বর্তমান সময়ে মানসিক চিকিৎসা জগতে ‛কাউন্সেলিং’ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত মানসিক অসুস্থতার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু অনেকক্ষেত্রে বড়দের পাশাপাশি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের নানান মানসিক সমস্যাগুলি ‛কথার’ মাধ্যমে সমাধান করা হয়। এই কথার মাধ্যমে মানসিক সমস্যার সমাধান করার উপায়কে বলা হয় চিকিৎসার পরিভাষায় ‛সাইকোথেরাপি’। ‛কাউন্সেলিং’ হল এক বিশেষ ধরনের সাইকোথেরাপি। তবে কিন্তু কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি এক বিষয় নয়। এদের মধ্যে অল্পবিস্তর কিছু পার্থক্য রয়েছে। সাধারণভাবে কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপি এর মধ্যে মুখ্য যে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় তাহল- মানসিক সমস্যার প্রাথমিক চিকিৎসা হল কাউন্সেলিং। অর্থাৎ কেউ যদি মানসিক দিক থেকে হালকাভাবে অসুস্থ হয় তখন তাকে কাউন্সেলিং করা হয়। অপরদিকে মানসিক সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী চিকিৎসা হল সাইকোথেরাপি। অর্থাৎ কেউ যদি মানসিক দিক থেকে গভীর বা গুরুতরভাবে অসুস্থ হয় তখন তাকে সাইকোথেরাপি করা হয়ে থাকে।
এবার আমাদেরকে জানতে হবে ‘কাউন্সেলিং’ বিষয়টি আসলে কী? এর উত্তরে বলা যায়, কাউন্সেলিং হল মূলত মানসিক সমস্যা সমাধানের একটি চিকিৎসা পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে কথা বলার মধ্যে দিয়ে একজন কাউন্সেলর শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক সমস্যা সমাধান করে থাকে এবং শিশুর মানসিক বিকাশ ঘটিয়ে থাকে। এই প্রসঙ্গে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন এর সংজ্ঞা হল- ‛কাউন্সেলিং’ এমনই এক সহায়তা যা কোন একজনকে তার নিজের মানসিক বৃদ্ধির জন্যে সম্ভাব্য বাধাবিপত্তি উত্তীর্ণ হতে সাহায্য করে থাকে।
এই ‛কাউন্সেলিং’ শব্দটি রজার নাকে এক আমেরিকান মনোবিদ সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। তাঁর মতে কাউন্সেলিং হল ব্যক্তিকেন্দ্রিক অর্থাৎ যার সমস্যা, শুধুমাত্র তাকে কেন্দ্র করেই সমাধানের চেষ্টা করা হয়।
আমাদের সবার বাড়িতে শিশু ও কিশোর-কিশোরী রয়েছে। তাদেরও কিন্তু অনেক সময় বিশেষ সমস্যার জন্য কাউন্সেলিং করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। শিশুদের যেসকল সমস্যার জন্য কাউন্সেলিং করার প্রয়োজন হয় সেগুলো হল- শিশু অনেক সময় কোনও বিষয়ে নিজের মত বা ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করতে গিয়ে সমস্যায় বা দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। অর্থাৎ সে কী করবে, কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় প্রভৃতি বিষয়গুলি ঠিক করতে পারেনা এবং শিশু যখন তার নিজের পরিবেশ বুঝতে পারে না, শিশু দক্ষতা অর্জন করতে গিয়ে যখন বিভিন্ন মানসিক বাধার সম্মুখীন হয়, বাবা-মা কিংবা পরিবারের লোকজনদের সাথে ঠিকমতো ভাবে আচারব্যবহার, কথাবার্তা বলতে অসুবিধে হয়, পড়াশোনায় যখন মনোযোগ থাকে না বা পড়াশোনা মনে রাখতে পারে না, হাসি-আনন্দ থেকে যখন দূরে চলে যায়, গুরুজনদের সাথে যখন বিকৃত আচরণ করে এছাড়াও যদি কোন কিশোর-কিশোরী মাদক জাতীয় নেশার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে প্রভৃতি সমস্যাবলী। উপরিউক্ত সমস্যাগুলি যদি শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে দেখা যায় তাহলে তাদেরকে কাউন্সেলিং এর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। তখন তাদেরকে এক অভিজ্ঞ কাউন্সেলর এর কাছে নিয়ে যাওয়া দরকার হয়ে পড়ে।
প্রত্যেক অভিভাবকদেরকে সর্বদা নিজ সন্তানদেরকে পর্যবেক্ষণের আওতায় রাখা উচিত। অনেক বাবা-মা কাজের জন্য ছেলে-মেয়েদের প্রতি ঠিক সেইভাবে খেয়াল রাখতে সময় পায়না। উনাদেরকে বলব আপনারা ছেলে-মেয়েদেরকে সর্বদা নজরে রাখুন– অর্থাৎ সে কী করছে, আগে কিভাবে আচার-আচরণ করত, এখন কিভাবে আচার-আচরণ করে, পড়াশোনায় কতটা আগ্রহী বা মনোযোগ দেয় বা পড়াশোনা কতটা মনে রাখতে পারে, ছেলে-মেয়ে হাসিখুশিতে থাকছে কী না, অযথা হটাৎ চিন্তিত হয়ে পড়ছে কী না প্রভৃতি দিকগুলির উপর খেয়াল রাখুন। যদি উপরিউক্ত সমস্যাগুলি প্রায়ই লক্ষ্য করেন তাহলে তাদের সাথে একটু কথা বলুন, তাদেরকে একটু সময় দিন। তারা কী চায় সে বিষয়ে কথা বলুন। কারণ এই সমস্যাগুলি যদি প্রথম থেকেই না গুরুত্ব দেন তাহলে ধীরে ধীরে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের মানসিক বিকাশ ব্যাহত হবে। যার ফলে তাদের সামাজিকীকরণে (socialization) বাধা আসবে। ফলে তারা প্রকৃত শিক্ষিত মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না। এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখবেন শিশুদেরকে বেশি বকাবকি করবেন না। তাদেরকে যতটা সম্ভব বুঝিয়ে বলবেন। কার্লসন নামে এক মনোবিদ বলেছেন- ছোটোদের বুঝিয়ে বললে ভালো হয়। তাই প্রত্যেক বাবা-মাকে এক একজন প্রাথমিক কাউন্সেলর হয়ে উঠতে হবে।
আর যদি উক্ত এই সমস্যাগুলি ধীরে ধীরে বেড়ে চলে তাহলে অবশ্যই একজন অভিজ্ঞ কাউন্সেলরের কাছে নিয়ে যাবেন। একজন অভিজ্ঞ কাউন্সেলর একটি শিশুর চিন্তা (Thinking), অনুভব (Feeling), এবং ব্যবহার (Behaviour) ভালো করে বুঝতে পারে। তাই তিনি কাউন্সেলিং এর বিভিন্ন থিয়োরি (এনডোজেনাস থিয়োরি,এক্সোজেনাস থিয়োরি,কনসস্ট্রাকটিভ থিয়োরি) এবং থেরাপি (রিয়েলিটি থেরাপি, র্যাশনাল ইমোটিভ থেরাপি, পেরেন্ট কাউন্সেলিং, ব্যক্তিকেন্দ্রিক কাউন্সেলিং, গ্রুপ কাউন্সেলিং) এর সাহায্যে বিজ্ঞানসম্মতভাবে শিশুদেরকে কাউন্সেলিং করিয়ে থাকেন।
যার ফলে একজন শিশু মানসিক সমস্যাগুলো থেকে খুব দ্রুত বেরিয়ে আসতে পারে। তবে কোন কোন শিশুকে কাউন্সেলিং কম করাতে হয় আবার কোন কোন শিশুকে একাধিকবার কাউন্সেলিং করাতে হয়। অর্থাৎ যতদিন না পর্যন্ত শিশুটি তার মানসিক দুর্বলতাকে কাটিয়ে উঠতে না পারছে ততদিন পর্যন্ত তাকে কাউন্সেলিং করাতে হবে। আর একটি কথা প্রত্যেক বাবা-মাকে বলব, শিশুর পারিবারিক তথা সামাজিক পরিবেশকে সর্বদা ঠিক রাখতে হবে। শিশুর সামনে যেন কোনরূপ ঝগড়া-কলহ না করা হয়।শিশুদেরকে সর্বদা হাসিখুশিতে রাখতে হবে। মাঝে মাঝে তাকে শিশু উদ্যানে বেড়াতে নিয়ে যেতে হবে। তার ছোটো ছোটো চাহিদাগুলিকে পূরণ করতে হবে। তাকে সর্বদা পড়াশোনার জন্য বেশি চাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সম্ভব হলে শিশুকে প্রাতঃকালে উঠিয়ে মনসংযোগের বিভিন্ন ব্যায়াম ও যোগাসনগুলো করাতে হবে।
বিভিন্ন মহাপুরুষদের মোটিভেশনাল উক্তি শোনাতে হবে এছাড়াও শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সবুজ শাক-সবজি, প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি করে খাওয়াতে হবে। তাহলে ছেলে-মেয়েদের শারীরিক-মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক থাকবে।
যাইহোক কাউন্সেলিং চিকিৎসা পদ্ধতি শিশুর মানসিক বিকাশে খুবই উপকারী। তাই শিশুরা যদি কোনরূপ ভাবে মানসিক সমস্যায় ভোগে তাহলে তাকে অবশ্যই কাউন্সেলিং এর জন্য অভিজ্ঞ কাউন্সেলর এর কাছে নিয়ে যাবেন।
তথ্যসূত্র-
(১) মল্লিক, ড.অমরনাথ (২০১৯) ; শৈশব ও কৈশোরের কাউন্সেলিং, দীপ প্রকাশন, কলকাতা।পৃষ্ঠা-১০২
(২) তদ্বেব,পৃষ্ঠা-১০২
(৩)তদ্বেব,পৃষ্ঠা-১০৫-১১১
বৈদ্যুতিন তথ্যসূত্র-
১)শাহনেয়ওয়াজ,ফিরোজ (৯ জুন ২০১৮); শিশুর কাউন্সেলিং,রাইজিং বিডি, ঢাকা।