কবি রবীন বসুর ছয়টি কবিতা

রবীন বসু
রবীন বসু
3 মিনিটে পড়ুন
সাময়িকী আর্কাইভ

নির্জন সভ্যতার মার্চমাস

মুথাঘাস থেকে জীবনানন্দের ফড়িং যেই মুখ তুলল
পৃথিবীতে মার্চমাস এসে গেল। পুরুলিয়ার
টাঁড়-টিকড় মাটিতে লাল পলাশ ফুটেছে বিস্তর,
সুরপার্টি-ঝুমুরগান, তার অনুষঙ্গ নাচনিনাচ দেখতে
শহর থেকে এসে পড়ল মাল্যবান-হেম-কল্যাণী।
তাদের যাত্রা পথে যে নির্জ্ঞান ভ্রমণ
ক্লান্ত বিলাসিতা, রঙের সদালাপী আয়োজন
তা ফ্রয়েড-শিষ্য ইয়ুঙের হয়তো জানা আছে।
মহুয়ামাতাল সেই রাত্রির গভীর থেকে
নিশাচর পাখির মত তীক্ষ্ণ চিৎকার দিল দুঃখ,
বিমগ্ন কবি কানে নিলেন সেই স্বর, বুকে নিলেন
আবিষ্ট মগ্নতার ভ্রামণিক, অযোধ্যাপাহাড় ভেদ করে
আরো গাঢ় অন্ধকার গায়ে মেখে উঠে এলেন
ডানাভাঙা বসন্ত বাতাসে;
সঙ্গে মাফিয়া রঙের লাল নির্জন সভ্যতার মার্চমাস।

জাদুবাক্স

পুরনো অ্যালবামে ধুলো, বড়বেশি মায়া টানে
নিদাঘ গ্রিষ্মের দিন
তপ্ত হাওয়া ঢুকে আসছে ঘরে
খাঁ-খাঁ শূন্যতা বইছে, কিসের অপেক্ষায়
কারা যে দাঁড়িয়ে থাকে ঠায়?
ঘরের মধ্যেও স্মৃতি প্রতীক্ষা করে।

এই যে নিদাঘকাল, এই বেসাহারা
স্মৃতির অ্যালবাম, জাদুবাক্স খুলে ফ্যালে
মোহিতে আবিষ্ট হই
চোখে লাগে রঙের বর্শা
সুনিপুণ টান দেয় সময়ের ঘুড়ি
মুখ থুবড়ে পড়ে যাই ভোকাট্টা আমি।

যতই সাবধানে থাকি, যতটা লুকাই
নিজের আস্তিন থেকে বেরিয়ে পড়ে ছুরি
ফালাফালা করে দেয় সব গুপ্ত কারিকুরি।

মহাজাগতিক গান

এই ক্ষত যদি গাঢ় হয়, অবলেপ লেপে দিও তুমি
গভীর প্রদাহ নিয়ে রোগ যেন শিকড়ে না যায়;
জলের কিনার ধরে এত যে ভ্রমণ হাঁটে প্রতিদিন
পদশব্দে স্তব্ধতা ভেঙেছে আর অবিন্যস্ত হাওয়ায়
তুমুল তোলপাড় চলছে অন্তরীক্ষে গাছেদের গায়ে
বল্কলের আস্তরণ ভেদ করে শরীরের অভ্যন্তর
যেন বা পেয়েছে কিছু আর্ত এক শীতলের সংবহন;
রৌদ্র চাই রৌদ্র চাই, তীব্র আশ্লেষ খোঁজে আবর্ত
অস্থির এই উন্মুখ ফেরি, চলাচল ঘাট, পাটাতন
পদস্পর্শে তপ্ত সমূহের বিষাদ ছুঁয়েছে দ্রুত
ওপারেই লগ্ন মেঘ জড়াজড়ি জীবন আগ্রহ
পুনরায় ভিক্ষাপাত্র হাতে তৃষিত পথের টান
জেগে ওঠে অলৌকিক রাত্রি, গভীর সে বিমর্ষতা
তবুও গ্রহান্তরের সেতু কম্পমান দোলে আড়াআড়ি
সুস্থির সময় আসে ইহা গচ্ছ, ইহা তিষ্ঠ, এইরূপ
মন্ত্র বাজে, বেজে ওঠে শাঁখ; তরঙ্গে তরঙ্গে কাঁপে
সভ্যতার সযত্ন সংকেত-সিদ্ধ মহাজাগতিক গান।

লখিন্দর প্রেম

নাবিকের গল্প যেখানে শেষ হয়েছিল
সেখান থেকেই জলকন্যা তার সাঁতার শুরু করল

সে সাঁতারে কী কারুকাজ, কী মোহিনীঅট্টম
দাঁড়ের ওঠাপড়ার মত সাবলিল গতি
অথচ কোন অগ্রগমন নেই, নেই কোন যাত্রা
স্থবিরতা আর ক্লান্তি জলকন্যাকে জড়িয়ে ধরে
আমরা এক মৃতপ্রেমকে ভাসতে দেখি

ছায়াময় সেই ভাসান বেহুলানৃত্য হয়ে
স্বর্গ নয়, এই মাটি এই বৃক্ষ এই জলবিন্দু
স্পর্শ করে এক লখিন্দর প্রেম !

আবহমানে ভাসে নৈঃশব্দ্যের ইশারা…

তথাগত বুদ্ধ

তিনি রাজপুত্র, তিনি গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী
তিনি নির্বাণ-উন্মুখ এক শাশ্বত পরিব্রাজক;
শ্রমণের পীতবর্ণে আলোর প্রত্যাশী
তিনি সিদ্ধার্থ, গৌতম আবার তথাগত বুদ্ধ।
কাবা থেকে কুশিনগর শেষ যাত্রায়…
তিনি অবসন্ন ক্লান্ত অসুস্থ জরাজীর্ণ
নক্ষত্রভরা আকাশের নীচে
হিরণ্যবতী নদীর জলে পা রাখলেন
শুধু মানুষের জন্য, দুঃখ থেকে মুক্তির পথ!
শেষে শালমলি বৃক্ষের নিচে আত্মোপলব্ধি
নির্বাণের মধ্যম পথ…চতুরার্য সত্য।

তবু মানুষ এখনও দুঃখময়, জরাজীর্ণ
তুমি আর একবার আসবে কি, তথাগত বুদ্ধ?

অস্বাভাবিক

মেঘলা মেদুর দিন বিকেলের দিকে
চলে গেছে সোজা রাস্তা বহমানতায়
দু’পাশে সবুজ গাছ, ছায়া পাশটিতে
লিখে রাখে অন্যকিছু ভগ্ন মমতায়।

সযত্ন আগ্রহ নিয়ে হাঁটে লোক হাটে
কেনাকাটা করে কিছু, কিছু ভুলে যায়
ফেরার তাড়াতে দ্রুত নেমে আসে মাঠে
যে বাড়ি গিয়েছে ছেড়ে ফিরতে সে চায়।

কী স্মৃতি পিছনে আছে? কত মহোৎসব
আয়োজন কাঁপে নাকি বেদনার ভার
যতটা গভীরকে খায়, তত পরাভব
সব আজ জড়ো হবে নদীটির পার।

ওপারে অনন্ত আছে অদৃশ্য ম্যাজিক
কী খেলা দেখায় দেখি, সে অস্বাভাবিক।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: রবীন বসু
জন্ম ১৯৫৮ দঃ ২৪ পরগনা । পিতা প্রমথনাথ বসু, মা রাধারানি বসু । শিক্ষা অনার্স সহ স্নাতক। ডিপ্লোমা ইন প্রিন্টিং টেকনোলজি। পেশা : প্রকাশনা সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। কলেজে পড়ার সময় অশোক সেন সম্পাদিত “বারোমাস” পত্রিকায় প্রথম কবিতা ও “নবকল্লোল” পত্রিকায় গল্প প্রকাশ পায় (১৯৭৮) l বাংলা ভাষায় প্রকাশিত প্রায় সব পত্র-পত্রিকা ও দৈনিকে লেখকের লেখা প্রকাশিত হয়েছে বা হচ্ছে l পঞ্চাশের উপর সংকলন গ্রন্থে কবিতা, গল্প ও প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে l সম্পাদিত গ্রন্থ ৪ । কবিতার জন্য ৭টি ও গল্পের জন্য "মহাশ্বেতা দেবী স্মৃতি-পুরস্কার", দক্ষিণ ২৪পরগনা সেরা গল্পকার ১৯৮৪ সহ ৫টি পুরস্কার পেয়েছেন। পেয়েছেন দুটি জীবনকৃতি সম্মাননা সারা জীবনের সাহিত্য চর্চার জন্য (২০১৯, ২০২১) । প্রকাশিত কবিতার বই : সাম্প্রতিক দু’জন (১৯৮০) পঁচিশে বোশেখের কবিতা (১৯৮১) নাবিক ও জলকন্যার গল্প (২০১৮) ক্ষুধার স্তিমিত গদ্যে কবিতার মানচিত্র (২০১৮) ধর্ম ভাসে জলজ শ্যাওলায় (পকেট বুক : ২০১৯) জন্মের প্রবাহিত ঋণ (২০১৯) চতুর্দশপদী ( ২০২১) প্রকাশিত উপন্যাস : ভাঙন (১৯৮৩) প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ : সোনালী মাছের আঁশ (১৯৮৪) ইলিশ ভাপা ও অন্যান্য গল্প (২০২০) হাওয়ায় ওড়ে মেঘজীবন ( অণুগল্প : ২০২০)
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!