যে জন থাকে অন্তরে স্মরণে এনায়েত হোসাইন মিলন

ইমানুল হাকিম
ইমানুল হাকিম
18 মিনিটে পড়ুন
এনায়েত হোসাইন মিলন। ছবি: নজরুল ইসলাম চুন্নু।

কবিতার শহরে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ গঠন হয় সত্তর দশকের শেষদিকে। জেলা ইউনিট’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন লেখক, গবেষক অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। তিনি তখন বরিশাল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। সম্পাদক ছিলেন কবি, বাচিক শিল্পী ফয়জুল হাকিম। তিনি এসময় শেবাচিম’এ অধ্যয়নরত ছিলেন। যুক্ত ছিলেন আরো কিছু কবি, লেখক, অধ্যাপক সহ মেধাবী তরুণ। তরুণদের বেশিরভাগ ছিল বরিশাল মেডিকেলের ছাত্র। যাঁরা বাম রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। সেসময় সংগঠনের বেশিরভাগ কার্যক্রম পরিচালিত হতো পাবলিক লাইব্রেরি সংলগ্ন জাহানারা হলে। সেসব পোগ্রামে আলোচক হিসেবে মহিলা কলেজের ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক কবি আবু যোবের স্যার নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন। আমি তখন বরিশাল-রাজশাহী আসা-যাওয়ার মধ্যে থাকি। এরমধ্যে একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর যোদ্ধা আনোয়ারুল কবির কাসেম ইউনিট’র কর্মী হিসেবে যোগ দেন। তাঁর যোগদানে সংগঠন নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পেলো। তাঁর চেষ্টায় ‘লেখক শিবির, বরিশাল ইউনিট’র একটা ঠিকানা হলো। সদর রোডস্থ আসাদ ম্যানসন’র তিনতলা ভবনের চিলেকোঠায়। ছোট্ট একটা রুম। ১০/১২ জন বসতে পারে এরকম। বিশাল খোলা ছাদ। এটা ছিল বাড়তি লাভ। শুরুতে ভাড়া ছিল ৫০ টাকা। শেষে ১০০ টাকা। এখনও মনে আছে, রুমের সেই ভাড়া যোগার করতে আমাদের কি যে হিমশিম খেতে হতো। প্রায়ই ঘর ভাড়া বাকি পড়তো। পথ নাটক করে, শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে সেই বকেয়া মিটাতে হতো। বরিশাল’র আধুনিক নাটকের পুরোধা পুরুষ আকবর হোসেন’র নাটকের সংগঠন ‘খেয়ালী’র কার্যালয় ছিল ঐ একই ভবনের দোতলায়। আমার বন্ধু সদ্য প্রয়াত দিদারুল আলমের নাটকের গ্রুপ ‘পদক্ষেপ’ ছিল তিনতলায়। পরে সেখানে আরো অনেক সংগঠনেরই জায়গা হলো। ‘আসাদ ম্যানসন’ হয়ে উঠলো যেনো সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্রভবন। আবৃত্তিকার, অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক মীর মুজতবা আলী ‘খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার’র সাথে যুক্ত থেকে মঞ্চে দাপটের সাথে কাজ করছেন। শহরে একই পাড়ায় থাকার কারণে তাঁর সাথে আমার আগে থেকেই মিষ্টিমধুর সম্পর্ক ছিল। আসাদ ম্যানসনে জায়গা হওয়ায় ‘লেখক শিবির’র কাজের পরিধি বেড়ে গেলো। খোলা ছাদ নাটকের রিহার্সাল করার উপযুক্ত স্হান হলো। একের পর এক স্বৈরাচার বিরোধী পথনাটক খোলা জায়গায়, পথে, জনারণ্যে মঞ্চস্হ হতে লাগলো। অন্যদিকে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের প্রতি আগ্রহ আমার আগে থেকেই ছিলো। এবার সেটার সদ্ব্যবহার করতে আমরা ক’জন ‘খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটার’র সাথে জড়িয়ে গেলাম। সময় যেনো লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। ভাবলাম আবৃত্তি’র একটা অনুশীলন কেন্দ্র করলে কেমন হয়। কারণ ইতিমধ্যে আবৃত্তির প্রতি তরুণদের আগ্রহ বাড়ছিল। ‘লেখক শিবির’র সকল পোগ্রামের শুরুতেই থাকতো প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি। সে কবিতা যেমন ছিল সুকান্ত, সুভাষ, পাবলো নেরুদা, হেলাল হাফিজ’র। ছিল রফিক আজাদ, মায়োকোভস্কি ও নাজিম হিকমত’র। এসব কবিতার দীপ্ত পঙক্তিমালা তখন বাচিকশিল্পীদের কন্ঠে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এবিষয়ে প্রথম আলাপ করলাম নিজের সংগঠন ‘খেয়ালী’র সাথে। আবৃত্তির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নাটক’র দল থেকে আরম্ভ করা যায় কিনা? কি এক অজ্ঞাত কারণে সে প্রস্তাব সংগঠন গ্রহণ করলো না। মন কিছুটা খারাপ হলো। নিজের নাটকের দল এই অগ্রচিন্তাকে আমলে নিলো না। ‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’ এসময় অশ্বিনীকুমার টাউন হলে অসাধারণ সব নাটক মঞ্চায়ন করে দর্শকদের ভিতর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এর সম্পাদক ছিলেন আমার অগ্রজ প্রিয় মানুষ, তুখোড় সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা শাহনেওয়াজ ভাই। কলেজে নাটক করতে গিয়ে তাঁকে আমি কাছে পাই। সে আরেক পর্ব। তো তাঁকে আবৃত্তি নিয়ে ভাবনাটা ব্যক্ত করি। ‘শব্দাবলী’ এসময় আগের জায়গা ছেড়ে লুকাস বিল্ডিং এর বর্তমান পরিসরে চলে এসেছে। ইংরেজ আমলের এক ইতিহাস প্রসিদ্ধ বাড়ি। যাহোক শাহনেওয়াজ ভাই শোনার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, কোনো কথা নেই ‘আবৃত্তি অনুশীলন’র ক্লাস ‘শব্দাবলী’তে হবে। ঠিক হলো সপ্তাহের ছুটির দিন এই ক্লাস চলবে। প্রশিক্ষক হিসেবে যুক্ত হলেন প্রথিতযশা আইনজীবী, নন্দিত আবৃত্তিকার এনায়েত পীর খান, বাচিক শিল্পী, অভিনেতা, নাট্যনির্দেশক মীর মুজতবা আলী এবং ব্রজমোহন কলেজ’র বাংলার যশস্বী অধ্যাপক আ.খ.ম আবদুর রব। আমি থাকলাম পরিচালক, সমন্বয়কারীর দায়িত্বে। শাহনেওয়াজ ভাই থাকলেন ‘শব্দাবলী’র পক্ষে পৃষ্ঠপোষক ও শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে। আবৃত্তি অনুশীলন এভাবে প্রায় তিনবছর চললো। সেসময় এনায়েত হোসাইন মিলন ‘আবৃত্তি অনুশীলন’র একজন সুহৃদ হিসেবে সবসময় খোঁজখবর রাখতেন। বলতেন, সমস্যা হলে বলবে। এই যে লজিস্টিক সাপোর্ট তখন ‘শব্দাবলী’র পক্ষে শাহনেওয়াজ ভাই, মিলন ভাই’র কাছ থেকে আমরা পেয়েছি সে কথা কি কখনও ভোলা যাবে, না সে ঋণ পরিশোধ করা যাবে! তাঁরা জানতেন আমরা একাধারে ‘খেয়ালী এবং ‘লেখক শিবির’ দুটোই করি। তারপরও জেনেশুনে ‘আবৃত্তি অনুশীলন’ গঠনে নেপথ্যে থেকে যে ভূমিকা তাঁরা পালন করেন তা ছিলো এককথায় অভাবনীয়। এরপর সাংগঠনিক কিছু নীতি ও আদর্শগত বিষয় নিয়ে ‘খেয়ালী’র সাথে আমার মতবিরোধ ঘটে। আমি সংগঠনের তখনকার কিছু অসাংবিধানিক সিদ্ধান্তের সাথে দ্বিমত পোষণ করে একরকম অব্যাহতি নিয়ে ঘরে বসে থাকি । ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে বরিশাল কলেজে ইতিহাস’র অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেছি। কলেজ আর ক্লাস এনিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এরমধ্যে ‘শব্দাবলী’র কর্মী মান্নান সৈয়দ মনু হঠাৎ একদিন আমার বাসায় এলো। ওর কাছ থেকে জানলাম যাঁদের হাত ধরে ‘শব্দাবলী’ প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তাঁরা সকলে একে একে বরিশাল ছেড়ে রাজধানী মুখী হয়েছে। এই শূন্যতার কারণে সংগঠন এই মুহূর্তে একটি কঠিন সময় পার করছে। সংগঠনের আজকের যিনি কর্ণধার, যিনি ‘শব্দাবলী’র স্টুডিও থিয়েটার’র উদ্ভাবক এবং নির্মাতা, নাট্যজন সৈয়দ দুলাল তখন তিনি দেশের বাইরে সম্ভবত জাপানে অবস্থান করছিলেন। মনুর ভাষায়, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ‘শব্দাবলী’তে নাটক নির্দেশনা দিবেন সেরকম কেউ নেই। এখন আপনি যদি আমাদের একটু সময় দেন আমরা খুব উপকৃত হই। বললাম কি বলো, আমি তো এমনিতে বসেই আছি- আর তাছাড়া ‘শব্দাবলী’র কাছে আমি অনেক দিক থেকেই ঋণি। তুমি চিন্তা করোনা আমার দায়বদ্ধতা থেকেই আমি তোমাদের সহায়তা করবো। এরপর যে ক’দিন আমি ‘শব্দাবলী’তে গিয়েছি সে ক’দিন এনায়েত হোসাইন মিলন আমার খোঁজ নিয়েছেন। আমার যাতে কোনোরকম অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রেখেছেন। এই হলেন এনায়েত হোসাইন মিলন। আমাদের মিলন ভাই। যাঁর মন ছিল স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ ও আকাশের মতে উদার।

বরিশাল কলেজে আমার অবস্থান ছিল ‘৮৫’র জানুয়ারি থেকে ‘৮৯’র জুন পর্যন্ত। এসময়টুকু আমার জীবনের এক বর্ণিল সময়। একেতো বয়স কম তার উপর শিক্ষাকতার মতো মহৎ পেশায় জড়িয়ে বিদ্যার্থীদের ভিতর নিজেকে নতুন করে আবিষ্কারের পালা। তখন কলেজ অধ্যক্ষ ছিলেন বরেণ্য শিক্ষাবিদ, আমার পিতার শিক্ষক, আমার পূজনীয় শিক্ষক, অভিভাবক, অধ্যাপক মো. সিরাজুল হক। তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের সামনে দাঁড়ায় এমন বুকের পাটা তখন ক’জনের। আমি ভয়ে দূরে দূরে থাকি। এনায়েত হোসাইন মিলন আমাদের মিলন ভাই এসময় কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। আর কি। প্রাণের যোগ ঘটে গেলো। দেখলাম অধ্যক্ষ স্যার তাঁকে খুব পছন্দ করেন। আর কেনই বা করবেন না। কলেজের সাহিত্য সংস্কৃতির অনুষ্ঠান থেকে জাতীয় দিবস উদযাপন সবক্ষেত্রে নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন এই মানুষটি। এমনকি বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠান সেখানেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকতেন তিনি। নিরলস পরিশ্রম করতে পারতেন। যখন যে কাজটি করতেন তাতেই তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দিতেন। আমি এমন নিঃস্বার্থ মানুষ খুব কম দেখেছি। আমি যোগদান করলে তিনি একজন সঙ্গী পেলেন। বেশ কাটছিলো দিনগুলি। এরমধ্যে অধ্যক্ষ স্যার একদিন আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি জানি কোনো বিশেষ কাজ না থাকলে স্যার এমনি তলব করেন না। আসবো স্যার…। রাশভারি মানুষটি মাথা নাড়লেন। সালাম দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।.. বসো । বসলাম। এবার আমার পিতার শিক্ষক সস্নেহের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কলেজ বার্ষিকী বের করতে হবে। তুমি মোজাম্মেল হক’র ( তিনি তখন বাংলার প্রধান) সাথে কথা বলো। আমার কথা বলো। জ্বি স্যার..। দ্বিরুক্তি না করে সোজা চলে গেলাম মোজাম্মেল হক স্যার’র কাছে। বললাম স্যার’র অভিপ্রায়ের কথা। চুপ করে শুনলেন। তারপর বললেন, স্যার যখন বলেছেন তখন অবশ্যই ম্যাগাজিন বের করতে হবে। তবে বাস্তবতা কি জানো। আমি এর আগে বার্ষিকীর লেখা চেয়ে দু’বার নোটিশ করেছিলাম। তাতে ছাত্রছাত্রীদের দিক থেকে সাড়া যে পাইনি তা নয়। সব লেখা আমার কাছে জমাও আছে। তাহলে..? এবার স্যার’র কন্ঠে কিছুটা হতাশা, কিছুটা বিষন্নতার সুর। লেখা আছে । কিন্তু তার একটিও ছাপবার যোগ্য নয়। কলেজ বার্ষিকীতে ছেপে বের করার মতো নয়। এখন আমি কি করবো বলো..? মোজাম্মেল স্যার করুন দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। স্যার’র দিকে তাকিয়ে আমিও যেনো কেমন বিহবল হয়ে পড়লাম। বললাম, স্যার আর একবার চেষ্টা করলে হয়না। কি হবে..? নোটিশ করলে যদি কিছু নোতুন লেখা পাই। এমনতো হতে পারে ছাপবার যোগ্য কিছু ভালো লেখা পেয়ে গেলাম। মনে হলো স্যার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বললেন, দেখো চেষ্টা করে। কলেজ বার্ষিকীর লেখা আহবান করে ছাত্রছাত্রীদের ভিতর আবার নোটিশ জারি করা হলো। কিছু লেখা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে হাতেও এলো। আগের এবং পরের সংগৃহিত সব লেখা বাসায় নিয়ে এলাম। ছড়া, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ আর কৌতুকে ছড়াছড়ি। রাত জেগে জেগে সবগুলো পড়লাম। মোজাম্মেল হক স্যার’র কষ্টমাখা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। স্যার’কে আর কিছু না জানিয়ে আমি সোজা চলে গেলাম অধ্যক্ষ স্যার’র কাছে। আমার শেষ আশ্রয়। আদ্যপ্রান্ত সব খুলে বললাম। শুনলেন। তারপর তাকালেন আমার দিকে। বললেন, এতক্ষণ যা বললে, এগুলো আমার জানা। বার্ষিকী বের করতে হবে এটাই শেষ কথা। নাহলে তোমাকে ডেকেছি কেন! আমি সোজা চলে গেলাম মিলন ভাই’র কাছে।

আমাকে দেখেই মিলন ভাই উৎসুক চোখে তাকালেন। কিছু একটা ঘটেছে বুঝতে পারছিলেন। ভণিতা করলাম না। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বলে গেলাম। শুনলেন। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। শেষে বললেন, ‘নো চিন্তা ডু ফূর্তি’। তুমি কোনো চিন্তা করোনা ম্যাগাজিন বেরুবে। তখন সদর রোডে ‘আহমেদ প্রিন্টিং প্রেস’ চালাচ্ছিলেন বরিশাল ইসলামিয়া কলেজ’র বাংলার অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া মনু। অত্যন্ত সজ্জন, সদালাপী একজন মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের দু’জনের সাথেই তাঁর মধুর সম্পর্ক। আমরা গেলাম তাঁর কাছে। এখন তিনজন হলাম। শুধু বললেন, কোনো সমস্যা নেই। আমার প্রেস আপনাদের জন্য ছেড়ে দিলাম। যে কাজ বাড়িতে কিংবা কলেজে বসে করতেন, সেটা আমার এখানে বসে করবেন। তাতে কাজে গতি আসবে, ভুলভ্রান্তি কম হবে। আবার সময়ও বাঁচবে। ম্যাগাজিনও ঠিকঠাক বেরিয়ে যাবে। এরপর মিলন ভাই আর আমার শুরু হলো বিরামহীন পরিশ্রম। সেদিন দেখেছি মিলন ভাই’র আরেক রূপ। চ্যালেঞ্জ নেয়ার দৃঢ়তা। একজন মুক্তিযোদ্ধার অসম্ভবকে সম্ভব করার লড়াই। আমি তাঁর সেই সহযোগিতার কথা কি করে ভুলি! কলেজ বার্ষিকী বের হলো। এত দ্রুত কাজটি শেষ হবে কেউ ভাবতে পারেনি। আমি ধন্যবাদ জানাই মোজাম্মেল হক স্যার’কে। কমিটির আহবায়ক ছিলেন তিনি। এই কাজে একবারের জন্য প্রশ্ন তোলেননি। বরং আমাদের সকল আবদার অম্লান বদনে মেনে নিয়েছেন। তাঁর সেই উদার সহযোগিতা এই সুযোগে স্মরণ করছি। একইসাথে কৃতজ্ঞতা জানাই আহমেদ প্রিন্টিং প্রেস’র অধ্যাপক গোলাম কিবরিয়া মনু’র প্রতি। তাঁর হাত বাড়ানো ছিল অবিস্মরণীয়। আমার আনন্দ আমার পরম পূজনীয় অভিভাবক’র একান্ত ইচ্ছে মিলন ভাই আর আমি যথাসময়ে পূরণ করতে সমর্থ হয়েছি। এই মেলবন্ধন পরবর্তীতে কলেজের সাহিত্য, সংস্কৃতি থেকে জাতীয় দিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করে নাটক মঞ্চয়ন সকল কর্মসূচি বাস্তবায়ন সহজ করে দেয়। বরিশাল কলেজ’র জন্য সময়টা ছিলো তখন উজ্জ্বল স্বর্ণালি দিন। একদিকে বরেণ্য শিক্ষাবিদ সিরাজুল হক’র মতো ব্যক্তিত্ববান সুযোগ্য অধ্যক্ষ। অন্যদিকে উপাধ্যক্ষ’র দায়িত্বে ছিলেন ভাষাসংগ্রামী আমার পিতার বন্ধু-সহপাঠী, ইতিহাসবিদ মো.হোসেন আলী। সাথে একঝাঁক মেধাবী, পরিশ্রমী, তেজস্বী, অঙ্গীকারাবদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ। ফলে কলেজ ছিল এসময় সুনামের শিখরে। শতবর্ষী তমাল তলা ঘিরে বিদ্যার্থীদের কলরব। জমজমাট ক্যাম্পাস। এক উচ্চমাধ্যমিকেই সহস্রাধিক’র উপর ছাত্র। সাথে ছিল নৈশ বিভাগ। ছাত্রদের পদভারে কলেজ থাকতো সর্বক্ষণ মুখরিত। ইতিমধ্যে কলেজ সরকারি হয়েছে। সবার ভিতর বেশ একটা চনমনে ভাব। শিক্ষক, কর্মচারী সকলেই আত্মীকৃত হয়েছে। মনে আছে, আমি সেসময় একসাথে বকেয়া বেতন-ভাতাদি মিলে বেশ কিছু টাকা হাতে পেলাম। একসাথে এতটাকা! আমি নিজেও তখন অনেকটা বিহবল। মিলন ভাই আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন, টাকাতো পেলে। কিছু ভেবেছো? কি করবে এদিয়ে? আমি তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঠিকইতো এই টাকার ভবিষ্যৎ তো আমার ভাবা হয়নি। বললেন, আমি বলি কি তুমি এই টাকা অন্যত্র খরচ না করে বরং দশ শতক জায়গা কিনে রাখো। পরে কাজে লাগবে। সেসময় নগরের কলেজ এভিনিউ এলাকায় দশ শতাংশ জায়গা ৮০ হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল। মিলন ভাই সহ আমার পরিচিত সহকর্মীরা কেউ কেউ সেই জায়গা কেনার পরিকল্পনা করছেন। কিনলেনও তাঁরা। আমার কেনা হয়নি। কেনো জানি মাথায় তখনও এই বৈষয়িক চিন্তাভাবনা বাসা বাঁধেনি। এই হলেন এনায়েত হোসাইন মিলন। আমার প্রতি কতখানি স্নেহান্ধ ভালোবাসা থাকলে আমার ভালো চিন্তা করে একান্তে ডেকে নিয়ে ভালো পরামর্শটি দেন। কারণ তিনি জানতেন বয়স কম বলে এই টাকা নানা অপ্রয়োজনীয় কাজে শুধু শুধু খরচ করে ফেলবো। আরেকটি ঘটনা। আমার বদলীর আদেশ এসেছে। পদায়ন বিএম কলেজে। কলেজ সরকারি হবার পর আমিই প্রথম ব্যক্তি যাঁর এক কলেজ থেকে আরেক কলেজে বদলীর আদেশ এলো। স্বভাবতই সবাই আমার পিঠ চাপরাচ্ছেন। আর অভিনন্দন জানাচ্ছেন। মিলন ভাইও খুশি। কিন্তু গোল বাঁধলো রিলিজ নিতে গিয়ে। লাইব্রেরিয়ান রব ভাই ইতিমধ্যে অধ্যক্ষ মকবুল উদ্দিন আহমেদ স্যার’র গোচরে এনেছে, কলেজ ইমানুল হাকিম’র কাছে তিনখানা বই পাবে। ঘটনাটি জানার পর আমি রব ভাইকে বললাম, আপনিতো জানেন এই বই আমি নেইনি। এই কলেজ’র আপনার পুরনো একজন সহকর্মী বই তিনটি নিজের নামে ইস্যু করেন। তিনি বদলী হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ায় আপনি তাৎক্ষনিকভাবে তাঁর কাছ থেকে বইটি সংগ্রহ করতে পারেননি। এখন সেটার দায়ভাগ আমার ওপর চাপাচ্ছেন। তো আমি সেটা নিতে যাবো কেন? বরঞ্চ আপনিই আমাকে তাঁর হয়ে অনুরোধ করলেন আমি যদি আমাদের ওই প্রিয় সহকর্মীর নামে ইস্যুকৃত বই তিনটি আমার নামে ইস্যু করে নেই, তাহলে আপাত একটা সমাধান হয়। আর ভদ্রলোকও এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে রেহাই পান। যেহেতু মানুষটি আমারও খুব প্রিয় একজন, আমি শেষে রাজী হলাম। ঠিক কিনা বলেন? রব ভাই বললেন, সব ঠিক স্যার। এখন আমি কি করবো? প্রিন্সিপাল স্যারতো আমাকে দুষছেন। আর বললেন এটার সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ইমানুল হাকিম রিলিজ পাবে না। আমি বললাম, ঠিক আছে নিয়ম অনুযায়ী বই’র দ্বিগুণ দাম দিতে আমি রাজি আছি। আপনি হিসেব কষে দাম বলেন আমি এখুনি দিয়ে দেবো। লাইব্রেরিয়ান রব ভাই আমার বয়ান শুনে বললেন, ঠিক আছে স্যার এই কথাগুলো আপনি প্রিন্সিপাল স্যারকে বলেন। মিলন ভাই’র সামনেই স্টাফ কাউন্সিলে বসে কথা হচ্ছিল। তিনি আমাকে ইশারা দিলেন প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে যেতে। গেলাম। স্যার’কে আদ্যপ্রান্ত সব বললাম। শুনলেন। বোধহয় একটু নরম হলেন। বললেন, দেখো টাকা দিয়ে বই’র দাম পরিশোধ করাতো বড় কথা নয়, কলেজ লাইব্রেরি থেকেতো তিনখানা বই কমলো। এখন একটা পথ খোলা আছে, তুমি যেভাবে একজন’র সুহৃদ হয়ে বইগুলি নিজের নামে বরাদ্দ নিয়ে তাঁর উপকার করলে এখন দেখো এই কলেজে তোমার তেমন কোনো উপকারী শুভানুধ্যায়ী আছে কিনা যে তোমাকে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে স্বেচ্ছায় উদ্ধার করবে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লে। একটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়লাম। ঘড়ির কাটা তখন চারটার ঘর ছুঁইছুঁই করছে। আমি একরকম দৌঁড়ে চলে এলাম স্টাফ কাউন্সিলে। দেখলাম কেউ নেই। চেনা সহকর্মীরা সকলেই বাড়িমুখো হয়েছে। কেবল সোফায় হেলান দিয়ে বসে আছেন এনায়েত হোসাইন মিলন। তিনি রয়ে গেছেন আমার অপেক্ষায়। লাইব্রেরিয়ান রব ভাইকে শুধু বললেন, আপনি এতো উৎকন্ঠিত হচ্ছেন কেনো? খাতা দেন। ইমানুল হাকিম’র নামে বরাদ্দ সব বই আমি নিজের নামে বরাদ্দ নিয়ে নিচ্ছি। আপনার প্রব্লেম ডিসমিস। আমাকে বললেন তুমি রিলিজ নিয়ে বাড়ি চলে যাও। আমার চোখ ততক্ষণে পানিতে ভরে গেছে। সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।

সবশেষে একটা তথ্য আপনাদের জানিয়ে রাখি। আমি জানি অনেকেই এটা জানেন। তারপরও বলি, বরিশাল কলেজ’র দক্ষিণের প্রধান ফটকের সিমেন্টের উপর ছেনি দিয়ে কেটে যে অক্ষর বসানো হয়েছে সে কাজটি এনায়েত হোসাইন মিলন’র। যে একই ধরনের কাজ তিনি ব্রজমোহন কলেজেও করেছেন। আমি দেখেছি। কারণ ওই সময়টা আমি তাঁর কাছে থাকার চেষ্টা করেছি। দেখেছি দিনের পর দিন মাচার উপর দাঁড়িয়ে একজন মানুষ নিজের খাওয়াদাওয়া ভুলে কি অসীম ধৈর্য, মগ্নতা আর পরম মমতায় ব্রজমোহন কলেজ লেখাটি বাংলা এবং ইংরেজি উভয় বর্ণে গোটা গোটা অক্ষরে জীবন্ত করে তোলেন। একবার শুধু কল্পনা করুন। এনিয়ে তাঁকে কখনো বড়াই করতে দেখিনি। এখন বড়াই করার লোকের অভাব নেই। তাঁর মুখে পারবোনা, পারা যাবে না- এরকম শব্দ কাছের কেউ শুনেছেন কি…? তাঁর সহধর্মিণী আমাদের ভাবীর সাথে দেখা নেই বহুদিন। একমেয়ে, একছেলে ওদেরও দেখেছি যখন ওরা ছোটো। স্কুলে নিচের ক্লাসে পড়ে তখন। আজ সেসব যখন মনে করি, ভিতরে বুকটা ভারী হয়ে আসে। চোখের পাতা অজান্তেই ভিজে যায়। আমার দেখা এক অসামান্য মানুষ। এই স্মৃতির শহরে একদিন ছিলেন। আজ নেই। দেখা নেই কতদিন! পরম স্রষ্টার কাছে শুধু প্রার্থনা, পরপারে তিনি যেনো ভালো থাকেন। তাঁর বিদেহী আত্মা চিরশান্তি পাক।

স্মরণে এনায়েত হোসাইন মিলন: প্রথম পর্ব

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সাবেক অধ্যক্ষ, ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!