কবিগুরু স্মরণে:
মৃত্যুশোক ও রবীন্দ্রনাথ

রঞ্জনা রায়
রঞ্জনা রায়
8 মিনিটে পড়ুন
ছবি সংগৃহীত।

“আমি পরানের সাথে খেলিব আজিকে / মরণখেলা / নিশীথবেলা” (ঝুলন)

অথবা

“মরণ রে তুহু মম শ্যাম সমান” (ভানুসিংহের পদাবলী)
মৃত্যু” মানবজীবনের এই চিরন্তন সত্য ঘটনাটি রবীন্দ্রনাথ জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে নানাভাবে উপলব্ধি করেছেন। মৃত্যু যেমন তাঁর কাছে ভয়ংকর তেমনি মৃত্যু তাঁর মনে অমৃতের আভাষ এনে দেয়। “হে বিশ্ববিধাতঃ, আজ আমাদের সমস্ত বিষাদ-অবসাদ দূর করিয়া দাও – মৃত্যু সহসা যে যবনিকা অপসারণ করিয়াছে তাহার মধ্য দিয়া আমার অমৃতলোকের আভাস আমাদিগকে দেখিতে দাও।” (মহর্ষির আদ্যকৃত্য উপলক্ষে প্রার্থনা।চরিত্রপূজা)তাই মৃত্যু যেমন খেলা আবার তা শ্যামে’র মতই সুন্দর।

মৃত্যু সম্বন্ধে একটা অনুভূতি অতি শিশু বয়সেই রবীন্দ্রনাথ প্রত্যক্ষ করেছিলেন।মা সারদাদেবীর মৃত্যু শিশুমনে একটা অভাববোধের সঞ্চার করেছিল।তবে সে মৃত্যু বালক রবির কাছে “সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে-রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর।” (জীবনস্মৃতি) জীবনের সেই অভাববোধ যার সাহচর্যে মুছে গিয়েছিল তিনি হলেন নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী। “বাড়িতে যিনি কনিষ্ঠা বধূ ছিলেন তিনিই মাতৃহীন বালকদের ভার লইলেন।” (জীবনস্মৃতি)

কিন্তু এরপর রবীন্দ্রনাথ যে মৃত্যুটির মুখোমুখি হলেন তার অভিঘাত রবীন্দ্র জীবনে একটি চিরস্থায়ী ছাপ রেখে গেল। কবির তখন চব্বিশ বছর বয়স সেই সময় নতুন বৌঠান কাদম্বরী দেবী হঠাৎই আত্মহত্যা করেন। “শিশু বয়সে লঘু জীবন বড়ো বড়ো মৃত্যুকেও অনায়াসেই পাশ কাটাইয়া ছুটিয়া যায়- কিন্তু অধিক বয়সে মৃত্যুকে অত সহজে ফাঁকি দিয়া এড়াইয়া চলিবার পথ নাই। তাই সেদিনকার সমস্ত দুঃখ আঘাত বুক পাতিয়া লইতে হইয়াছিল।” (জীবনস্মৃতি)

কাদম্বরী দেবীর মৃত্যুর কিছুদিন আগেই ফুলতলির দশ বছরের ভবতারিণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিবাহ হয়েছে। যাকে ‘স্বর্ণ মৃণালিনী’ হবার আশীর্বাদ করেছিলেন দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর। বিয়ের পর তার ঠাকুরবাড়ির উপযুক্ত বধূ হবার শিক্ষা শুরু হল। লরেটো স্কুলে পড়া, পিয়ানো শেখা, সংস্কৃত শেখা তার সঙ্গে বড়জা নীপময়ির কাছে ঠাকুরবাড়ির আদব কায়দা ও সহবত শিক্ষা সবই চলতে লাগল। এতকিছু শিক্ষার পরও তিনি রইলেন নিভৃতচারিণী হয়ে। পরিবারের সকলকে ভালবাসা, সকলের সুখ দুঃখের শরিক হয়ে সকলকে আপন করে নেবার এক আপার শক্তি ছিল তার মধ্যে। কবির সব কাজেই ছিল তার নীরব উপস্থিতি। শান্তিনিকেতন আশ্রমের বালকদের তিনি মাতৃস্নেহে আগলে রাখতেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমের জন্য তিনি কবির হাতে নিজের গয়নাও তুলে দিয়েছেন। রথীন্দ্রনাথ লিখেছেন “শেষ পর্যন্ত হাতে কয়েক গাছা চুড়ি ও গলায় একটি চেন হার ছাড়া তাঁর কোন গয়না অবশিষ্ট ছিল না।” আশ্রম স্থাপনের কঠোর পরিশ্রম মৃণালিনীর সহ্য হল না। শান্তিনিকেতন স্থাপনের এগারো মাস পরেই তিনি কঠিন অসুখে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। কবির প্রাণঢালা সমস্ত সেবা শুশ্রূষা ব্যর্থ করে তার জীবন থেকে চিরদিনের মত হারিয়ে গেল তার প্রিয়তমা ‘ভাই ছুটি’। পত্নীর মৃত্যুর পর শোকগ্রস্ত কবি ছেলেমেয়েদের নিয়ে শান্তিনিকেতনে আশ্রয় নিয়েছেন। কবি অনুভব করছেন”এখানে (শান্তিনিকেতন) আমি জীবন-মৃত্যুর উপর মনকে রাখতে পারি, কলকাতায় সে আশ্রয় নেই। “রবীন্দ্রনাথ এখানে রোজ সকালে শান্তিনিকেতনের বাড়ির বারান্দায় এককোণে বসে মাতৃহারা সন্তানদের শিখিয়েছেন উপনিষদের মন্ত্র, বুঝিয়েছেন তার মর্মার্থ। এ যেন কবির নিজেকেই একপ্রকার সান্ত্বনা দেওয়া। “স্মরণ’ এর কবিতায় ঝরে পড়েছে লোকান্তরিতা পত্নীর জন্য তার সুপ্ত বেদনা।

এরপর আসি রবীন্দ্রকন্যা মাধুরীলতার প্রসঙ্গে। মাধুরীলতা ওরফে বেলা মাত্র একত্রিশ বছর বেঁচে ছিলেন। পিতা হবার মধুর উপলব্ধি বেলাকে প্রথম কোলে নিয়েই পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।কিছু চিঠিপত্র ও স্মৃতিকথা ছাড়াও বেলার শিশু বয়সের কথা আঁকা আছে ‘কাবুলিওলার’ মিনির মধ্যে। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়ে যায়। পাত্র কবি বিহারীলাল চক্রবর্তীর ছেলে শরত চক্রবর্তী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্র। এই বিয়েতে রবীন্দ্রনাথ মোটা বরপণ দিয়েছিলেন। শরত চক্রবর্তী মজঃফরপুরে ওকালতি করতেন। দীর্ঘ সতেরো বছরের দাম্পত্য জীবন মাধুরী ও শরত নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছিল। নানা ধরনের মানসিক কষ্টে বেলার স্বাস্থ্যের অবনতি হতে লাগল।অবশেষে এল সেই দিন যেদিন পিতা রবীন্দ্রনাথের কোল খালি করে ইহজগৎ থেকে বিদায় নিল আদরের বেলা আর লেখক রবীন্দ্রনাথের মনে বুনে দিয়ে গেল ‘হৈমন্তী’ গল্পের বীজ।

রেনুকা রবীন্দ্রনাথের মেজ মেয়ে।ছোট থেকেই একটু জেদি ও একরোখা প্রকৃতির, সাজগোজ পছন্দ করতো না।মাত্র এগার বছর বয়সেই পিতা রবীন্দ্রনাথ তার বিয়ে দিয়ে দেন।পাত্র সত্যেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।বিয়ের শর্ত ছিল পাত্রকে বিলাত পাঠাতে হবে। রবীন্দ্রনাথ এই শর্তে সম্মত হয়েই মেয়ের বিয়ে দিয়েছিলেন।এই বিয়েও সুখের হয় নি।বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে রেনুকা যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়।তার স্বামী চিকিৎসার সঠিক বন্দোবস্ত করতে পারেন নি।ফলে পিতা রবীন্দ্রনাথকেই তার চিকিৎসা ও সেবা শুশ্রূষার ভার নিতে হয়।সুচিকিৎসার জন্য তিনি কন্যাকে নিয়ে গেছেন হাজারিবাগ এরং আলমোড়াতে।কিন্তু রেনুকার জীবনদীপটি ক্রমশ ম্লান হতে লাগল।কন্যার অনন্তলোকে যাত্রা পথটিকে সুগম করার জন্য পিতা রবীন্দ্রনাথ আদরের রানীকে শোনাতে লাগলেন উপনিষদের মন্ত্র।”ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি নমস্তেহস্তু”এই মন্ত্রটি রেনুকার বড়ই প্রিয় ছিল।

জীবনের ঠিক অন্তিম সময়ে সে পিতার কাছে এই মন্ত্রটি শুনতে চেয়েছিল।পরে নির্মলকুমারী মহলানবিশ এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনোভাব ব্যক্ত করে বিশ্বভারতী পত্রিকায় যে প্রবন্ধটি লিখেছিলেন তার কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি “আমি মন্ত্রটি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গেই তার শেষ নিঃশ্বাস পড়ল।তার জীবনের চরম মুহূর্তে কেন সে”পিতা নোহসি”স্মরণ করল, তার ঠিক মানেটা আমি বুঝতে পারলুম।তার বাবাই যে তার জীবনে সব ছিল, তাই মৃত্যুর হাতে যখন আত্মসমর্পণ করতে হল তখনো সেই বাবার হাত ধরেই সে দরজাটুকু পার হতে চেয়েছিল।তখনো তার বাবাই একমাত্র ভরসা ও আশ্রয়।বাবা কাছে আছে জানলে আর কোন ভয় নেই ।সেইজন্য ভগবানকে পিতারূপে কল্পনা করে তাঁর হাত ধরে অজানা পথের ভয় কাটানোর চেষ্টা করেছিল”।(নির্মল কুমারী মহলানবিশ: ওঁ পিতা নোহসি, বিশ্বভারতী পত্রিকা ১৩৫০,মাঘ-চৈত্র)

মৃণালিনীদেবীর মৃত্যু ১৩০৯সালের ৭ই অগ্রহায়ণ।ঠিক এর পাঁচ বছর পর রবীন্দ্রনাথের জীবনে আবার বজ্রপাত। ১৮৯৬সালের ১২ই ডিসেম্বর জন্মেছিল রবীন্দ্রনাথের পঞ্চম এবং শেষ সন্তান শমীন্দ্রনাথ।ছেলেটি রূপে গুনে অনেকটাই বাবার মত ছিল।ভাল কবিতা পড়তে পারত,ভাল অভিনয় করতে পারত,লেখার হাত ভাল ছিল।তার সবকিছুতেই ছিল যেন এক বিরল প্রতিভার ছোঁয়া।পিতার স্নেহ ও ভালবাসার ছায়ায় সে নিজেকে পিতার যোগ্য সন্তান রূপে গড়ে তুলছিল।এখন শান্তিনিকেতনে যে বসন্তোৎসব হয় তার সূচনা শমীই করেছিল তার মৃত্যুর কয়েক মাস আগে।বাবার গান তার খুব প্রিয় ছিল , বিশেষত “একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ” এই কঠিন গানটি।সে ছিল শান্তিনিকেতন আশ্রমের প্রথম যুগের ছাত্র।পুজোর ছুটিতে বন্ধুর সঙ্গে মুঙ্গেরে গিয়েছিল এবং সেখানে কলেরায় আক্রান্ত হয়।ছেলে অসুস্থ শুনে কলকাতা থেকে ডাক্তার নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ছুটে গিয়েছিলেন কিন্তু শেষরক্ষা হল না।১৩১৪সালের ৭ই অগ্রহায়ণ মায়ের মৃত্যুদিনে শমী এই পৃথিবী অন্ধকার করে বিদায় নিল।রবীন্দ্রনাথ এই সময় পাশের ঘরে ধ্যানমগ্ন থাকলেন।শোক তাকে আঘাত করছে বারে বারে কিন্তু পরাভূত করতে পারছে না – “আরো আঘাত সইবে আমার সইবে আমারো/আরো কঠিন সুরে জীবন তারে ঝঙ্কারো”।এই সহ্য শক্তি নিয়ে তিনি পরে অবলা বসুকে লিখলেন -“ঈশ্বর আমাকে যাহা দিয়াছেন, তাহা তিনি গ্রহণ করিয়াছেন ।তাহা শিরোধার্য করিয়া লইব।আমি পরাভূত হইব না।”

কবি জীবন পথে বিভিন্ন সময়ে মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন কিন্তু মৃত্যুশোকে সম্পৃক্ত হন নি এক অদ্ভুত নির্লিপ্ততা তাঁর মধ্যে জারিত হয়েছে।”জগতকে সম্পূর্ণ করিয়া এবং সুন্দর করিয়া দেখিবার জন্য যে দূরত্বের প্রয়োজন মৃত্যু সেই দূরত্ব ঘটাইয়া দিয়াছিল। আমি নির্লিপ্ত হইয়া দাঁড়াইয়া মরণের বৃহৎ পটভূমিকার উপর সংসারের ছবিটি দেখিলাম এবং জানিলাম তাহা বড়ো মনোহর।” (জীবনস্মৃতি) ।আর এই অনুভূতি থেকেই কবি বলেন – “ আছে দুঃখ , আছে মৃত্যু , বিরহ দহন লাগে / তবু শান্তি , তবু আনন্দ , তবু অনন্ত জাগে।“

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
অখণ্ড মেদিনীপুর জেলার দাঁতন থানার অন্তর্গত কোতাইগড়--- তুর্কা এস্টেটের জমিদার বংশের সন্তান রঞ্জনা রায়। জন্ম, পড়াশুনা ও বসবাস উত্তর কলকাতায়। বেথুন কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে সাম্মানিক স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর উপাধি লাভ করেন। ১৯৭০ সালের ৩০শে মে রঞ্জনা রায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম স্বর্গীয় জগত কুমার পাল, মাতা স্বর্গীয় গীতা রানি পাল। স্বামী শ্রী সন্দীপ কুমার রায় কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ের আইনজীবী ছিলেন। রঞ্জনা উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করছেন সাহিত্যপ্রীতি। তাঁর প্রপিতামহ স্বর্গীয় চৌধুরী রাধাগোবিন্দ পাল অষ্টাদশ দশকের শেষভাগে 'কুরু-কলঙ্ক’ এবং 'সমুদ্র-মন্থন’ নামে দু'টি কাব্যগ্রন্থ রচনা করে বিদ্বজনের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। ইতিপূর্বে রঞ্জনা রায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'এই স্বচ্ছ পর্যটন’ প্রকাশিত হয়েছে এবং তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ 'ট্রিগারে ঠেকানো এক নির্দয় আঙুল' সাহিত্যবোদ্ধাদের প্রভূত প্রশংসা পেয়েছে। তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ 'নিরালা মানবী ঘর' (কমলিনী প্রকাশন) ও চতুর্থ কাব্যগ্রন্থ 'ইচ্ছে ঘুড়ির স্বপ্ন উড়ান' (কমলিনী প্রকাশন) দে’জ পাবলিশিংয়ের পরিবেশনায় প্রকাশিত। বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন সাহিত্য পত্রিকায় কবির কবিতা নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে প্রকাশিত হয়ে চলেছে।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!