোনও বাস বা গাড়ি যাওয়ার সময় অন্তত কিছুক্ষণের জন্য হলেও, দাঁড়াবেই। শুধুমাত্র ল্যাংচার জন্য নয়, ল্যাংচার পাশাপাশি সীতাভোগ, মিহিদানা এবং ছানাপোড়ার জন্য।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

বিষয়:
এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!