‘আমি তো মোহন কাওরা’ পর্ব এক

অবশেষ দাস
অবশেষ দাস
13 মিনিটে পড়ুন

ডায়মন্ড হারবার রোড লাগোয়া খোর্দ শাসন মোড় থেকে হাঁটা পথে তাজপুর গ্রামে যেতে মিনিট সাতেক সময় লাগে। ইট বিছানো সরু রাস্তা সাপের মত এঁকে বেঁকে গিয়েছে। রাস্তার বামপাশে তালবাগানের তলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটা টিউবওয়েল সারা গ্রামের একমাত্র সম্বল। তালবাগানের ছায়া মারিয়ে প্রতিদিন কটা ছাগল বাঁধা থাকে দুচারটে গরুও চোখে পড়ে। পূর্বদিকে ধূধূ মাঠ একটু এগিয়ে গেলেই পাইক পাড়া। এই রাস্তার ডানদিকে বিঘে কয়েক বাঁশবাগানে নিত্য মুরগি চড়ে বেড়ায় তাদের নখওলা পা দিয়ে মাটি আগলায়, খুঁটে খুঁটে কিসব খায়। রাস্তার গা ঘেঁষে কচুরিপানায় ভরাট হওয়া লম্বা নয়ন ঝুড়ি। ধার ঘেঁষে কচুগাছের ঢিবি। ঝাঁক ঝাঁক হাঁস ডানার ভেতর মুখ ঢুকিয়ে ডাঙাতেই জিরোচ্ছে। তাদের অন্য সঙ্গী সাথীরা সদলবলে এই পাড়ার আর যেসব পুকুর আছে সেখানে ভেসে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে এরা একসাথে হয়। দেখলে মনে হয়, হাঁসের মিছিল। চারিদিকে ঝোপঝাড় জঙ্গলে ভরে আছে। বাঁশবাগানের তলায় সারাক্ষণ বাতাস খেলে বেড়ায়। শুকনো বাঁশপাতা হাওয়া পেলে পাখির মত ওড়ে। কত শালিক পাখি, ছাতড়া পাখি এই বাঁশবাগানের আলো ছায়ার মধ্যে সংসার পেতেছে। বড় বড় বাঁশগাছের নেমে আসা কঞ্চিতে ফিঙে পাখির দোল খেতে দেখা যায়। বাঁশবাগান লাগোয়া উত্তর ও পশ্চিমে কয়েকটা পোড়ো পুকুর আছে। গরমের সময় জল কমে গেলে ছেলেরা হই হই করে মাছ ধরে। বাঁশবাগানের ভেতর থেকে এই পুকুরগুলোর চারপাশে মাছরাঙার গভীর যাতায়াত। আসা যাওয়ার পথে তালবাগান থেকে শুরু করে বাঁশবাগান লাগোয়া অল্প ব্যবধান রেখে দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ গুলোতে বাবুই পাখির ঝুলন্ত বাসা চোখে পড়ে। চারিদিকটা শান্তির জলছবি মনে হয়। সকালের ব্যস্ততা সরিয়ে পাইক পাড়ার স্তব্ধ দুপুর যখন ঝ্যাঁতলা পেতে একটু জিরিয়ে নিতে চায়, তখন মাঝে মাঝে কোকিলের উদাসী ডাক কানে আসে। দুপুরবেলা চারিদিক যখন শান্ত হয়ে যায় পাড়ার সমস্ত কুকুর এই বাঁশবাগানের তলায় এসে জট পাকায়। কখনও দৌড়ে ওরা পাশের পাড়ায় যায়। হুল্লোড় করে। বাঁশবাগানের গা ঘেঁষে খানিকটা পূর্বদিকে বেঁকে একটানা পশ্চিমে ছড়িয়ে আছে পাইকপাড়া। পাড়ার শেষে দক্ষিণে প্রশস্ত মাঠ। একটা সরু রাস্তা ওই মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়ে উস্থি রোডে গিয়ে মিশেছে। কেমন যেন একটা বাউল বাউল গন্ধ। বিশালাকার ইলেকট্রিক পোলগুলো নির্দিষ্ট ব্যবধান রেখে দক্ষিণ মাঠের বুক চিরে বহুদূর চলে গেছে। এ যেন শ্রীচৈতন্যের নীলাচল যাত্রা। ভরদুপুরে পাইক পাড়ার ছেলেপুলেরা ঘুমোয় না। নয়-দশ বছর বয়স না হলে তারা ঠিক মত জামাকাপড়ও পড়ে না। সকাল সন্ধ্যে এদের বেশিরভাগের লেখাপড়া নেই। কাদামাটি মাখে, খেলা করে, ছাতড়া পাখির মত হৈচৈ করে। আগানে বাগানে ঘুরে বেড়ায়। শালুক ফুল চিবোয়। পাড়ায় নতুন কোনো লোকজন দেখলে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। বিকেলবেলা পাড়ার মেয়েরা কলসী কাঁখে জল আনে স্কুলের কাছে থেকে। বাঁশবাগানের ভেতরে পাইকপাড়ার অনেক বউ ঝাঁট দিয়ে শুকনো বাঁশপাতা ঢিবি করে। কাঁখে করে বয়ে এনে উনুন ধারে রাখে। সন্ধ্যে হলে বাড়ি বাড়ি শাঁখ, ঘন্টা বেজে ওঠে। মা শীতলার থানে বছরে এক আধবার ধূপকাঠি জ্বলে। কিন্তু পাইক বাড়ির বউরা বাড়ির দাওয়ায় দাঁড়িয়ে শীতলা মায়ের থানের দিকে মুখ করে প্রদীপ দেখায়। সনাতনের বড় বউমা লক্ষ্মী একমাত্র সন্ধ্যার পর উঠান মারিয়ে থানে এসে প্রদীপ দেখায়। মাথায় ঘোমটা গলার বামদিক দিয়ে ডানদিকে আঁচল টানে। প্রদীপের আলোতে যুগল কিশোরের বউ লক্ষ্মীর মুখটা প্রতিমার মত মনে হয়।

পাইকপাড়া থেকে প্রায় ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে প্রাথমিক স্কুল থাকলেও মাস্টার মশাইদের ডেকে হেঁকে নিয়ে যেতে হয়। মাঝখান থেকে অনেকেই ছেড়ে দেয়। অনেকে খিচুড়ি স্কুলে যায়। একমুঠো করে খাওয়া হয়। একটু একটু লেখাপড়া শেখা হয়। লেখাপড়ার আলো তাদের চোখে জ্বলবার আগে সংসার পেতে বসে। সাত তাড়াতাড়ি তারাও ছেলেপুলেদের বাবা মা হয়ে যায়। তাই বলে শাসন তাজপুর মধ্যবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়টি একেবারেই রত্নহীন নয়। এই স্কুল থেকে অনেকেই কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে। তবে সেটা পাইকপাড়ার কেউ নয়। মন্ডল, বৈদ্য, কীর্তনিয়া পদবী বহনকারীরা সেদিক থেকে এগিয়ে আছে। এ পাড়ায় বিশাল উন্নতি করা পরিবারটি পূর্ব-পুরুষদের দুর্বলতার গন্ধ মুছে ফেলতে নিজেদের পদবীটাই পরিবর্তন করে ফেলেছে। তারা যেন এ গ্রামের কেউ নয়, এদের কেউ নয়। তারা আগের পদবী মুছে রায়চৌধুরী পদবী ধারণ করেছে। অভিজ্ঞ লোকজন অনেকেই বলেছেন, ‘পদবী পরিবর্তন করাটা পূর্বপুরুষদের ঠাট্টা করা ছাড়া আর কিছু নয়।’ সেদিক থেকে পাইকপাড়ার মাধব পাইক একেবারেই পূর্ব পুরুষদের অনুগামী হয়েছে বলা যায়। তখনকার দিনে ফকির চাঁদ কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়েও চাকরি-বাকরি কিছুই জোটায়নি। চুপরি, ঝোরা বিক্রি করেই জীবন কাটাচ্ছে। সেজন্যই তার কোনো আক্ষেপ নেই, বরং সে সন্তুষ্ট। মাধবের ভরা সংসার। চাষবাস আছে। বাবাকেলে জমিজমা নাড়াচাড়া করে তাদের চলে যায়। মাধবের ছেলে দুটো ঘরের ধান চাল খাওয়া মোরগের মত ডাঁটো। ঠিকমত লেখাপড়া না শিখলেও ওরা বেশ চালাক চতুর হয়েছে। পাড়ার সমবয়স্ক ছেলেদের ধরে ধরে মারে। চাকতি খেলায় তাদের কেউ হারাতে পারে না। টিকিট খেলা, মার্বেল গুলি খেলা, ডুবসাঁতার, চিৎ সাঁতার সবকিছুতেই তারা এগিয়ে। ছোট ছেলেটা বছর দশেক হবে। বড়টা আরও দুবছর বেশি। তাদের মাটির দাওয়া খড়ের চাল। উঠানের দিকে দিকে নেমে আসা খড়ের চালের নীচের বাঁশে শালিক পাখির পিঁজড়ে ঝুলে থাকে। ওটা শালিক পাখির ঘর। মাধবের বড় ছেলে চিকু বছর দুয়েক আগে একজোড়া শালিকের ছানা এনেছিল। এখন বেশ বড় হয়ে গেছে। বাড়িতে যখন কেউ থাকে না, তখন মাধবের বউ দুলালিকে পাখি দুটো সঙ্গ দেয়। পাখিদুটোর জন্য দুলালি কোথাও যেতে পারে না। ছোটো ছেলে ভুজো একটা কুকুর পুষেছে। নাম রেখেছে চ্যাপেল। কুকুরটা ঠিক মত খেতে পায় না। পাখির খেতে দেওয়া আর কুকুরের খেতে দেওয়া তো এক নয়। আসলে দুলালি পেরে ওঠে না। চ্যাপেল মাধবের বাড়ির পোষ্য হলেও সে গোটা পাইকপাড়ার হয়ে গেছে। সকালবেলা বেড়িয়ে যায় বেলার দিকে কোনো কোনো দিন ফিরে আসে। মাটির দাওয়ায় শুয়ে লেজ নাড়ায়। কোনো কোনো দিন সারাদিনের মত উধাও হয়ে যায়। চ্যাপেল রাতে কখনও বাইরে থাকে না। বাড়ির ভেতর থাকে। চ্যাপেলকে, দুলালি নাম ধরে একবার ডাকলেই কোলের কাছে এসে শুয়ে পড়ে।

সনাতন ঘর থেকে বেরিয়ে পথের উপর দাঁড়িয়ে আছে। মাধব ঘর থেকে বেরিয়ে হাটের দিকে যাচ্ছে। মাধব সনাতনকে দেখে জিজ্ঞাসা করলো, কাকা কেমন আচো? খেতে পারতেচো তো?
– ‘এই আচি বাবা। অনেক হইচে, এবার যেতে পারলে বাঁচি।’
– ‘ওরকম কথা বলুনি কাকা। তোমার আটটা ছেলে। সাতটা হাতে ধরতে হয়ে গেচে। কচিটা আর একটু বড় না হলে তোমার যাওয়া হবে নে। তাড়াতাড়ি ভালো হয়ে ওটো। আমাদের বাড়ি এবেলা চা খেতে যেও। একমুঠো মুড়ি আলুভাজাও খেয়ে আসবেকনে।’
– ‘আচ্চা । আচ্চা বাবা যাব। তুই কোথায় চললি?’
– ‘কটা মুরগি বাচ্চা কিনিচি। ওদের জন্য ওষুধ আনতে যাচ্চি। কদিন বাদেই তো ডিম দেবে। ছেলেপুলে আনন্দ করে খাবে। ঘরে চাল, আলু, ডিম থাকলে বুকটা আঁটা থাকে। যাই কাকা। ওবেলা দেখা হবে।’ সনাতনের বাড়ির পাশেই মাধবের বাড়ি। দুই বাড়ির খড়ের চালের জল এক ছাঁজ দিয়ে নেমে যায় পুকুরের দিকে। কত খুঁটিনাটি বিষয়ে ওদের মধ্যে অশান্তি হয়েছে। ওরা কখনও সম্পর্ক ভাঙেনি। ঘরের চাল ডালের মত ঠিক মিশে গেছে। উনুনের উপর মাটির হাঁড়ি বসিয়ে খানিকটা জ্বাল দিলে জল ফুটতে শুরু করে। ধোয়া চাল ডাল ওই ফোটা জলে যখন ঢেলে দেওয়া হয় তখন হাঁড়ির মধ্যে বেশ মারামারি শুরু হয়। এমনই অবস্থা হয় যে শেষ পর্যন্ত হাঁড়ির মুখ থেকে মাটির সরা টুকুও সরিয়ে নিতে হয়। হাঁড়ির ভিতর চাল ডালের গজর গজর চলতেই থাকে। চাল ডাল ফুটতে ফুটতে একটা সময় মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। উনুন থেকে নামানোর পর সব ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায়। মাটির হাঁড়ির বুকে অশান্তির যে ছাপটুকু লেগে থাকে তার সবটুকু গৃহলক্ষ্মী
আপন দক্ষতায় মুছে ফেললে বোঝার উপায় থাকে না। কত অশান্তির পরে এক হাঁড়ি শান্তির অন্নভোগ হয়েছে। শুধু সনাতন, মাধব নয় গোটা পাইকপাড়ার ছবিটা অনেকটা সেরকম। অশান্তি তো লেগেই থাকে। পাখির চেয়ে এদের কিচিমিচি আরও বেশি। থানা-পুলিশ, কেশ, আইন-আদালত এরা বছর বছর মাড়িয়ে আসছে। তবুও এদের ঘেন্না ধরেনি। এদের ঘরে ভাত না থাকলেও কোর্ট কাচারি আছে, কেশ আছে। মারামারি, অশান্তি যতই হোক ওদের অল্প বাজেটের কালিপূজোতে সবাই মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়। বউ-মেয়ে, কুটুম থেকে শুরু করে জামাই বাড়ির লোকজনেরাও এই পূজাতে নাচানাচি করে। নেশা, গালিগালাজ এই পাড়ার আট দশটা সাধারণ ঘটনার মত পরিচিত। এদের মূল লড়াইটা ভাতের। শিক্ষাদীক্ষা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা নেই। পাইকপাড়ার কেলেঙ্কারি নিয়েও অনেকে ফিসফাস করে। সেসব কথা অনেকে মুখে আনতে চায় না। মেয়ে মেয়ে ঝগড়া হলে ওরা যখন মুখে লাগাম একদম খুলে দেয়। তখনই সব জানাজানি হয়ে যায়। পাইক পল্লীর এই ছবি নিত্যদিনের, বহুদিনের। আজ, কাল, পরশুরও। পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সনাতনের মাথাটা একটু ঘুরে যায়। শরীরটা টাল খেয়ে যায়। এক পাঁজা কলসি মাথায় নিয়ে সনাতনের শানো ছেলে বৃন্দাবন বাড়ির কাছে চলে এসেছিল। সনাতনকে টাল খেতে দেখে ঘাড়টা শক্ত করে ডানদিকে দুলিয়ে কঞ্চির বোঝা মাটিতে ফেলে দেয়। সনাতন মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ার আগেই বৃন্দাবন তাকে ধরে নেয়। মাটির উঁচু দাওয়া থেকে সনাতনের বড় বউমা লক্ষ্মী জল ভর্তি বালতি নিয়ে দৌড়ে আসে। পথের পাশে বাঁশের খাটিয়াতে বাঁশ বাগানের ছায়া এসে জায়গাটা শীতল পাখি করে রেখেছে। ওখানেই সনাতনের মাথাটা লক্ষ্মী ধুইয়ে দেয়। পরম মমত্বে আঁচল দিয়ে মাথাটা মুছিয়ে দেয়। বৃন্দাবন আর লক্ষ্মী সনাতনকে দুদিকে ধরে লম্বা উঠোন পেরিয়ে দাওয়ায় পাতা তক্তপোষের ওপর বসিয়ে দেয়। সনাতনের বড় ছেলে যুগলকিশোর বলে সারাবেলা কোদাল কুপিয়ে একটু আগে ফিরেছে। স্নান সেরে একমুঠো রেশনের চালের ভাত মুখে দেবার জন্য অপেক্ষা করছিল তারমধ্যেই এই ঘটনা। সে বলল, এক সপ্তার বেশি হয়ে গেল জ্বরে ভুগদেছো কি দরকার বলো তো রোদে গিয়ে দাঁড়গে থাকার। নিজে তো মরবে, আর সবাইকে মারবে। বলতে বলতে দাদার পাশে এসে সে বসে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস করে। তাজপুরের সবার ঘরে এখনও আলো পৌঁছায়নি। অনেকে হুকিং করে আলো জ্বালে। বারবার লোড সেটিং হয়। এখন তবে লোড সেটিং নয়। সনাতনের বাড়িতে কোনো ইলেকট্রিক পাখার ব্যবস্থা নেই। রাস্তা থেকে টেনে আনা তারে এদের ঘরে শুধু আলো জ্বলে। টিভিও নেই। মেজো ছেলেটার ঘরে একটা রেডিও আছে। আকাশবাণীর যখন খবর হয় তখন সনাতন ওর ঘরে গিয়ে খানিকটা বসে থাকে। খবর শোনার বাতিক তার বহুকালের। কিন্তু এই পাড়াতে রেডিও কেনার সামর্থ্য সবার ছিল না। একে একে দুএকজন টেলিভিশন কিনেছে। যাদের বাড়িতে টেলিভিশন আছে তারা বাঁশের মাথায় অ্যান্টেনা বেঁধে দাঁড় করিয়ে রাখে।অ্যান্টেনার সঙ্গে তারের সংযোগের সঙ্গে কোনো ব্যাঘাত ঘটলে ছবি খুব ঘোলা হবে। সাউন্ড অস্পষ্ট শোনাবে। সাদা কালো টেলিভিশন হলেও গোটা পাড়া উজাড় হয়ে টেলিভিশন দেখতে আসে। পাইকপল্লী তে কারোর টেলিভিশন নেই। রামায়ণ মহাভারত দেখার জন্যে ওরা মন্ডল পাড়ায় যায়। কোনো কোনো দিন দাওয়া ভর্তি লোক হয়ে যায়। টেলিভিশন উঠোনে টেবিল পেতে চালাতে হয়। মন্ডল পাড়ার তপনদের বাড়িতে টেলিভিশন আছে। বাড়িতে বেশি ঝামেলা হলে তপনের বউ আবার রাগ করে। মুখ ভারী করে থাকে। সেজন্য অনেকেই যেতে চায় না। কালিপূজার পরেরদিনেই পাইকপাড়াতে বিকেল পাঁচটা থেকে ভিডিও আসর বসে। বিকেল পাঁচটা থেকে পরেরদিন সকাল সাতটা পর্যন্ত। তেমন হলে বেলা নটা গড়িয়ে যায়। পাইকপাড়ার মা বোনেরা একরাতে তিন চারটে সিনেমা দেখে। গুরুদক্ষিণা, বেদের মেয়ে জোৎস্না, রক্তে লেখা, ভাই আমার ভাই, এরকম কত সিনেমা পাইকপাড়ার ভিডিওতে দেখেছে তার ঠিক নেই। পাইকপাড়ার ছোটরাও দেখেছে এই সিনেমা। এদের ঘরের বাজনা অষ্টপ্রহরে আটবার বাজে। টানা তিনদিন হাঁ হাঁ করে মাইক বাজে। এতেই এদের আনন্দ। নিরন্ন পাইকপাড়া কালীপূজার দুটো দিন ঝলমল করে ধারদেনা হলেও সবাই যেন একগতিতে চলতে চায়। তাদের এই দুই দিনের দেখানো গতি, বানিয়ে তোলা সারাবছর ঝিমিয়ে থাকা পাইকপাড়ার ছবিটা আসল সত্য । তবুও উৎসবের আনন্দ এদের জীবনে কতখানি অন্তরঙ্গ কালীপূজা না এলে বোঝার উপায় থাকে না। ধারদেনা দেখে এদের ভয় নেই। এই পাড়ার অনেকেই দুর্গাঠাকুর তোলার স্বপ্ন দেখে। এক একজন সাতদিনের রোজগারের সমান চাঁদা দেবে বলে। কিন্তু এদের খেয়াল থাকে না মাসে এরা কদিন রোজগার করে। খুব বেশি হলে আঠারো কুড়িদিন এরা কাজ করে। সবাই নয়। বেশিরভাগ দশ পনেরো দিন কাজ করে। বাড়ির বউ-মেয়েরা বিড়ি বাঁধে । বাজারে পেনের কাজে যায়। হাটবারে ঝ্যাঁতলা বিক্রি করে। খালের ধার থেকে, পুকুর থেকে মেয়েরা কতরকম পাতানাতা তোলে, শাক তোলে। হাটে এসে বেচে দিতে পারলে দুটো পয়সা পায়। ব্যাগ ভর্তি বাজার করতে না পারলেও দু চারদিন চলে যাওয়ার মতো রসদ তারা পেয়ে যায়। কিন্তু দুর্গা ঠাকুর তোলার স্বপ্ন তারা ছাড়তে পারে না।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
জন্ম: দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা। বাবা গৌরবরণ দাস এবং মা নমিতা দেবী। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি তুলনামূলক ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা। দুটোতেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি। এছাড়া মাসকমিউনিকেশন নিয়েও পড়াশোনা করেছেন। বর্তমানে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার বিদ্যানগর কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক। প্রথম লেখা প্রকাশ 'দীপশিখা' পত্রিকার শারদ সংখ্যায়। তাঁর কয়েকটি কবিতার বই: মাটির ঘরের গল্প ( ২০০৪), কিশোরবেলা সোনার খাঁচায় (২০১৪), হাওয়ার নূপুর (২০২০) সহ অজস্র সংকলন ও সম্পাদিত গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার আগেই তিনি একজন প্রতিশ্রুতিমান কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। কবিতা চর্চার পাশাপাশি প্রবন্ধ ও কথাসাহিত্যের চর্চা সমানভাবে করে চলেছেন। কবি দুই দশকের বেশি কাল ধরে লেখালেখি করছেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ও সংকলনে। বেশকিছুদিন সম্পাদনা করেছেন ছোটদের 'একতারা' সাহিত্য পত্রিকা। এছাড়া আমন্ত্রণমূলক সম্পাদনা করেছেন বহু পত্র-পত্রিকায়। তিনি গড়ে তুলেছেন শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক দুটি অন্যধারার প্রতিষ্ঠান 'বাংলার মুখ' ও মেনকাবালা দেবী স্মৃতি সংস্কৃতি আকাদেমি।' তাঁর গবেষণার বিষয় 'সুন্দরবনের জনজীবন ও বাংলা কথাসাহিত্য।' পাশাপাশি দলিত সমাজ ও সাহিত্যের প্রতি গভীরভাবে মনোযোগী। ফুলের সৌরভ নয়, জীবনের সৌরভ খুঁজে যাওয়া কবির সারা জীবনের সাধনা। সবুজ গাছপালাকে তিনি সন্তানের মতো ভালবাসেন। সুন্দরবন তাঁর কাছে আরাধ্য দেবী। সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন অজস্র পুরস্কার ও সম্মান: সুধারানী রায় স্মৃতি পুরস্কার (২০০৪), বাসুদেব সরকার স্মৃতি পদক (২০০৬), রোটারি লিটারেচার অ্যাওয়ার্ড (২০০৬), ১০০ ডায়মণ্ড গণসংবর্ধনা (২০০৮), পাঞ্চজন্য সাহিত্য পুরস্কার (২০১০), শতবার্ষিকী সাহিত্য সম্মাননা (২০১১), এশিয়ান কালচারাল লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড (২০১৪), ডঃ রাধাকৃষ্ণন সম্মাননা (২০১৫), ডি.পি.এস.সি. সাহিত্য সম্মাননা (২০১৮), আত্মজন সম্মাননা (২০১৯), বিবেকানন্দ পুরস্কার (২০১৯), দীপালিকা সম্মাননা (২০১৯), সংহতি সম্মাননা (২০২০), সুকুমার রায় পুরস্কার (২০২০)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!