কাঁটাতারে লাঠির সাঁকো

গোলোকেশ্বর সরকার
গোলোকেশ্বর সরকার
29 মিনিটে পড়ুন
ছবি: প্রতীকী

হেমতাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে টোটো চলছিল পকেট রুটের রাস্তা ধরে। পাকা রাস্তা। রাস্তার অবস্থা ভালো। টোটো চলছিল গড়গড় করে, মসৃনভাবে। তেমন ঝাঁকুনি হচ্ছিল না। টোটোতে বৃদ্ধ আশির্বাদ ও যুবক সাধন। পেছনের আসনে আশির্বাদ ও সাধন দু’জন পাশাপাশি বসে। সাধন একহাত দিয়ে আশির্বাদকে শক্ত করে ধরেছিল। টোটোতে ওঠার সময় আশির্বাদ টোটোর তিনটে চাকা বেশ করে পরখ করে টোটো চালককে জিজ্ঞেস করেছিল, চাকাগুলো ভালো আছে তো?

টোটো চালক বলেছিল, হ্যাঁ, চাকাগুলো একদম নতুন। রাস্তা ভালো, চাকা নতুন। তাই রাস্তার মাঝে চাকা ফুটো হয়ে যাওয়া বা ফেটে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। আশির্বাদের টোটোটা পছন্দ হয়েছিল। সাধনের হাত ধরে টোটোটিতে উঠেছিল বৃদ্ধ আশির্বাদ।

আশির্বাদের বয়স পঁয়ষট্টি বছর।অবিবাহিত। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি ও সাদা পাজামা। ‘আপন জন’ নামে একটি অনাথ আশ্রমের সাথে যুক্ত। আশ্রমই তার ঘর, আশ্রমই তার ঠিকানা। আশ্রমের অনাথ বাচ্চাদের পড়াশোনা শেখায়। নিয়মিত পরিচর্যা করে, জল দিয়ে আশ্রমের গাছগুলোর পরিচর্যা করে, সবুজ রাখে।

সাধনের বয়স ঊনিশ বছর। কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। প্রেম করে।আশির্বাদের কাঁধে একটি ব্যাগ। হাতে একটি ভর দিয়ে চলার লাঠি। কয়েক বছর ধরে লাঠি ছাড়া আশির্বাদ হাঁটতে পারে না।

আশির্বাদ একটু হেলে টোটোর সামনের চাকা এবং এদিক ওদিক বসে পেছনের চাকা দুটো ভালোভাবে লক্ষ্য করছিল। চাকার দিকে তাকিয়ে আশির্বাদ দেখছিল, চাকা কীভাবে তাদেরকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে চলছিল। নজর রাখছিল, কীভাবে তিনটে চাকা তাদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছিল, তাদের গন্তব্যস্থানের দিকে পৌঁছে দিচ্ছিল। আশির্বাদ আসনের মাঝে স্থির হয়ে বসে জিজ্ঞাসা করলো, সাধন, বলতে পারবি চাকার জন্ম হয়েছিল কেন?

সাধন কলেজ পড়ে। তবে চাকা সম্পর্কে তার তেমন জানা ছিল না। সাধন উত্তর দিল, না, জানি না।

আশির্বাদ বলল, বহু বছর আগে কোনও কিছু টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মানুষের পক্ষে কঠিন ছিল। কোনও জিনিস এক স্থান থেকে অন্য স্থানে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্য চাকার জন্ম হয়েছিল।

সাধন উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল, দাদু, কী দিয়ে প্রথম চাকা তৈরি হয়েছিল?

আশির্বাদ বলল, কাঠের গুঁড়ির চাকতি দিয়ে প্রথম চাকা বানানো হয়েছিল।

সাধন আবার প্রশ্ন করল, সেই পুরনো সময়ে মানুষের মনে চাকার ব্যাপারটা এসেছিল কীভাবে?

আশির্বাদ উত্তর দিল, সম্ভবত, পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়তে দেখে মানুষের মনে চাকার ধারণা এসেছিল। বুঝলি সাধন, চাকা মানুষকে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় টেনে নিয়ে যায়, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বয়ে নিয়ে চলে। যেমন, চাকা আমাদের ডালখোলা থেকে হেমতাবাদে নিয়ে এসেছে আবার হেমতাবাদ থেকে মেলাতে নিয়ে চলেছে। চাকা নিজেই আমাদের বহন করে নিয়ে চলেছে।

দুই

টোটো চলছিল গ্রামের রাস্তা ধরে গ্রামের মেলার উদ্দেশ্যে। যেদিকে তাকানো যায় শুধু সবুজ গাছপালা আর সবুজ শস্যক্ষেত। সবুজের সৌন্দর্যে মন তরতাজা হয়ে উঠল আশির্বাদের।

আশির্বাদ বলল, জানিস সাধন, ডাক্তারবাবুরা বলেন, সবুজ রং চোখের পক্ষে খুবই উপকারী। কিন্তু শুধু চোখ নয়, সবুজ রং চোখের সাথে সাথে মনকেও ভালো রাখে।

সবুজের সমারোহ দেখে সাধনের মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল, “খুবই সুন্দর! অপূর্ব!

আশির্বাদ শ্বাস টেনে বুক ভরে গ্রামের বিশুদ্ধ বাতাস নিল। বলে উঠল, কি আরাম! কি প্রশান্তি! এরপর সাধনকে বলল, জানিস সাধন, যে গ্রামকে আমরা অবহেলা করি, এমন একদিন আসবে, যেদিন শহরের লোকেরা গ্রামে ছুটে আসবে বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য, আসলের খোঁজে, খাঁটির সন্ধানে।

আশির্বাদ সাধনকে জিজ্ঞেস করল, মেলা’ কথার মানে কি জানিস?

সাধন বলল, হ্যাঁ, জানি। ‘মেলা’ শব্দের অর্থ মিলন।

চাকা কিন্তু আপন মনে তার কাজ ঠিক মতো করে যাচ্ছিল। কর্তব্যে গাফিলতি ছিল না তার। নিজস্ব গতি নিয়ে এগিয়ে চলছিল সামনের দিকে। লক্ষে স্থির চাকা।

আশির্বাদ প্রশ্ন করল, সাধন, গ্রামের মেলায় গিয়েছিস কখনও?

উত্তরে সাধন বলল, ছোটবেলায় বাবা-মা’র হাত ধরে গ্রামের মেলায় গিয়েছি। বড় হয়ে গ্রামের মেলায় আর যাওয়া হয়নি। মেলা মানে একে অপরের সাথে প্রাণ খুলে মেশা। মেলা মানে শুধু খুশি আর খুশি, আনন্দ আর আনন্দ।

সাধন বলল, গ্রামের মেলা বছরে কোনও নির্দিষ্ট দিনে অথবা তিথিতে হয়ে থাকে। গ্রাম্য মেলাতে থাকে মাটির স্বাদ। গ্রামের মেলা প্রকৃতির মাঝে কোনও ফাঁকা জায়গায় কিংবা খেলার মাঠে বসে। কোথাও মেলা সকাল থেকে বসে, কোথাও দুপুর থেকে বসে। সাধারণত মেলা চলে রাত পর্যন্ত। তবে দূরের লোকেরা সন্ধের পরে বাড়ি ফিরতে শুরু করে।

সাধন প্রশ্ন করল, দাদু, কী জন্য আপনি মেলায় যাচ্ছেন?

আশির্বাদ বলল, এই মেলাতে ‘অম্বালিকা’ আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে। লোক মারফৎ আমাকে এই মেলাতে ডেকে পাঠিয়েছে। তিরিশ বছর পর আমাদের দেখা হবে।

তিন

টোটোর তিনটে চাকা সম্মিলিতভাবে আশির্বাদ আর সাধনকে এক জায়গায় নিয়ে এসে দাঁড় করালো। টোটোর চাকাগুলো এক জায়গায় স্থির হয়ে স্বস্তির শ্বাস নিতে শুরু করল। যে কর্তব্য তাদের ওপর ছিল, তা তারা সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করেছে।

টোটোওয়ালা বলল, দাদু, আপনার জায়গা এসে গেছে।

আশির্বাদ বলল, জানি। এই জায়গা আমার চেনা। সাত বছর আগে একবার বন্ধুর সাথে এখানে মেলা দেখতে এসেছিলাম।

টোটোতে বসেই আশির্বাদ সাধনকে বলল, আমার ব্যাগটা নে আর আমার হাতটা একটু ধর। আমি নামব।

সাধন এক হাতে ব্যাগটি নিল। অন্য হাতে আশির্বাদের বা’হাত ধরল। আশির্বাদ ডান হাতে লাঠিতে ভর করে টোটো থেকে নামল। ভাড়া মিটিয়ে দিলে টোটোওয়ালা চলে গেল।

আশির্বাদ বলল, সাধন, আমাকে ভালো করে ধরে রাখিস। নইলে পড়ে যেতে পারি।

সাধন শক্ত করে আশির্বাদের ডান হাত ধরে থাকল। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে লাঠিতে ভর দিয়ে ঠকঠক করতে করতে সামনের দিকে এগিয়ে চলল আশির্বাদ।

কিছুটা পথ চলার পর আশির্বাদ একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। আশির্বাদ বলল, সাধন, এই জায়গাতেই মেলা বসে।

সাধন বলল, দাদু, এখানে তো নাগরদোলা, সার্কাস,পুতুলনাচ, ম্যাজিক প্রদর্শনী কোনওটাই দেখছি না।

আশির্বাদ বলল, ওগুলো এই মেলায় বসে না। আশির্বাদ ব্যাগ থেকে দুটো আসন বের করল। আসন দু’টি মাটিতে পাতল। সাধনকে একটি আসন দেখিয়ে বলল, সাধন, বোস, আসনটিতে বোস।

সাধন আসনে বসল। অপর আসনে আশির্বাদ বসল। আশির্বাদ ব্যাগের ভেতর থেকে লাল ও হলুদ রঙের দুটো ফোল্ডিং ছাতা বের করল। হলুদ রঙের ছাতাটি সাধনকে দিয়ে লাল রঙের ছাতাটি নিজে নিল। আশির্বাদ লাল রঙের ছাতাটি ফুটিয়ে নিজের মাথায় দিল। সাধনকে ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিতে বলল।

সাধন বলল, দাদু, আমি কিন্তু এই মেলাতে কোনও দিনও আসিনি। সকাল সাড়ে এগারোটা বাজে। মাথার ওপর সূর্য। দু’জনে ছাতা মাথায় দিয়ে মাটিতে পাতা আসনে বসে রইল বিস্তীর্ণ মাঠের একধারে।

চার

গতকাল আশির্বাদ সাধনকে বলেছিল, আমি আগামিকাল এখান থেকে অনেকদূর হেমতাবাদে এক মেলাতে যাব। কিন্তু শরীরটা আমার ভালো লাগছে না। দুর্বল লাগছে। মাঝে মাঝে মাথা ঘুরছে। তুই যদি আমার সাথে যাস, আমার সঙ্গে থাকিস, আমাকে সাহায্য করিস, তাহলে আমি নিশ্চিন্তে যেতে পারি। মেলাটিতে আমার যেতেই হবে।

আশ্রম থেকে কিছুটা দূরে সাধনের বাড়ি। সাধন জিজ্ঞেস করেছিল, কখন যাবেন?

আশির্বাদ বলেছিল, ভোরবেলা যাব, সন্ধেবেলায় ফিরে আসব। তোর যাতায়াত, খাওয়া দাওয়া সমস্ত খরচ আমি দেব। গ্রামের মেলা।

সাধন আশির্বাদের কথা ফেলতে পারেনি।

আশির্বাদ সাধনের বাবা মাকেও বলেছিল কথাটা। সাধনের বাবা-মাও সম্মতি জানিয়েছিল। মা সাধনকে বলেছিল, সাধন, দাদুকে একা একা ছাড়বি না। দাদু অসুস্থ। দাদুর সাথে সাথে থাকবি। দাদুকে ধরে রাখবি।

সাধন বলেছিল, ঠিক আছে মা। ভোরবেলা সাধন আশির্বাদের আশ্রমে এসে হাজির হয়েছিল। আর আশির্বাদ আগে থেকে তৈরি হয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো।

উত্তর দিনাজপুর জেলার হেমতাবাদ মোড় থেকে অনেকটা ভেতরে মেলাটি বসে। আশির্বাদ ও সাধনের বাড়ি এই জেলারই ডালখোলা নামে স্থানে। ডালখোলা থেকে রায়গঞ্জ আবার রায়গঞ্জ থেকে হেমতাবাদে বাসে করে আসতে সকাল দশটা বেজে গিয়েছিল। হেমতাবাদে হোটেলে দু’জনে ভাত খেয়ে সকাল সাড়ে দশটায় মেলার উদ্দেশ্যে টোটো ধরেছিল।

সাধন ছাতা মাথায় বসে থেকে চারদিকে তাকাল। দেখল, অনেকদূর পর্যন্ত কোনও বাড়িঘর নেই। ফাঁকা মাঠ। কিছু লোকজন ঘোরাঘুরি করছে। সামনের দিকে কাঁটাতারের বেড়া। সাধন কিছু জিজ্ঞেস করার আগে আশির্বাদ বলল, ওটা ভারত-বাংলাদেশ কাঁটাতারের বেড়া। ওপারে বাংলাদেশ এপারে ভারত।

সাধন জিজ্ঞেস করল, দাদু, মেলা কখন শুরু হবে?

আশির্বাদ বলল, অনেকক্ষণ আগে মেলা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিবছর আজকের দিনে মেলাটি হয়। ওই যে লোকগুলো ঘোরাঘুরি করছে, ওরা মেলারই লোক।

সাধন চারদিক তাকিয়ে দেখে নিল। তারপর আশির্বাদকে বলল, দাদু, এখানে তো কোনও মিষ্টির দোকান, জিলিপির দোকান, মনোহারি দোকান, মাটির তৈরি জিনিসের দোকান, হাতের কাজের দোকান, বেলুনওয়ালা, বাঁশিওয়ালা কোনও রকম কিছু দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে মেলা কই?

আশির্বাদ উত্তর দিল, এই মেলাতে ওসব কিছুই দেখা যায় না। ওসব কিছু আসে না এখানকার মেলাতে।

সাধনের মাথায় কিছু ঢুকল না। সাধনের মাথা গুলিয়ে গেল। সাধন আর কোনও কথা না বলে চুপ করে রইল।

একে একে অনেক লোক আসতে লাগল। যুবক, যুবতী, বিবাহিত ছেলেরা , বউরা, বৃদ্ধ, বৃদ্ধা সকলে এই জায়গায় এসে জমায়েত হতে লাগল। সাধন দেখতে পেল, কিছু সময়ের মধ্যে লোকে ভরে গেল ফাঁকা মাঠ। শয়ে শয়ে লোক। সাধন জিজ্ঞেস করল, দাদু, এখানে এত লোক জমায়েত হচ্ছে কেন? আশির্বাদ বলল, এই সমস্ত লোক মেলার লোক। সব লোক এখানকার মেলায় এসেছে।

সাধনের কোনও কিছু বোধগম্য হলো না। সাধন লক্ষ্য করল, কাঁটাতারের ওপারেওঅনেক লোক। সাধন বুঝল, এখানকার মেলাটা খুব বড় ও বিখ্যাত মেলা। তাই ওপারের লোকজনও এই মেলা দেখতে এসেছে।

সাধন বলল, দাদু, অম্বালিকার বয়স কত হবে?

আশির্বাদ বলল, একষট্টি বছর।

দেখতে কেমন?

খুবই সুন্দর। গায়ের রং ফর্সা। ঘন কালো চুল, চোখ দুটো টানাটানা। মাঝারি উচ্চতা।

ভদ্রমহিলা আপনার সাথে দেখা করার কোনও সময় দিয়েছে কি?

হ্যাঁ। ঠিক বিকেল সাড়ে তিনটে।

পাঁচ

অল্প সময়ের মধ্যে মেঘে ঢেকে গেল আকাশ। কিছুক্ষণ আগে যে সূর্যের আলো গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল, সেটা উধাও হয়ে গেল। গুমোট আবহাওয়া। কেউ কেউ বলতে লাগল, বৃষ্টি আসবে বোধ হয়।

সাধন দেখল, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত লোক একসঙ্গে জোরে কেঁদে উঠল। জোরে জোরে কান্না। হাউ হাউ করে কান্না। কান্নার শব্দে ভরে গেল সারা মাঠ। আকাশে বাতাসে শুধু কান্না শুধু কান্না। আশির্বাদও কাঁদতে শুরু করল। দু’চোখ দিয়ে অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল তার। কিছুক্ষণ পর সকলের কান্নার তীব্রতা ধীরে ধীরে কমে গেল। হেঁচকি তুলতে তুলতে আশির্বাদের কান্না থেমে গেল।

সাধন আশ্চর্য হয়ে গেল। আশির্বাদকে জিজ্ঞেস করল, দাদু, সকলে একসাথে এমন কেঁদে উঠল কেন? আপনি অঝোরে কাঁদছিলেন কেন?

আশির্বাদ বলল, মেলা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। এটা কাঁদাকাঁদির মেলা। এই মেলায় আসা লোকেরা তাদের আত্মীয়-স্বজন, আপনজন, প্রতিবেশী বন্ধুদের দু’চোখ ভরে দেখে আর কাঁদতে থাকে। অনেক সময় ধরে চলে এই মেলা। প্রথমে ধীরে ধীরে কান্না এরপর কান্নার শব্দ ক্রমশ বাড়তে থাকে। একসময় সবাই খুব জোরে জোরে কাঁদতে শুরু করে।

আশির্বাদ সাধনকে বলতে থাকল, ওই যে কাঁটাতারের দেখছিস, ওই বেড়ার এপারে ভারত আর ওপারে বাংলাদেশ। ভারতের লোকেরা তাদের বাংলাদেশের আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশি, বন্ধুদের দেখে কাঁদতে থাকে। আবার বাংলাদেশের লোকজন তাদের ভারতের আত্মীয়,বন্ধু, পড়শীদের দেখে অঝোর ধারায় কান্না করে। কাঁটাতারের বেড়ার এপারের ভারতের লোকজন আগে ওপারে বাংলাদেশে থাকত। ওপার থেকে তারা ভারতে এসে স্থায়ীভাবে ভারতে বসবাস করে। সদু’দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহযোগিতায় বছরের আজকের বিশেষ দিনে দু’পারের লোকজন দু’পারের লোকজনকে দু’চোখ ভরে দেখে আর কাঁদে। অজস্র ধারায় কাঁদে। শুধু কাঁদে, শুধু কাঁদে…

সাধন সামনের দিকে তাকাল। দেখল, লোকগুলো তখনও কাঁদছিল। নিচু স্বরে কাঁদছিল। সকলের চোখে জল। ঝরঝর করে জল ঝরে পড়ছিল।

সাধন তার হাতঘড়ি দেখল। দেখল, দুপুর আড়াইটে বাজে। আর এক ঘন্টা বাকি অম্বালিকা আসার।

সাধন আশির্বাদকে জিজ্ঞেস করল, দাদু, অম্বালিকা আপনার কে হন?

আশির্বাদ বলল, তিরিশ বছর আগে অম্বালিকা আমার প্রেমিকা ছিল। আমরা একে অপরকে খুব ভালোবাসতাম। এখন অম্বালিকার স্বামী আছে, সংসার আছে, ছেলে ওমেয়ে আছে। তিরিশ বছর আমাদের মধ্যে কোনও যোগাযোগ ছিল না।

সাধন জিজ্ঞেস করল, দাদু, অম্বালিকা তো বিকেল সাড়ে তিনটের সময় দেখা করার কথা, তাহলে এত সময় আগে পৌঁছেছিলেন কেন? এত সকাল সকাল এসেছেন কেন?

আশির্বাদ বলল, গাড়ি ও যানবাহন চলাচলের অসুবিধের জন্য যদি বিকেল সাড়ে তিনটের মধ্যে না পৌঁছতে পারি, সেজন্য আগে এসে পৌঁছেছি।কোনও রকম ঝুঁকি নিতে চাইনি।”

ছয়

বৃষ্টি আসতে পারে, এই ভেবে আশির্বাদ ও সাধন ছাতা ফুটিয়ে মাথায় দিয়ে আসনে বসে ছিল। সাধন বলল, দাদু,অম্বালিকার সাথে আপনার প্রেমের কথা বলা যাবে কি?

আশির্বাদ এতদিন তার প্রেমের কথা কাউকে খুলে বলেনি। কিন্তু সাধনকে আশির্বাদ জানাল, হ্যাঁ, অবশ্যই বলা যাবে। আশির্বাদ বলতে শুরু করলো, আমি ও অম্বালিকা দু’জনেই বাংলাদেশের বগুড়া জেলার সান্তাহার শহরে ‘ব্রাইট ফিউচার’ নামে চাকরির এক কোচিং সেন্টারে কোচিং নিতাম। কোচিং সেন্টারটি ছিল দোতলা। অম্বালিকা আসত টপশার্ট, জিনস পরে। অম্বালিকাকে এক মুহূর্ত দেখে ভালো লেগে গিয়েছিল আমার। অম্বালিকাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। মেয়েদের একটা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থাকে, যার সাহায্যে তারা বা’দিক, ডানদিক তো বটেই পেছনে হলেও বুঝতে পারে তাদের কেউ দেখছে। অম্বালিকা বুঝতে পারত, তাকে একটা ছেলে দূর থেকে গোপনে গোপনে দেখে। পরে অম্বালিকার কাছে শুনেছিলাম, আমাকে প্রথম দেখেই ভালো লেগে গিয়েছিল অম্বালিকার। আমার স্মার্ট, ফর্সা, লম্বা, সুন্দর চেহারা মুগ্ধ করেছিল অম্বালিকাকে। অম্বালিকা সবে কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়েছিল আর আমার ভর্তি হওয়া বেশ কিছুদিন হয়ে গিয়েছিল। আমার রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। চোখের সামনে শুধু অম্বালিকা। না, না। কেউ বলার আগে তাকে বলতেই হবে আমার মনের কথা। বলতেই হবে, অম্বালিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি, মনের গভীর থেকে ভালোবাসি।

আমি ঠিক করেছিলাম, অম্বালিকা যখন একা থাকবে, তখন গিয়ে বলব আমার মনের কথা। অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্রের দোতলা বারান্দার একধারে দাঁড়িয়ে একটা খবরের কাগজ দেখছিল। আমি বাথরুমে ঢুকেছিলাম। বাথরুমের ভেতর একটা গোটা সিগারেট খেয়েছিলাম। তারপর বুকভরা শ্বাস নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। সাহস নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম অম্বালিকার দিকে। অম্বালিকার সামনে আসতেই কী যে হয়ে গিয়েছিল! সব গুলিয়ে ফেলেছিলাম! কী বলব, কী করব খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অম্বালিকা খবরের কাগজ থেকে মুখ তুলে জিজ্ঞেস করেছিল, কিছু বলবেন? আমি তোতলাতে শুরু করেছিলাম, না, মানে ইয়ে,আজ কত তারিখ? অম্বালিকা চোখ বড় বড় করে বলেছিল, আমি কী ক্যালেন্ডার, নাকি পঞ্জিকা? বাড়িতে ক্যালেন্ডার নেই? বাড়িতে গিয়ে ক্যালেন্ডার দেখুন, যান। আমি ভয় পেয়ে তাড়াতাড়ি সরে পড়েছিলাম। কী হলো! এমন হলো কেন! আমি কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না।

অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্র থেকে বের হচ্ছিল। আমি দূর থেকে দেখতে পেয়েছিলাম। মনে মনে শক্তি সঞ্চয় করেছিলাম। আমি এগিয়ে অম্বালিকার কাছে যেতেই আবার সব গোলমাল পাকিয়ে গিয়েছিল। বেলুনের যেমন ফুস করে হাওয়া বের হয়ে চুপসে যায় আমার বুকের ভেতরটা ঠিক, তেমনই হয়েছিল। আমি কিছু বলতে পারিনি। অম্বালিকা বলেছিল, কী ব্যাপার? আমার সামনে অমন ঘুরঘুর করছেন কেন? আমি তাল হারিয়ে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, মানে ইয়ে, আচ্ছা, আগামিকাল কি এই কোচিং কেন্দ্র বন্ধ? অম্বালিকা দাঁড়িয়ে গিয়ে বলেছিল, আচ্ছা, আমার মুখ দেখে কী মনে হচ্ছে, আমি এই কোচিং কেন্দ্রের প্রিন্সিপাল? কোচিং কেন্দ্র খোলা না বন্ধ থাকবে, সেটা প্রিন্সিপালকে গিয়ে জিজ্ঞেস করুন, যান। অদ্ভুত ব্যাপার! এমন হচ্ছে কেন! আমি ভেবে কুল কিনারা পাচ্ছিলাম না। বন্ধু আয়ুষ্মানকে খুলে বলেছিলাম সব কথা। আয়ুষ্মান প্রেম করত। সে বলেছিল, শোন বন্ধু, শুধু তুই কেন, অনেক বড় বড় বাঘও মেয়েদের সামনে গিয়ে ভেড়া হয়ে যায়। তোর যেমন অবস্থা, তেমন আমারও হয়েছিল। তবে কোনও মতেই হাল ছাড়লে চলবে না, মনোবল হারালে চলবে না।

আমার হাতে সরু রবার দিয়ে প্যাঁচানো কিছু কাগজ ছিল। অম্বালিকার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম আমি। সে বারও আমার মুখ থেকে কোনও কথা বের হয়নি। উপরন্তু আমার হাতে থাকা কাগজে প্যাঁচানো সরু রবারটা ভয়ে আমার হাতের টান খেতে খেতে ফটাশ করে ছিঁড়ে গিয়েছিল। অম্বালিকা বলেছিল, কী ব্যাপার? এখানে কেন? আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল, আচ্ছা, আপনার কাছে কি সরু রবার হবে?

অম্বালিকা বলেছিল, কেন? চুল বাঁধবেন বুঝি? আমি খেই হারিয়ে ফেলেছিলাম। বলেছিলাম, না, মানে ইয়ে… কথা সম্পূর্ণ করতে পারিনি। দ্রুত পালিয়ে এসেছিলাম আমি।

আয়ুষ্মানকে গিয়ে বলেছিলাম, ধুর! ধুর! আমার দ্বারা এসব হবে না। আমাকে একশো কেজি ওজন তুলতে বল, তা আমি তুলতে পারব, কিন্তু আমি এসব বলতে পারব না।

আমি কোচিং কেন্দ্রের একদিকে একা একা বসে একটা সিনেমার পত্রিকা ঘাটছিলাম। অম্বালিকা এগিয়ে এসেছিল আমার দিকে। আমার কাছে এসে বলেছিল, কী করছেন? আমি থতমত খেয়ে গিয়েছিলাম। কোনওমতে বলেছিলাম, একটা সিনেমার পত্রিকা দেখছিলাম।

অম্বালিকা বলেছিল, একটা লালকালির কলম হবে? দরকার আছে। আমার ব্যাগের মধ্যে একটা লালকালিরকলম ছিল। আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গিয়েছিল। পড়িমরি করে ব্যাগের ভেতর থেকে আমি লালকালির কলম বের করে দিয়েছিলাম। কলম হাতে নিয়ে অম্বালিকা বলেছিল, এই যে শুনুন, এই সব সিনেমার পত্রিকা না ঘেঁটে সেই সময়টা অন্য কাজে দিলে জীবনে কিছু হবে। এই বলেই অম্বালিকা চলে গিয়েছিল।

এর দু’দিন পরের ঘটনা। কোচিং সেন্টারে ভেতর আমার হাতে একটা সিনেমার পত্রিকা ছিল। পত্রিকাটা আমার ছিল না। পত্রিকাটি ছিল আয়ুষ্মানের। আমাকে কিনতে দিয়েছিল। পত্রিকাটি আমি খুলে দেখিনি। তখনও অম্বালিকা কোচিং কেন্দ্রে আসেনি। বন্ধু আয়ুষ্মানের জন্য পত্রিকাটি আমার ব্যাগের মধ্যে ভরতে যাচ্ছিলাম, তখনই অম্বালিকা এসে দাঁড়িয়ে বলেছিল, এই যে শুনুন, আপনি যদি নায়ক হতে চান কিংবা অভিনয় জগতে যেতে চান, তাহলে ঠিক আছে। তা না হলে সিনেমার পত্রিকা না পড়ে সাধারন জ্ঞানের বই পড়ুন, কাজে দেবে। এই নিন আপনার লালকালির কলম। আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম অম্বালিকার মুখের দিকে। অম্বালিকা কলম ফেরত দিয়ে সিঁড়ি ধরে চলে যাচ্ছিল। কিছুটা গিয়ে অম্বালিকা থামলো, পেছন ফিরে তাকিয়ে আমার দিকে একটা হাসি দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে চলে গিয়েছিল। আমার মনে গিটার বেজে উঠেছিল। মেয়েদের মুখের হাসি বহু বহু বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। আমারও বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল। আমি জোরে বলে উঠেছিলাম, অম্বালিকা, আমি তোমাকে ভালোবাসি। আই লাভ ইউ অম্বালিকা… অম্বালিকা শুনে দাঁড়িয়ে গিয়ে আমার দিকে আবার একটা হাসি দিয়ে চলে গিয়েছিল। ক্রিকেট খেলায় ক্যাচ ধরলে যেমন আনন্দ হয়, তেমনই আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলাম আমি।

সেদিন থেকেই আমি আর অম্বালিকা প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। গভীর প্রেম। দু’জনে দু’জনকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। প্রেমের ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে গিয়েছিল আমাদের দু’জনের বাড়িতে। আমার বাবা-মা মারা গিয়েছিলেন। আমি ছিলাম একমাত্র সন্তান। আমার পিসির বাড়িতে থাকতাম। আমার পিসি রাজি থাকলেও অম্বালিকার বাবা-মা রাজি ছিলেন না। একদিন অম্বালিকা জানিয়েছিল, আশির্বাদ, আমাকে না জানিয়ে আমার বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে। পাত্র সরকারি চাকরি করে। আমি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারব না। আমি তোমাকেই বিয়ে করতে চাই।

আমি বলেছিলাম, অম্বালিকা, আমি কোনও কাজ করি না। আমি বেকার। তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমি চাই না তুমি আমাকে বিয়ে করে কষ্ট পাও । আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি বলেই তোমাকে সুখী দেখতে চাই। তুমি তোমার বাবা-মার পাত্রটিকে বিয়ে করো। অম্বালিকা বলেছিল, আমি তোমার জন্য দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা সব সহ্য করতে রাজি।

আমি জানিয়েছিলাম, অম্বালিকা, তুমি আমার সাথে ঘর বেঁধে কষ্ট পেলে আমার ভালোবাসাকে অশ্রদ্ধা করা হবে, আমার ভালোবাসাকে অমর্যাদা করা হবে। অম্বালিকা, তুমি যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো, তাহলে তুমি তোমার বাবা-মা’র পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করো।

অম্বালিকা তার বাবা-মা’র পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করেছিল। আমাকে দেখে অম্বালিকার সংসার করতে যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সেজন্য আমি বিয়ের রাতেই গোপনে বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে চলে এসেছিলাম। আর বাংলাদেশে ফিরে যাইনি। ভারতে এসে প্রথমে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে অবশেষে ডালখোলার ‘আপন জন’ অনাথ আশ্রমে এসে আমার মনটা থিতু হয়েছিল। পাকাপাকিভাবে এই আশ্রমেই থেকে যাই আমি।

সাত

সাড়ে তিনটে বাজতে এখনও তিরিশ মিনিট বাকি। আশির্বাদের বুকের ভেতর ঢিপঢিপ শুরু হয়ে গেল। জোরে জোরে চলতে লাগল হৃদপিন্ড। এমননিতে মানুষের হৃদস্পন্দন মিনিটে বাহাত্তর বার। কিন্তু মাপলে বোঝা যেত, আশির্বাদের হৃদস্পন্দন একশো পার হয়ে গিয়েছে। কোনও মতেই বুকের ঢিপঢিপকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না। আশির্বাদ নিয়মিত ব্যায়াম করে, প্রাণায়াম করে, তবু হৃদপিন্ডের জোরে চলাকে আটকাতে পারছিল না।

নিচু স্বরে ধীরে ধীরে কান্না চলছিল। আশির্বাদ তার হাতঘড়ি দেখল। সাড়ে তিনটে বেজে গেল। অম্বালিকার দেখা নেই। হাহাকার করে উঠল আশির্বাদের মন। তার আর সহ্য হলো না। সে বলল, সাধন, যা তো। একবার ওপারে জোরে ডেকে ডেকে অম্বালিকার খোঁজ করে আয়।

সাধন কাঁটাতারের বেড়ার কাছে গিয়ে জোরে জোরে ডেকে উঠল, ওপারে অম্বালিকা নামে কেউ আছেন? কোনও উত্তর এল না। সাধন আবার বলল, অম্বালিকা নামে যদি কেউ এসে থাকেন, তাহলে এখানে আসবেন। আশির্বাদ দেখা করতে এসেছে। কোনও সাড়াশব্দ নেই। সাধন ফিরে এসে বলল, না দাদু, অম্বালিকা আসেনি। আশির্বাদ মুষড়ে পড়ল। দুমড়ে মুচড়ে গেল তার মন। বিকেল চারটে বাজল। একটি ছেলে এসে বলল, এখানে আশির্বাদ নামে কেউ আছে? অম্বালিকা দেখা করতে এসেছে।

আশির্বাদ পড়িমরি করে উঠে দাঁড়াল। ছাতাটা গুটিয়ে নিয়ে বলল, আমিই আশির্বাদ। কোথায় অম্বালিকা? কোথায়? ছেলেটি পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে চলল। আশির্বাদ ছাতাটি ব্যাগে ঢুকিয়ে লাঠি নিয়ে সাধনের হাত ধরে ঠকঠক করে ছেলেটির পেছন পেছন যেতে লাগল। ছেলেটি আশির্বাদকে কাঁটাতারের বেড়ার কাছাকাছি নিয়ে গেল। আশির্বাদ বলল, কই, অম্বালিকা? কই? ছেলেটি ওপারে এক হাতে লাঠি ধরে অন্য হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে থাকা এক বৃদ্ধাকে দেখিয়ে বলল, ওই যে অম্বালিকা। এরপর ছেলেটি আশির্বাদকে দেখিয়ে বৃদ্ধাটিকে বলল, দিদিমা, এই যে আশির্বাদ।

আশির্বাদ অম্বালিকাকে দেখল। অম্বালিকাও আশির্বাদকে দেখল। আশির্বাদের মুখের ভাষা হারিয়ে গেল। এত বছর পর অম্বালিকাকে দেখে মনটা ভরে গেল তার। এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল অম্বালিকার দিকে। আশির্বাদের মনে পড়ল, অম্বালিকা তার বউ হয়ে রিকশা করে সারাদিন ঘুরেছিল। একদিন একটি রিকশা দেখে অম্বালিকা বলেছিল, আশির্বাদ, আমার মনে হয়, রিকশার আবিষ্কারক বোধ হয় প্রেমিক প্রেমিকা কিংবা স্বামী–স্ত্রীর কথা ভেবে দু’আসনের রিকশার সৃষ্টি করেছিল। আরও বলেছিলো অম্বালিকা, জানো আশির্বাদ, কোনও যুবক যুবতী রিকশায় পাশাপাশি বসে রিকশার হুডটি মাথার ওপর তুলে দিলে মনে হয়, যুবকটির বিয়ে করা নতুন বউ লজ্জায় মাথায় ঘোমটা দিয়ে রয়েছে। সেদিন রিকশা ভাড়া করে আশির্বাদ ও অম্বালিকা পাশাপাশি বসে রিকশার হুড মাথার ওপর তুলে অম্বালিকা নতুন বউ হয়ে সমস্ত সান্তাহার শহরটা ঘুরেছিল।

আট

আশির্বাদ এগিয়ে গিয়ে হাত দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া আঁকড়ে ধরল। কাছে থেকে প্রাণ ভরে দেখতে থাকল অম্বালিকাকে। বহু বছর পর দেখা হলেও অম্বালিকাকে চিনতে অসুবিধে হলো না আশির্বাদের। আশির্বাদের দু’চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল ঝরে পড়তে লাগল। অম্বালিকার চোখে চশমা। চশমার নিচ দিয়ে অজস্র ধারায় জল গড়িয়ে পড়তে লাগল অম্বালিকার।

আশির্বাদ বলল, অম্বালিকা, তুমি এত দেরি করলে কেন?

অম্বালিকা বলল, আমাদের নিজস্ব গাড়ির চাকা পরীক্ষা করে গাড়িতে উঠেছিলাম। দেখেছিলাম, ভালো চাকা। কিন্তু রাস্তায় চাকার মধ্যে কাঁটা ঢোকায় চাকা পাংচার হয়ে গিয়েছিল। তাই আসতে দেরি হলো।

আশির্বাদ বলল, অম্বালিকা, তুমি কেন আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছ।

ওপার থেকে অম্বালিকা বলে উঠল, আশির্বাদ, আমি তোমাকে দেখতে এসেছি। অনেকদিন তোমার সাথে দেখা হয়নি। একটিবার তোমাকে আমি দেখতে এসেছি।

বহুদিন পর অম্বালিকার মধুর কন্ঠস্বর শুনে আশির্বাদের হৃদয় জুড়িয়ে গেল। আশির্বাদ মনে মনে বলে উঠল, আহ, কি মিষ্টি কন্ঠস্বর!

আশির্বাদের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। বুকের হাড় পাঁজর সব মড়মড় ভেঙে গেল। তোলপাড় শুরু হয়ে গেল দেহের মধ্যে। শরীরের ভেতর উথাল পাথাল আরম্ভ হয়ে গেল।

আশির্বাদ গায়ের সব শক্তি দিয়ে বলে উঠল, অম্বালিকা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি। ওপার থেকে অম্বালিকা জোরে জোরে বলে উঠল, আশির্বাদ, আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। খুব ভালোবাসি।

আশির্বাদ ও অম্বালিকার দু’চোখ দিয়ে অশ্রুর বন্যা বয়ে যেতে লাগল যেন দু’জনের চোখে হড়পা বান এসেছে। অম্বালিকা বা’হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে ডান হাতে তার লাঠিটি সোজা ভাবে কাঁটাতারের বেড়ার মধ্যে প্রবেশ করাল। এদিক থেকে আশির্বাদও বা’হাতে কাঁটাতারের বেড়া ধরে ডান হাতে তার লাঠি সোজা করে কাঁটাতারের ভেতরে প্রবেশ করাল। দু’টি লাঠির মাথা কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে সোজা ভাবে একে অপরকে স্পর্শ করল। পরস্পরকে স্পর্শ করে সোজা রূপে রইল দু’টি লাঠি। জুড়ে থাকা দুটি লাঠির মধ্যে দিয়ে ওপারের অম্বালিকার ছোঁয়া আশির্বাদের দেহে আবার এপারের আশির্বাদের স্পর্শ অম্বালিকার শরীরে প্রবাহিত হতে লাগল। আশির্বাদের দেহে শক্তি চলে এল। দেহের প্রতিটি কোষ সতেজ হয়ে উঠল। মাংসপেশী সজীব হয়ে উঠল। চনমন করে উঠল মন। আশির্বাদ অম্বালিকার সোজা ভাবে থাকা লাঠির ওপর তার লাঠিটি সোজা করে রেখে অম্বালিকার লাঠির অনেক অনেকটা জায়গা স্পর্শ করাল।

আকাশে পাখিরা উড়ছিল। মৃদুমন্দ বাতাস বইছিল। গাছের পাতাগুলো নড়ছিল এদিক ওদিক। আকাশে মেঘ ভেসে চলছিল। আশির্বাদের লাঠি ও অম্বালিকার লাঠি পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রইল অনেকক্ষণ… অনেক সময়।

এরপর অম্বালিকা তার লাঠির ওপর আশির্বাদের লাঠি নিয়ে লাঠি ছুঁয়ে থাকল বহু সময়। বহু… বহু… বহু সময়।

আশির্বাদ জিজ্ঞেস করল, অম্বালিকা, তোমার সাথে কে এসেছে?

অম্বালিকা জানাল, আমার সাথে আমার স্বামী এসেছে। সে দূরে গাড়িতে বসে রয়েছে। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ।

নয়

আশির্বাদ ও অম্বালিকা তাদের লাঠি দুটো তির্যকভাবে ওপরের দিকে তুলল। দুটো লাঠি পরস্পরকে স্পর্শ করল। তারপর দু’টি লাঠি একে অপরকে জড়িয়ে থাকল অনেকটা সময়। সীমান্তরক্ষীরা জানাল, সময় শেষ। আর এখানে থাকা যাবে না।

আশির্বাদ ও অম্বালিকা লাঠি স্পর্শ করে একই রকম ভাবে দাঁড়িয়ে রইল। কোনও দিকে তাদের খেয়াল নেই। কোনও হুঁশ নেই ওদের।

সাধন বলল, দাদু, চলুন সময় শেষ হয়ে গেছে। ভ্রুক্ষেপ নেই আশির্বাদের। সাধন জানাল, দাদু, এখন না গেলে ডালখোলা যাওয়ার বাস পাবেন না। আশির্বাদ কোনও উত্তর দিল না। সাধন বলল, দাদু, আমি জানলাম, মেলার নিয়মকানুন না মানলে মেলায় আর আসা যাবে না।

আশির্বাদ লাঠি সরিয়ে নিল। অম্বালিকা লাঠি টেনে নিল। লাঠি দুটো বিচ্ছিন্ন হওয়ার সাথে সাথে ওরা দু’জনে জোরে জোরে কেঁদে উঠল। হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। মেলায় আসা অন্যান্য লোকজনের কান্নার সঙ্গে আশির্বাদ আর অম্বালিকার কান্নাও জুড়ে গেল। চারিদিকে শুধু কান্না আর কান্না। কাঁদাকাঁদির মেলা কান্নাতে ভরে উঠল।

দশ

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। ঘরে ফিরতে হবে। লাঠি নিয়ে আশির্বাদ চলতে লাগল। সাধন আশির্বাদকে ধরতে গেল। আশির্বাদ বলল, না। আমাকে ধরতে হবে না। আমার মাথা ঘোরা, শরীর দুর্বলতা সেরে গিয়েছে। এরপর আশির্বাদ একাই লাঠিতে ভর করে ঠকঠক করে চলতে লাগল। একা একা লাঠি হাতে ঠকঠক করে অপরের সহায়তা ছাড়া চলতে চলতে আশির্বাদ বুঝতে পারল, লাঠি মানুষকে হাঁটতে এবং ভারসাম্য ঠিক রাখতে সাহায্য করা ছাড়াও মানুষকে অসীম সুখ দেয়, অপার আনন্দও দেয়। পেছনে তখনও অনেক লোকের সমবেত কান্না চলছিল। কাঁদাকাঁদির মেলা চলছিল।

সাধন আশির্বাদের হাত ধরে টোটোতে ওঠাতে গেলে আশির্বাদ সাধনের সাহায্যকে প্রত্যাখ্যান করে একা একা টোটোতে গিয়ে উঠল। সাধন আশির্বাদের পাশে গিয়ে বসল। সন্ধ্যাবেলায় অম্বালিকাকেও ঘরে ফিরতে হবে। ওপারে অম্বালিকা একা তাদের গাড়িতে চালকের আসনে বসা স্বামীর পাশে গিয়ে বসল।

গাড়ির কাচ তুলে লাঠি বের করে লাঠি উঁচিয়ে অম্বালিকা আশির্বাদের দিকে তার লাঠিটি এদিক ওদিক নাড়াতে লাগল। মনে মনে বলল, আশির্বাদ, আমার ক্যানসার হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, আমি আর তিন মাস বাঁচব। পরের বছর আর দেখা হবে না। আর কোনও দিন দেখা হবে না। বাই…বাই…

সাধনের পাশে বসা আশির্বাদ লাঠিটি উঁচু করে অম্বালিকার উদ্দেশ্যে লাঠিটি এপাশ ওপাশ নাড়াতে লাগল। মনে মনে বলল, অম্বালিকা, পরের বছর আবার দেখা হবে এই মাকড়হাটের মেলায়। টা টা।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
পশ্চিমবঙ্গে বাস করেন। ঊষাতিটি, মেখলা ও হসন্তিকা নামে লেখকের মোট তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। নিয়মিত লিখছেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায়। ২০১৫ সালে 'কলকাতা পার্ক সার্কাস লেখক-শিল্পী মহল' থেকে 'ঊষাতিটি' নামক ছোটগল্প বইয়ের জন্য সাহিত্যে স্বর্ণপদক লাভ করেছেন। এছাড়াও ২০১৯ সালে কলকাতা 'বুলবুল' পত্রিকা আয়োজিত সাহিত্যে 'শহীদউদ্দিন খান' পুরস্কার লাভ করেছেন।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!