দু’টি বাউন্ডারী, একটি জ্যাক ও শেখ কামালের দু’টি স্মৃতি

তানভীর মোকাম্মেল
তানভীর মোকাম্মেল
5 মিনিটে পড়ুন
শেখ কামাল। ছবি সংগৃহীত।

ধানমন্ডী পাড়ায় যারা বড় হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে তাদের অনেকেরই কিছু স্মৃতি রয়েছে। কারণ এ পরিবারটির সবাই-ই ছিলেন খুব সামাজিক। সবার সঙ্গেই মিশতেন। তবে সবচে মিশুক ছিলেন শেখ কামাল। আর তার কারণও ছিল। কারণ শেখ কামাল বিভিন্ন অঙ্গনেই ছিলেন। ছিলেন খেলার মাঠে, সংস্কৃতি অঙ্গনে, নাট্যজগতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সাংগঠনিক কাজে। ওঁকে আমি পেয়েছিলাম মূলত: খেলার মাঠে। শেখ কামাল ক্রিকেট খেলতেন। আবাহনীর মাঠে, আউটার স্টেডিয়ামে আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ওঁর সঙ্গে খেলেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে উনি খেলতেন সমাজবিজ্ঞান বিভাগে। আমি খেলতাম ইংরেজী বিভাগের হয়ে। বয়সে বড়। কিন্তু দেখা হলেই হাসতেন। ওঁর পুষ্ট গোঁফের নীচে বন্ধুসুলভ এক হাসি। এক দিনের স্মৃতি মনে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে ম্যাচ। শেখ কামাল পেস বল করতেন। বলে বেশ গতি ছিল, কিন্তু লাইন-লেন্থ তেমন ঠিক হোত না। মনে আছে ওঁর ওভারের শেষ দুই বলে পর পর দু’টো বাউন্ডারী মেরেছিলাম। একটা মিড-উইকেট দিয়ে, আর একটা কভার ড্রাইভ। আমি তখন ঢাকার প্রথম বিভাগ লীগে আর ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপে নিয়মিত খেলি। ফলে যাকে বলে রীতিমতো ‘ইন ফর্ম’ ব্যাটসম্যান। মনে আছে ওভার শেষে পাশ দিয়ে যাবার সময় ওঁর সেই মোটা গোঁফের নীচে একটু মুচকি হেসে বলেছিলেন; “অত বাউন্ডারী মারলে হবে! আমি কী প্রাকটিস করার সময় পাই?” মনে হয়েছিল একবার বলি, প্রাকটিস করেন না তো ম্যাচ খেলতে এসেছেন কেন? কথাটা যে আর বলিনি সেটা এ কারণে নয় যে উনি প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, বলিনি আমাদের সংস্কৃতিতে বয়সে কিছুটা বড়দের সম্মান দেখানোর যে রেওয়াজ রয়েছে, সে কারণে। অন্যথায় উনি যে দেশের প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রীর ছেলে, আর যে সে প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী নন, স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছেলে, এ বিষয়টি শেখ কামাল আমাদের কখনোই বুঝতে দেননি। কিন্তু পাল্টা কিছু না বললেও কী রক্ষে আছে! স্লিপে দাঁড়িয়ে সারাক্ষণ নানা হাসির কথা বলে সবাইকে হাসাচ্ছেন। সে কালের শ্লেজিং আর কী! আমি হেসে উঠব, না মন:সংযোগ দিয়ে ব্যাটিং করব, সে এক মহাসমস্যা! যেখানেই যেতেন সবাইকে মাতিয়ে রাখার এক অদ্ভুত যাদুকরী ক্ষমতা ছিল ওঁর।

আরেকটা স্মৃতির কথা মনে পড়ে। ওঁর একটা টয়েটো করোনা গাড়ী ছিল- নীল রঙয়ের। ঘটনাক্রমে আমারও একটা নীল রঙয়ের টয়োটা করোনা গাড়ী ছিল। আমার মানে বাড়ীর গাড়ী, আমিই চালিয়ে বেড়াতাম। তখন তো ঢাকার রাস্তায় এত প্রাইভেট কার ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাড়ায় তো আরো কম। তো রাস্তায় কখনও দু’গাড়ীর ক্রসিং হলে উনি গাড়ীর জানালা দিয়ে হাত বের করে হাত নাড়তেন। মোটা গোঁফের নীচে থাকত সেই বন্ধুবৎসল হাসিটা। আরিচা খেয়াঘাটে এক দূর্ঘটনায় আমার গাড়ীটার চাকা তোলার জ্যাকটা ভেঙ্গে গিয়েছিল। তো সেদিন দুপুরে, যেখানে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি বিভাগ, মানে বাংলা একাডেমীর গেটের বেশ কাছেই, আমার গাড়ীটার পেছনের টায়ারটা গেল বসে। বাইরে বেরিয়ে ভাঙ্গা জ্যাকটা দিয়ে কিছু চেষ্টা করলাম, সুবিধা হোল না। গাড়ীর পাশে কিছুটা অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি কোনো বন্ধু বা পরিচিত কাউকে যদি পাই। উদ্দেশ্য গাড়ীটার কাছে একটু থাকতে বলব আর জিকাতলায় যে গ্যারেজে গাড়ী সারাতাম সেখান থেকে একজন মিস্ত্রী বা একটা জ্যাক নিয়ে আসব। গাড়ীর কাছে কাউকে থাকতে বলার কারণ সে সময় ঢাকায় গাড়ী, বিশেষ করে গাড়ীর কাঁচ, খুব চুরি হোত। এ সময় দেখি কামাল ভাইয়ের গাড়ীটা পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। এবং জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে সেই হাত নাড়া! কিন্তু গাড়ীটা চলে গেল না। একটু সামনে যেয়ে ব্রেক কষল। এবং কামাল ভাই গাড়ী থেকে মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে?” বললাম; “জ্যাকটা ভাঙ্গা.. চাকাটা..”! ওঁর গাড়ীটা ব্যাক করে উনি আমার গাড়ীর সামনে এনে রাখলেন। নিজে নেমে গাড়ীর পেছনের বনেটটা খুলে ওঁর গাড়ীর জ্যাকটা বের করে দিলেন। ওঁর সঙ্গে আরেকজন ছিলেন। সমাজবিজ্ঞান বিভাগেরই। তিনি আর আমি দু’জনে মিলে আগের চাকাটা খুলে স্পেয়ার চাকাটা লাগালাম। তিন-চার মিনিটের কাজ। কামাল ভাই ঠায় পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। দু’একবার হাঁটু গেড়ে বসে আমাদের সাহায্য করতেও চাইছিলেন। আমি তা আর করতে দিই নি। সিনিয়র মানুষ!

একটু পরেই গাড়ীটা চালিয়ে বেরিয়ে গেলেন। চলে যাওয়ার আগে দূর থেকে গাড়ীর জানালার বাইরে থেকে আবার সেই হাত নাড়া। আমিও হাত নাড়লাম। কিন্তু সেই-ই শেষ! আজো মনে এক গভীর দু:খ রয়ে গেছে আমার, ঘাতকদের বুলেটে যখন উনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, শেখ কামাল নামে প্রাণবন্ত, ব্যতিক্রমী ও সাদা মনের এই যুবকটিকে আমরা তাঁর বিদায়ের ক্ষণে হাত নেড়ে সম্মানের সাথে বিদায় জানাতে পারিনি। যে সম্মান ও ভালোবাসাটা ওঁর প্রাপ্য ছিল খুবই। তবে আমি জানি, এ কেবল আমার একার বেদনা নয়, আমার মতো সে সময়ে বেড়ে ওঠা গোটা এক তরুণ প্রজন্মেরই এ হয়ে রইল চিরকালীন এক দু:খবোধ। ওঁর পুরুষ্ট গোঁফের নীচে সারল্যে ভরা হাসিটা যে কোনো দিনই আর দেখতে পাব না এ আমাদের জন্যে সারাজীবনই হয়ে রয়েছে সুগভীর এক মনোবেদনা।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
তানভীর মোকাম্মেল প্রখ্যাত বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক। তিনি বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের পরিচালক ও বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট। জন্ম ১৯৫৫, তিনি খুলনায় বড় হন। তাঁর বাবা নড়াইলের ম্যাজিস্ট্রেট ও মা স্থানীয় একটি কলেজের শিক্ষিকা ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন সময়ে মোকাম্মেল গ্রামীণ এলাকার ভূমিহীন কৃষকদের জন্য বামপন্থী সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন।একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে তিনি ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, পনেরোটি প্রামাণ্যচিত্র এবং স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন, যাদের মধ্যে কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করে। তার নির্মিত চলচ্চিত্রগু হচ্ছে নদীর নাম মধুমতি, চিত্রা নদীর পারে, লালসালু, লালন, রাবেয়া, এবং জীবনঢুলী। তানভীর মোকাম্মেলের উল্লেখযোগ্য প্রামাণ্যচিত্র হলো দ্য গার্মেন্ট গার্ল অব বাংলাদেশ, দ্য আননোওন ব্যার্ড টিয়ারড্রপস অব কর্ণফুলী, রাইডার্স টু সুন্দরবনস, এ টেল অব দ্য যমুনা রিভার, 'দ্য প্রমিসড ল্যান্ড তাজউদ্দীন আহমেদ: অ্যান আনসাং হিরো, দ্য জাপানিজ ওয়াইফ, স্বপ্নভূমি এবং "১৯৭১। ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউশন দ্বারা দর্শক ও সমালোচকদের মধ্যে পরিচালিত এক জরিপে তার চলচ্চিত্র নদীর নাম মধুমতি এবং চিত্রা নদীর পাড়ে বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্রের মধ্যে যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থান অর্জন করে। মোকাম্মেল কবিতা, ছোটগল্প এবং চলচ্চিত্র সংস্কৃতি বিষয়ে পত্রিকায় নিবন্ধ লিখেছেন। তানভীর মোকাম্মেলের লেখা বই হচ্ছে এ ব্রিফ হিস্টোরি অব ওয়ার্ল্ড সিনেমা, দ্য আর্ট অব সিনেমা, চার্লি চ্যাপলিন: কনকোয়েস্টস বাই এ ট্র্যাম্প, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, সিসিফাস অ্যান্ড কোয়েস্ট অব ট্রেডিশন ইন নভেল (সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক একটি কাজ), গ্রান্ডভিগ অ্যান্ড ফোক এডুকেশন (বিকল্প শিক্ষাব্যবস্থার ধারণা বিষয়ক বই), এবং ম্যাক্সিম গোর্কির দ্য লোয়ার ডেফথস নাটকের অনুবাদ। মোকাম্মেল বাংলাদেশ চলচ্চিত্র কেন্দ্র নামে একটি চলচ্চিত্র ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিল্পকলায় (চলচ্চিত্র) বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র (প্রযোজক) - ১৯৯৯ (চিত্রা নদীর পারে), ২০০১ (লালসালু) বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ পরিচালক - ১৯৯৯ (চিত্রা নদীর পারে), ২০০১ (লালসালু) বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা - ১৯৯৬ (নদীর নাম মধুমতী), ১৯৯৯ (চিত্রা নদীর পারে), ২০০১ (লালসালু) বিজয়ী: শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার - ১৯৯৬ (নদীর নাম মধুমতী), ১৯৯৯ (চিত্রা নদীর পারে) জিওনজু চলচ্চিত্র উৎসব মনোনীত: এশীয় নব আগমন - ২০০১ (লালসালু)
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!