বাংলাদেশে আদিবাসী শব্দ নিয়ে বিতর্ক একটি পুরনো এবং জটিল বিষয়, যা একাধিকবার রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এসেছে। সম্প্রতি, মাধ্যমিক স্তরের একটি পাঠ্যবইয়ের প্রচ্ছদে ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহার বাতিল করার পর থেকে আবারও এই বিতর্ক নতুন করে প্রকাশ্যে এসেছে। পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সামনে আন্দোলনরত বিভিন্ন নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনা আরও জোরালো করে তুলেছে এই প্রশ্নটি—আসলেই কি বাংলাদেশে ‘আদিবাসী’ শব্দটির স্থান আছে? অথবা, এটি ব্যবহারের ফলে কি রাষ্ট্রীয় সংহতির উপর কোনো ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে?
আদিবাসী পরিচয়ের দাবি: ইতিহাস এবং সংকট
বাংলাদেশে আদিবাসীদের পরিচয় কখনোই আঠালোভাবে ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃত হয়নি। সরকার এসব জনগণের পরিচয়কে ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ হিসেবে বর্ণনা করেছে, যার মধ্যে কিছু জনগণ নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত করতে চায়। বিশেষত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ দীর্ঘদিন ধরে তাদের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত এবং ঐতিহাসিক পরিচয়কে ‘আদিবাসী’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আন্দোলন করে আসছে। তবে, সরকারের পক্ষ থেকে এই শব্দটি ব্যবহারে সর্বদা সংরক্ষিত অবস্থান নেয়া হয়েছে, কারণ তাদের মতে, ‘আদিবাসী’ শব্দের ব্যবহারের মাধ্যমে কোনো জাতিগত বা আঞ্চলিক বিভাজন সৃষ্টি হতে পারে যা দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ঐক্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এমনকি ২০১১ সালে, তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিপু মনি বাংলাদেশের কূটনীতিকদের জানিয়ে দিয়েছিলেন যে পার্বত্য চট্টগ্রামের ‘ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর’ জনগণকে ‘আদিবাসী’ বলা না হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এই শব্দটি এতদিন পর্যন্ত বিবেচিত হয়নি এবং তা ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র এবং বিশ্বজনীন সংজ্ঞা
এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে, জাতিসংঘ আদিবাসী জনগণের অধিকার সম্পর্কে একটি ঘোষণা করেছে, যেখানে ‘আদিবাসী’ জনগণের অধিকারগুলো বিশেষভাবে উল্লিখিত হলেও, ‘আদিবাসী’ শব্দটির কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তবে, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য কিছু শর্ত রয়েছে—যেমন, কোনো গোষ্ঠী ঐ অঞ্চলে দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করেছে, তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, এবং বিশ্বাস রয়েছে, এবং তারা আধিপত্যবাদী গোষ্ঠী নয়।
এছাড়া, আদিবাসী হিসেবে নিজেদের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করার জন্য পৃথিবীজুড়ে যে জনগণ নিজেদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচিত করে, তাদের অধিকারের মধ্যে ভূমির অধিকার, ঐতিহ্যগত জীবনধারা রক্ষা এবং সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অন্যতম।
সরকারের অবস্থান এবং সামাজিক বিভাজন
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল এবং সীমান্ত এলাকা অত্যন্ত স্পর্শকাতর। সরকারের মতে, ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করলে ওই অঞ্চলে অবস্থানরত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে এবং সামরিক তৎপরতাও সংকটের মধ্যে পড়তে পারে। এর ফলে সরকারের পক্ষ থেকে একাধিক বার স্পষ্টভাবে এ শব্দটি ব্যবহারে বিরত থাকার অনুরোধ জানানো হয়েছে।
তবে, আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দাবি করা নৃ-গোষ্ঠীগুলোর নেতৃত্ব মনে করেন, যে তাদের সাংবিধানিক অধিকার পাওয়া প্রয়োজন, যেমন—ভূমির অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান এবং আর্থিক উন্নতি। গজেন্দ্র নাথ মাহাতো, বাংলাদেশের আদিবাসী ফোরামের সহ-সাধারণ সম্পাদক, এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন যে, “যদি আমরা আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি পাই, তাহলে আমাদের ভূমির অধিকার সংরক্ষণে রাষ্ট্রীয় বাধ্যবাধকতা তৈরি হবে এবং এটি আমাদের সাংস্কৃতিক অধিকারও রক্ষা করবে।”
সমাধান কি সম্ভব?
এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশের সরকার কি আদিবাসী শব্দের স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত? অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, সরকারের উচিত এই বিষয়টি আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা, যেখানে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলোর বৈধ অধিকারকে গুরুত্ব দেয়া হবে। সরকারের উচিত, তাদের ভূমির অধিকার এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করা এবং তাদের উন্নয়ন নিশ্চিত করা। তবে, সবকিছু মিলিয়ে একটি ‘শব্দ’ দিয়ে কোনো জাতি বা গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করা কি আদর্শ? না, বরং তাদের অধিকারকে সম্মান করা এবং তাদের ভূমিকার স্বীকৃতি দেওয়া প্রয়োজন।
এখানে প্রশ্ন উঠছে, আদিবাসী শব্দটির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ‘তাদের’ স্বীকৃতি দেওয়া গেলে, ভবিষ্যতে দেশের সামগ্রিক ঐক্য এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে কি?