যমুনায় ভিটেমাটি হারানো স্বরবানু দুলু খাতুনসহ অর্ধশতাধিক দুঃস্থের মানবেতর দিনযাপন

শামছুর রহমান শিশির
শামছুর রহমান শিশির
5 মিনিটে পড়ুন

শাহজাদপুরে যমুনার প্রবল ঘুর্ণিস্রোতে আবারও ধ্বসে গেছে শ’তাধিক কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১’শ বছরের টেকসই যমুনা নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধ! এ ধ্বসে দুঃস্বপ্নের মত সহসাই তলিয়ে গেছে স্বামীহারা স্বরবানু আর বিধবা দুলু খাতুনদের মতো অসংখ্য অসহায় দুঃস্থদের বসতভিটা। স্বরবানু গালা ইউনিয়নের মাজ্জান গ্রামের বাসিন্দা। স্বামী মারা গেছেন একযুগ আগে। ছেলে ও মেয়েদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে অন্যত্র বিয়ে করেননি আর। স্বামীর ভিটা আঁকড়ে ধরে অন্যের বাড়িতে এবং খেতে-খামারে কাজ করেই কোনমতে দিনাতিপাত করে আসছেন তিনি। কঠোর পরিশ্রম আর নিজের আত্মবিশ্বাস দিয়ে জীবন যুদ্ধে অপরাজেয় মা স্বরবানু দুই মেয়ে ও ছেলেকে বিয়েও দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে ছেলের স্ত্রীও মারা যায়। পরে ছেলেটা দ্বিতীয় বিয়ে করে জীবীকার তাগিদে চলে গেছেন শহরে। এর পর স্বর বানুুর যেন দুঃখের দিন শেষ হচ্ছে না। ছেলেটা অন্যত্র বিয়ে করে শহরে যাওয়ার সময় রেখে গেছেন ৪ বছর বয়সী সন্তান। এই ছোট্ট শিশুকে নিয়ে কোনরকমে খেয়ে না খেয়ে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন স্বর বানু। কিন্তু এও কপালে সইলো না তার। হঠাৎ করে বাড়িটাও যমুনা গর্ভে বিলীন হয়ে গেল। ফলে খোলা আকাশের নীচে ভাঙা টিন মাথার উপর দিয়েই সরকারি বাধের ওপর আশ্রয় নেয়া স্বরবানু’র প্রতিটি মুহুর্ত প্রতিটি দিন কাটছে অনাদরে অতিকষ্টে। দেখার কেউ নেই!

এদিকে, দুলু খাতুনেরও দুনিয়ায় কেউ নেই। একমাত্র সম্ভল বসতভিটাও চলে গেছে নদী গর্ভে। এখন তার দুচোখে কেবল যমুনার স্রোতের মত টলটলে অশ্রæ আর কুয়াশায় আচ্ছাদিত হয়ে চোখেমুখে অন্ধকার নেমে এসেছে। অপরদিকে, ৫৪ বছর বয়সী ঈসমাই হোসেন। সোনাতুনি ইউনিয়নের হাতকোড়া গ্রাম নদী গর্ভে চলে যাওয়ার পর ভিটেমাটি হারিয়ে ১০ বছর আগে বাড়ি করেছিলেন যমুনার কোল ঘেঁষে। ভেবেছিলেন সরকার যেহেতু কোটি কোটি টাকা খরচ করে নদী তীর রক্ষা বাঁধ করেছেন এখন আর ভাঙনে অন্তত বসতভিটা হারাতে হবে না। তাই তিনি শেষ বয়সে একটু নিশ্চিত জীবন যাপনের জন্য প্রায় পনেরো লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করেছিলেন পাকা ঘর। কিন্তু তারও আর দুঃখের দিনও শেষ হলোনা। একরাশ হতাশার মধ্যেই তার স্বপ্ন ডুবিয়ে দিয়ে যখন যমুনা তীর রক্ষা বাঁধে ধস নামে তখন কেবল ঘরের কয়েকটি জানালা, দরজা আর আসবাবপত্র কোনক্রমে সরিয়ে নিতে পেরেছেন তিনি। আর নিরুপায় দেখেছেন কি করে সাধের বসতভিটা আস্তে আস্তে আস্ত গিলে খেলো রাক্ষুসী যমুনা! এভাবেই রূপচাঁদ মোল্লা, এরশাদ মোল্লা, মজনু মোল্লা, আলী মোল্লা, আমদ আলী মোল্লা, বাতেন মোল্লা সহ অর্ধশতাধিক মানুষ কোনক্রমে ঘরের চাল খুলে নিয়ে খুঁজে ফিরছেন একটু নিরাপদ আশ্রয়।

সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, ২০১২ সালে ১১০ কোটি টাকা ব্যয়ে কৈজুরী থেকে বিনোটিয়া পর্যন্ত ১’শ বছরের টেকসই ১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যমুনা নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণ করা হয়। সেই শতকোটি টাকার বাঁধে একদশক যেতে না যেতেই বিভিন্ন জায়গায় নেমেছে ধ্বস। হুমকির মুখে পড়েছে অসংখ্য স্থাপনা আর বাড়িঘর।

স্থানীয় গালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল বাতেন বলেন, ‘গত শুস্ক মৌসুমে যমুনা নদী তীর সংরক্ষণ বাঁধের খুব কাছ থেকে অবৈধভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়েছিল। সেই সময় বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডকে লিখিতভাবে জানালেও তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। যে কারণে বর্ষা মৌসুমে ওই স্থানগুলোতে জিও টেক্সটাইল সরে গিয়ে ও ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে সিসি বøক ধ্বসে গেছে। অথচ এই বাঁধের পাশেই ৩ বছর আগে ১’শ ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে আরেকটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। আর মাত্র ৪০/৫০ মিটার ভাঙলেই বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধেও ধস দেখা দিতে পারে বলে।

এ বিষয়ে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরত ইঞ্জিনিয়ার শাহীন কামাল জানান, ভাঙন শুরু হওয়ার সাথে সাথেই আমরা জিও ব্যাগ ফেলা শুরু করেছি। আশাকরি আমরা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারবো। পানি উন্নয়ন বোর্ড, সিরাজগঞ্জের কার্যসহকারি মোঃ নুরুল ইসলাম জানান, নদীতে তীব্র ¯্রােত থাকায় হঠাৎ করেই ধ্বস শুরু হয়। তবে আমরা ভাঙন ঠেকাতে সাথে সাথেই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। এ বিষয়ে শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ তরিকুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আমাকে জানানোর পর সাথে সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ডকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেছি। ইতোমধ্যেই তারা জিও ব্যাগ ফেলতে শুরু করেছে। অন্যদিকে, যমুনায় ভিটেমাটি হারানো স্বরবানু, দুলু খাতুন, রূপচাঁদ মোল্লা, এরশাদ মোল্লা, মজনু মোল্লা, আলী মোল্লা, আমদ আলী মোল্লা, বাতেন মোল্লাসহ অর্ধশতাধিক চির অবহেলিত, পতিত, অপাংক্তেয়, যাদের বুক ফাঁটলেও মুখ ফোঁটেনা! যাদের বিচারের বাণী নিরবে নিভৃতে কাঁদে-তারা এ দুর্বিসহ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায়; চায় দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে। এজন্য, তারা স্থানীয় এমপি প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতাসহ সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করেছেন।#

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!