গল্প: মিতালীদি’র হাজব্যান্ড

জয়ন্ত সাহা
জয়ন্ত সাহা
10 মিনিটে পড়ুন
লেখক জয়ন্ত সাহা

মিতালী ইদানিং প্রায়ই শোনায়, “তোমার সঙ্গে আর ঘর করা যাচ্ছে না।উপায় আর নেই তাই…… “
আমি নাকি অকর্মার ঢেঁকি। কোন কাজই নাকি এখন আর আমার দ্বারা হয় না।আমি মিতালীকে মানে আমার স্ত্রীকে এ ব্যাপারে বিশেষ একটা দোষ দিই না। বাইরে যতই বীর পুরুষ সাজি না কেন ঘরের মধ্যে কেঁচো হয়ে থাকি। নিজের পাজামা-পাঞ্জাবির পর্যন্ত খোঁজ রাখি না।খস খস করে দুই পাতা লিখে দেবো হয়তো কিন্তু গুছিয়ে মশারী টাঙ্গানো এখনো পর্যন্ত শিখলাম না। প্রতি রাতে ভুল একটা হবেই। ওর কথার নিশ্চয়ই যুক্তি আছে।প্রতিবাদ করি নি। বড় ভুলো-মনের মানুষ আমি। দু দশক ধরে ডেলি প্যাসেঞ্জার। কিন্তু যাওয়ার সময় কখনও মান্থলি, মানি ব্যাগ, কখনও টিফিন বক্স, জলের বোতল নিতে আমার ভুল হবেই হবে। একাধিক দিন মিতালীই সামলে দিয়েছে।একদিন তো শিয়ালদা স্টেশনে বেদম অপদস্ত হতে হল। জরিমানা দিয়ে সে যাত্রায় রক্ষা পেয়েছি। যেমন ধরুন ক’দিন আগে সংসারের মাসকাবারি জিনিসপত্র কেনার জন্য মিতালী বাইশ দফার লম্বা চওড়া ফর্দ হাতে ধরিয়ে দিলো। ছুটির দিন ,ভাবলুম হাতের কাজটা শেষ করে মুদিখানার কাজটা ধরবো। আমার তখন মাথায় খেলছে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের লেটেস্ট আপডেট দেখে নিয়ে অফিসে পাঠানোর বন্দোবস্ত করা। মিডিয়া অফিসে কাজ। এখন শুরু হয়েছে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। বাড়িতে বসেও স্বস্তি নেই। আমার তো মাথায় হাত। ভাবলাম বলি,কাউকে বলো না একটু করে দিতে।তোমার কথায় কেউ ‘না’ করবে না। মিতালীর পাড়ায় বাড়তি সুনাম আছে। সমাজ সেবায় এক নম্বরে। কারুর বিপদে আপদে ও ছুটে যাবেই। কারুর কথাই গ্রাহ্য করে না। এই জগত সংসারে আমারও একটা পরিচিতি আছে। লিখি টিখি বলে অনেকেই চেনেন টেনেন।যৎসামান্য আদর যত্নও পাই। কিন্তু পাড়া-পড়শি মহলে আমি মিতালীদি’র হাজব্যান্ড হিসেবেই খ্যাত। আমার নামটা কিছুতেই কারুর মুখ দিয়ে খসে না। আগে খারাপ লাগতো। এখন সয়ে গেছে। কিছুদিন আগে এক সাহিত্য সভায় দশটা লোকের মাঝে অল্প বয়সী এক মহিলা বলে উঠলেন, “আরে! আপনি মিতালীদি’র হাজব্যান্ড না!বেশ লিখেছেন তো!আমরা একটা লিটিল ম্যাগাজিন করি।একটা লেখার আবদার করছি।” সবে কবিতা পড়ে মেমেন্টো নিয়ে বাহাদুরি পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ছবি তুলছি। ফেসবুকে দেবো। মেজাজটাই বিগরে গেল। এও এক ধরণের অস্তিত্ব সংকট।
গৃহকর্ত্রীর নির্দেশে শান্তি বজায় রাখতে আমাকে সেই ফরমান মানতেই হল। পাজামা পাঞ্জাবী পরে আর মুখে দু’দুটো মাস্ক আটকে,ফেস শিল্ড চাপিয়ে রওনা দিলাম ‘জয় বাংলা’ভেরাইটি স্টোরে। ‘জয় বাংলা’ নামটা এখন বেশ খাচ্ছে।আগে বাল্যকালে জয় বাংলা বললে বুঝতাম, এক ধরণের স্বপ্লকালীন চোখের রোগ।এর একটা ইংরেজি নামও আছে। বিশ্বাস করুন,এতো জায়গায় ঘুরি-ফিরি কোন দোকানের নাম যে ‘জয় বাংলা’ হতে পারে সত্যিই আমার জানা ছিল না। জয়বাংলা এ তল্লাটের অলংকার।গুছিয়ে সংসার-জীবনে নামতে হলে ‘জয় বাংলা’য় আপনাকে আসতেই হবে। যা চাইবেন তাই পাবেন। কেউ খালি হাতে ফেরে না। শুনেছি দোকানের বর্তমান মালিক শ্রীরামচন্দ্র এদেশী। ওর ঠাকুরদার ওপার বাংলা থেকে এসে একটা মুদিখানার দোকান দিয়েছিলেন।তার পর থেকেই দোকানের নাম হয়ে যায় জয় বাংলার দোকান। দোকানের উল্টোদিকেই ব্যাঙ্ক। সব সময় লোকজন গমগম করে। ‘জয়বাংলা’য় গিয়ে দেখি লম্বা সাইজের ভিড়।কেউ কাউকে যাতে ছুঁতে না পারে তার জন্য গোল গোল করে গোণ্ডি কাটা। আমি পাঁচ নম্বর গোন্ডিতে ক্যাবলার মতন দাঁড়ালাম। হাতে তিন তিনটি ঝোলা ব্যাগ। পাঞ্জাবির বুক পকেটে কালচে মোটা মানিব্যাগ। বাইরে তাকাবো কি!মুখোশে ডাকা মুখ। চেনা মানুষকে চিনতেও ভুল হয়ে যাচ্ছে।
অফিসে খবর পাঠাতে পাঠাতেই পড়ে নিয়েছিলাম মহামূল্যবান মাসকাবারি ফর্দ। লিভোসিন বেল, ভেসলিন, ধূপকাঠি, নকুলদানা, চানাচুর, মুড়ি, এক কেজি করে মুগ, মসুর, বিউলির ডাল, দশ টাকা দামের চারটে ভীমবার। ভীমবারে আবার ব্রেকেট দিয়ে লেখা, ‘দাম বেশি হলে নিও না। আমি দেখে নেব।’ ‘এই দেখে নেব’ কথাটাই আমার আপত্তি ছিল। কাকে দেখে নেবে আবার! অভিজ্ঞ মানুষ তো! ল্যাঙ্গুয়েজে খটকা লাগলো। আমাকে আবার কি দেখাবে! পরে উপলব্ধি করলাম মিতালী দাম বেড়ে গেলে ভিমবার আর ঘরে তুলবে না। সাবেকি প্রথাই ফিরে যাবে।আমার সাশ্রয়ী বউয়ের এমন টিপস আমি আগেও পেয়েছি। কিন্তু ওই যে বললাম ভুলো মনের মানুষ আমি।
লম্বা ফিরিস্তিতে আছে আরও পাঁচ মিশালি পদ। যেমন ধোনের গুঁড়ো, গোটা হলুদ, একশ গ্রাম চা পাতা,আটা, ঠাকুরের তেল। ঠাকুরের তেলে আবার চোখ আটকে গেল। সেটা আবার কি?পরিমাণও লেখা আছে। দু’শ গ্রামের শিশি। একটু শুনে নেব তার ও জো নেই। মিতালী তখন ‘দেশোদ্ধারে’ পাশের বাড়ি গেছে।মেয়ে বললো,”মা’কে এখন ডিস্টার্ব করো না বাবা।প্রাইম মিনিষ্টারের চেয়ে ব্যস্ত”।আর ডেকে শোনাটাও প্রেসটিজের ব্যাপার। এদিকে ফোনও আসছে ঘনঘন।অফিস সামলাবো না বাড়ি! শেষমেষ টুপি টাপা দিয়ে জয়বাংলা’র দোকানে।
ঠা ঠা রোদে ঠাঁই দাঁড়িয়ে গোলাকার বৃত্তে। মনে হলো আমার মতন হতভাগ্য স্বামী’রাই বোধহয় এমন শাস্তি ভোগ করে। পাঁচ নম্বর গোন্ডি থেকে যখন লাফিয়ে চার নম্বরে এলুম হাতের ঘড়ি বলছে পাক্কা পঁচিশ মিনিট লাগলো। একটু বেলা করেই বেরিয়েছি।হিসেব কষে দেখলুম,এখনও ঘন্টা দেড়েকের মামলা। মোবাইলটা আবার বাড়িতে ফেলে এসেছি। বাড়িতে যে লেটেস্ট ডেভলপমেন্টটা জানাবো তারও সুযোগ নেই ।দেরী হলেও ফ্যাচা়ং। কৈফিয়ত দিতে হবে।আমি নাকি পেট আগলা মানুষ।কোথায় কী বলতে হয় জানি না। এক সময় তো তোতা পাখির মতো পড়াতো। মা মেয়ে যৌথ উদ্যোগে ট্রেনিং দিয়েছে কতদিন ! এদিকে আবার খালি হাতেও বাড়ি ফেরা যায়না। আমারও তো একটা মান সম্মান আছে।
“তাপস বাবু না”, মুখ তুলে দেখি আমারই পাড়ার অংশু দা। একটি সরকারি ব্যাংকের ক্যাশিয়ার ছিলেন। টাকা গুনেই জীবনটা কাটালেন। বুঝলাম বউয়ের তাড়া খেয়ে রোদ্দুরে ঝোলাঝুলি নিয়ে ‘জয় বাংলা’য় হাজির।দেখলাম মাক্স সমেত আমাকে চিনতে পেরেছেন। ভালো লাগলো। অন্যের মুখে নিজের নামটা শুনে বেশ তৃপ্তি বোধ করলাম। সুযোগ পেলেই সভা-সমিতি করে বেড়াই।শীতকালে রবিবার তো কবি সম্মেলন বাঁধা। আমি যে কেবল মিতালীর হাজব্যান্ডই নই তা বোঝাতে কসুর করিনা। পত্রপত্রিকায় আবার নাম বেরোলে সবাইকে ঘটা করে দেখায়।
ঠায় দাঁড়িয়ে। কি আর করবো! এই গরমে এক লাইন কবিতাও মাথায় নাচছে না। ভুল করেছি। আজকের কাগজটা আনলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই পড়া যেতো। ওই একটু খেজুরে আলাপ জুড়ে দিলুম অংশু দা’র সঙ্গে।
মনেই ছিল। এ কথা সে কথায় ফর্দে লেখা ঠাকুরের তেলের কথাটা অংশু দা’র কানে তুললাম। “ঠাকুরের তেল!”ব্যাপারটা কী একটু বলতে পারবেন!”
একটু ভেবে বললেন অংশু বাবু বললেন, “ওঃহোঃ এটা বুঝলেন না?”
মনে মনে বলি, বুঝলে কি আর আপনাকে জিজ্ঞাসা করি।
“ঠাকুরের তেল হল,সন্ধ্যাবেলায় প্রদীপ জ্বালাতে তেল লাগে না! ওটা আপনার স্ত্রী বোধহয় ঠাকুর ঘরে আলাদা করে রেখে দেয়। এখন দু’‌শ গ্রামের শিশিও বেরিয়ে গেছে।”
সত্যিই তো হিসেব মিলে গেল। মিতালী তো দু’শ গ্রামের শিশি’ই তো আনতে বলেছে।আর পুজো আচ্চা তো করেই।
“মশাই,আপনার স্ত্রী তো খুব হিসেবি মানুষ। কেমন মেপে জুপে ঘর সংসার করে। “অংশু বাবু বলেই চললেন।
আমার কথা বলতে বলতে গলদঘর্ম হচ্ছে। ঠিক তখনই ডাক পড়ল,”মিতালীদি’র হাজব্যান্ড এগিয়ে আসুন।”
ইনিও দেখছি আমার স্ত্রীকে চেনেন? থলথলে চেহারার ভদ্রলোক লুঙ্গিটা আধাআধি গোটানো। একটা ফতুয়া টাইপ জামা গায়ে দিয়ে মেজাজে খদ্দের সামলাচ্ছেন।তিন তিনজন কর্মচারী যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মালপত্র দেওয়া নেওয়া করছেন। বেশ খাতির করে ফ্যানের তলায় বসালেন। “আপনার কথা অনেক শুনেছি মিতালী দি’র মুখে।আপনি তো খুব গুণী মানুষ। দিন দেখি ফর্দটা!হাওয়া খান।আমি মাল গুলো গুছিয়ে রাখি।বেশী সময় নেবো না।”
আমার ফর্দ! বুক পকেটে হাতড়াচ্ছি, মানিব্যাগ দেখছি পাজামা প্রায় খুলে যাবার জোগাড়।লাগাতার ঝাড়াঝাড়ি করছি।কিন্তু আমার ফর্দ কই? আশ্চর্য ব্যাপার! মাটিতে পড়ে গেল নাকি? তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি ‘লক্ষ টাকা’ দামী সেই টুকরো কাগজ।তার কোন হদিস নেই। সত্যিই আমি অস্বাভাবিক ঘামছি।তাহলে কি বাড়ি থেকে বেরনোর সময় না নিয়েই চলে এসেছি! ‘জয়বাংলা’র মালিক ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছেন আমার পরিস্থিতি। বাচ্চাদের মতন বলেই ফেললাম, “ভাই কিছু মনে করো না। আমি না একটা কাগজ হারিয়ে ফেলেছি।ওই ফর্দটা।তোমাদের মিতালীদি’র দেওয়া ফর্দ।”
“ওওও।আপনার মনে নেই কি কি আনতে হবে?”
দুঃখ দুঃখ গলায় বললাম,”দুটো একটা মনে আছে!দু’শ গ্রাম ঠাকুরের তেল, মুড়ি, চানাচুর, ভীমবার…”
আমি পড়ে গেলাম মহা খ্যাঁচা কলে।যেন স্কুল ছাত্রের মতো পড়া মুখস্থ দিচ্ছি।
“আপনি মাসের বাজার করতে এসেছেন তো। একটা কাজ করি, আমি হিসেব কষে দিয়ে দিই। কম বেশী যা হবে পরে দেখা যাবে।মিতালী দি আমার চেনা।এত টেনশন করবেন না দাদা।”
কী যে বিপদে পড়লাম। বাড়ি গিয়ে কী করে বলি ফর্দ হারিয়ে গেছে। অনেক দক্ষযজ্ঞ করে তিনটি ঢাউস ব্যাগ নিয়ে শুকনো মুখে বাড়ি ফিরছি ভীতু বিড়ালের মতন। মিতালী তো ফর্দ মিলিয়ে দেখবে। বাড়ি ঢুকে সদর দরজায় খিল তুলে দিলুম। মেয়ে তো আমাকে দেখে চিৎকার জুড়ে দিলো। “তোমাকে অফিস থেকে সিরাজুল কাকু বারবার ফোন করছেন, ফোনটা নিয়ে যাওনা কেন বলতো নিয়ে!” মেয়ে তো প্রায়ই ঝাঁজিয়ে উঠলো। সত্যি কথা বলতে কি অফিসের কথা আমার মাথা বেরিয়েই গেছে।
ঢোক গিলে বললাম, “তোর মা কোথায়! এখনো ফেরেনি?”
“দিপু কাকিমা অসুস্থ। দেখতে গেছে। তোমাকে খেয়ে নিতে বলেছে। “আপাতত স্বস্তি।টেবিলে চোখ যেতেই দেখলাম, সেই ফর্দ আমার মোবাইলে চাপা পড়ে আছে। সিরাজুলকে কোনরকমে সামালে মিসেসের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে বলে ফোন কেটে দিলাম। সমাজসেবা করে মিতালী ফিরল একটু বাদে। তারপরের ঘটনা বলার মত নয়। আমারও তো একটা মান সম্মান আছে।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
শিক্ষক ও সাংবাদিক জয়ন্ত সাহা দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষায় কবিতা,গল্প প্রবন্ধ, ফিচার লিখে আসছেন। এক সময় আনন্দ বাজার পত্রিকা, প্রবাসী আনন্দ পত্রিকা, দৈনিক বসুমতী, যোজনা, যুব মানস সহ বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। একাধিক পত্র পত্রিকাতে গল্প কবিতা প্রকাশিত হয়। তিনি বর্তমানে আকাশবাণী কলকাতার সংবাদ বিভাগে সম্পাদনার কাজে যুক্ত।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!