আলো অন্ধকারে যাই (পর্ব ১২)

গৌতম রায়
গৌতম রায়
9 মিনিটে পড়ুন

আমাদের ইংরেজি ভাষা শিক্ষা-২    

ইংরেজি ভাষা শিক্ষায় আমাদের ইতিহাসটি প্রায় দুশো বছরের পুরোনো। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের অবধারিত উপজাত হিসেবে এটি আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। ব্রিটিশ-রাজ টিকিয়ে রাখতে শুরুতে এদেশে একটি ইংরেজি জানা কেরানি শ্রেণি গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে ইংরেজি শিক্ষা শুরু হলেও ধীরে ধীরে এটি অভিজাতের ভাষা হিসেবে বেশ পাকাপোক্ত জায়গা করে নেয়।

গত দুশো বছর ধরে জীবনের নানা প্রান্তে অনেক পরিবর্তন ছুঁয়ে গিয়েছে আমাদের। কিন্তু এই দুশো বছরে আমাদের ইংরেজি শেখার আয়োজনটা খুব একটা পাল্টায়নি। ক্লাসে কোনোদিন বলা হয়নি তুমি তোমার ক্লাসরুমটিকে বর্ণনা করো, বা তোমার বাবা বা মা, বা ভাই, বা বোন এর বর্ণনা দাও; সত্যিকারের বর্ণনা। কোনো মানুষের personality type বর্ণনার শব্দগুলি আমাদের শেখানো হয়নি। শেখানো হয়নি চারপাশের নানা রঙ, মানুষের আবেগ, দৈহিক বর্ণনার ভাষাসমূহ – এগুলি short/tall, fat/thin, happy/unhappy, angry/polite এর বাইরে যায়নি কখনো। আচ্ছা, কারো গায়ের রং যদি বাদামি হয়, আমরা কি তাকে ব্ল্যাক বলবো? কারো চুল যদি কোচকানো হয় বা ঢেউ খেলানো – তাহলে কী ইংরেজি হবে? কোনো মানুষের একটি ভুড়ি থাকলে কীভাবে প্রকাশ করবো, আর টাক থাকলেই বা কী লিখবো, বা মাথায় হালকা চুল থাকলে কী লিখবো সেটি শেখানো হয়নি। এখনো হয় কি?

গত শতাব্দীর সত্তর ও আশির দশক জুড়ে আমরা যখন মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী তখন ইংলিশ গ্রামারের জন্যে যে বইগুলি বেশ প্রচলিত ছিল সেগুলি হলো, কলিমদাদ খানের ইংলিশ গ্রামার, এমাজ উদ্দিনের গ্রামার এন্ড কম্পোজিশন, পি কে দে সরকার-এর ইংলিশ গ্রামার এন্ড কম্পোজিশন। এর বাইরে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকেরা কিছু বিষয়ের ডেফিনিশন বাংলাতে বলে দিলে আমরা সেগুলি খাতায় নোট করে নিতাম। ব্ল্যাকবোর্ডে সেগুলির খুব ক্লিশে টাইপ কিছু উদাহরণ দেয়া হতো ইংরেজিতে। ক্লাসটি পুরোটাই বাংলাতে পরিচালিত হতো এবং এটি সেই সময় যখন আমাদের বয়ঃসন্ধিকাল চলছে। মানুষ সব থেকে ভালোভাবে ভাষা শেষে তার বয়ঃসন্ধিকালের পূর্বে। বয়ঃসন্ধিকাল থেকে হরমোনের পরিবর্তনের কারণে আমাদের শরীর ও মস্তিষ্কেও নানা পরিবর্তন আসে এবং মানুষ সাবলীলভাবে ভাষা শেখার দ্রুততা হারাতে থাকে।  

আমাদের যখন একটি বিদেশি ভাষা শেখার সুবর্ণ সময় পার হচ্ছিলো তখন আমরা বাংলা মাধ্যমে ইংরেজি শিখেছি। তার মানে আমরা আসলে বাংলাই শিখেছি। ইংরেজি ক্লাসে বাংলা ব্যবহার হয়েছে নব্বই শতাংশ বা তারও বেশি সময়। আর বাদবাকি সময় টুকটাক ইংরিজি, যা শিক্ষক বলেছেন বা লিখেছেন। ইংরেজিতে আমাদের নিজেদের ভেতরে কোনো ভাবের আদান-প্রদান হয়নি। আমরা অন্যের শিখিয়ে দেয়া aim in life পড়ে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছি এমনকি যারা মানবিক শাখায় পড়ত তারাও। উচ্চবিত্ত, নিম্নবিত্ত সকলেই full free studentship এর জন্য আবেদনপত্রে লিখেছি – My father is a petty clerk. He cannot run our family with his small income. এমনকি যাদের বাবা কৃষক ছিলেন, বা দোকানি, বা অফিসার সকলেরই ভাষা এক। তখন কারো বাবাই সংসার চালাতে পারতেন না তার ছোট্ট উপার্জন দিয়ে – ব্যাপারটা এরকম। এটি করে শুধু যে আমাদের নিজেদেরকে প্রকাশ করতে না পারার দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে তা নয়; আমাদের অসত্য বা মিথ্যে কথা বলার ক্রমাগত অভ্যাসের ভেতরে ঠেলে দেয়া হয়েছে; যা আমার প্রয়োজন নেই সেটিও আমাকে করতে বাধ্য করা হয়েছে। আর বাবাদেরকেও অসম্মানিত করা হয়েছে। অথচ কত বিষয়ই তো আছে যা জীবন-ঘনিষ্ঠ আর সেগুলি নিয়ে যে আবেদনপত্র লেখা যায়, সেটি কোনো শিক্ষকের বিবেচনাতেই আসেনি।    

আমাদের শিক্ষকেরা মাঝে মাঝে নেসফিল্ড এর উদাহরণ দিতেন। একমাত্র জনাব আব্দুল মালেক স্যার এর কাছে এই বইটি আমি দেখেছি। শুধু দেখিইনি উনি অনেক সময় আমাদের পড়াতে পড়াতে কিছু নিয়ে অনিশ্চিত বোধ করলে, বইটি বের করে নিজে দেখে নিয়েছেন আবার আমাদেরকেও বইয়ের পাতা খুলে দেখিয়েছেন বা পড়ে শুনিয়েছেন কী লেখা আছে। আমি ১৯৯৯ সালে ইংল্যান্ডে গিয়ে Nesfield এর গ্রামার কিনতে গিয়ে পাইনি। ওদের ডাটাবেইজে এই বই এর কোনো তথ্য নেই। বই এর দোকানি আমাকে বুক মিউজিয়ামে এই বই এর সন্ধান করতে বলেছিল আর জিজ্ঞেস করেছিল, আমি এতো পুরোনো একটা বই খোঁজ করছি কেন। পরে আমি Cobuild English Grammar কিনেছিলাম একটি ভালো, নির্ভরশীল ইংলিশ গ্রামার রেফারেন্স বই কাছে রাখার মানসে। 

Nesfield, Wren and Martin, PK Dey Sarker এর গ্রামার বইগুলি শতাব্দী প্রাচীন। অন্যদিকে ভাষা একটি বহমান নদীর মতো। প্রতিদিন ভাষা একটু একটু করে পাল্টে যায়। ভাষার ব্যবহার, ব্যাকরণও পাল্টাতে থাকে। একশো বছর আগে ইংরেজি ভাষা যেভাবে ব্যবহার করা হতো এখন সেটি করা হয় না। আজকের ইংরেজিতে shall এর ব্যবহার বিলুপ্ত হবার দ্বারপ্রান্তে, passive voice এর ব্যবহার উঠে যাচ্ছে খুব দ্রুত, কথ্য ভাষায় at আর in এর পার্থক্য খুব বড় নয় এখন, – এই বিষয়গুলি আমাদের শিক্ষকবৃন্দ কতটা উপলব্ধি করেন জানি না। করলে শতাব্দী-প্রাচীন গ্রামার বই আর বস্তাপচা উদহারণ থেকে নিশ্চয়ই তাঁরা বের হয়ে জীবনের সাথে গ্রামারকে মেলানোর চেষ্টা করতেন। 

আমাদের সময়ে বেশিরভাগ ইংরেজি শিক্ষক নির্ভর করেছেন বাজারের প্রচলিত নোটবই এর উপরে। সেগুলি আবার ‘written by an expert head master’। এটি ছাড়া তাদের কাছে খুব একটা বিকল্প ছিল না – কারণ তারা কেউই আব্দুল মালেক স্যার এর মতো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ গ্রাজুয়েট ছিলেন না। তাই তাদের বিষয়-সংশ্লিষ্ট জ্ঞান বা কন্টেন্ট নলেজের ঘাটতি ছিল। কিছু সহজ বিষয় (যেমন tense, voice change, narration, gap filling with appropriate preposition, use of shall and will) কাজ চালিয়ে নেবার মতো করে শেখা যায় কিন্তু real life situation এ কম্যুনিকেশন চালিয়ে যেতে হলে যে শব্দভাণ্ডার, প্রিসিশন, কনভেনশন ও প্রেক্ষিত অনুযায়ী ভাষা ব্যবহারের দক্ষতা প্রয়োজন হয় সেটি তাদের ছিল না। সেটি এখনো একটি বড় অংশের ইংরেজি শিক্ষকের মাঝে অনুপস্থিত।

আমাদের একজন স্যার সারাজীবন ধরেই সক্রেটিসকে ‘সক্রেটস’ বলে গেলেন। এটি নিয়ে আমাদের হাসাহাসি ছিল, কিন্তু কে উনাকে সংশোধন করবে? অষ্টম-নবম শ্রেনিতে Give me a glass of water.- কে passive voice করতে বলা হতো অহরহ। আজও হয়। পাঠক, জীবনে একদিনের জন্যও কি শুনেছেন কেউ আপনাকে বলছেন – Let a glass of water be given? তাহলে এ ধরনের বিযুক্ত ও হাস্যকর গ্রামার শেখানো কেন? 

কীভাবে চা বানাতে হয় সেটি আমাদের শিক্ষার্থীরা জানে কিন্তু ইংরেজিতে বলতে পারে না কারণ এই প্রসেস ল্যাঙ্গুয়েজ তাদের শেখানো হয় না। ভাত রান্না কীভাবে করতে হয় বলতে গিয়ে উল্টাপাল্টা যা কিছু বলে সেটুকুও থেমে যায় ভাতের মাড় গালতে (drain out) গিয়ে। এটির ইংরিজি তারা জানে না। চাল ধোয়ার ইংরেজিও জানে না হয়তো অনেকে – কোনটা rinse আর কোনটা wash সেটি তারা বুঝতে অসমর্থ। 

আবার ইংরেজিতে যখন ট্রানস্লেশন এর যুগ ছিল, তখনও সেই গৎবাঁধা কিছু detached sentence ইংরেজি করতে দেয়া হতো – ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেলো, আমি স্টেশনে পৌঁছাইবার আগে ট্রেনটি ছাড়িয়া দিলো, আমি স্কুলে যাই, রাহিম বাড়িতে যায় – এসব। আর এর বাইরে গাদাগাদা উপদেশমূলক বাক্য যেমন – সততা, দেশপ্রেম, নিয়মানুবর্তিতা বিষয়ক ছোট ছোট উপদেশমূলক টেক্সট বাংলাতে লিখে দিয়ে সেটির ইংরেজি করতে দেয়া। বিষয় হিসেবে এগুলো ভালো কিন্তু শুধু উপদেশ কেন? কেন ছোট ছোট গল্প নয়? মানুষ একনাগাড়ে বেশিক্ষণ উপদেশ শুনতে পছন্দ করে না। সুতরাং মজার কোনো জীবনঘনিষ্ঠ বিষয়ের মাঝ দিয়েও উপদেশটা দেয়া যেত। কিন্তু না, সেই চেষ্টা কখনো ছিল বলে মনে পড়ে না। 

এটির কারণ কী? রড এলিস নামে একজন বিখ্যাত মার্কিন শিক্ষাবিদ মনে করেন, শিক্ষকতা মূলত এক ধরনের শিক্ষানবিশি। একজন শিক্ষক মনে করার চেষ্টা করেন তার শিক্ষক কীভাবে শিখিয়েছেন এবং সেই শিক্ষকও মনে করতেন তার শিক্ষক কীভাবে শিখিয়েছেন। এভাবে পূর্ববর্তী শিক্ষকের শিখনধারা ক্রমাগত চলমান থাকে যদি শিক্ষক নিজে পেশাগত উৎকর্ষের জন্যে চেষ্টা না করেন। আবার সেলিংকার, স্কিনার, ল্যাডো যারা interlanguage hypothesis ও আনুসঙ্গিক বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন তাঁদের ধারণা এরকমটি হবার কারণ হচ্ছে problem in transfer of training. আমি যা শিখেছি সেটি আমার training আর আমি যখন শেখাচ্ছি সেটি আমার transfer of training. শেখার জায়গায় আমার সমস্যা থাকলে আমার শিখন ট্রান্সফারে সমস্যা থেকেই যাবে। 

উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের বিসিএস করা প্রভাষক বা সহকারী অধ্যাপক যখন work আর works এর পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যর্থ হন তখন লজ্জা পাই বৈ কি! মাধ্যমিকে না হয় বিষয়ের বাইরের অন্য শিক্ষকও অনেক সময় ইংরেজি পড়ান কিন্তু কলেজে তো সেই সুযোগ নেই। এই পর্যায়ের শিক্ষকও যখন present perfect আর past indefinite গুলিয়ে ফেলেন তখন বুঝে পাইনা তাহলে গ্রামার – ট্রানস্লেশন পদ্ধতি নিয়ে এতো বাগাড়ম্বর বা হ্যাঙওভার কীসের? কীসের জন্যে communicative language teaching – কে এত আক্রমণ। পরক্ষণেই মনে হয়, এই আক্রমণের একটি কারণ আমাদের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ইংরেজির কন্টেন্ট শিখছে যতটুকু পারে কিন্তু কম্যুনিকেশন/ ল্যাঙ্গুয়েজ শিখছে কম। আবার যে কন্টেন্ট শিখছে সেখানেও বড় রকমের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে তিনি যখন লিখছেন বা বলছেন সেখানে।

এভাবেই আমাদের ইংরেজি শিক্ষা এক ধরণের চক্রব্যূহের্ মাঝে আটকে থাকছে। আগামী পর্বে এ নিয়ে আরো আলোচনা করার ইচ্ছে রইলো।

(চলবে)

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: গৌতম রায়
গৌতম রায় ইংরেজির অধ্যাপক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেবার পর বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বেশ তরুণ বয়সেই শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। পড়িয়েছেন দেশে ও দেশের বাইরে বিভিন্ন কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার প্রতি ভালোবাসা থেকেই পরবর্তীতে ছাত্র হয়েছেন ইংল্যান্ডের এক্সিটার ইউনিভার্সিটির।‌ যুক্তরাষ্ট্রের অরেগন ইউনিভার্সিটি, ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি ও ওয়ার্ল্ড লার্নিং থেকে নিয়েছেন পেশাগত প্রশিক্ষণ। এখন কারিকুলাম বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন বাংলাদেশের জাতীয় ‌শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে। শিক্ষা বিষয়ক বর্ণিল কাজে নিজেকে ‌সম্পৃক্ত রাখার জন্যই বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে তিনি দেখেছেন খুব কাছে থেকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে গৌতম রায়ের পছন্দের আঙ্গিনা শিক্ষকের অনিঃশেষ পেশাগত দক্ষতা, ইন্টারেক্টিভ মেটিরিয়ালস ডিভ্যালপমেন্ট, ও লার্নিং এসেসমেন্ট।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!