সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের মহান শিক্ষা দিবস আজ

ড. বাহাউদ্দিন গোলাপ
ড. বাহাউদ্দিন গোলাপ
7 মিনিটে পড়ুন

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ১৭ সেপ্টেম্বর একটি অনন্য দিন। আত্মদানে গৌরবোজ্জ্বল এই দিনটি বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। কেবল শিক্ষার দাবিতে এমন রক্তক্ষয়ী এবং বিপুল আন্দোলন এ দেশে আর কখনও হয়নি। ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে দিনটি।

১৯৬২ সালটি ছিল আন্দোলনমুখর এক অগ্নিগর্ভ বছর। ১৯৬১ সালের ডিসেম্বর মাসেই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত গোপন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ ও খোকা রায়-এর মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে আইউব খাঁর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত হয়। কথা ছিল ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসেই আন্দোলনের সূচনা হবে।কিন্তু ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি পাকিস্তানের এককালের প্রধানমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের কর্ণধার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচিতে গ্রেফতার করে আইউবের পুলিশ

সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের পরিপ্রেক্ষিতে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি ও চার বছরের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ আন্দোলনের সূচনা করে। আন্দোলনের মূল সংগঠক ছিল ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন। ফেব্রুয়ারিতে শুরু হয়ে তীব্র দমন নীতির মধ্যেও এই আন্দোলন মার্চ মাস পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। মাঝে দমন-পীড়নের জন্য কিছুটা স্তিমিত হলেও এপ্রিল থেকে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র ইস্যুতে আবার ছাত্রসমাজ মাঠে নামে।

এসব আন্দোলনের ফলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ‘ফিল্ড মার্শাল’ আইউব খান পিছু হটতে বাধ্য হন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন পাকিস্তানে ৪৪ মাস স্থায়ী সামরিক আইন প্রত্যাহার হয়। এই পটভূমিতে ১৯৬২ সালের আগস্ট মাস থেকে ছাত্রসমাজ আবার ‘শরীফ শিক্ষা কমিশন’-এর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল ঢাকা কলেজে। এটিই একমাত্র ছাত্র আন্দোলন, যা ছাত্র সংগঠনগুলোর পূর্ব পরিকল্পনা, তাদের উদ্যোগে বা তাদের নেতৃত্বে শুরু হয় নি। সরকার শরীফ কমিশন বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণের, বিশেষত তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স চালু এবং উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে অতিরিক্ত ইংরেজি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে প্রথমে ঢাকা কলেজের, পরে দেশের বিভিন্ন অংশের কলেজ-ছাত্ররা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সভা-সমাবেশ, প্রতিবাদী মিছিল ইত্যাদি করতে থাকে। বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের ধারণা ছিল, কেবল শিক্ষার ইস্যুতে বড় কোনো আন্দোলনে ছাত্রসমাজের সাড়া পাওয়া যাবে না। অতীতে জাতীয় রাজনৈতিক ইস্যুর সাথে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া জুড়ে দিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলার অভিজ্ঞতাকেই তারা প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কিন্তু সাধারণ ছাত্ররা তাদের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে। আন্দোলনরত ছাত্রদের মধ্যে প্রথমে ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে এবং পরে ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে দলমতের ঊর্ধ্বে সাধারণ ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম গড়ে ওঠে। প্রথমে কলেজ-ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৫ আগস্ট থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় ছাত্র সমাবেশের ভেতর দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে।

ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ আন্দোলনের বিস্তৃতি এবং তীব্রতা উপলব্ধি করে শিক্ষার দাবিতেই এই আন্দোলনকে আরও সুসংগঠিত এবং কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অধীনে আনার জন্য ঐকমত্যে পৌঁছান। এবার তাদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’।

ছাত্রসমাজ বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্তভাবে তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স বাতিল বা ইংরেজির বোঝা কমানোর মতো দাবি রেখেই মূল দাবি হিসেবে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিটিকে সামনে আনেন।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর আইউব খাঁ শিক্ষা সংস্কারের লক্ষ্যে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এককালের শিক্ষক এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব এসএম শরিফকে চেয়ারম্যান করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের ২৬ আগস্ট তার অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন। দীর্ঘদিন পর ১৯৬২ সালে চূড়ান্ত রিপোর্ট ছাপিয়ে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করা হয়।

সম্পূর্ণ গণবিরোধী এবং প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের এই রিপোর্ট কেবল শিক্ষা সংকোচনের দলিলই ছিল না, এই রিপোর্টের অনেক সুপারিশ বাংলা ভাষা এবং বাঙালি জাতিসত্তার মর্মমূলে আঘাত হেনেছিল। রিপোর্টের মূল কয়েকটি সুপারিশ ও অভিমতের মধ্যে ছিল-
– শিক্ষা নাগরিকের জন্মগত অধিকার নয়। শিক্ষা একটি উত্তম ব্যয়বহুল বিনিয়োগ।
– অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা অবাস্তব এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়।
– ষষ্ঠ থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক।
– ডিগ্রি কোর্স হবে তিন বছর মেয়াদি।
– সমগ্র পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের বোধগম্যতার জন্য উর্দুকে জনগণের ভাষায় পরিণত করা। কোরআনের ভাষা আরবি লিপিতে উর্দুর মতো বাংলাও লেখা যেতে পারে। তবে চূড়ান্ত সুপারিশে বলা হয়, বাংলা ও উর্দু লিপি সংস্কার করে রোমান হরফে বাংলা এবং উর্দু লেখা।

শরীফ কমিশনের এসব গণবিরোধী এবং চরম প্রতিক্রিয়াশীল সুপারিশ বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এবং শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের মধ্যে তীব্র ঘৃণার সঞ্চার করে। ছাত্রসমাজ শরীফ কমিশন বাতিলের দাবি উত্থাপন করলে তা সামগ্রিকভাবে জনগণের বিপুল সমর্থন পায়। আন্দোলন সংগঠিত ও মিলিটেন্ট রূপ নেয়।

১৫ আগস্ট থেকে আন্দোলনে বাঁধ ভাঙা জোয়ারের সৃষ্টি হয়। একের পর এক ধর্মঘট সমাবেশের কর্মসূচি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেমন অচলাবস্থার সৃষ্টি করে, তেমনি ক্রমেই এই আন্দোলনের শ্রমজীবী ও পেশাজীবী বিভিন্ন স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ, আন্দোলনটিকে ‘গণ-আন্দোলনে’ রূপান্তরিত করে। ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে অবস্থানের ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১০ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচি বাতিলর করে। তবে তার পরিবর্তে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে।১০ সেপ্টেম্বর সরকার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। সরকারের প্রত্যাশা ছিল সোহরাওয়ার্দী মুক্ত হলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়বে। কিন্তু এই আশা-দুরাশায় পরিণত হয়।

১৭ সেপ্টেম্বর সারাদেশে অভূতপূর্ব হরতাল ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। রাজপথে নেমে আসে রাজধানী ঢাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পুলিশকে সহায়তা করার জন্য ইপিআর ও সেনাবাহিনী নামায়। ছাত্র-জনতার বিশাল জঙ্গি মিছিল হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গণি রোডে (সচিবালয়ের কাছে) প্রবেশ করতেই মিছিলের ওপর নির্বিচার গুলিবর্ষণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে তাৎক্ষণিকভাবে নিহত হন বাবুল এবং বাস কন্ডাক্টর মোস্তফা। গৃহভৃত্য ওয়াজিউল্লাহ গুরুতর আহত হয় এবং সে ১৮ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। ১৭ সেপ্টেম্বর কার্যত ছাত্রসমাজের অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। ঐ দিনের বিক্ষোভ মিছিলে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরের সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণই প্রধান হয়ে ওঠে।

১৭ সেপ্টেম্বরের হত্যাকান্ডের বিরুদ্ধে প্রচন্ড দমন-পীড়ন ও প্রতিকূলতার মধ্যেও ছাত্রসমাজ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। একপর্যায়ে সরকার নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ছাত্রসমাজ ও আন্দোলনকারী জনগণের পক্ষে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর গোলাম ফারুকের সাথে আলোচনায় বসেন। ২৪ সেপ্টেম্বর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বপ্রথম পল্টন ময়দানে জনসভা আহ্বান করে। ঐ জনসভা থেকে সরকারের প্রতি ‘চরমপত্র’ দেওয়া হয়।ইতোমধ্যে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে গভর্নর গোলাম ফারুকের কয়েক দফা বৈঠক হয়। ছাত্রসমাজের এই ‘চরমপত্র’ দেওয়ার তিন দিন পর, সরকার শরীফ কমিশন রিপোর্ট স্থগিত ঘোষণা করে। ডিগ্রি কোর্সের ছাত্রদের, যাদের দুই বছর অতিক্রান্ত হয়েছিল এবং তৃতীয় বর্ষে উঠেছিল তাদের বিনা পরীক্ষায় সবাইকে পাস ঘোষণা করা হয়। গ্রেফতারকৃত ছাত্রদের মুক্তি দেওয়া হয়।

অবশেষে বিজয়ের ভেতর দিয়ে বাষট্টির গৌরবোজ্জ্বল ছাত্র আন্দোলনের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে। ১৯৬৩ সাল থেকে ছাত্রসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর দিনটিকে প্রতিবছর ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে। পূর্বে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে এই রক্তঝড়া দিবসটি পালিত হতো। নতুন প্রজন্মের কাছে দিনে দিনে বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাচ্ছে সংগ্রাম ও ঐতিহ্যের গৌরবমাখা মহান শিক্ষা দিবস। দায় এড়ানোর সুযোগ নেই আমাদের।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
বাহাউদ্দিন গোলাপ ডেপুটি রেজিস্ট্রার বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!