স্মৃতিচারণ: সেই সৌমিত্রদা

সিদ্ধার্থ সিংহ
সিদ্ধার্থ সিংহ
5 মিনিটে পড়ুন
লেখক সিদ্ধার্থ সিংহ এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

কোন প্রকাশনী, সেই নামটা আর বলছি না। সেখান থেকে তখন আমার সবেমাত্র দু’-তিনটে বই বেরিয়েছে। প্রায়ই যাই। শঙ্করদা নয়, শংকরদার ছেলে দীপ্তাংশুর সঙ্গে আড্ডা মারি।
বই করার জন্য যে সব তরুণ কবি-লেখকদের পাণ্ডুলিপি জমা পড়ে, মাঝে মাঝেই আমাকে সেই পাণ্ডুলিপিগুলো দেয় একবার পড়ে দেখার জন্য।
আমি সেই কাজগুলো অত্যন্ত যত্ন নিয়ে ভালবেসেই করতাম। একদিন কথায় কথায় শংকরদা আমাকে বললেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা করব। কিন্তু উনি বেছে দেওয়ার মতো সময় পাচ্ছেন না। তোমাকে সবগুলো কবিতাই দিয়ে দেব। তুমি সেখান থেকে একটু বেছে দিও তো কোন কোন কবিতাগুলো শ্রেষ্ঠ কবিতায় রাখা যায়।
আমি বললাম, ঠিক আছে। কিন্তু এটা তো অনেক শ্রমসাধ্য কাজ, আমাকে একটু খুশি করে দেবেন।
শংকরদা বললেন, ঠিক আছে, আমি কথা বলে দেখছি।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে আমি খুব ভাল করেই চিনি। আমরা যখন খুব ছোট, তখন হাজরা মোড়ের বসুশ্রী সিনেমা হলের দোতালায় যে কফি হাউসটা ছিল, সেখানে তিনি প্রায় প্রতি রবিবারই আড্ডা মারতে আসতেন।
না, আমাদের টেবিলে নয়। ওঁর কিছু বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে ওই দিকের কোণের একটা টেবিলে বসে চুটিয়ে আড্ডা মারতেন।
১৯৮০ সালে উত্তমকুমার মারা যাওয়ার পরে আমরা যখন উত্তমকুমারকে নিয়ে একটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করার কথা ভাবছিলাম, তখনই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি।
পরবর্তিকালে সেই তথ্যচিত্রর পরিকল্পনা বাতিল করে ঠিক হয় যাঁরা যাঁরা উত্তমকুমারের সঙ্গে কাজ করেছেন, সে অভিনেতা থেকে সহ-অভিনেতা, পরিচালক, ক্যামেরা ম্যান, লাইকম্যান, ড্রেসার, মেকআপম্যান থেকে শুরু করে স্পট বয়, মোদ্দা কথা যাঁরা যাঁরা উত্তমকুমারকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং মিশেছেন তাঁদের সাক্ষাৎকারভিত্তিক একটি ধারাবাহিক তৈরি হবে দূরদর্শনের জন্য। মাঝে মাঝে থাকবে বিভিন্ন সিনেমার ক্লিপিংস-সহ একান্তই ব্যক্তিগত দুর্লভ স্থিরচিত্র এবং তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র।
আমাদের সেই কাজে ভীষণ ভাবে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী থেকে শুরু করে বাংলার তাবড় তাবড় সব মানুষজনেরা।
সে সময় যেমন সরযূবালা দেবী, তরুণকুমার, দেব নারায়ণ গুপ্ত, পরিচালক তরুণ মজুমদার থেকে শুরু করে নিমাই ঘোষদের মতো ফটোগ্রাফারদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম, ঠিক তেমনি কথা বলেছিলাম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গেও।
সেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতার বই হবে এর থেকে ভাল আর কী হতে পারে! আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম।
যে দিন সৌমিত্রদার পাণ্ডুলিপি আনার জন্য শ্রীমানী মার্কেটের কাছে ওই প্রকাশনীতে যাওয়ার কথা, সে দিনই ওই প্রকাশনীর কর্ণধার বললেন, তোমাকে একটু কষ্ট করতে হবে। সৌমিত্রদার বাড়ি থেকে পাণ্ডুলিপিটা নিতে হবে। আর এই পাণ্ডুলিপি গুছিয়ে দেওয়ার জন্য তুমি কত কী নেবে সেটাও সৌমিত্রদার সঙ্গে একটু কথা বলে নিয়ো, কেমন?
সৌমিত্রদা কখন থাকবেন আগেই ফোন করে জেনে নিয়েছিলাম। সেই মতো দু’দিন পরেই চলে গিয়েছিলাম তাঁর বাড়িতে। প্রচুর কবিতা। অন্তত চার-পাঁচটি ফাইল তো হবেই। সবই প্রকাশিত। সেখান থেকে বেছে পাণ্ডুলিপি তৈরি করাটা সত্যিই বেশ সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। অথচ হাতে অত সময় নেই। বইমেলা তখন নাকের ডগায়।
ফাইলগুলো উনি আমার দিকে এগিয়ে দিতেই আমি বললাম, এই কাজের জন্য টাকা পয়সার ব্যাপারে শংকরদা আপনার সঙ্গে কথা বলে নিতে বলেছেন।
উনি বললেন, ওটা তো ওরা দেবে। আমি কেন দেব?
কথাটা আমার ভাল লাগেনি। তত দিনে আমার একক এবং যৌথ সম্পাদনায় প্রায় একশোর উপর সংকলন বেরিয়ে গেছে।
যুগ্মভাবে সম্পাদনা করেছি লীলা মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, রমাপদ চৌধুরী, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শংকর, মহাশ্বেতা দেবী, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, সুচিত্রা ভট্টাচার্য, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়দের সঙ্গে। এবং সেই সংকলনগুলোর বিক্রি অনেক প্রথিতযশা কবি-লেখকদের বইয়ের বিক্রিকেও একেবারে স্নান করে দিয়েছে।
আমি হাতে-কলমে সম্পাদনা শিখেছি লেখকদের লেখক সম্পাদকদের সম্পাদক রমাপদ চৌধুরীর কাছে। ফলে অনেক পিএইচডি, ডক্টরেট করা ছেলেমেয়েরাও তাঁদের পাণ্ডুলিপি আমাকে দিয়ে চেক করিয়ে নেন।
সুতরাং সম্পাদনার জন্য যথার্থ টাকা পাওয়াটা আমার হক হয়ে দাঁড়িয়েছে। টাকা না পেলে ফালতু ফালতু আমি একটা পাণ্ডুলিপি তৈরি করে দিতে যাব কেন!
সৌমিত্রদার বাড়ি থেকেই আমি ফোন করলাম শংকরদাকে। একবার, দু’বার, তিন বার। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক শংকরদার সঙ্গে আমার ব্যাটেবলে হল না।
তাই আমি সৌমিত্রদাকে বলেছিলাম, ঠিক আছে, আমি আগে শংকরদার সঙ্গে কথা বলে নিই, তার পর না হয় পাণ্ডুলিপি নিয়ে যাব।
আমি খুব স্বাভাবিক ভাবে কথাগুলো বললেও সেই কথাগুলো বোধহয় সৌমিত্রদার খুব একটা ভাল লাগেনি। সেটা তখনই তাঁর মুখ দেখে আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
পরে যখন শংকরদার কাছে গেলাম, জানতে পারলাম সৌমিত্রদা নাকি বলেছেন, সিদ্ধার্থ ছাড়া কি আর কেউ নেই যে এই কাজটা করতে পারে?
এই কথা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ওই কাজটি থেকে হাত গুটিয়ে নিয়েছিলাম। না, আমি জানি না ওই বইটি পরে ওই প্রকাশনী থেকে আদৌ বেরিয়েছিল কি না।
তবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম, বছর দুয়েক আগে গ্র্যান্ড হোটেলে যখন আমাদের মুখোমুখি দেখা হল, পাশাপাশি বসে চা খেলাম, তখন আমাদের মধ্যে যে কথাবার্তা হয়েছিল তাতে বুঝেছিলাম, ওই অপ্রীতিকর ঘটনাটা যেমন আমি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি, উনিও মনে রাখেননি। না হলে অতক্ষণ আড্ডা হয়!

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
২০২০ সালে 'সাহিত্য সম্রাট' উপাধিতে সম্মানিত এবং ২০১২ সালে 'বঙ্গ শিরোমণি' সম্মানে ভূষিত সিদ্ধার্থ সিংহের জন্ম কলকাতায়। আনন্দবাজার পত্রিকার পশ্চিমবঙ্গ শিশু সাহিত্য সংসদ পুরস্কার, স্বর্ণকলম পুরস্কার, সময়ের শব্দ আন্তরিক কলম, শান্তিরত্ন পুরস্কার, কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার, কাঞ্চন সাহিত্য পুরস্কার, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা লোক সাহিত্য পুরস্কার, প্রসাদ পুরস্কার, সামসুল হক পুরস্কার, সুচিত্রা ভট্টাচার্য স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার, অণু সাহিত্য পুরস্কার, কাস্তেকবি দিনেশ দাস স্মৃতি পুরস্কার, শিলালিপি সাহিত্য পুরস্কার, চেখ সাহিত্য পুরস্কার, মায়া সেন স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার ছাড়াও ছোট-বড় অজস্র পুরস্কার ও সম্মাননা। পেয়েছেন ১৪০৬ সালের 'শ্রেষ্ঠ কবি' এবং ১৪১৮ সালের 'শ্রেষ্ঠ গল্পকার'-এর শিরোপা সহ অসংখ্য পুরস্কার। এছাড়াও আনন্দ পাবলিশার্স থেকে প্রকাশিত তাঁর 'পঞ্চাশটি গল্প' গ্রন্থটির জন্য তাঁর নাম সম্প্রতি 'সৃজনী ভারত সাহিত্য পুরস্কার' প্রাপক হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!