যে জন থাকে অন্তরে স্মরণে এনায়েত হোসাইন মিলন

ইমানুল হাকিম
ইমানুল হাকিম
13 মিনিটে পড়ুন
এনায়েত হোসাইন মিলন। ছবি: নজরুল ইসলাম চুন্নু।

সৃজনশীল এক কর্মমুখর মানুষ এনায়েত হোসাইন মিলন; আমাদের মিলন ভাই এই আশ্চর্য পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন আজ দশবছর হলো। ছিলেন নান্দনিক কাজের এক অনুপম কারিগর। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সাহস ও বীরত্ব ছিল তারুণ্যের অহংকার। হৃদয় ছিলো আকাশের মত প্রশস্ত, সমুদ্রের মতো অতল। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর সান্নিধ্য পাবার। এক অভূতপূর্ব স্বর্গীয় ভালোবাসার বন্ধনে আমরা জড়িয়ে ছিলাম। তাঁর সাহচর্যে আসি ১৯৭৪ সালে। এসময় গড়ে ওঠা আবৃত্তিকারদের সংগঠন ‘আবৃত্তি সংঘ’র উদ্যোগে দর্শনীর বিনিময়ে ‘আবৃত্তি সন্ধ্যা’ হবে অশ্বিনী কুমার টাউন হলে। অনুষ্ঠানটি যাতে সবদিক থেকে সুন্দর ও আকর্ষণীয় হয় তারজন্য সকলেই যথাসম্ভব হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সেই ধ্রুপদী সন্ধ্যায় যাঁরা আবৃত্তি করবেন তাঁরা নিয়মিত অনুশীলনে ব্যস্ত থাকছেন শেরে বাঙলা মেডিকেল কলেজের এক নম্বর গ্যালারীতে। অনুশীলনের জন্য এটি ছিলো চমৎকার একটি জায়গা। পারভেজ ভাই তখন মেডিকেলের ছাত্র। ভালো আবৃত্তি করেন। ‘আবৃত্তি সংঘ’র অন্যতম সংগঠক। এই সুযোগটি পেয়েছিলাম তাঁরই ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। দিন, তারিখ ঠিক হলে প্রচারে এবং টিকেট ‘পুশিং সেল’ এ সবাই নেমে পড়লাম। শহরে মাইকিং হলো। আমি নিজেই এই দায়িত্ব কাঁধে নিলাম। মঞ্চের নান্দনিক রূপসজ্জা দিতে হবে। সেসাথে হলের ভিতরের আবহ, পরিবেশ, লাইট, সাউন্ড সবকিছুর সমন্বয় ঘটাতে হবে। এনিয়ে ঘনঘন আলোচনা চলছে নিজেদের মধ্যে। আমার মনে আছে, এব্যাপারে আমরা প্রথম যাঁর স্মরণাপন্ন হলাম তিনি হলেন এনায়েত হোসেন মিলন। মানুষটির কাছাকাছি যাবার সেই প্রথম সুযোগ হলো এবং সেইসাথে একজন উদ্ভাবনী চিন্তার মননশীল ব্যক্তিকে অনুভব করলাম। কবিতার সাথে আবহ ও লাইটের সম্পর্ক’র বিষয়টি সেদিন তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও নিপুণতার সাথে নেপথ্যে থেকে সম্পন্ন করেন। সেদিনের তাঁর এই সহযোগিতা কি ভোলা যায়! নাকি ভোলা সম্ভব? নিজের অজান্তেই তিনি একটি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলেন। সেই শুরু। আমার ধারণা এসব নান্দনিক কাজে এভাবেই তিনি এই কবিতার শহরে অনিবার্য হয়ে ওঠেন। কবিতার সংকলন বের করবো প্রচ্ছদ কে করবেন? এনায়েত হোসেন মিলন। কাঠের ব্লক তৈরি করা, স্টেজের ব্যাক স্ক্রিনের উপর অক্ষর বসানো, নাটক’র লাইট ঠিক করা, চরিত্রের মেকআপ কে করবেন? এনায়েত হোসেন মিলন। না- মানুষটির মধ্যে কোনো ক্লান্তি নেই, বিরক্তি নেই, নেই কোনো নালিশ। কাজের মধ্য দিয়েই তাঁর সাথে আমার পরিচয়। ক্রমশ সেটি গভীরতায় রূপ নেয়। পরে আমি তাঁর সহকর্মী হই।

বিদায় নেন এক বিষন্ন রাতে। গুমরে ওঠে শ্রাবণ’র মেঘ। শুরু হল সকাল থেকে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। প্রকৃতির সে কান্না ছুঁয়ে যায় সবার মন। প্রথম জানাজা হয় অশ্বিনীকুমার হলে। দ্বিতীয় জানাজা পড়া হয় নিজ গ্রামের হস্তিশুন্ড প্রাইমারি স্কুলের মাঠে। দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় সন্মান। শেষে পারিবারিক গোরস্থানে বাবা-মা’র পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

বোধে, মননে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব এবং বহুমুখী প্রতিভার মানুষ ছিলেন এনায়েত হোসাইন মিলন। জন্ম এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। ১৯৪৫’র ২১ জানুয়ারি বরিশাল জেলার উজিরপুরের হস্তিশুন্ড গ্রামে। পিতা শাহাবুদ্দিন আহম্মেদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। হস্তিশুন্ড হাইস্কুল তাঁর হাত ধরেই গড়ে ওঠে। পুত্র মিলন যদিও পড়াশোনা করেন ব্রজমোহন বিদ্যালয়ে। ম্যাট্রিক পাশ করেন এখান থেকে। বিএসসি ডিগ্রি নেন ব্রজমোহন কলেজ থেকে। শিল্পের প্রতি অনুরাগ তাঁর ছেলেবেলা থেকেই। ভালো ছবি আঁকতেন। দৃষ্টিভঙ্গি আকাশের মতো প্রসারিত। অনুসন্ধিৎসু ছিল মন। বেড়ে উঠেছেন বরিশাল শহরে। থাকতেন অনামি লেনে। তাঁর চাচাতো ভাই সংস্কৃতজন নজরুল ইসলাম চুন্নুর লেখা থেকে জানা যায় অনামি লেনে তাঁদের যৌথ পরিবারে তখন দুটি বড় দোতলা ঘর ছাড়াও একটি বৈঠকখানা ছিল। এখানেই তাঁর আশ্রয়, এখানেই তাঁর স্বপ্ন বোনা, ছবি আঁকা। আর এখানেই ইতিহাসের এক যুগ সন্ধিক্ষণে ‘যুব সংঘ’র প্রতিষ্ঠা। সময়টা ১৯৬৫ সাল। এনায়েত হোসাইন মিলন হলেন এর একজন উদ্যোক্তা। অনেকের মতো সেসময় পালন করলেন এক অনন্য ভূমিকা। বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা করলেন ১৯৬৬’তে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি জোট বাঁধতে আরম্ভ করে। শুরু হল স্বাধীকারের লড়াই। ‘যুবসংঘ’ তাতে সামিল হলো। পাকিস্তানি শাসকদের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে তাদের শাসন-শোষণ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে জনগণকে উদ্দীপ্ত করার কাজে নিজেদেরকে তারা সমর্পণ করলো। আবৃত্তি, গান, নাটক’র মধ্য দিয়ে এর কর্মীরা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বীজমন্ত্র জনগণের ভিতর ছড়িয়ে দিতে থাকলো। এনায়েত হোসাইন মিলন সেই হৃৎস্পন্দন ধারণ করেন। ঊনসত্তরে গড়ে ওঠে নাটক’র দল ‘খেয়ালী’। তিনি ‘খেয়ালী’র নাটকে রূপসজ্জা, মঞ্চসজ্জা ও আলোক ব্যবস্থাপনার কাজ একহাতে করতেন। এভাবেই তিনি নাটক’র মঞ্চসহ কারিগরির সূক্ষ দিকগুলি সম্পাদনে দক্ষ হয়ে ওঠেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি এর সূচনায় ‘যুব সংঘ’র কর্মী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বরিশাল ধর্মরক্ষিণী সভাগৃহে যে কজন সাহসী মুক্তিযোদ্ধা জীবন বাজি রেখে দেশীয় অস্ত্র তৈরি করেন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭৮ সালে ‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠা পেলে তিনি এর সাথে জড়িয়ে যান। ক্রমেই তাঁর কাজের ভিতর দিয়ে তিনি এই সংগঠনের একজন সৃজনশীল কর্মী হিসেবে নাট্যাঙ্গণে নন্দিত হন। টানা নয় বছর তিনি সংগঠনের সম্পাদকের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছিলেন এর কোষাধ্যক্ষ।

দেশ স্বাধীন হলে নিজেকে তিনি নানা গঠনমূলক কাজের সাথে যুক্ত করেন। বেছে নেন সাংবাদিকতা, সাথে শিক্ষকতা। দু”ক্ষেত্রেই তিনি সমান দক্ষতা ও নিষ্ঠার পরিচয় দেন। একাত্তর পরবর্তী দেশের দ্বিতীয় সংবাদপত্র ‘বাংলাদেশ’ পত্রিকার তিনি ছিলেন প্রকাশক। রণাঙ্গনের পত্রিকা ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’-যার সম্পাদক ছিলেন অমিত সাহসী মুক্তিযোদ্ধা নূরুল আলম ফরিদ। তিনি সেটার সাথেও যুক্ত হন। একসময় এটাই হয়ে উঠেছিল তাঁর ঠিকানা। কাজ করেন ঢাকা থেকে প্রকাশিত ‘মর্নিং পোস্ট’ পত্রিকার বরিশাল প্রতিনিধি হিসেবে। আমরা দেখি এর সমান্তরালে তিনি কর্মজীবনে ছিলেন একজন সফল শিক্ষক। পেশাগত দায়িত্বপালনে এতটুকু উদাসীনতা আমি তাঁর মধ্যে লক্ষ্য করিনি। নিজের ভিতরের আলোটুকু ছড়িয়ে দিয়েছেন বিদ্যার্থীদের মাঝে। প্রথম জীবনে শিক্ষাকতা করেন শরিয়তপুর রুদ্রকর মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও বরিশাল টাউন স্কুলে। পরে তিনি সরকারি বরিশাল কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ’র প্রদর্শক শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন।

এনায়েত হোসাইন মিলন জীবনের গড্ডালিকার স্রোতে মিশে যাননি। একজন মুক্তিযোদ্ধা, একজন সাংবাদিক, একজন শিক্ষক হিসেবে জীবনের সীমারেখায় তিনি নিজেকে ধরেও রাখেননি। কাজ করেছেন শিশুদের নিয়ে, কাজ করেছেন শিল্প, সাহিত্য, নাটক নিয়ে। ক্লান্তি নেই, অবসাদ নেই, সবকিছু যেনো তাঁর মেধা ও কর্মী হাতের স্পর্শে এক অনন্য রূপ নিতো। আমাদের কৈশোরত্তীর্ণ বয়সে এবং পরেও কোনো কবিতার সংকলন কিংবা সংগঠন’র স্মারক পুস্তিকা বের করলে তার প্রচ্ছদ চিত্রের কাঠ খোদাইয়ের কাজটি তিনি অবলীলায় সম্পন্ন করতেন। এমনকি কোনো অনুষ্ঠান হবে- মঞ্চের ব্যাক স্ক্রিনের উপর রঙিন মার্বেল পেপার কেটে অক্ষর তৈরি করে সেই অক্ষর যেভাবে তিনি আলপিন অথবা গাম দিয়ে সেঁটে দিতেন যা দেখে আমরা অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকতাম। মঞ্চের চেহারাই ম্যাজিকের মতো পাল্টে যেতো। কতরকম শৈল্পিক কাজের সাথে তিনি নিজেকে যুক্ত রেখেছিলেন ভাবলে আজও অবাক হই।

mi যে জন থাকে অন্তরে স্মরণে এনায়েত হোসাইন মিলন
স্ত্রী ও সন্তানের সঙ্গে এনায়েত হোসাইন মিলন। ছবি: নজরুল ইসলাম চুন্নু।

দেশ স্বাধীন হলে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, নাটক সব ক্ষেত্রে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি চলে আসে। মঞ্চে নিরীক্ষা ধর্মী নাটক মঞ্চায়ন হতে থাকে। আমার শ্রদ্ধাভাজন শিক্ষক ছিলেন অধ্যাপক সাইখুল ইসলাম ও আলমগীর হাই। উভয়ই তখন শতবর্ষী কলেজ বিএম কলেজ’র নন্দিত শিক্ষক। কলেজ’র বার্ষিক নাটকে আমার অভিনয়ের হাতেখড়ি এই দু’জন পূজনীয় শিক্ষক’র হাত ধরে। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই তাঁদের প্রতি। বরিশালে বিরুদ্ধ সময়ে ‘শব্দাবলী’ এদের এবং ধীমান নাট্যকর্মীদের হাত ধরেই গঠন হয়। আলমগীর হাই স্যার ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এনায়েত হোসাইন মিলন ছিলেন তাঁর ছাত্র। সেসময় আধুনিক নাটকের ধারায় ‘শব্দাবলী গ্রুপ থিয়েটার’ কবিতার শহরে এক অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করে। যা আজও বহমান। সংগঠনের জন্য এনায়েত হোসাইন মিলন ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ‘শব্দাবলী’ ছিল তাঁর স্বপ্নের বাড়ি। এই মানুষটি চলে যাওয়ায় শুধু ‘শব্দাবলী’ নয় বরিশাল সাংস্কৃতিক অঙ্গন তার পরম সুহৃদকে হারালো। আমি তখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। এখন রাজশাহী যাতায়াত যতটা সহজ, তখন এতটা সহজ ছিলোনা। পঁচাত্তর পরবর্তী অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা তখন ফুঁসে উঠছে। শিক্ষাঙ্গণ ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ছাত্রদের আন্দোলনের কারণে মাঝেমধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হচ্ছে। প্রশাসন হল ছেড়ে দিতে ছাত্রদের বাধ্য করছে। ফলে এহেন উদ্ভূত পরিস্থিতির মুখে পড়ে হঠাৎ হঠাৎই বরিশাল আসি। ইতিমধ্যে আমি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’র সাথে যুক্ত হয়েছি। তখন এর সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিপন্থী শিক্ষক, গবেষক ড. আহমদ শরীফ, সম্পাদক ছিলেন লেখক, সাংবাদিক, সংগঠক শাহরিয়ার কবির। তিনি সেসময় বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’র সাথে যুক্ত ছিলেন। সম্পাদক ছিলেন আমার মামা শাহাদত চৌধুরী। একাত্তরে ঢাকা গেরিলা ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসী যোদ্ধা ছিলেন তিনি। শাহরিয়ার কবির’র সাথে যোগাযোগ ঘটে ‘বিচিত্রা’র মাধ্যমে। সে আরেক পর্ব। বস্তুত তাঁর সূত্র ধরেই এই প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠনটির হয়ে কাজ করা। বরিশালেও সংগঠনটির ইউনিট গড়ে ওঠে। সভাপতি ছিলেন প্রগতিবাদী লেখক, অধ্যাপক গোলাম রব্বানী। সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন শেবাচিম ছাত্র কবি ফয়জুল হাকিম। ছুটিতে বরিশাল এলে ইউনিটের বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেই। বিশেষকরে স্বৈরাচারী শাসনামলে দানেগড়া ঐতিহ্যবাহী বরিশাল সদর হাসপাতাল ভবনকে অবলুপ্ত করে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্হাপনের বিরোধিতা করে যে গণআন্দোলনটি গড়ে ওঠে সেখানে ‘বাংলাদেশ লেখক শিবির’ বরিশাল ইউনিট’র একটি সাহসী ভূমিকা ছিলো। আন্দোলনের তীব্রতার কারণে এক পর্যায় স্বৈরাচার’র প্রতিভূ হোসাইন মুহম্মদ এরশাদ’র প্রশাসন যন্ত্র তাঁর হাইকোর্ট বেঞ্চ উদ্বোধনের তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয়। এবং এরই এক পর্যায় জনগণের স্বাস্থ্য সেবার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে স্বৈরশাসন যন্ত্র বরিশালের ঐতিহ্যবাহী জেলা সদর হাসপাতাল থেকে হাইকোর্ট বেঞ্চ প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। তখন এই অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ‘লেখক শিবির’ পথে প্রান্তরে, জনারণ্যে যেভাবে প্রতিবাদী কবিতা আবৃত্তি, গণসংগীত, পথনাটকের ভিতর দিয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করছিলো সেটি এনায়েত হোসাইন মিলনকে অভিভূত করে। তিনি আমাদের এই লড়াকু চেতনাকে মন থেকে শ্রদ্ধা করতেন। নানাভাবে উৎসাহ যোগাতেন। এমনকি অনেক সময় দেখেছি তিনি আমাদের আবৃত্তি শুনছেন, নয়তো দাঁড়িয়ে পথনাটক দেখছেন। এই হচ্ছেন মুক্তমনের সংস্কৃতিবান মানুষ এনায়েত হোসাইন মিলন।

প্রচারবিমুখ, নিভৃতচারী এই কর্মবীর নিজেকে সবসময় প্রচারের আড়ালে রাখতেন। ভিতরের শিল্পী সত্তাকে তিনি লালন করতেন মনের গহীনে। সাংবাদিক, খেয়ালী গ্রুপ থিয়েটারের বর্তমান সভাপতি, সংস্কৃতজন নজরুল ইসলাম চুন্নু জানান ‘দাদা খুব ভালো বেহালা ও বাঁশের বাঁশি বাজাতে পারতেন। এটা তিনি আয়ত্ত করেন মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় ‘যুবসংঘ’র কর্মী, রণাঙ্গনের দুঃসাহসিক যোদ্ধা, ভাস্কর্য শিল্পী চিত্ত হালদার’র কাছ থেকে। সুহৃদ মুস্তাফিজ রহমান তিনিও ফেসবুকে এবিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি আরও যে ঘটনাটি নজরে আনেন তাহলো : ‘বরিশালে সদর রোডস্থ যুব সংঘ’র উদ্যোগে ট্রাকে করে পথনাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। একই রাতে শহরের শহরের সাতটি স্হানে সে নাটক মঞ্চস্হ হয়। এরকম পথনাটক শুধু বরিশালেই প্রথম তা নয়, শিল্পী অধ্যাপক সাধন ঘোষ’র ভাষ্য মতে এটা বাংলাদেশেরও প্রথম পথনাটক। আর মিলন দাদা এটার সাথে সরাসরিই যুক্ত ছিলেন’। যুবসংঘ’র ট্রাক ড্রামার বিষয়টি আমার জানা ছিলো। যতদূর মনে পড়ে, দেশ তখন কেবল স্বাধীন হয়েছে- বাহাত্তরে আমি তখন দশম শ্রেণির ছাত্র। বরিশাল জিলা স্কুলে পড়ি। জগদীশ সিনেমা হলের মোড়ে (এখন যে স্হানটি কাকলীর মোড় হিসেবে পরিচিত) হঠাৎ দেখলাম একটা ট্রাক এসে দাঁড়ালো। পাটাতনের উপর বেশ কিছু লোকজন। তাঁরা ট্রাকের উপর একটি নাটক মঞ্চস্থ করলেন। নাটকটির নাম ছিল ‘আলোর পথযাত্রী’। মনে থাকার কারণ অগ্রজ প্রিয় নাট্যজন মিন্টু বসু আমাদের মিন্টু দা’র সাথে এবিষয়ে তাঁর জীবদ্দশায় আমার কথা হয়। তিনি নিজেও ‘যুবসংঘ’র সাথে যুক্ত ছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং আলোচিত নাটকের একজন কুশীলব ছিলেন। আজ দু’জনের কেউ পার্থিব জগতে নেই। কিন্তু ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবেন চিরকাল।

এনায়েত হোসাইন মিলন সৃজনশীল কাজের সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পছন্দ করতেন। নিজের পছন্দের জায়গা থেকে ‘বরিশাল চারুকলা বিদ্যালয়’র সাথে শুরু থেকেই জড়িত হন। শিশুদের প্রতি তাঁর হৃদয়ে একটি কোমল জায়গা ছিলো। বিশেষকরে শিশুদের ছবি আঁকা শেখানোর ক্ষেত্রে তাঁর আগ্রহ আর ধৈর্য দেখে বিমুগ্ধ হতাম। ‘বরিশাল চারুকলা বিদ্যালয়’ থেকে ‘প্রান্তিক সংগীত বিদ্যালয়’র চারুকলার শিক্ষক হিসেবে সর্বত্রই তিনি ছিলেন সাবলীল। ছিলেন নিজে একজন দক্ষ শিশু সংগঠক। বরিশালে ‘চাঁদের হাট’ শিশু সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিলো চোখে পড়ার মতো। এরমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের পত্রিকা সাপ্তাহিক ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’র শিশু পাতা ‘সূর্যসাথী’ সাংগঠনিক রূপ পেয়েছিল তাঁর নিরবচ্ছিন্ন সময় দেয়ার কারণে। এনায়েত হোসাইন মিলন ছিলেন এর পরিচালক। এছাড়া শিশু একাডেমির চারুকলা বিভাগের প্রশিক্ষক’র দায়িত্ব পালন করেন দীর্ঘদিন। বরিশাল প্রেস ক্লাব (শহিদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত বরিশাল প্রেসক্লাব) ছিল তাঁর ভালোবাসার একটি জায়গা। বন্ধু বৎসল এই মানুষটি প্রায় প্রতিদিনই সেখানে সহযাত্রী আপনজনদের সাথে সময় কাটাতেন। এর কার্যনির্বাহী পরিষদে বিভিন্ন পর্যায় কোষাধ্যক্ষ’র দায়িত্ব পালন করেন। আগেই বলেছি কাজের মধ্য দিয়ে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। তারপর ঘনিষ্ঠতা, গভীরতা, শ্রদ্ধা, ভালোলাগা সবকিছু।

চলবে…

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
সাবেক অধ্যক্ষ, ব্রজমোহন কলেজ, বরিশাল।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!