বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম কি কি দিয়েছেন

সাময়িকী ডেস্ক
সাময়িকী ডেস্ক
8 মিনিটে পড়ুন
২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে শতকের পর তামিম ইকবাল। ফাইল ছবি

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম কি কি দিয়েছেন

তামিম ইকবাল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের হয়ে তার খেলোয়াড়ি জীবনের ইতি ঘোষণা করেছেন- এটাকে অনেকেই অনেকভাবে দেখছেন। কেউ বলছেন ‘সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত’, কেউ বলছেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য ‘অপূরণীয়’ এক ক্ষতি, কেউ বলছেন বিষয়টা আরও ‘সম্মানের সাথে’ হতে পারতো।

গত ২০ বছরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে জনপ্রিয়তার বিচারে শীর্ষ পর্যায়ের যে পাঁচজন ক্রিকেটারকে ধরা হয়, বা মিডিয়াতে যাদের ‘পঞ্চপাণ্ডব’ বলে উল্লেখ করা হয়, তাদের একজন: তামিম ইকবাল।

এই তালিকার বাকি চারজনের মধ্যে শুধুমাত্র সাকিব আল হাসানই এখনও তিন ফরম্যাটে খেলছেন, মুশফিকুর রহিম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সীমিত ওভারের ক্রিকেট ভবিষ্যৎ এখন শংকায় এবং টেস্ট থেকে তিনি অবসর নিয়েছেন।

আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মাঠে এখন আর নেই মাশরাফী বিন মোর্ত্তজা, তবে মাশরাফী যেদিন অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন, তাকে মাঠেই আনুষ্ঠানিক আয়োজন করে ক্রিকেটাররা ও সমর্থকরা বিদায় জানিয়েছেন ২০২০ সালে। মজার বিষয় হচ্ছে- সেই সিরিজেই তামিম ইকবাল তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের সর্বশেষ দুটি সেঞ্চুরি হাঁকান।

তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ওয়ানডে ফরম্যাটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক- ১৪টি।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম কি কি দিয়েছেন
তামিম বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে ‘ভয়ডরহীন সংস্কৃতি’ তৈরির নেপথ্যে ছিলেন। ফাইল ছবি

তামিমকে নিয়ে স্মৃতিকাতর যারা

তামিম ইকবাল বুধবার চট্টগ্রামের একটি হোটেলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে তৎক্ষণাত বিদায়ের ঘোষণা দেয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রেন্ডিং তিনি। ‘পপুলার নাউ’ লেখা আসছে তার নামের পাশে।

বাংলাদেশে যারা ক্রিকেট ভালোবাসেন ও নিয়মিত খেলা দেখেন তারা তামিম ইকবালকে নিয়ে পোস্ট দিচ্ছেন। ক্রিকেটার মুস্তাফিজুর রহমান তার পোস্টে লিখেছেন যে তিনি তার কাঁধে তামিমের হাত মিস করবেন।

তাসকিন আহমেদ তার ভেরিফাইড পেইজের প্রোফাইল পিকচার বদলে তামিমের সাথে ছবি দিয়ে লিখেছেন, “মাঠে ও মাঠের বাইরের মুহূর্ত ও স্মৃতি জমেছে অনেক। আমার প্রতি আপনার সমর্থনের জন্য আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো।”

লিটন দাস লিখেছেন, “একসাথে ব্যাট করেছি, একই ড্রেসিংরুমে সময় কাটিয়েছি। অনেক স্মৃতি আছে। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না আপনি বাংলাদেশের হয়ে আর খেলবেন না।”

চিত্রনায়ক সিয়াম আহমেদ লিখেছেন, “কত দারুণ সব মুহূর্ত উপহার দিয়েছেন আমাদের। জহির খানকে ডাউন দ্য উইকেটে মারা ছক্কায় নিজের আবির্ভাবের জানান দেয়া, লর্ডসের অনার্স বোর্ডে বলে-কয়ে নিজের নাম ওঠানো, এশিয়া কাপে টানা চার ম্যাচে ফিফটি…।”

কেন তামিম বিশেষ ক্রিকেটার

তামিম ইকবালের শুরুর দিককার মেন্টর ছিলেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম। দীর্ঘদিন বাংলাদেশ ক্রিকেটের গেম ডেভেলপমেন্টে কাজ করার পর তিনি এখন বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির ক্রিকেট প্রধান হিসেবে কাজ করছেন।

তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “তামিমকে নিয়ে যদি একটা মুহূর্তের কথা জিজ্ঞেস করা হয় বলা যাবে না। লর্ডসের কথা বলতে হবে, ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের কথা বলতে হবে, ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজের কথা বলতে হবে।”

তবে তিনি লর্ডসের সেঞ্চুরিকে এগিয়ে রাখবেন। লর্ডস ক্রিকেট বিশ্বের সবচেয়ে তাৎপর্যময় ভেন্যু হিসেবে পরিচিত এবং এই মাঠে শতক হাঁকালে বা পাঁচ উইকেট নিলে তার নাম ওঠে অনার বোর্ডে।

লর্ডসের অনার বোর্ডে একমাত্র বাংলাদেশি সেঞ্চুরিয়ান হিসেবে তামিম ইকবালের নাম আছে। আর পাঁচ উইকেট নেয়ার কারণে শাহাদাৎ হোসেন রাজিবের নামও আছে এই বোর্ডে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম কি কি দিয়েছেন
অনুর্ধ্ব ১৫ পর্যায়ে খেলার সময় নাজমুল আবেদীন ফাহিমের সাথে তামিম ইকবাল, কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে। ফাইল ছবি

ওয়ানডেতে তামিমের অবদান

শুরুর দিনগুলোতেই তামিমকে মনে করা হতো বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ। অনেকেই মনে করেন তামিম-সাকিবের প্রজন্মই বাংলাদেশকে প্রথম ভয়ডরহীন ক্রিকেট খেলাটা শেখান।

২০০৭ সালের বিশ্বকাপ তামিম ইকবাল, সাকিব আল হাসান ও মুশফিকুর রহিমের প্রথম বিশ্বকাপ।

সেই বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে তামিম পোর্ট অফ স্পেনে ৫৩ বলে ৫১ রানের ইনিংস খেলে ম্যাচ জেতায় ভূমিকা রাখেন। অনেক দিন পর্যন্ত এটাই ছিল বিশ্বকাপের মঞ্চে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ইনিংস।

নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, “অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড বা ভারতের মতো বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাস খুব বেশিদিনের না। আমরা যখন শুরু করি তখন আমাদের অবস্থান অনেক নিচে ছিল। সেখান থেকে যে আমরা একটা পর্যায়ে উঠে আসলাম এটার পেছনে তামিমের একটা বড় অবদান রয়েছে।”

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকরা সবসময়ই তামিম ইকবালের সাথে কে খেলবেন এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভেবেছেন।

কখনো ইমরুল কায়েস, কখনো এনামুল হক জুনিয়র, কখনো শাহরিয়ার নাফীসরা ছিলেন, কিন্তু তামিমের মতো করে কেউই বাংলাদেশের উদ্বোধনী ব্যাটার হিসেবে টিকে যেতে পারেননি।

তামিমকে একটা ভরসার জায়গা হিসেবেই দেখছেন মি. ফাহিম।

“একটা সময় কিন্তু তামিম সাকিবের মতোই অপূরণীয় ছিলেন। এখন হয়তো তামিমের মতো ব্যাটার আছেন বেশ কজন। কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য তামিমের শূণ্যস্থান পূরণ করা কঠিনই ছিল।”

এখন বাংলাদেশের হয়ে নিয়মিত ওপেন করছেন লিটন কুমার দাশ। কখনো কখনো তিনি অধিনায়কত্বও করেছেন। আছেন নাজমুল হোসেন শান্ত।

কিন্তু একটা সময় পর্যন্ত তামিম ইকবালের বিকল্প হিসেবে কারও নামই আসতো না।

পাকিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশের ওয়ানডে ইতিহাসের প্রথম ম্যাচ ও সিরিজ জয়ের নায়ক ছিলেন তামিম ইকবাল।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম কি কি দিয়েছেন
তাসকিন বলছেন, তিনি তামিমের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবেন। ফাইল ছবি

মূলত তামিম ২০০৭ বিশ্বকাপের পর আর ওয়ানডে বিশ্বকাপের মঞ্চে উল্লেখ করার মতো খেলতে পারেননি। তাই ২০১৫ সালে বিশ্বকাপেও ব্যাট হাতে ব্যর্থতার পর তুমুল সমালোচনা হচ্ছিল। সেই সময় পাকিস্তান ক্রিকেট দল বাংলাদেশ সফর করে এবং তামিম ইকবাল পরপর দুই ম্যাচে ১৩২ ও ১১৬ রানের ইনিংস খেলে নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন।

তামিম ইকবাল বাংলাদেশের মাটিতে ও বাংলাদেশের বাইরে একইভাবে পারফর্ম করতেন।

ঘরের মাটিতে তার গড় ৩৭, ঘরের বাইরে ৩৫ এর মতো, দুই জায়গাতেই সমান সাতটি করে সেঞ্চুরি আছে তামিমের। তামিম ইকবাল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চারটি এবং শ্রীলঙ্কা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, পাকিস্তান, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দুটি করে ওয়ানডে সেঞ্চুরি করেছেন। বাংলাদেশের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে তামিমের টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি সেঞ্চুরি আছে।

টেস্ট ক্রিকেটেও তামিমের ভূমিকা রয়েছে

তামিম ইকবালের টেস্ট ক্রিকেট যাত্রা শুরু হয়েছে নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে। ২০০৮ সালের এই সিরিজে তামিম টেস্ট অভিষেকেই দুই ইনিংসে ৫৩ ও ৮৪ রান তুলেছিলেন। তবে তামিমের সবচেয়ে আইকনিক ইনিংস ছিল লর্ডসে– ১০০ বলে ১০৩ রান তুলেছিলেন তিনি।

এই সেঞ্চুরির উদযাপনও ছিল মনে রাখার মতো, সেঞ্চুরি করা মাত্রই তামিম ইকবাল লাফিয়ে উঠে তার নাম লিখে রাখতে বলেন লর্ডসের অনার বোর্ডে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটকে তামিম কি কি দিয়েছেন
লর্ডসে সেঞ্চুরি হাঁকানোর পর তামিম ইকবালের উদযাপন। ফাইল ছবি

পরের ম্যাচেও ম্যানচেস্টারে তামিম ১০৮ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন। ২০১৫ সালের তামিম বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে ডাবল সেঞ্চুরিও করেছিলেন, পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনায়

টেস্ট ক্রিকেটে তামিমের মোট ১০টি সেঞ্চুরি, যার মধ্যে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিনটি। ভারত, নিউজিল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও আছে একটি করে শতক।

২০১৬ সালে তামিমের ১০৪ রানের ইনিংস ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র টেস্ট ম্যাচ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল।

এরপরের বছরই শ্রীলঙ্কার মাটিতে বাংলাদেশের টেস্ট ইতিহাসের শততম টেস্ট ম্যাচে তামিম ইকবাল দুই ইনিংসে ৪৯ ও ৮২ রানের ইনিংস খেলে অবদান রেখেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়েও তামিম দুই ইনিংসে ৭১ ও ৭৮ রান তুলেছিলেন।

তামিম ইকবাল যে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘উজ্জ্বল এক নক্ষত্র’ হবেন সেটা তার ১০ থেকে ১৫ বছর বয়সেই বোঝা গিয়েছিল বলছেন নাজমুল আবেদীন ফাহিম।

মি. ফাহিম তামিম ইকবালের অনুর্ধ্ব-১৫ ক্রিকেট দলের কোচ ছিলেন। ২০০৫ সালে তামিম বয়সভিত্তিক দলের হয়ে যুক্তরাজ্যের যুব দলের বিপক্ষে ৭১ বলে ১১২ রানের একটি ইনিংস খেলেছিলেন।

নাজমুল আবেদীন ফাহিম বলেন, “এমন একজন ক্রিকেটার, যার এতো অবদান, সে চোখে পানি ফেলে বিদায় নিচ্ছে, এটা কাঙ্খিত নয়।”

“আশা করি এই দৃশ্য দেখার পর আমরা সচেতন হবো এবং সামনে যারা বিদায় নেবেন তাদেরকে আরও সম্মানের সাথে বিদায় দেয়ার চেষ্টা করবো,” বলেন তিনি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!