বিস্ময়কর প্রতিভা বাবা আলাউদ্দীন খান

ঋভু চট্টোপাধ্যায়
ঋভু চট্টোপাধ্যায়
9 মিনিটে পড়ুন
ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহ্যশালি এই ভারতবর্ষের সঙ্গীতজগতে বহু নক্ষত্রের জন্ম হয়েছিল। তাঁরা তাঁদের নিজেদের ঐশ্বরিক প্রতিভার মাধ্যমে ভারতবর্ষের সঙ্গীত শাস্ত্রকে বিশ্বের দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। স্বামী হরিদাস, মিঞা তানসেন পুরন্দর দাস প্রমুখ সঙ্গীত বিশারদদের নাম ভারতবর্ষের সঙ্গীত জগতের সাথে সমার্থক হয়ে গেছে।আর ভারতবর্ষের চিরন্তন সঙ্গীত জগতের হয়ত শেষ সাধক বাবা আলাউদ্দীন খান।

সঙ্গীত জগতে তাঁর পরিচয় শুধু বাবা নামে। একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ভারতের মধ্যে ঐক্য থাকলেও উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের সঙ্গীতের মধ্যে একটি চোখে পড়বার মত বৈপরীত্য আছে। সঙ্গীত ভাষার মতই প্রবাহমান। উত্তর ভারতের ভাষাতে যেমন বিদেশী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়, তেমনি উত্তর ভারতের সঙ্গীতেও লক্ষ্য করা যায়। সে জায়গা থেকে আলাদা হল দক্ষিণ ভারতের ভাষা ও সঙ্গীত। স্বভাবতই ইংরেজ শাসনের অনেক আগে থেকেই ভারতবর্ষে আসা শক, হুণদের পাশে পার্শি, আরব ও আফগান প্রভাব ভারতের সঙ্গীত জগতে এসে পড়ে। পরবর্তীকালে যা ভারতীয় সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে। বাবা আলাউদ্দীন খান এই সমৃদ্ধ ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতিনিধি।

বাবা আলাউদ্দীনের জন্ম হয় বাংলাদেশের কুমিল্লা জেলার শিবপুর গ্রামে ১৮৭১ সালে। তাঁর বাবার নাম ছিল সাধু মিঞ্রা, মায়ের নাম হরসুন্দরী দেবী। সাধু মিঞার পূর্বপুরুষ হিন্দু ছিলেন। যতদূর জানা যায় আলাউদ্দীনের এক পূর্ব পুরুষের নাম ছিল ছিল দীনানাথ দেব শর্মা, কিন্তু তাঁর সন্তান পরবর্তী কালে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়, অবশ্য ইসলাম ধর্মালম্বী হলেও আলাউদ্দীন নিয়মিত কালিপূজা করতেন। আলাউদ্দীনের নিজের ভাই ফকির আফতাবউদ্দীন একজন কালি সাধক ছিলেন। শুধু তাই নয় তাঁর অনেক হিন্দু শিষ্যও ছিল। দাদা আফতাবউদ্দীন নিজে হারমোনিয়াম, বাঁশি, পাখোয়াজ, তবলা, দোতারা সহ অনেক রকমের সঙ্গীতযন্ত্র বাজাতে পারতেন। আলাউদ্দীনের বাবাও একজন সেতার বাদক ছিলেন। বাবা ও দাদার কাছ থেকে বিভিন্ন রকমের বাদ্যযন্ত্রের সুর শুনতে শুনতে শৈশবেই আলাউদ্দীনের সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহের সৃষ্টি হয়।

ছোট থেকেই বাবা আলাউদ্দীনের (ডাক নাম আলম) পড়াশোনাতে বিশেষ মন ছিল না। বেশিরভাগ সময়েই গ্রামের শিব বা কালিমন্দিরে কীর্তন শুনতে চলে যেতেন অথবা দাদা আফতাবউদ্দীন যেখানে তবলা পাখোয়াজ শিখতেন সেখানে চলে যেতেন। দুঃখের বিষয় বাবা ও দাদা দুজনেই সঙ্গীত অনুরাগী হলেও বাবা আলাউদ্দিনের সঙ্গীত শিক্ষার পথ সুগম হয়নি। মা হরসুন্দরী আলমের এই স্কুল কামাই করে সঙ্গীত শুনতে চলে যাওয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারেন নি। এমনকি আলমকে একবার তিনদিন খাওয়া বন্ধ করে দেন। কিন্তু বাবা আলাউদ্দীনের সঙ্গীত প্রতিভাকে কোন অবস্থাতেই বন্ধ করে রাখা যায় নি, বরং আট বছর বয়সে সঙ্গীত শিক্ষার জন্যে বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। বাড়ি থেকে পালিয়ে ঘটনাচক্রে এক যাত্রাদলের সাথে যুক্ত হয়ে যান। তাদের সাথে নারাযণগঞ্জ, ঢাকা সহ সমগ্র বাংলাদেশ ঘুরতে থাকেন। ঐ যাত্রাদলে থাকাকালীন আলাউদ্দীন তবলা, পাখোয়াজ, হারমোনিয়াম বাজাতে শেখেন, যদিও সঙ্গীত সাগরের সন্ধানে সাধককে শুধুমাত্র তবলা, পাখোয়াজের মধ্যেই আবদ্ধ রাখা যায় কি? তাই সেই যাত্রাদলকে ছেড়ে আবার বেরিয়ে পড়েন। ঢাকা থেকে আলাউদ্দীন কলকাতা চলে আসেন। কলকাতা শহরে তাঁর না ছিল কোন চেনাশোনা, না ছিল থাকবার আস্তানা। স্বভাবতই এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করেন। খিদে পেলে শুধু গঙ্গার জল পান করতেন বা কাঙালি ভোজনের জায়গাতে চলে যেতেন। রাতে কারো বারান্দাতে শুয়ে থাকতেন। আর দিনে শহরটার এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতেন। কলকাতা শহরে টুকটাক কাজ করে কিছু টাকাও জমিয়েছিলেন, যদিও সেসব টাকা চুরি হয়ে যায়।শেষকালে কলকাতাতেই কেদারনাথ নামে এক দয়াল চিকিৎসকের সাহায্যে গোপাল চক্রবর্তী (যিনি নুলো গোপাল নামে পরিচিত ছিলেন) নামের এক গোঁড়া ব্রাহ্মণের কাছে প্রসন্ন বিশ্বাস ছদ্মনামে সঙ্গীত শেখা আরম্ভ করেন। তাঁর কাছে বাবা প্রায় সাত বছর সঙ্গীত শিক্ষা নেন। এই নুলো গোপাল বা গোপাল চক্রবর্তী রাজা জ্যোতিন্দ্রমোহন ঠাকুরের বিশেষ প্রিয়জন ছিলেন। এই সময় বাবা বেশ কিছু অনুষ্ঠানও করেন। গোপাল চক্রবর্তীর মৃত্যুর পর বাবা আলাউদ্দীন পূনরায় প্রসন্ন বিশ্বাস ছদ্মনামে গিরিশ থিয়েটারে কাজ আরম্ভ করেন। এই সময় বিবেকানন্দের ভাই হবু দত্তের সাথে তাঁর বিশেষ পরিচয় ঘটে। হবু দত্ত সেই সময় একটি অর্কেস্ট্রার পরিচালনা করতেন। আলাউদ্দীনের এই সময় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ম্য সঙ্গীত সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ হয়। একবার কোন সঙ্গীত শুনেই বাবা তার নোটেশন তৈরী করে নিতে পারতেন। মাইহার ব্যাণ্ড তৈরীর পরিকল্পনাও এই সময়কার। আলাউদ্দীন লোবো নামের এক জন অ্যাংলো ইণ্ডিয়ানের কাছ থেকে বেহালা, আনন্দবাবু নামে একজনের কাছ থেকে তবলা ও মৃদঙ্গ, মেছুয়া বাজারের হাজারিলাল ওস্তাদের কাছ থেকে সানাই, টিকারা ও নাকারা বাজনা শেখেন। এই সময় থেকেই বেশি করে বিভিন্ন জায়গায় অনুষ্ঠান আরম্ভ করেন। এই রকম একটি অনুষ্ঠানেই আলাউদ্দীনের সাথে তাঁর দাদা ফকির আফতাবউদ্দীনের সাথে দেখা হয়ে যায়, তাঁকে নিজের ঘরে নিয়ে আসেন। কিছু দিনের মধ্যে আলাউদ্দীনের সাথে মদনমঞ্জরির প্রথম বিবাহও হয়, কিন্তু সঙ্গীত জগতের অমোঘ আকর্ষণে আলাউদ্দীন আবার ঘর ছাড়েন। ঘুরতে ঘুরতে উপস্থিত হন রাজা জগত কিশোর আচার্যের রাজ্যে। রাজার অনুরোধে এরপর প্রখ্যাত সরোদ বাদক আহমেদ আলির কাছে বাবা আলাউদ্দীনের সরোদ শিক্ষা আরম্ভ হয়। আলাউদ্দীনের বাজনা আহমেদ আলিকেও মুগ্ধ করত। আহমেদ আলির সাথে বাবা আলাউদ্দীন বিভিন্ন অনুষ্ঠান করতে যেতেন। তবে আহমেদ আলির মাত্রাধিক্য সুরাসক্তি বাবা আলাউদ্দীনকে মানসিক ভাবে আঘাত করে। কয়েকদিনের মধ্যেই আলাউদ্দীন তাঁর নিজের ঠাকুমার নির্দেশ মত ওস্তাদ আহমেদ আলিকে ছেড়ে রামপুরে ওস্তাদ উজির আলির কাছে সঙ্গীতের তালিম নেবার জন্যে ভর্তি হন। এই সময় ধ্রুপদ, ধামাড়, খেয়াল, টপ্পা, ঠুমরির সাথে সুরবাহার, সেতার সারেঙ্গি, বাঁশি প্রভৃ্তি বিভিন্ন রকমের সঙ্গীতযন্ত্র শিখতে আরম্ভ করেন ও অল্প দিনের মধ্যে যথেষ্ট দক্ষ হয়ে ওঠেন। রামপুরের নবাব হামিদ আলি খান, বাহাদুরের পৃষ্টপোষকতায় রামপুর ব্যাণ্ড নামে একটি ব্যাণ্ডে মাসে পঁচিশ টাকা মাইনেতে বেহালা বাদক হিসাবে যোগ দেন।

রামপুরে থাকবার সময় সঙ্গীতের বিভিন্ন দিকের সাথে তাঁর যোগাযোগ আরম্ভ হয়। বাড়ির লোকেরা রামপুরে থাকবার খবর পান, এবং তাঁর দ্বিতীয় বিয়ের আয়োজন করা হয়। আলাউদ্দীনের দ্বিতীয় বউ ছিল খুব সুন্দরী, কিন্তু দ্বিতীয়বার বিয়ের পরেও আলাউদ্দীনের সঙ্গীত শিক্ষার ইচ্ছে কমে যায় নি, এমনকি বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যেই আলাউদ্দীন আবার রামপুরো চলে যান। রামপুরে পৌছানোর কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর আত্মহত্যার খবর আসে, কিন্তু এসবের পরেও আলাউদ্দীনের সঙ্গীত শিক্ষার কোন ছেদ পড়ে না। এরপরেই গুরু ওয়াজির আলির আদেশে ও নির্দেশ মত সঙ্গীতকে সারা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরবার মহান দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন। শ্যামলাল খেত্রি নামে এক ব্যক্তির মাধ্যমে মাইহার নামে এক শহরে মাইহারের রাজা ব্রিজি নারায়ন সিংজির রাজদরবারে রাজসভার সভাগায়ক হিসাবে যোগ দেন এবং আমৃত্যু সেই মাইহারের মা সারদা (মা কালির) পায়ের নিচেই জীবন উৎসর্গ করেন।

এটা বলা হয় ভারতীয় রাগসঙ্গীত পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষ দিকে পর্দার আড়ালে চলে যায়। সঙ্গীতের নবজীবন আসে গোয়ালিয়রের মহারাজা মানসিংহ ও মহারানী মৃগনয়নির হাত ধরে। পরে মহারানীর মৃত্যু হলে ঐ রাজ্যে তানসেনের সঙ্গীত চর্চা আরম্ভ হয়। সঙ্গীত জগতে তানসেনের অবদান এখন নতুন করে বলবার কিছু নেই। তানসেনের মৃত্যুর পর তাঁর চারপু্ত্রের মধ্যে (সুরাট সেন, সরত সেন, তরঙ্গ সেন ও বিলাস খান) ছোট পুত্র বিলাস খান সঙ্গীত চর্চার ঐতিহ্য সারা ভারতে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহন করেন। বিলাস খানের উত্তরাধিকারীরা রাবাইয়া ঘরানা এবং অন্য সন্তানদের উত্তরাধিকারী সেনিয়া ঘরানার নামে পরিচিত হন। তানসেনের কন্যা সরস্বতীর হাত ধরেই বীনকর ঘরানার সূত্রপাত। ওস্তাদ আলাউদ্দীন খানের অন্যতম গুরু ওস্তাদ ওয়াজির খান এই ঘরানার অর্ন্তগত। তাই আলাউদ্দীনের খানের মধ্যেও সেই তানসেনের ঘরানার ছাপ লক্ষ্য করা যায়।

ভারতীয় সঙ্গীত জগতে আলাউদ্দীন খানের মত সঙ্গীত প্রতিভা না আর জন্মেছে না জন্মাবে। ভাবতেই অবাক লাগে কিভাবে একজন মানুষ একা ধ্রুপদ, ধামাড়, খেয়াল তারানা তিরবাট হলকের মত তানে নিজস্ব প্রতিভার নিদর্শন রাখবার পাশে তবলা, খোল পাখোয়াজের সঙ্গে সরোদ, সুরবাহার সেতার এমনকি সানাই ও সমান দক্ষতায় বাজাতে পারতেন। তাল যন্ত্রে তাঁর প্রতিভা দেখেই তাঁকে ‘তালবাজ’ উপাধিও দেওয়া হয়। বাবা আলাউদ্দিন হেমন্ত, হেমবেহাগ, প্রভাকাল সুভারথি, কৌশিক, ভৈরব রাগিনী এবং অনেক তাল সৃষ্টি করেন।‘মাইহার ব্যাণ্ড’ অর্কেস্ট্রা জগতে বিপ্লব নিয়ে আসে। চন্দ্রসারং ও তালতরঙ্গ প্রভৃতি বেশ কিছু সঙ্গীত যন্ত্রও তিনি তৈরী করেন। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন ভারতীয় সঙ্গীতের কারিগর। রবিশঙ্কর, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, তিমিরবরণ, প্রমুখ বিশ্ববিখ্যাত শিল্পীদের গুরু বাবা আলাউদ্দীন। এতসব বলবার পরেও আর একটা কথা না বলে পারা যায় না, এই শিল্পী তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি কোনটাই পান নি। হয়ত এটাই আমাদের দেশের ঐতিহ্য।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ঋভু চট্টোপাধ্যায়, পোশাকী নাম সৌগত চ্যাটার্জী, কবিতা গল্প নিবন্ধ, বিভিন্ন বানিজ্যিক পত্রিকায় নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ, সরকারি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!