স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

রঞ্জনা রায়
7 মিনিটে পড়ুন
সুকান্ত ভট্টাচার্য

স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

02C30A8D F630 4C4C 8CBA E662A1516C46 স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

আমরা সিঁড়ি
তোমরা আমাদের মাড়িয়ে
প্রতিদিন অনেক উঁচুতে উঠে যাও,
তারপর ফিরেও তাকাও না পিছনের দিকে; তোমাদের পদধূলি ধন্য আমাদের বুক
পদাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় প্রতিদিন। -সিঁড়ি, ছাড়পত্র

বাংলা সাহিত্যে মার্কসবাদী চেতনার ভাবধারা তিনি বহন করেছেন এবং তার মধ্যে ছিল একটি প্রগতিশীল চেতনার স্ফূরণ। কবির জন্ম হয় ১৯২৬ সালের ১৫ আগস্টকলকাতায় কালীঘাট অঞ্চলের ৪৩ নম্বর মহিম হালদার স্ট্রিটের বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। এটি ছিল তার মাতামহের বাড়ি।কবির বাবার নাম ছিল নিবারণ ভট্টাচার্য এবং মা ছিলেন সুনীতি দেবী। আর্থিকভাবে দুর্বল পরিবারেই কবির জন্ম হয়েছিল।

কবির পৈতৃক বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলার অন্তর্গত ঊনশিয়া গ্রামে। বেলেঘাটা দেশবন্ধু স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে অকৃতকার্য হন। এই সময় প্রত্যক্ষভাবে বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং তার লেখাপড়ার পরিসমাপ্তি ঘটে। সুকান্তের বাল্যবন্ধু ছিলেন কবি অরুণাচল বসু ।সুকান্ত সমগ্রতে লেখা সুকান্তের চিঠিগুলির বেশিরভাগই অরুণাচল বসুকে লেখা।অরুণাচল বসুর মা কবি সরলা বসু সুকান্তকে পুত্রের মত স্নেহ করতেন। কবির জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছিল কলকাতার বেলেঘাটায় ৩৪ নম্বর হরমোহন ঘোষ লেনের বাড়িতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কবি সুকান্তের সম্পর্কিত ভাইপো ছিলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, ফ্যাসিবাদী আগ্রসন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রভৃতির বিরুদ্ধে তিনি কলম ধরেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন। সেই বছর “আকাল” নামে একটি কাব্য সংকলন গ্রন্থ তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়।কৈশোর থেকেই সুকান্ত যুক্ত হয়েছিলেন সাম্যবাদী রাজনীতির সঙ্গে, পরাধীন দেশের দুঃখ-দুর্দশা জনিত বেদনা ও শোষণমুক্ত স্বাধীন সমাজের স্বপ্ন, শোষিত মানুষের কর্ম জীবন এবং ভবিষ্যত পৃথিবীর জন্য সংগ্রাম তার কবিতার মূল প্রেরণা। ১৯৪১ সালে কলকাতা রেডিওর গল্প দাদুর আসর এ যোগদান করেন। সেখানে তিনি প্রথম রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করেন।

- বিজ্ঞাপন -

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর সেই আসরেই নিজের লেখা কবিতা পাঠ করে তাকে শ্রদ্ধা জানান। গল্প দাদুর আসরের জন্য সেই বয়সেই তিনি গান লিখেছিলেন এবং সেই গান সুর দিয়ে গেয়েছিলেন সেকালের অন্যতম সেরা গায়ক পঙ্কজ মল্লিক। সুকান্তকে আমরা কবি হিসেবেই জানি কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যেমন কেবল কবি ছিলেন না ।তেমনি সুকান্ত ওই বয়সেই লিখেছিলেন কবিতা, ছড়া, গান, গল্প, নাটক এবং প্রবন্ধ ।তার ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধটি পাঠ করলে বেশ বোঝা যায় ওই বয়সেই তিনি বাংলা ছন্দের প্রায়োগিক দিকটি শুধু আয়ত্তেই আনেনি ভালো তাত্ত্বিক দক্ষতাও অর্জন করেছিলেন।

আট-নয় বছর থেকেই সুকান্ত লিখতে শুরু করেন। স্কুলের হাতে লেখা পত্রিকা ‘সঞ্চয়’এ একটি হাসির গল্প লিখে তিনি প্রথম আত্মপ্রকাশ করেন। তার দিন কয়েক পরে বিজন গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘শিখা’ কাগজে প্রথম ছাপার মুখ দেখে তার লেখা বিবেকানন্দের জীবনী। মাত্র ১১ বছর বয়সে ‘রাখাল ছেলে’ নামে একটি গীতিনাট্য রচনা করেন। এটি পরে ‘হরতাল’ বইতে সংকলিত হয়। বলে রাখা ভাল তিনি স্কুলে পড়ার সময় ‘ধ্রুব’ নাটিকার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাল্যবন্ধু অরুণাচল বসুর সঙ্গে মিলে আরেকটি হাতে লেখা কাগজ ‘সপ্তমিকা’ সম্পাদনা করেন।

স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এক অগ্নিময় কবি পুরুষ। তার কবিতার ভুবন বিদ্রোহের আগুনে ঝলসানো। মানুষের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তার কন্ঠ ছিল উচ্চকিত। অবহেলিত মানুষের অধিকার আদায়ের স্বার্থে অত্যাচারের বিরুদ্ধে নজরুলের মতো তিনিও ছিলেন সক্রিয়। যাবতীয় শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে ছিল সুকান্তের দৃঢ় অবস্থান। মার্কসীয় ভাবধারায় বিশ্বাসী কবি দূর করতে চেয়েছেন শ্রেণীবৈষম্য।মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন। বিদ্রোহের ডাক তার কবিতায়-

“বেজে উঠল কি সময়ের ঘড়ি?
এসো তবে আজ বিদ্রোহ করি
আমরা সবাই যে যার প্রহরী
উঠুক ডাক
উঠুক তুফান মাটিতে পাহাড়ে
জ্বলুক আগুন গরিবের হাড়ে
কোটি করাঘাত পৌঁছোক দ্বারে
ভীরুরা থাক ।
মানবো না বাধা মানবো না ক্ষতি
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি।
কবিতা – বিদ্রোহের গান, কাব্যগ্রন্থ – ঘুম নেই

মানবিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বাংলা কাব্য ধারার প্রচলিত প্রেক্ষাপটকে আমূল বদলে দিতে পেরেছিলেন। তার কবিতা, গান, নাটক সব রচনার ছন্দে ছন্দে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ। রচনাবলীর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ – ছাড়পত্র, ঘুম নেই, পূর্বাভাস ,ছড়ার বই মিঠে কড়া, দুইটি নাটক সংকলন, অভিযান হরতাল গল্পের বই, গীতিগুচ্ছ গানের বই ইত্যাদি। তার জীবদ্দশায় কোন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়নি। কবি সুকান্ত তার বয়সের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করেছিলেন। সংগ্রামী চিন্তাধারার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন তার অবিস্মরণীয় সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে। প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী কন্ঠে বলেছেন

- বিজ্ঞাপন -

……ডাক ওঠে যুদ্ধের।
গুলি বেঁধে বুকে উদ্ধত তবু মাথা
হাতে হাতে ফেরে দেনা-পাওনার খাতা,
শোন হুঙ্কার কোটি অবরুদ্ধের।
দুর্ভিক্ষকে তাড়াও ,ওদেরও তাড়াও
সন্ধিপত্র মাড়াও, দুপায়ে মাড়াও। – ডাক, ছাড়পত্র
অথবা
আদিম হিংস্র মানবিকতার আমি যদি কেউ হই
স্বজন হারানো শ্মশানে তোদের
চিতা আমি তুলবোই। – কাব্যগ্রন্থ- ছাড়পত্র

চলছে তেভাগা আন্দোলন,ঘটছে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা, দেশবিভাগের ধাক্কায় মানচিত্র কাঁপছে। মানুষ অসহায়, সমাজ ভাঙছে। এই ভাঙা-গড়ার মধ্যে কবির হৃদয় স্থির থাকতে পারেনি এক মুহূর্ত। তাই কবিতায় লিখে যান তিনি বিপ্লবের রক্তমাখা ইতিহাস

বিদ্রোহী মন! আজকে ক’রো না মানা,
দেব প্রেম আর পাব কলসীর কাণা,
দেবো, প্রাণ দেব মুক্তির কোলাহলে,
জীন ডার্ক, যীশু, সোক্রোটিসের দলে
কুয়াশা কাটেছে, কাটবে আজ কি কাল
ধুয়ে ধুয়ে যাবে কুৎসার জঞ্জাল ।
ততদিন প্রাণ দেব শত্রুর হাতে
মুক্তির ফুল ফুটবে সে সংঘাতে
ইতিহাস! নেই অমরত্বের লোভ
আজ রেখে যাই আজকের বিক্ষোভ। -(বিক্ষোভ, ঘুম নেই)

- বিজ্ঞাপন -
80507183 9024 4B10 A140 ED555865D2B2 স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য
স্বাধীনতা দিবসের আলোয় কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য

তিনি চেয়েছিলেন সমাজ-সংসারে আমূল পরিবর্তন
“চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।”

১৯৪৭ সালের ১৩ই মে মাত্র একুশ বছর বয়সে মারা যান। তাই পৃথিবীর বুকে ভাবীকালের জন্য তিনি তারুণ্যের জয়গান করে গেছেন। ‘আঠারো বছর বয়স’ কবিতায় কবি বলেছেন –
এ বয়স জেনো ভীরু কাপুরুষ নয়
পথ চলতে এ বয়স যায় না থেমে ,
এ বয়সে তাই নেই কোনো সংশয়
এদেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে। -ছাড়পত্র

সুকান্তের কবিতা সব ধরনের বাধা বিপত্তিকে জয় করতে শেখায়। যাপিত জীবনের দুঃখ যন্ত্রণাকে সহ্য করার অনমনীয় শক্তি সুকান্তের কবিতায় পাওয়া যায়। রবীন্দ্রযুগের পর বাংলা কবিতার বৈপ্লবিক ভাবধারাটি যাদের সৃষ্টিশীল রচনা সমৃদ্ধ করেছে সুকান্ত তাদের মধ্যে অন্যতম।

আজ স্বাধীনতা দিবসের দিন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের প্রতি রইল আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার অন্তর্গত কোতাইগড়--- তুর্কা এস্টেটের জমিদার বংশের সন্তান রঞ্জনা রায়। জন্ম, পড়াশুনা ও বসবাস উত্তর কলকাতায়। বেথুন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ৩০শে মে রঞ্জনা রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম স্বর্গীয় জগত কুমার পাল, মাতা স্বর্গীয় গীতা রানি পাল। স্বামী শ্রী সন্দীপ কুমার রায় কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের আইনজীবী ছিলেন। রঞ্জনা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছেন সাহিত্যপ্রীতি। তাঁর প্রপিতামহ স্বর্গীয় চৌধুরী রাধাগোবিন্দ পাল অষ্টাদশ দশকের শেষভাগে 'কুরু-কলঙ্ক’ এবং 'সমুদ্র-মন্থন’ নামে দু'টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করে বিদ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ইতিপূর্বে রঞ্জনা রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'এই স্বচ্ছ পর্যটন’ প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ট্রিগারে ঠেকানো এক নির্দয় আঙুল' সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রভূত প্রশংসা পেয়েছে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'নিরালা মানবী ঘর' (কমলিনী প্রকাশন) ও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'ইচ্ছে ঘুড়ির স্বপ্ন উড়ান' (কমলিনী প্রকাশন) দে’জ পাবলিশিংয়ের পরিবেশনায় প্রকাশিত। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় কবির কবিতা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
মন্তব্য নেই

Log In

Forgot password?

Don't have an account? Register

Forgot password?

Enter your account data and we will send you a link to reset your password.

Your password reset link appears to be invalid or expired.

Log in

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!