‘মঙ্গল আসর’-এ স্মরণ ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘আহমদ ছফা’

আবদুল্লাহ আল মোহন
আবদুল্লাহ আল মোহন
23 মিনিটে পড়ুন
আহমদ ছফা স্মরনে 'মঙ্গল আসর' এর আলোচনা সভা, ২৭শে জুলাই

১.

ঢাকার ভাসানটেক সরকারী কলেজের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর প্রতি সপ্তাহের নিয়মিত জুম আলোচনা গত ২৭ জুলাই ২০২১ মঙ্গলবার রাত ৯.০০ টায় অনুষ্ঠিত হয়। চিন্তাচর্চায় আলোচ্য বিষয় ছিলো ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘আহমদ ছফা’। কথামালা উপস্থাপন করেন ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য সিরাজুল কবীর সাকিব মহাত্মা ‘আহমদ ছফা’ এবং ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে, আর ‘আহমদ ছফা’কে নিয়ে রাবেয়া সুলতানা নীপা। সুমাইয়া কীরাণের কণ্ঠে ‘আলো আমার আলো ওগো আলোয় ভুবন ভরা’ রবীন্দ্র সংগীতের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দেড় ঘন্টাধিক সময় ব্যাপ্তির আলোচনাসভায় অংশ নেন মো: আল আমিন, রাহুল আদিত্য, সুমাইয়া কীরাণ, শেখ আবু সাঈদ, সায়মন শুভ প্রমুখ। সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র, বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বিএসএস) সিনিয়র সাংবাদিক এবং বাংলাদেশ মানবাধিকার সাংবাদিক ফোরাম (বিএমএসএফ)-এর মহাসচিব জনাব খায়রুজ্জামান কামাল। আয়োজনে সম্মানিত বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকার ভাসানটেক সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন মহোদয়। প্রতিবারের মতোই এবারও ‘মঙ্গল আসর’-এর শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন সক্রিয় সদস্য নূসরাত শাহ। ‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনায় ছিলেন ভাসানটেক সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, লেখক ও গবেষক আবদুল্লাহ আল মোহন।

Sofa WM 2 4 ‘মঙ্গল আসর’-এ স্মরণ ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘আহমদ ছফা’
‘মঙ্গল আসর’-এ স্মরণ ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ এবং ‘আহমদ ছফা’ 39

২.

উল্লেখ্য, ঢাকার ভাসানটেক সরকারী কলেজের আনন্দময় সহশিক্ষার সৃজনশীল আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’-এর প্রতি সপ্তাহের নিয়মিত জুম আলোচনার পাশাপাশি ২৮ জুলাই ২০২১ বুধবার রাত ৯.০০টায় মহাত্মা আহমদ ছফার (জন্ম: ৩০ জুন ১৯৪৩ – মৃত্যু: ২৮ জুলাই ২০০১) স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে অনলাইন ভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা ‘চিরঞ্জীব’ প্রকাশনা উৎসবের আয়োজন করা হয়। আহমদ ছফা স্মরণিকা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশনায় সম্পাদনাসহ  সার্বিক দায়িত্ব পালন করেছেন ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য শেখ মো: আবু সাঈদ। সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন সিরাজুল কবীর সাকিব। ‘মঙ্গল আসর’-এর অনলাইনভিত্তিক দেয়াল পত্রিকা ‘চিরঞ্জীব’ প্রকাশনা পাঠ উন্মোচন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী সাবরিনা শ্যামা। অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাহুল আদিত্য। মহাত্মা ‘আহমদ ছফার জীবনী নিয়ে কথা বলেন রাবেয়া সুলতানা নীপা। ‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনায় ছিলেন জনাব আবদুল্লাহ আল মোহন (সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ)।

৩.

‘মঙ্গল আসর’-এর নিয়মিত আয়োজনে সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র এবং গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব জনাব খায়রুজ্জামান কামাল ব্যক্তিগত নানা অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ও স্মৃতিচারণা করে বলেন, মৃত্যুর পর আহমদ ছফা ও তাঁর দর্শন অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে উঠেছেন, আরও অনেক বেশি জীবন্ত হয়ে উঠবেন। আলোচনার শুরুতেই খায়রুজ্জামান কামাল ‘মঙ্গল আসর’-এর নানাবিধ কর্মকাণ্ডের ভূয়সী প্রশংসা করে মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিতকরণে এই মডেল সারাদেশে অনুসরণের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহ্বান জানান। মনীষী লেখক, দার্শনিক ও কবি আহমদ ছফাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতার স্মৃতিমালা উপস্থাপন করে খায়রুজ্জামান কামাল বলেন, মানবিক মূল্যবোধ ও গুণাবলির জন্যও আহমদ ছফা ছিলেন অনন্য। আহমদ ছফা অনেকের জীবনের নানা সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়েছেন, বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং নিজের পক্ষে যতটুকু সম্ভব সহায়তার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আহমদ ছফা ছিলেন একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, অথচ সাম্প্রদায়িকতার লেশমাত্রও ছিল না তাঁর মধ্যে। যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উস্কানির বিরুদ্ধে জ্বলে উঠেছেন বারুদের মতো। শিশুদের সঙ্গে একদম শিশু হয়ে যেতেন। অথচ নিজে প্রচলিত ঘরানায় ঘরসংসার করেননি। বাংলার নামকরা চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন আহমদ ছফা। দুজনই ছিলেন ভবঘুরে, অবিবাহিত এবং খ্যাতি, ধন-সম্পদ বা অন্যান্য বৈষয়িক মোহবর্জিত। তিনি ছিলেন শোষিত মানুষের পক্ষে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ, জাতির শিক্ষক ও জাতির দর্পণ হিসেবে আহমদ ছফাকে অভিহিত করা হয়। অনেকেই আহমদ ছফাকে প্রাবন্ধিক হিসেবে দেখলেও তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক লেখক। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, চিন্তাবিদ ও বিশিষ্ট কলামিস্ট। তাঁর লেখায় বাংলাদেশি জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি আজো গুরুত্বপূর্ণ চিন্তক।

৪.

জনাব খায়রুজ্জামান কামাল শতবর্ষ পূর্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অভিনন্দন জানিয়ে একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী হিসেবে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, শুরু হোক গৌরবের নতুন পথচলা। জন্মলগ্ন থেকে আলোকিত করা বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনন্য অবদানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, দেশের প্রাচীনতম, সর্ববৃহৎ এবং উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ঔপনিবেশিক সময়ে বঙ্গভঙ্গ এবং তা রদের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রধানতম উদ্দেশ্য ছিল, তৎকালীন পূর্ববাংলার পিছিয়ে পড়া মানুষকে শিক্ষা-সংস্কৃতির পাশাপাশি আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বঞ্চনা থেকে মুক্তি দেওয়া। উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন ছিল, এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাতিসত্তার চেতনার বিকাশ ঘটানো। বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন দাবির মুখে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১০০ বছরে বলতে গেলে বাঙালির সব অর্জনের সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে আছে সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্জনগুলোর পেছনে অনন্য ভূমিকা রাখা দেশের এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এক জীবন্ত ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এত অর্জন নেই। শতবছরের পথপরিক্রমায় সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এই ভূখণ্ডের মানুষকে কেবল সংস্কৃতিমানই করেনি; একটি জাতিসত্তা তৈরি, নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ে কৃতিত্বের দাবিদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। শুধু তা-ই নয়, রাষ্ট্র সৃষ্টির পর সঠিক পথে পরিচালনার ক্ষেত্রে যুগে যুগে পথপ্রদর্শকের ভূমিকাও রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা বাঙালি জাতির রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রযাত্রায় বহুলাংশে সাফল্যের দাবিদার। তাই বলা হয়ে থাকে, বাংলাদেশই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় অর্জন। এছাড়া মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি এবং পশ্চাৎপদ সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার প্রধান দাবিদারও এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সাধারণভাবে বিশ্বব্যাপীই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়কে এর একাডেমিক অর্জন দিয়ে মূল্যায়ন করা হয়ে থাকে। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ জ্ঞান সৃষ্টি; সে কারণে মৌলিক গবেষণা, বিশ্বের অন্যতম বড় পুরস্কার নোবেল অর্জন, দেশে-বিদেশে এর গ্র্যাজুয়েটদের অবস্থান প্রভৃতি বিবেচনায় নেওয়া হয়। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে একটি সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারত সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হলে বঙ্গভঙ্গ রদের রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এর উদ্দেশ্যও ছিল রাজনৈতিক। তাই সার্বিক প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন খুঁজতে গেলে দেখা যাবে, তা কেবল একাডেমিক ক্ষেত্রে সীমিত থাকেনি। এর বহুমাত্রিক অর্জন আছে, সেসব বিচারে বলা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই।

৫.

আয়োজনে সম্মানিত বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তৃতাকালে ঢাকার ভাসানটেক সরকারী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন বাঙালির বাতিঘর প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ স্মরণ উদযাপন এবং বাংলাদেশর কিংবদন্তি লেখক, কথাসাহিত্যিক ও দার্শনিক আহমদ ছফার প্রয়াণ দিবস স্মরণ আয়োজন করায় ‘মঙ্গল আসর’-এর প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ প্রকাশ করে বলেন, আহমদ ছফা বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের মানচিত্র অঙ্কন করেছেন। করেছেন বুদ্ধিজীবীদের ব্যর্থতায় বাংলাদেশের কী দুর্দশা হতে পারে তার সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে রচিত বিভিন্ন রচনায়, প্রবন্ধগ্রন্থে উন্মোচন করেছেন সুবিধাবাদিতার প্রকৃত রূপ। তাঁর রচিত প্রতিটি উপন্যাসই ভাষিক সৌকর্য, বিষয়বস্তু ও রচনাশৈলীর অভিনবত্বে অনন্য। মানসিক, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অনুষঙ্গসহ ছফার চরিত্র সৃষ্টির তথা কাহিনীকথনের সৃষ্টিকরণ ছিলো অসামান্য। আহমদ ছফা যুবক বয়েসে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে তাঁর কলম নির্দিষ্ট কোনো দলের পক্ষে ছিল না। তাঁর কলম অনেকের কাছেই ছিল খুব অস্বস্তিকর। তিনি তাঁর কলমকে অস্ত্রে পরিণত করেছিলেন। বলা হতো, তাঁর মসি ছিল অসির চেয়েও ধারালো। যে সত্য প্রকাশ করতে তাঁর সমকালীন অনেকে হিমশিম খেতেন, তিনি তা অসংকোচে অবলীলায় প্রকাশ করতেন। আহমদ ছফা ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন প্রগতিশীল লেখক। অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার ও অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তাঁর কলম ছিল ক্ষুরধার। অনেকের মতে, বাংলাদেশে আহমদ ছফার মতো সাহসী লেখক দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি কখনো হিসেব করে লিখতেন না। অত্যন্ত রাগী ছিলেন, কখনো কারও সঙ্গে আপস করেননি। বলা হয়, বাংলাদেশে আহমদ ছফা একজনই। বাংলা সাহিত্যে এ পর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক, লেখক ও সাহিত্যিক জন্ম নিয়েছেন, তাদের মধ্যে আহমদ ছফাই সবচেয়ে সাহসী, কুশলী, বহুমুখী- এক কথায় অসাধারণ ছিলেন।

৬.

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে আলোচনায় অধ্যক্ষ অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন বলেন, প্রতিষ্ঠার পর অবহেলিত পূর্ববাংলার বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের নেতৃত্ব সৃষ্টিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান উল্লেখযোগ্য। তৎকালীন কিছু প্রভাবশালী মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। কিন্তু নেতাদের শক্তিশালী অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজ শাসকরা সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বৈষম্য নিরসনের পক্ষে অনড় থাকার শক্তি পেয়েছিলেন। ফলে শেষ পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। রাজনৈতিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তৎকালীন পূর্ববঙ্গের সমাজটি ছিল পশ্চাৎপদ, যেটাকে এগিয়ে নিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছিল। শুরু থেকে এটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাক্ষেত্রে অর্জন তো আছেই। সবচেয়ে বড় সেই অর্জন হচ্ছে, পূর্ববাংলায় মুসলমান-হিন্দু উভয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ ঘটাতে বড় ভূমিকা রেখেছে। পাশাপাশি নিজে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান রূপে থেকে অসাম্প্রদায়িকতা লালন করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।

৭.

‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য রাবেয়া সুলতানা নীপা ‘আহমদ ছফা’কে নিয়ে কথামালা উপস্থাপনাকালে জানান, লেখক, ঔপন্যাসিক, কবি, চিন্তাবিদ আহমদ ছফা ১৯৪৩ সালের ৩০ জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে নিত্যানন্দ গৌরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম নাজিরহাট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন; একই বৎসরে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে। পরে বাংলা বিভাগে ক্লাশ করা অব্যাহত রাখেননি। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে প্রাইভেটে পরীক্ষা দিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগেই বাংলা একাডেমির পিএইচডি গবেষণা বৃত্তির জন্য আবেদন করেন এবং তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের জন্য মনোনীত হন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাইভেটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ পরীক্ষা দেন। তার পিএইচডি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ১৯৭১ সালে ‘লেখক সংগ্রাম শিবির’ গঠন ও এর বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশ নেন। ৭ মার্চ ‘স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা’ হিসেবে প্রতিরোধ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এপ্রিল মাসে কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সেখান থেকে দাবানল নামের পত্রিকা সম্পাদনা করেন। দেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশে ফিরে লেখালেখি করতে থাকেন। ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক নাজিমুদ্দিন মোস্তানের সহায়তায় কাঁটাবন বস্তিতে ‘শিল্পী সুলতান কর্ম ও শিক্ষাকেন্দ্র’ চালু করেন। পরে ১৯৮৬-তে জার্মান ভাষার ওপর গ্যেটে ইনস্টিটিউটের ডিপ্লোমা ডিগ্রিও লাভ করেন তিনি, যা তাকে পরবর্তী সময়ে গ্যেটের অমর সাহিত্যকর্ম ফাউস্ট অনুবাদে সহায়তা করেছিল। আহমদ ছফা সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন দীপ্তিময়ভাবে। গল্প, গান, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে তিরিশটির বেশি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার জনপ্রিয় লেখা হলো আব্দুর রাজ্জাক স্যারকে নিয়ে লেখা “যদ্যপি আমার গুরু”, বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, বাঙালি মুসলমানের মন, গাভী বিত্তান্ত, পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ, অলাতচক্র। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ১৯৭৫ সালে লেখক শিবির পুরস্কার ও ১৯৯৩ সালে বাংলা একাডেমির সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ২০০২ সালে বাংলাদেশ সরকার তাকে সাহিত্যে মরণোত্তর একুশে পদক প্রদান করেন। ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের আটাশে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তাঁর দাফন হয়। প্রতিষ্ঠানবিরোধী আহমদ ছফা ‘লেখক শিবির পুরস্কার’ এবং বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রণীত ‘সাদত আলী আখন্দ পুরস্কার’ প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৮০ সালে ‘ইতিহাস পরিষদ পুরস্কার’ ও ২০০২ সালে ‘মরণোত্তর একুশে পদক’ এ ভূষিত হন আহমদ ছফা। তিনি একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

৮.

মহাত্মা আহমদ ছফাকে নিয়ে কথামালা উপস্থাপনকালে ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য সিরাজুল কবীর সাকিব আহমদ ছফার বচন ‘সৎসাহসকে অনেকে জ্যাঠামি এবং হঠকারিতা বলে মনে করে থাকেন, কিন্তু আমি মনে করি সৎসাহস হল অনেক দূরবর্তী সম্ভাবনা যথাযথভাবে দেখতে পারার ক্ষমতা’ তুলে ধরে বলেন, প্রতিবাদী লেখক, প্রগতিপন্থি সাহিত্যকর্মী ও সংগঠক আহমদ ছফা, আমাদের সেই আলোকিত নক্ষত্র, যে নক্ষত্রের মৃত্যু নেই, আলো ছড়িয়ে যায় অনন্ত কাল। সেই ‘মহাত্মা’ ছফা অজানালোকে চলে গেছেন কিন্তু নতুন সাহিত্যিকদের এক অনুসরনীয় নানা রকম দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী সৃষ্টিশীল লেখক আহমদ ছফাকে আমাদের সবার আরো জানার চেষ্টা করা উচিত, মনোযোগ দিয়ে তাঁকে পাঠ করা জরুরি বিবেচনা করি। এমন মনের মানুষ কালেভদ্রে জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালির আত্মপরিচয় বিকাশের প্রাণকেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ পূর্তি বিষয়ে আলোচনাকালে সিরাজুল কবীর সাকিব জানান, জাতির বাতিঘর হিসেবে যুগ যুগ ধরে আলো ছড়ানো এই বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল, দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিল উচ্চশিক্ষার এই প্রতিষ্ঠানটির। অবশ্য যাত্রা শুরু হয়েছিল সীমিত পরিসরেই। সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত ও আইন- এই কয়টি বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু। আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১২টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৫৪টি গবেষণাকেন্দ্র, ১২৩টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন। আর শিক্ষক ছিলেন মাত্র ৬০ জন। বর্তমানে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আর পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন দুই হাজারের বেশি শিক্ষক।

৯.

দেড় ঘন্টাধিক সময়ের জুম অনুষ্ঠানে সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে আলোচনায় অংশ নিয়ে ‘মঙ্গল আসর’-এর সক্রিয় সদস্য নূসরাত শাহ বলেন, আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ ও প্রগতিপন্থি একজন সংস্কৃতিকর্মী। প্রগতির সংঘশান্তিতে তিনি আস্থাবান ছিলেন। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতাও ছিল প্রচুর। আহমদ ছফা ছিলেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী একজন সৃষ্টিশীল লেখক। ষাটের দশকে তাঁর সাহিত্য-জীবনের সূচনা হয়। সৃষ্টিধর্মী লেখক হিসেবে তিনি গল্প, উপন্যাস, কবিতা, প্রবন্ধ, সমালোচনা, অনুবাদ, শিশুসাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব দেখান। তিনি বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সাময়িকপত্র সম্পাদনা করেন। বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে তিনি এক সফল লেখক। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে তিনি গল্প-উপন্যাস রচনায় কাজে লাগিয়েছেন। তাঁর আখ্যানমূলক রচনায় বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা, মুক্তিকামনা ও স্বাধীনতাস্পৃহা এবং সামাজিক অসঙ্গতি ও বৈষম্যের চিত্র রূপায়িত হয়েছে। ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ নিয়ে আলোচনাকালে ‘মঙ্গল আসর’-এর শিক্ষামূলক সফরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতিমালা উপস্থাপনা করে নূসরাত শাহ বলেন, দেশ ও সমাজের বিকাশ ও অগ্রগতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এমন অনেক পথিকৃৎ ব্যক্তিত্বের ছাত্রজীবন কেটেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে, যাঁরা পরবর্তীকালে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কলাভবন, মধুর ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, হাকিম চত্বর, টিএসসি, সায়েন্স অ্যানেক্স ভবন ও কার্জন হলের সবুজ চত্বর এখনো অনেককে স্মৃতিকাতর করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই অবদান রাখছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথমদিকের বছরগুলোয় এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার উচ্চমান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন। যে কারণে এ প্রতিষ্ঠান ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসাবে খ্যাতি লাভ করে। লীলা নাগ নামের এক ছাত্রী ১৯২১ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ কোর্সে যোগদান করেন। তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। ১৯৩৫ সালে করুণাকণা গুপ্ত প্রথম মহিলা শিক্ষক। সেই সময়কার চরম রক্ষণশীল সমাজে ওই দুই ঘটনা বিস্ময়ের পাশাপাশি ছিল অসম সাহসী পদক্ষেপ। এভাবে এ বিশ্ববিদ্যালয় সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মধ্যে শিক্ষা ও জ্ঞানের আলো জ্বালানোর ক্ষেত্রে অবদান রাখতে থাকে।

১০.

শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা দিক তুলে ধরে ভাসানটেক সরকারী কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মোহন তার বক্তৃতাকালে জানান, জাতির বাতিঘর হিসেবে যুগ যুগ ধরে আলো ছড়ানো ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিল, আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল এই প্রতিষ্ঠানের। তৎকালীন ব্রিটিশশাসিত বাংলায় এটিই ছিল একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান। পরাধীন দেশে এবং রাজকীয় ক্ষতিপূরণ হিসাবে পশ্চাৎপদ এ অঞ্চলের মানুষকে শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে নিতে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের প্রেক্ষাপটে সর্বজনীন দাবির মুখে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গত ১০০ বছরে বলতে গেলে বাঙালির সব অর্জনের সঙ্গে যে নামটি জড়িয়ে আছে সেটি হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস অব্যাহত সংগ্রামের ইতিহাস। লড়তে হয়েছে তাকে দুই ফ্রন্টে- একটি জ্ঞানের, অপরটি সামাজিকতার। এই যুদ্ধটা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেই সত্য। কিন্তু কম বিশ্ববিদ্যালয়কেই এই দ্বৈত কর্তব্য এমন মাত্রায় পালন করতে হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় মাত্রই জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য সংগ্রাম করে। এই জ্ঞান অর্জিত হয় সামাজিকভাবে। জ্ঞান চলে যায় সমাজে। মানুষের কাজে লাগে, উপকার হয়। সমাজ আবার বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণও করতে চায়। সম্পর্কটা একরৈখিক নয়, দ্বান্দ্বিক বটে।’- অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর উপরোক্ত বক্তব্য তুলে ধরে আবদুল্লাহ আল মোহন বলেন, বাঙালির সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক অর্জনগুলোর পেছনে অনন্য ভূমিকা রাখা দেশের এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ এক জীবন্ত ইতিহাস। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা। পৃথিবীর আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের এত অর্জন নেই। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত মান বজায় রাখার কারণেই প্রতিষ্ঠানটি অভিধা পেয়েছে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ হিসেবে। পাশাপাশি এটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দায়িত্বও পালন করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালুর ২৬ বছরের মধ্যে ব্রিটিশদের কবল থেকে উপমহাদেশ মুক্ত হয়। সৃষ্টি হয় পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি রাষ্ট্র। সেই ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২৪ বছরের মধ্যে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের। পাকিস্তান সৃষ্টির পরের বছর থেকেই এই বিশ্ববিদ্যালয় স্বতন্ত্র জাতিসত্তা সৃষ্টির আন্দোলনে নিবেদিত হয়। এক কথায় বলতে গেলে, দেশ স্বাধীন এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ গঠন ও পরিচালনায় যারা ভূমিকা রেখেছেন তাদের ৫০ বছর ধরে তৈরি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলন, ১৯৬২ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে গৃহীত পাকিস্তান সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ, বাঙালির মুক্তির সনদখ্যাত ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবি আদায়, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান এবং ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবরণের পর আশির দশকে জেনারেল জিয়াউর রহমান ও পরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন সূচিত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গণতান্ত্রিক সরকারগুলোকে সঠিকপথে রাখতে ছোটখাটো আন্দোলন আর একাডেমিক সমালোচনায় নেতৃত্ব দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এসব কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষায় অবদানের পাশাপাশি রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েও সমান আলোচনা হয়ে থাকে। এ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় নতুন দিগন্তের। স্বাধীনতার পর দেশ গঠনেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অপরিসীম অবদান। অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর দেশের প্রতিটি স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের ভিত্তিভূমি ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই কেবল শিক্ষা বা একাডেমিক দিকই নয়, দেশ ও জাতিসত্তা তৈরি, দেশকে সঠিক পথে পরিচালনা, দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রের জন্য সব ধরনের নেতৃত্ব সৃষ্টি করেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া বাঙালি সমাজ-সংস্কৃতি লালন ও বিকাশ এবং জ্ঞানভিত্তিক ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার পৃষ্ঠপোষকতায়ও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে প্রধান ভূমিকা। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন বহুমাত্রিক। শিক্ষক ও ছাত্রদের স্বাধীনভাবে পড়ালেখা ও জ্ঞান অর্জনের লক্ষ্যে সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স ১৯৬১ রদ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ জারি করে। এর ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুজ্জীবিত হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকের সংখ্যা অভাবনীয়ভাবে বাড়তে থাকে।

১১.

স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ চিন্তক বলে বিবেচিত আহমদ ছফার সাথে ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণা ও তাঁর রচনা পাঠের ভাব-অনুভব তুলে ধরে আবদুল্লাহ আল মোহন বক্তৃতাকালে জানান, বাঙালি মনীষার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্তের নাম আহমদ ছফা, তাঁর প্রিয়জনদের কাছে মহাত্মা আহমদ ছফা। বাংলার মনন ও সৃজনীশক্তির এক ব্যতিক্রমী এবং বিরল ব্যক্তিত্ব আহমদ ছফা। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক মানুষ, একাধারে কবি, উপন্যাসিক, গল্পকার, দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবী। জীবদ্দশায় আহমদ ছফা তাঁর প্রথাবিরোধী, নিমোর্হ, অকপট নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গীর জন্য বুদ্ধিজীবি ও চিন্তকমহলে বিশেষভাবে আলোচিত, সমালোচিতও ছিলেন। বাংলাদেশের মনন ও সৃজনীশক্তির এক বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে আমাদের কাছে অনন্য হয়ে আছেন আহমদ ছফা। আহমদ ছফার তুলনা কেবলমাত্র আহমদ ছফা নিজেই। তাঁর লেখা যেমন অনন্য, বলাও তেমন অতুলনীয়। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফা মূলত ছিলেন দল-মতের ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী একজন চিন্তক। তিনি মানবিক যুক্তিবোধ ছাড়া কাউকে তোয়াক্কা করতে না, তোষামদী তো নয়ই। সময়ের প্রচলিত ধারার বাইরে পা ফেলতে তিনি মোটেই দ্বিধা করতেন না। তাঁর ব্যক্তিত্ব এমনই আপন ধাতুতে গড়া ছিলো। আর তাই সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে তাঁকে বিচার করলে ভুল হবে,তাঁর প্রতি অবিচার হবে। আহমদ ছফা সারা জীবন আপন সমাজের কথা ভেবেছেন। আহমদ ছফা স্বপ্ন দেখেছিলেন, বাংলাদেশের গণসংগ্রামের উত্তাপ থেকে নতুন মানুষ জন্ম নেবে। তাঁর বিশ্বাস ছিল, অন্তরের অমৃত বলে বুক বেঁধে আবার দাঁড়াবে বাংলাদেশ। আহমদ ছফার রাষ্ট্রচিন্তা, সমাজ চিন্তা, বিশ্ববীক্ষা, মানুষের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদ এবং সমাজ নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে পারার কথা বলেছেন অনেকেই। বাঙালি জাতি ছফার কাছে কৃতজ্ঞ। সাত হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি জাতির মধ্যে নানান ধরনের যে বৈশিষ্ট্য জমা হয়েছে ছফা তা বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেভাবে সমাজ নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। আহমদ ছফার রাষ্ট্রচিন্তা কত যে প্রাসঙ্গিক তা বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক সংকট দেখেই বুঝতে পারা যায়। ছফা কত পূর্বে এসব সংকট নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ লিখে যান। আহমদ ছফা বাঙালি জাতিরাষ্ট্র গঠনে তাঁর প্রখর ধী-শক্তির বিকাশ ও মানুষের কাছে পৌঁছানোর দায় নিয়ে কথা বলেন। তাঁর লেখায় বাংলাদেশী জাতিসত্তার পরিচয় নির্ধারণ প্রাধান্য পেয়েছে বলেও মন্তব্য করেন। আহমদ ছফার লেখায় রসবোধ, গদ্যের নির্মাণ শৈলী ও কবিতার গভীরতা ছিলো বলেই সমালোচকগণের অভিমত। আহমদ ছফার সারা জীবনের লক্ষ্য ছিল আপন সমাজের মানুষকে ন্যায়নীতি, বিজ্ঞানদৃষ্টি, মানবিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার দিকে চালিত করা। কারণ, আমরা জানি, শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত সঠিকভাবে চিন্তা করতে পারার ক্ষমতা অর্জন। এখানেই সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আর্থিক বিনিয়োগ প্রয়োজন, ছফা এটা বুঝেছিলেন। সেই কারণেও ছফা অনন্য, স্মরণীয়।

১২.

অংশগ্রহণকারী সবাইকে ধন্যবাদ ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ‘মঙ্গল আসর’-এর স্মরণ আয়োজনটি শেষ হয়। সমাপনী ঘোষণাকালে সভাপতির দায়িত্বপালনকারী ভাসানটেক সরকারী কলেজের বর্তমান এবং প্রাক্তন শিক্ষার্থীদেরসহ ‘মঙ্গল আসর’-এর চিন্তনসখাদের প্রতি মঙ্গলবার রাত নয়টার সময় জুম আলোচনায় অংশগ্রহণে সাদর আমন্ত্রণ জানান।

‘মঙ্গল আসর’-এর পক্ষে –

আবদুল্লাহ আল মোহন / সিরাজুল কবীর সাকিব

২৯ জুলাই ২০২১

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
পাবনার যমুনা পাড়ের নগরবাড়ী ঘাটের ‘যমুনা পুত্র’ আবদুল্লাহ আল মোহন-এর জন্ম ১০ ফেব্রুয়ারি। পোশাকী নাম আবদুল্লাহ আল মামুন। বর্তমানে ঢাকার ভাসানটেক সরকারি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। সৃজনী জীবনের সুপ্ত স্বপ্নকে বিকশিত করতে প্রিয় শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষকতার পাশাপাশি আমাদের শিক্ষাঙ্গণে আলোচিত সৃজনশীল সহশিক্ষার আনন্দময় আয়োজন ‘মঙ্গল আসর’ পরিচালনা করে আসছেন। অনুকরণীয় শিক্ষকের নানাবিধ কর্মকাণ্ড নিয়ে সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় তৈরি হয়েছে তথ্যচিত্র ‘মোহনের মঙ্গল আসর।’ বিপরীতমুখী পেশাজীবনের বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ তার জীবন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের একান্ত সহকারী হিসেবে যেমন দায়িত্ব পালন করেছেন, তেমনি আবার বিশ্ববরেণ্য জাদুশিল্পী জুয়েল আইচের জাদু দলের একজন সদস্য হিসেবে আলোক প্রক্ষেপণেও সহযোগিতা করেছেন মঞ্চে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কাজ করেছেন তৎকালীন বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক ভোরের কাগজে। এরপর ইমপ্রেস টেলিফিল্ম, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা প্রশিকার প্রশিক্ষণ বিভাগ এবং রাষ্ট্রায়ত্ব সোনালী ব্যাংকেও কাজ করেছেন। তার লেখালেখির আগ্রহের অন্যতম বিষয়- আলোকিত ব্যক্তিত্বদের অনুপ্রেরণামূলক জীবনী ও ভ্রমণ কাহিনি। জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নিয়মিত সরব কিন্তু সেখানেও প্রবলভাবে অনুরাগী তিনি জীবনী, ছড়া-কবিতা, প্রবন্ধে-আলোচনায়, সর্বোপরি মননশীল চিন্তাচর্চায়। গভীরভাবে ভালোবাসেন বইয়ের পাশাপাশি ‘মানুষ’ নামক জীবন্ত বিশ্বকোষ, মহাগ্রন্থ নিরন্তর পাঠ করতে। প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : ‘বঙ্গবন্ধু ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ’, ‘খোকা থেকে মুজিব : বঙ্গবন্ধু থেকে জাতির পিতা’, ‘সম্পর্কের সেতুবন্ধনে : বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা’, ‘হাসু থেকে শেখ হাসিনা : দেশনেত্রী থেকে বিশ্বনেত্রী’, ‘দৃষ্টি ও অর্ন্তদৃষ্টির ভারত ভ্রমণ’ (দিল্লী, আজমীর, জয়পুর ও আগ্রা ভ্রমণ কাহিনি), ‘খুঁজে ফেরা : বঙ্গবন্ধু ও ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’, ‘মানবাধিকার চর্চা’, ‘বঙ্গবন্ধুর লেখক সত্তা।’
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!