ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেনের অন্যতম সহযোগী প্রথম বিপ্লবী বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের আত্মাহুতি দিবস আজ।
২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৩২ সাল। পাহাড়তলীর একটি নির্জন স্থান। ঘুটঘুটে অন্ধকার। একে একে সবাই এলেন। যথাসময়ে অন্ধকার ফুঁড়ে হাজির হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলার বিপ্লবী মহানায়ক মাস্টারদা সূর্যসেন। কমসময়। সংক্ষিপ্ত নির্দেশনা। প্রীতিলতা তার মাকে পৌঁছানের জন্য তাকে একটি চিঠি দিলেন। সূর্যসেন দ্রুত অন্ধকারে মিশে গেলেন। রাত প্রায় ১০ টা। তারাও রওনা দিলেন ইয়োরোপিয়ান ক্লাবের দিকে। সবার হাতে অস্ত্র। প্রীতিলতা ও সিনিয়রদের হাতে পিস্তল। অন্যদের হাতে বোমা। প্রীতিলতাই কেবল জানেন- তিনি আর ফিরবেন না। মা’র কথা মনে পড়ে। বাবা, দুই ভাই, আরও দুই বোন ঘরে।
রামকৃষ্ণের মুখখানি চোখের সামনে ভেসে এলো। তার চাইতে মাত্র এক বছরের বড়- ২০ বছরের যুবক রামকৃষ্ণ। সেদিন ছিল ২ ডিসেম্বর, ১৯৩০ সাল। তারই মতো – চাঁদপুর রেলস্টেশনে বাংলার অত্যাচারী, পুলিশের আইজিপি টি যে ক্রেগকে মারতে গিয়ে চাঁদপুরের, এসডিওকে গুলি করে হত্যা করেন। ধরা পরেন। বিচারে তার ফাঁসি। সহকর্মীদের যাবজ্জীবন। ফাঁসি কার্যকর হয় ৪ আগস্ট, ১৯৩১ সালে। দলের নির্দেশে রামকৃষ্ণের সাথে প্রায় প্রতি রোববার আলিপুর জেলে, সামান্য সেজে, বোনের পরিচয়ে দেখা করতেন। তার শিক্ষিকা উত্তরা চক্রবর্তীর লেখায়- কিঞ্চিৎ প্রেমের জন্মলাভ। বেথুন কলেজ হোস্টেল থেকে অনেক দূরে, প্রতিবার নতুন নতুন পথে যাওয়াআসা। মৃত্যুর জন্য অপেক্ষমান মানুষটির সুন্দর মুখখানি প্রাণভরে দেখা- তার কথা শুনা- অনেক কথা বলা। তিনি জানতেন- একজন বিপ্লবীর প্রেমে পড়া- মৃত্যুদন্ড তুল্য অপরাধ। তবে আজকের অভিযানের প্রেরণার উৎস সেই রামকৃষ্ণই। কিন্তু তার মতো পুলিশের হাতে কোনোক্রমেই ধরা পরা নয়। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে বিজয়লাভ অথবা শত্রুর হাতে মৃত্যু অথবা মাস্টারদার নির্দেশ মোতাবেক আত্মাহুতি দেন।
রাত প্রায় সাড়ে দশটা। প্রীতিলতার সশস্ত্র বাহিনী চট্টগ্রাম ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে। সফল অভিযানের শেষ পর্যায় তিনি গুলিবিদ্ধ হন। সবাইকে পালাবার সুযোগ করে দিয়ে রাত বারোটার পরে তিনি পটাসিয়াম সায়ানাইড খান। মারা যান আরও পরে। মৃত্যু হয় ২৪ সেপ্টেম্বর ।
শেষ রাতে বৃটিশ আর্মি সার্চ লাইট জ্বালিয়ে ঘরে বাইরে আহত ও নিহতদের খুঁজে এনে বারান্দায় লাইন করে রাখলো। নরনারী সবাই বিলেতি পোশাক পড়া। একজনের লুঙ্গি, পান্জাবী ও মাথায় কাপড় জড়ান জেলেদের পোশাক। তাকে নামিয়ে রাখতেই মাথার কাপড় সরে গিয়ে চুল বেড়িয়ে গেল। সংগে রাখা নোট বই পড়ে তার পরিচয় ও আক্রমনের উদ্দেশ্য জানা গেল।
উপরের পাতায় শ্রী কৃষ্ণের ছবি। ভিতরে সুন্দর ইংরেজি হস্তাক্ষরে লেখাঃ
I sacrifice myself in the name of God Whom I Have adored for years.
আমার দেশের মুক্তির জন্যই এ সশস্ত্র যুদ্ধ করছি। আজকের অভিযান স্বাধীনতা যুদ্ধের একটা অংশ… নারীরাও পারে- তা প্রমাণ করার জন্যই, আমি নেতৃত্ব গ্রহণ করেছি। আমি আত্মত্যাগের জন্য অগ্রসর হলাম
স্বাক্ষর
প্রীতিলতা
২৩/০৯/১৯৩২
বাবা পৌরসভার অবসরপ্রাপ্ত কেরানী। তাই দ্রুত সব সংবাদ জানতে পারলেন। তার ডাক নাম রাণী, রাণীমা বলে কপাল ঠুকছিলেন।
২৫ তারিখ সকাল বেলা পুলিশ তাকে থানায় নিয়ে যায়। প্রীতিলতার বাম হাতে ও বুকের পাশে গভীর ক্ষতচিহ্ন। পাঞ্জাবি ও তার নীচে মেয়েলী পোশাক গুলো প্রচুর রক্তে ভিজে জমাট ও শক্ত হয়ে গায়ের সাথে এঁটে গিয়েছে। তীব্র বিষক্রিয়ায় মুখমণ্ডল বিবর্ণ। তিনি একটা শাড়ি কিনে এনে পানি দিয়ে রক্ত মুছে রক্তাক্ত পোষাকগুলো খুলে মৃতদেহে শাড়িটি পড়িয়ে/পেচিয়ে দেন। মাকে লেখা পত্রে লিখেছেনঃ
‘মাগো তোমার সাথে আর আমার দেখা হবে না। স্বপ্নে দেখেছি, তুমি কাঁদছ৷ তোমার চোখের পানিতে আমার বুক ভিজে গেছে। আমি ইচ্ছে করে তোমার চোখ মুছে দিইনি৷ আমার জন্য তোমাকে তো আরও অনেক কাঁদতে হবে।’