নাটোরে মুক্তিযুদ্ধ এবং একটি পরিবারের অবদান

মাহাবুব খন্দকার
মাহাবুব খন্দকার - নাটোর প্রতিনিধি
8 মিনিটে পড়ুন

নাটোরের সিংড়া উপজেলার রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়নের কৈগ্রামের দেলাবাড়ির প্রামানিক পরিবারটি এই অঞ্জলের মধ্যে শিক্ষা-দিক্ষা, অর্থ, জনবল প্রভৃতি দিক থেকে বর্ধিষূ এবং রাজনীতি সচেতন পরিবার। এতদ্বাঞ্জলের মধ্যে এই পরিবার পূর্ব থেকেই প্রগতিশীল ও উদার জীবনমুখী।

পাকিস্তান আমলে ৬০-এর দশকে আইয়ূব খানের কনভেনশন মুসলিম লীগের গোলাপ ফুল মার্কা আর ফাতেমা জিন্নাহর কাউন্সিল মুসলিম লীগের হারকিন মার্কা প্রতীকের পোস্টার, হ্যানবিল এই পরিবারের বৈঠকখানা থেকে স্থানীয় কর্মীদের দ্বারা গ্রামে গ্রামে মাটির দেয়ালে লাগান/সাটান হতো।

আর সিংড়া এবং নাটোর থেকে টমটমে করে আসা নেতা কর্মীদেরকে ঐ বৈঠকখানায় বসে মিটিং-সিটিং ও মৌলিক গণতন্ত্রী ভোটারগণের মধ্যে ক্যানভাস করা হতো। ৭০-এর দশকে রাজনৈতিক কাজে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও এসেছেন।

উনিশশো একাত্তর সালে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে পাক-শক্রুদের বিরুদ্ধে লড়াই করার পথ উদ্ভাবনের জন্য আলোচনার উদ্দেশ্যে সিংড়া থানার আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহজাহান আলী, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. শাহাদত হোসেন, নন্দীগ্রাম থানার আওয়ামী লীগ নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা কে.এম মোকছেদ আলী এবং নাটোরের পতনের পর নাটোরের চৌধুরী বাড়ির বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আব্দুর রহমান খান সেলিম চৌধুরীও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে এই বাড়িতে এসেছেন।

আর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার ক’দিন পূর্বে গুরুদাসপুর থানার খুবজীপুরের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মো. সিরাজুল ইসলাম সরদারসহ প্রমুখ নেতাকর্মী এই বাড়িতে থেকেছেন। এছাড়া সরকারের যে কোন লোক-জন এলাকায় এলেই এই পরিবারের অতিথি হিসেবে তাঁদের বৈঠকখানায় থাকতেন।

তবে এই পরিবারের মৌলিক গণপন্ত্রী বয়জেষ্ঠ সদস্যরা উনিশশো উনসত্তরের গণআন্দোলনের পর অনেকটা লিবারেল হন। ‘৭০-এর জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে তাঁরা নতুন প্রজন্মকে সমর্তন দেন। বিধায় এই পরিবারের ক’জন কৃতিসন্তানও ঐ নির্বাচনে নিরবচ্ছিনভাবে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগের নৌকা মার্কার পক্ষে কাজ করেন এবং জাতির জনকের উদাত্ত আহবানে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

‘৭১-এ পাকিস্থান-আর্মীদের বিরূদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সিংড়ায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে সারা দিয়ে সিংড়া দমদমা হাই স্কুলের ছাত্রদের সাথে এই পরিবারের কৃতিসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মাহফুজুর রহমান তাঁর মৌলিক গণপন্ত্রী চাচা আব্দুল গফুর প্রামানিকের একনালা গাদা বন্দুক নিয়ে ছাত্র জনতার সাথে প্রশিক্ষণ ও প্রতিরোধে অংশ গ্রহন করেন।

এপ্রিল মাসে সমগ্র নাটোর পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আসায় এবং সিংড়ার প্রতিরোধ ছত্রভঙ্গ হওযায় তিনি গ্রামের বাড়ি চলে আসেন। ১৯৭১ সালে তিনি সিংড়া দমদমা হাই স্কুলের এস.এস.সি পরীক্ষার্থী ছিলেন এবং স্কুল হোস্টেলেই থাকতেন।

ঐ একই উদ্দেশ্যে এই পরিবারের আর এক কৃতিসন্তান ছাত্রলীগ কর্মী বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আতাউর রহমানও নন্দীগ্রামে পাকিস্তান আর্মীদের বিরূদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধে ছাত্র জনতার সাথে প্রশিক্ষণ ও প্রতিরোধে অংশ গ্রহন করেন। সে সময় তিনি নন্দীগ্রাম হাই স্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন এবং স্কুল হোস্টেলেই থাকতেন। ‘৭১-এর এপ্রিলে নন্দীগ্রাম পতনের পর মুক্তি সংগ্রাম বাহিনীর সদস্য হবার জন্য এবং প্রতিরোধে অংশ গ্রহণ করার কারণে গ্রেফতারের বিপদ মাথায় নিয়ে তিনিও গ্রামের বাড়ি চলে আসেন।

একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে এই পরিবারের আর এক কৃতিসন্তান বাগেরহাট পি.সি কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে গ্রামে চলে আসা প্রফেসর ডক্টর মো. আব্দুস সামাদ বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী। এলাকায় শান্তি-শৃংখলা রক্ষা এবং সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অনুপ্রাণিত করে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলতে সচেতন যুবকদেরকে সংগঠিত করেন।

মুক্তিযুদ্ধের এই সংগঠক ড. এম.এ সামাদেরই নেতৃত্বে তাড়াশ, রায়গজ্ঞ, সলঙ্গা এবং শেরপুর থানার হাজার হাজার সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের শরনার্থীদের ভারতে যাবার সময় এই এলাকায় ঊপযুক্ত নিরাপত্তা দিয়ে তাঁরা সাহায্য করেন। উল্লেখ্য রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে ড. এম.এ সামাদ পাকিস্তান ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বহী সদস্য ছিলেন।

১৯৬২ সালে ছাত্র লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ছাত্র লীগের কর্মী হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নাটোর মহকুমার দায়িত্ব পালন করেন। চাকুরী জীবনে উনসত্তরের গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও তিনি সক্রিয় ভুমিকা পালন করেন।

ড.এম.এ সামাদ এবং তাঁর ছোট ভাই মাহফুজুর রহমান ও আতাউর রহমান মুক্তি সংগ্রাম বাহিনীর সদস্য হবার কারণে এলাকায় সবার বিপদ আসতে পারে- ’৭১-এর মে মাসে এরকম ধারণা প্রকাশ পায়। তাই ডক্টর আব্দুস সামাদ দ্বি-পাকুরিয়া ও রামানন্দ খাজুরা গ্রামের তাঁর পরিচিত হিন্দু পরিবারের বন্ধুবান্ধবদের সাথে যোগাযোগ করে তাঁদেরকে নিয়ে যে কোন সময় ভারতে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

ইতোমধ্যে বিষয়টি জানাজানি হলে গ্রামের আওয়ামী লীগের ত্যাগীকর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর হোসেন এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু হোসেন আবুল ডক্টর আব্দুস সামাদের সাথে তাঁরাও ভারতে যাবার ইচ্ছা পোষণ করেন। অতপর ‘৭১-এর ৩০মে শুক্রবার রাতে এই দেলাবাড়ি থেকে মাহফুজুর রহমান, ওমর হোসেন, আবু হোসেন আবুল ও কছির উদ্দিন (আওয়ামী লীগ কর্মী) ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হন। তবে অনিবার্য কারণে সে সময় ড.এম.এ সামাদ এবং আতাউর রহমানের যাওয়া হয়নি।

‘৭১-এর উত্তাল দিনে এই পরিবারের লোকজন “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” এর সংগ্রামী অনুুষ্ঠানমালা এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ও সাফল্যের খবরা-খবর দিয়ে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে এলাকার মানুষদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন।

যেহেতু দেলাবাড়ির এই যৌথপরিবারটি ছিল সম্পূর্ণরুপে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এবং এলাকার মধ্যে আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। সেহেতু মুক্তিবাহিনী তাঁদের অধিক নিরাপত্তার কারণেই ঐ বাড়িকে শেল্টার হিসেবে বেছে নেন। সেহেতু মুক্তিবাহিনী তাঁদের অধিক নিরাপত্তার কারণেই ‘৭১-এর ১০ ডিসেম্বরে ঐ বাড়িকে শেল্টার হিসেবে বেছে নেন।

উল্লেখ্য সেসময় মুক্তাঞ্জল হিসেবে এই বাড়ির ক্যাম্পে স্বাধীনতার লাল সবুজের পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই পরিবারের সন্তান ভারতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বীরমুক্তিযোদ্ধা এফ.এফ ডেপুটি কমান্ডার মাহফুজুর রহমান তাঁর সাথীযোদ্ধা এম.বি কমান্ডার ওমর হোসেন, এফ.এফ কমান্ডার আবু হোসেন আবুল এবং গুরুদাসপুরের এম.বি কমান্ডার আব্দুল জলিল এর গ্রুপের মুক্তিযোদ্ধারা তাঁদের যুদ্ধ সামগ্রী নিয়ে ডিসেম্বরে কৈগ্রামের এই দেলাবাড়িতে উঠেন এবং ক্যাম্প স্থাপন করেন।

সে সময় এই যৌথ পরিবারের প্রতিটি সদস্য সাহসী ভূমিকা ও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আরাম-আয়েশ, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে স্বতঃস্ফুর্তভাবে প্রায় ৩০/৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধার নিরাপদ থাকা-খাওয়ায় সহযোগিতা করেন।

এই বাড়ির ক্যাম্পে ১২ নং রামানন্দ খাজুরা ইউনিয়নের মানিকচাপড়, ১ নং সুকাশ ইউনিয়নের বামিহাল, ৩ নং ইটালী ইউনিয়নের সাতপুকুরিয়া, ১০ নং চৌগ্রাম ইউনিয়নের বড়চৌগ্রাম এবং ২ নং ডাহিয়া ইউনিয়নের বিয়াস ক্যাম্পের রাজাকার, আলবদর, আলসামস্রা মুক্তিবাহিনীর সোসের্র মাধ্যমে অস্ত্র গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করে।

এখান থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা পাকবাহিনীর সাথে চৌগ্রামে যুদ্ধের রেকি করেন এবং যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এরপর অবশ্য কৈগ্রাম প্রাইমারী স্কুল মাঠে ক্যাম্পটি স্থানানতরিত হয়। অবশেষে বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার লাল সূর্য উদিয় হলে সিংড়া থানা শক্রু মুক্ত হয়।

এই গ্রামেরই দৃঢ় প্রত্যয়ী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ওমর হোসেন (এমবি কমান্ডার), দেশপ্রেমে উদ্দীপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. আবু হোসেন আবুল (এফএফ কমান্ডার) এবং অকুতোভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মাহফুজুর রহমান (এফএফ ডেপুটি কমান্ডার) এই দেলাবাড়ির মাটি থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের উদ্দেশে ভারতের মাটিতে পা-বাড়ান এবং এই বাড়ি থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা সিংড়া থানার উত্তরাঞ্জলকে মুক্তাঞ্জলে পরিনত করেন।

কৈগ্রামের দেলাবাড়ির এই পরিবার স্বাধীনতাযুদ্ধকে বেগবান ও গতিশীল করার লক্ষ্যে এহেন মহৎ কাজ করে কৃতিত্বের ছাপ রেখেছেন। তাই মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই পরিবারের কৃতিসন্তান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক প্রফেসর ডক্টর মো.আব্দুস সামাদ এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দেশপ্রেমের নিদর্শন ও অপরিসীম ত্যাগ এবং অবিস্মরণীয় অবদান অনিস্বীকার্য।

অতএব স্বাধীনতার পক্ষের সরকারকেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও স্মরণীয় করে রাখার জন্য এই বাড়ির ক্যাম্পকে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে এখানে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ে তোলা দরকার বলে মনে করেন এই পরিবার।

তথ্যসূত্র : পরিবারের সদস্য প্রফেসর ড. মো. আব্দুস সামাদ (আমেরিকা প্রবাসী), বীরমুক্তিযোদ্ধা মাহফুজুর রহমান, বীরমুক্তিযোদ্ধা মো. আতাউর রহমান, সাবেক ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেনসহ কৈগ্রামবাসী।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
লেখক: মাহাবুব খন্দকার নাটোর প্রতিনিধি
সাংবাদিক এবং লেখক
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!