নক্ষত্র শিক্ষক
আজ শিক্ষক দিবস। আজকের এই দিনে আমি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আমার সকল শিক্ষককে। আমার জীবনে যাদের শিক্ষক হিসেবে পেয়েছি তাদের সকলেই স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হলেও কয়েকজন স্যার ছিলেন উজ্জ্বল নক্ষত্র। আজ সেই নক্ষত্রদের কয়েকজনের কথা বলবো।
এই মুহূর্তে মনে পড়ছে সামাদ স্যারের কথা। বিভিন্ন ক্লাসে স্যার আমাদেরকে নানা বিষয় পড়িয়েছেন। সম্ভবত ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে তিনি আমাদের কিছুদিন কৃষি বিজ্ঞান পড়িয়েছেন, আবার কখনো তিনি আমাদেরকে অনিয়মিতভাবে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রও পড়িয়েছেন। কখনো আবার তিনি অন্য শিক্ষকের অনুপস্থিতিজনিত ক্লাস নিয়েছেন। অষ্টম বা নবম শ্রেণিতে তিনি আমাদের অঙ্কন বিষয়ের শিক্ষক ছিলেন।
খুব বিনয়ী, সদালাপী ও অমায়িক ব্যবহারের এই ভদ্রলোকটিকে আমি কখনো কোনো ছাত্রের সাথে রূঢ় আচরণ করতে দেখিনি। স্কুলে আসতেন একটা সাইকেলে চেপে। বেশিরভাগ দিন তার গায়ে থাকতো হালকা রঙের হাফ হাতা শার্ট। মনে পড়ে, একবার অঙ্কন ক্লাসে আমি একটি দৃশ্য আঁকছিলাম – একটা গাছ, গাছের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদী, নদীতে নৌকা, আকাশে সূর্য ও পাখি, নদীর পাড় ঘেঁষে ছিল ধানক্ষেত। এরকম ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েরা টিপিক্যালি যা ভাবে আর কি! স্যার আমার ছবিটা অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করে জিজ্ঞেস করলেন, কিসের ছবি আঁকছি আমি। যে গাছটা আমি আঁকছিলাম, সেটি দেখে উনি বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, “ওহ এটা গাছ! আমি ভেবেছিলাম, এটি মাগুরা মাইক্রোওয়েভ স্টেশনের ওয়্যারলেস টাওয়ার।”
খুব লজ্জা পেয়ে বুঝেছিলাম গাছটা গাছ হচ্ছে না আর যাই হোক। কিন্তু আমার করার কিছু ছিল না। স্কুলে অঙ্কনের কোনো শিক্ষক ছিল না। বেশিরভাগ দিন অঙ্কন ক্লাস হতোই না। আর হলেও যে স্যারের যখন সুযোগ হতো সেই স্যার তখন এসে কিছু একটা আঁকতে দিতেন। অঙ্কন শিক্ষকের তালিকায় পানু স্যার, রউফ স্যার, সামাদ স্যার ছিলেন। জানি না এখন স্কুলসমুহে অংকনের জন্যে ডেজিগনেটেড কোনো শিক্ষক আছেন কি না। তবে থাকা খুবই উচিত। কোনো কিছু না শিখিয়ে সে বিষয়ে পরীক্ষা নেয়াটা অনৈতিক। তাছাড়া স্কুলের ভাবভঙ্গিই বলে দিত এটি অপ্রয়োজনীয় একটি বিষয়। কিন্তু অঙ্কন চর্চা করাটা কোনো মতেই হেলা-ফেলা করার বিষয় নয়। এটি শিক্ষার্থীর কল্পনাশক্তি দারুণভাবে জাগিয়ে তুলতে, তার আবেগীয় ক্ষেত্রকে প্রভাবিত করতে সাহায্য করে।
একই অবস্থা সংগীতের বেলাতেও প্রযোজ্য। স্কুলগুলিতে সংগীতের একজন শিক্ষক থাকা খুব জরুরি। সঙ্গীত-দক্ষতা হাওয়ার্ড গার্ডনারের মাল্টিপল ইন্টেলিজেন্স এর একটি। কিন্তু সেটিও আমরা খুব অবহেলা করি। এটিও আমাদের আবেগীয় ক্ষেত্রকে খুব প্রভাবিত করে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এগুলিকে প্রাতিষ্ঠানিক চর্চার অন্তর্গত করতে পারিনি। ভাষা শিক্ষা, গণিত শিক্ষা, জীববিদ্যা বা ব্যবসায় শিক্ষার মতো এটিও যদি আমাদের বিদ্যালয়ে চর্চার অনুষঙ্গ হতো তবে শিক্ষা এতো ম্যাকানাইজড হতো না। মস্তিষ্কের কোষে কোষে যা ভরে দিচ্ছি আমরা তার সাথে কিছু রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, পঞ্চকবির গান, দেশাত্মবোধক বা মাটির গান শিখে যদি ছেলেমেয়েরা বড় হতো তবে তাদের দেশপ্রেম, মানবিকতা, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পেত, শিক্ষার্থীরা আরো বেশি চর্চিত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতো।
স্কুলে আমাদের আরেকজন জনপ্রিয় শিক্ষক ছিলেন – জনাব আব্দুল মালেক স্যার, যার ছবি এখানে ব্যাবহার করা হয়েছে। দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ মানুষ। সবার ভিতরে থেকেও অনন্য। মাগুরার আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতেন সাধারণ্যে কিন্তু স্কুলের কোনো অনুষ্ঠানে তাঁকে কিছু বলতে অনুরোধ করলে তিনি কথা বলতেন একদম খাঁটি শান্তিপুরী বাংলায়। স্যার অবশ্য ওই বঙ্গ থেকেই অভিবাসী হয়ে এদেশে এসেছিলেন। ইংরেজি ভাষাতে বিশেষ করে ইংলিশ গ্রামারে তার দখল ছিল মুগ্ধ করার মতো। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই আমলে ইংরেজিতে সম্মান ডিগ্রী সম্পন্ন করে শিক্ষকতায় ঢুকেছিলেন।
স্যারের বিশেষ বৈশিষ্ট্যের মাঝে একটা ছিল স্বল্পভাষীতা। তাঁকে সব অনুষ্ঠানেই কিছু না কিছু বলতে অনুরোধ করা হতো, কিন্তু কোনো দিন দেখিনি স্যার পাঁচ মিনিটের বেশি বক্তৃতা দিয়েছেন। হাসি হাসি মুখে পাঁচ মিনিটেরও কম সময়ে বক্তৃতা শেষ করতেন। আর সেজন্যেই হয়তো আমরা তাঁর বক্তৃতা শোনার জন্যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। স্যারের আরেকটা বিষয় আমাদের খুব আকর্ষণ করতো – সেটা হলো সবার ভিতরে অবস্থান করেও সবার থেকে আলাদা হতে পারা। সবার সাথে খুব সাধারণভাবে মিশতেন। এতো ভালো ও গুণী শিক্ষক কিন্তু তাঁর ভিতরে কোনো অহংকার বা সুপিরিওরিটি কমপ্লেক্স দেখিনি কখনো। শিক্ষকতার সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা শিক্ষক রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ততা, ক্ষমতার অলিন্দে থাকার বাসনা, ডমিনেট করার চেষ্টা তাঁকে ষ্পর্শ করেনি কখনো। একেবারেই ‘চির উন্নত মম শির’ এই বাক্যকে ধারণ করে চলেছেন সব সময়।
আমি স্যারের কাছে নবম শ্রেণিতে দু’মাস ও দশম শ্রেণিতে দু’মাস ইংরেজির তালিম নিয়েছি ব্যক্তিগতভাবে। স্যার বাড়ির বাইরে বৈঠকখানায় পড়াতেন। ইচ্ছে করলে স্কুলের সকল ছাত্রকেই পড়াতে পারতেন। কিন্তু স্যার তা পড়াতেন না। আমরা ৫/৬ জন স্যারের বৈঠকখানায় গিয়ে বসতাম, স্যার পড়াতেন শুনশান নিরবতার মাঝে। সামনে মাঠ আর বাঁশ বাগান। সারাদিনে ২/৩টি ব্যাচ, একেবারেই পাঠশালা নয়। মনে আছে স্যার একবার Charles Kingsley-এর The Sands of Dee কবিতার সারাংশ পড়া দিয়েছিলেন। আমি ঐ সারাংশটি কয়েকটা বই ঘেটেঘুটে যেখান থেকে যেটুকু ভালো লেগেছিল তা জোড়া লাগিয়ে পড়ে ফেললাম। স্যার যখন আমার লেখাটা পড়লেন, জিজ্ঞেস করলেন এটি আমি কোথা থেকে পেয়েছি বা কে আমাকে লিখে দিয়েছেন। আমার বাবার ইংরেজিতে ভালো দখল ছিল। তাই স্যার ধরেই নিলেন ওটা হয়তো বাবাই আমাকে লিখে দিয়েছেন। আমি সত্যি কথাটা স্যারকে বললে স্যার খুব প্রীত হন। আমাকে অনেক প্রশংসা করে অন্যান্য উত্তর এভাবেই যেন আমি নিজ থেকে তৈরি করি সেজন্যে আমাকে পরামর্শ দেন। দশম শ্রেণিতে তাঁর কাছে পড়ার শেষের দিন একটা কথা এভাবেই বলেছিলেন, “শোন, আমার বলার দরকার তাই বলতিছি – শোনা বা না শোনা তোর আর তোর বাড়ির ব্যাপার। ইন্টারমিডিয়েট পড়া শেষ হোলি ইংরেজিতে অনার্স পড়িস। ভালো করবি।” অনেক পরে আমি দ্বিতীয় বার মাস্টার্স করতে ইংল্যান্ড যাবার প্রাক্কালে স্যারের বাসায় যাই দেখা করতে। বললেন, “তুই তো এখন আমার থেকেও বড় মাস্টার। তবুও যে তুই আমার সাথে দেখা করতি আইছিস, আমি খুব খুশি হইছি। তা কোথায় যাচ্ছিস পড়তে?” বললাম। স্যার শুনে বললেন, “বিলেতে যাচ্ছিস যা, খুব ভালো খবর। মাগুরার কয়জন বিলেতে পড়তে গেছে ইংরেজিতে! তুই যাচ্ছিস – এটা গর্বের বিষয়। আমি খুশি। তবে আরো খুশি হতাম তুই যদি অক্সফোর্ডে পড়তে যেতিস।” আমার ইংরেজি পড়ার জন্যে এই মানুষটির অনুপ্রেরণা আমার বড় পাথেয় ছিল।
যেমনি গুণী শিক্ষক, তেমনি পরহেজগার। সহপাঠী বুলুর বড় ভাই থাকতো সৌদি আরবে। বুলু স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিল, “স্যার, আমার ভাই সৌদি আরব থেকে দেশে আসছে, আপনার জন্যে কী আনতে বলবো?” অনেক চাপাচাপির পর স্যারের উত্তর ছিলো – “তোর ভাইকে বলিস পারলে আমার জন্যে একটা টুপি আর তসবিহ নিয়ে আসে যেন কাবা শরীফে স্পর্শ করিয়ে।”
দশম শ্রেণিতে আমাদের ক্লাসের সময়ের সাথে স্যারের পড়ানোর সময় মিলছিলো না। অনেক জড়তা নিয়ে স্যারের কাছে নিবেদন করলাম, আমরা যে ৪/৫ জন স্যারের কাছে পড়তাম তারা যদি আমাদের বাসায় এক হই, তাহলে স্কুলে আসা-যাবার পথে স্যার একটু কষ্ট করে আসতে পারবেন কি না। স্যার মাথা চুলকে বললেন, “এটি আমি কখনো করি না। তবে এই ঝামেলাটা মেটানোও যাচ্ছে না। তোদের যদি এখন না পড়াই তাহলে বেশ ক’দিন দেরি করতে হবে, তোদের পরীক্ষা চলে আসছে। আমাকে সময় দে।” একটু ভেবে বলি। পরের দিন আমাকে ডেকে বললেন, “তোর বাবাকে বলিস, আমি তোদের বাসায় পড়াতে যাবো কিন্তু আমাকে যেন কোনো কিছু খাবার দাবার না দেয়া হয়। যাবো, পড়িয়ে চলে আসবো। ৪/৫ দিনের ব্যাপার। কিন্তু আমার শর্তটা মানতে হবে।” আমাদের বাসায় স্যারের কিছু খেতে না চাওয়ার মাঝে কোনো সাম্প্রদায়িক ভাবনা ছিল না যেমনটি এখন অনেকেরই থাকে। কিন্তু ছাত্রের বাসায় গিয়ে পড়িয়ে সেখান থেকে কিছু খাবেন – সেটা এড়িয়ে গিয়েছিলেন সচেতনভাবে।
আমি আর আমার মতো অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী স্যারকে মনে মনে প্রণাম করে চলেছি অবিরাম শুধু তাঁর অসাধারণ ব্যাক্তিত্ব আর পাণ্ডিত্যের জন্যে। এরকম শিক্ষকের জন্যেই বোধকরি বলা হয় শিক্ষক তাঁর ছাত্রের কাছে এক রোল মডেল। স্যারকে নিয়ে আগামি পর্বগুলিতে আরও লেখার বাসনা রইলো।
এই দুজন স্যারই পরলোকগমন করেছেন। ঈশ্বরের কাছে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। পরপারে ভাল থাকুন তাঁরা। সেখানেও যদি আমাদের মতো কোনো ছাত্র-মাত্র পেয়ে যান, নিশ্চয় তারা এঁদের সান্নিধ্যে আলোকিতই হবে।