বিজ্ঞান ও শিল্প

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
9 মিনিটে পড়ুন

[বিজ্ঞান ও শিল্পের মধ্যে কোন বিরোধ আছে কি? বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন বিখ্যাত বিজ্ঞনী তথা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কল্পবিজ্ঞান লেখক অধ্যাপক অ্যাইস্যাক অ্যাসিমভ (২.১.১৯২০-৬.৪.১৯৯২) তাঁর ‘দি রোভিং মাইন্ড’ বই-এ ‘আর্ট অ্যান্ড সায়েন্স’ প্রবন্ধটি অনুবাদ করেছেন ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী]

জ্ঞান অখণ্ড। অনেক মানুষ কোন একটি বিষয়ে জ্ঞান লাভ করে অন্য বিষয়কেও করায়ত্ত করতে পেরেছেন। কেউ যদি জ্ঞানকে খণ্ডিত ভাবেন, অন্য বিষয়কে উপেক্ষা করে শুধু মাত্র একটি বিষয়ে মনোসংযোগ করেন, তাহলে তাঁর পক্ষে প্রকৃত জ্ঞানী হয়ে ওঠা অসম্ভব। নিজের অধীত বিষয়টিতেও তিনি অজ্ঞ থেকে যাবেন।

মানুষ অনেক সময় বিজ্ঞান ও সাহিত্য সম্পর্কে এমন কথা বলেন যেন ওই দুটো বিষয় সম্পূর্ণই আলাদা। পরস্পরের সাথে যেন কোনই সম্পর্ক নেই। তাদের ধারণা শিল্পীরা হন আবেগ প্রবণ। তাঁদের সৃষ্টির মূলে কাজ করে তাদের স্বজ্ঞা, অনুভুতি বা স্বতঃলব্ধ জ্ঞান (intuition)। কোনো সচেতন বিচার-বিবেচনা বা যুক্তি-তর্ক ছাড়াই যেন তাদের সৃষ্টি কর্মটি ঘটেছে। হঠাৎ করেই যেন তিনি সব দেখতে পেয়ে যান। যুক্তি ও ভাবনার ধার ধারেন না তিনি। অপর পক্ষে বিজ্ঞানী শান্ত। শুধু যুক্তির উপরই তাঁর নির্ভরতা। ধাপে ধাপে তিনি যুক্তি সাজান। এর মধ্যে কল্পনার কোন স্থান নেই।

সম্পূর্ণই মিথ্যে এমন ধারণা। সত্যিকারের শিল্পী খুবই যুক্তি নির্ভর (Rational) এবং আবেগ প্রবণ। এবং জানেন তিনি কী করতে চলেছেন।

খাঁটি বিজ্ঞানী কিন্তু খুবই কল্পনা প্রবণ। এবং যুক্তিবাদীও। কখনও কখনও উপসংহারে দ্রুত পৌঁছে যান যেখানে যুক্তিনিষ্ঠ পদক্ষেপ এগোয় অত্যন্ত ধীর পদক্ষেপে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতির দিকে তাকালে দেখা যায় বহু ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও শিল্পকলা পরস্পরের হাত ধরে এগিয়েছে। একের উন্নতি নির্ভর করেছে অপর শাস্ত্রের অগ্রগতির উপর।

অতীত কালে, উদাহরন স্বরূপ, শিল্পীরা চেষ্টা করতেন তাদের অঙ্কিত বিষয়টি যেন বস্তুনিষ্ঠ হয়। সমতল ক্ষেত্রে ছবি আঁকতেন এবং বোঝাতে চাইতেন তাদের ছবির গভীরতা। ছবির ত্রিমাতৃক তাৎপর্য। এমন করতে হলে ছবির কোন বিষয়কে খুব ছোট আকারে আঁকতে হবে।

ইতালির শিল্পী লিও ব্যাতিস্তা আলবার্তি (১৪০৪-১৪৭২) একটা বই লিখেছিলেন (১৪৩৪) রেনেসাঁ সময়কালে। কেমন করে শিল্প বস্তুটির প্রেক্ষাপট (পারস্পেক্টিভ) সঠিক ভাবে তুলে ধরা যেতে আরে। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রবেশ করলেন অঙ্ক শাস্ত্রের হিসেব নিকেশে। ফলস্বরূপ শিল্পের একটা বিশেষ দিকের সমস্যার সমাধান হল। আর তাঁরা তৈরি করে ফেললেন এক নতুন জ্যামিতি বিজ্ঞান। যার নাম প্রজেক্টিভ জিওমেট্রি।

আবার মধ্যযুগে মানুষের শরীরতত্ত্ব বা অ্যানাটমির জ্ঞান ছিল খুব কম। মৃত দেহ কাঁটা ছেঁড়া না করলে তো অ্যানাটমির জ্ঞান লাভ সম্ভব নয়। কিন্তু সেই সময় মৃতদেহ কাঁটা ছেঁড়া বা শব ব্যবচ্ছেদ ছিল কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। অথচ চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য শরীরতত্ত্ব বা অ্যানাটমির জ্ঞান খুবই জরুরী। তাই শব ব্যবচ্ছেদ নিষিদ্ধ থাকার কারণে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি আটকে ছিল দীর্ঘকাল।

কিন্তু অ্যানাটমির জ্ঞান তো শিল্পীদেরও দরকার। ইটালির শিল্পী লিওনার্ডো দা ভিঞ্চি মানুষের যথার্থ ছবি আঁকতে চাইতেন। মানুষটির অবিকল চিত্রকর্ম। তেমন ছবি আঁকতে চাইলে তো অ্যানাটমি জানতে হবে। শরীরের পেশী ও হাড়ের গঠন আদতে কেমন, জানতে হবে।

সে সময় (১৫০০ সাল নাগাদ) তিনি গোপনে, শাস্তির ভয় সত্বেও ত্রিশ খানি মৃত শরীরের ব্যবচ্ছেদ করলেন। রাতের অন্ধকারে কবর থেকে মৃতদেহ তুলে নিয়ে তিনি ব্যবচ্ছেদ করতেন। শরীরের ভিতর হাড় ও মাংস পেশীর গঠন গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করতেন। আর সেই বিষয় গুলির ছবি দ্রুত হাতে এঁকে ফেলতেন। অসাধারণ সেই সব ছবি। হার্টের গঠন স্টাডি করেছিলেন তিনি। আর বুঝতে পেরেছিলেন, কেমন করে হার্ট যন্ত্রটি পাম্প করে শরীরের সর্বত্র রক্ত সরবরাহ করে।

অন্য ভাবেও এই জ্ঞানটি কাজে লেগেছিল। অর্ধ শতাব্দী পরে বেলজিয়ামের এক চিকিৎসক ভ্যাসিলাস (Andreas Vesalius) শব ব্যবচ্ছেদ করলেন। এবং প্রকাশ করলেন বিখ্যাত এক বই ‘on the structure of human body’ (১৫৪৩)।

আধুনিক অ্যানাটমি এবং পরবর্তী কালের ওষুধ বিজ্ঞানের ভিত্তি প্রস্তর এই বই। এই শাস্ত্রের এক মাত্র কারিগর ভ্যাসিলাস নন। অন্য অনেক চিকিৎসকরাও মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদ করতেন। তাঁরাও শরীর তত্ত্ব (Anatomy) বিষয়ে বই লিখেছিলেন। কিন্তু এদের সকলের মধ্যে ভ্যাসিলাসের কাজই শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদা পেল। কেন? তাঁর কাজের বিশেষত্ব কী ছিল?

ভ্যাসিলাসের বইয়ের বিশেষত্ব অসাধারণ সব ছবি। ভ্যাসিলাস তাঁর বইয়ে ছবি আঁকবার জন্য ডেকে আনলেন বিখ্যাত এক শিল্পীকে। তিনি ডাচ দেশের শিল্পী Jan Stevenszoon van Kalkar (ভেনিশের চিত্রশিল্পী টিটিয়ান-এর শিষ্য)। ভ্যাসিলাসের বইয়ের বিষয় ইলাস্ট্রেট করতে শুরু করলেন স্টিভেন্সুন। একটা ছবি যতটা ব্যাখ্যা করতে পারে, হাজার হাজার শব্দ তা করতে পারে না। বইটিতে অসাধারণ সব ছবি পরিবেশনের জন্যই অ্যান্ড্রে ভ্যাসিলাস (Andreas Vesalius) আধুনিক শরীর বিদ্যার (Anatomy) জনক হিসাবে সম্মানিত হয়ে রইলেন।

পরবর্তী কালেও বিজ্ঞান ও শিল্পের সম্মিলিত যাত্রা অব্যাহত ছিল। জার্মান বিজ্ঞানী জন উইলহেল্ম (John Wilhelm Ritter) দেখলেন (১৮০১) যে সূর্যালোক সাদা রঙের সিলভার ক্লোরাইডকে ভেঙে দেয় (Decompose)। তৈরি হয় সিলভার ধাতুর কালো ছোট্ট কণা।

সূর্যালোকের প্রভাবে কালো রঙ তৈরি হল। একে কাজে লাগিয়ে কি ছবি আকা যাবে? বিজ্ঞানিরা ব্যাপারটিকে কাজে লাগাতে পারেন নি। পারলেন এক শিল্পী। ফরাসী শিল্পী Louis Jacques Mande Daguerre। তিনি থিয়েটারের পটভূমি বা দৃশ্যপট (ব্যাকড্রপ) আঁকলেন ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে। ভাবতে থাকলেন (ব্যাপারটা কাজে লাগিয়ে) যদি আর কোন ভালো কাজ করা সম্ভব হয়।

আধুনিক বিজ্ঞান বড় বড় আবিষ্কার ঘটিয়েছে। যখনই শিল্পীর দৃষ্টিতে বিজ্ঞানী মহাকাশের দিকে তাকিয়েছেন, অনুভব করেছেন এই বিশাল মহাবিশ্ব অত্যন্ত সুচারু ভাবে এবং যথার্থ সামঞ্জস্য (symmetry ) বজায় রেখে সৃষ্টি হয়েছে। এর যন্ত্রপাতি, সৃষ্টি সবই অতি সরল (Simple) সুন্দর এবং সুশৃঙ্খল। তারা বিশ্বাস করেন মহাবিশ্বের ঘটনাবলীর ব্যাখ্যাও হতে হবে অতীব সুন্দর। কোন অসুন্দর তত্ত্ব দিয়ে মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা সম্ভব নয়। মহান শিল্প সুষমার আর এক নাম, এলিগ্যান্ট (সুশ্রী)। আর বিজ্ঞানিদের অনুসন্ধানেও আছে সেই এলিগ্যান্টের খোঁজ।

স্কটল্যান্ডের বৈজ্ঞানিক জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৭৯ সাল নাগাদ) উদ্ভাবন করলেন চারটে সূত্র (ইকুএশন)। অত্যন্ত সুন্দর এবং নিখুত সেই সব সূত্র। সূত্র গুলো নিপুণ ভাবে সামঞ্জস্য (Symmetry) বজায় রেখে প্রকৃতির বহু বিষয় খুব সুন্দর ভবে ব্যাখ্যা করতে সমর্থ হল। এই সূত্রগুলো আলোক (Light) চুম্বক (Magnetism) এবং বিদ্যুতের (electricity) পারস্পরিক সম্পর্ক জানান দিল। বিজ্ঞানিরা বুঝতে পারলেন সূত্রগুলো নিখুঁত নির্ভুল এবং এলিগ্যান্ট। অসাধারণ সুন্দর (এলিগ্যান্ট) সেই সূত্র গুলো মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হিসাবে বিবেচিত হল।

সেই থেকেই আমাদের বৈজ্ঞানিক মানসে প্রতিভাত হল যে বৈজ্ঞানিক তথ্যগুলো অতি সহজ সূত্রের মাধ্যমে প্রকাশ পাবে। যেমন কুয়ান্টাম থিয়োরির একটি প্রধান ধারণা প্রকাশিত হয় E=hv সূত্র দিয়ে। স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটির খুব বড় একটা ধারণা প্রকাশিত হল E = mc2 সূত্রের মধ্য দিয়ে।

জেনারাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি (১৯১৬ সালে উদ্ভবিত) সর্বজন গ্রাহ্য হয়ে ওঠেনি। অন্য বিজ্ঞনিরাও এই বিষয়ে একাধিক সূত্র তৈরি করেছিলেন। এগুলির কোনটা সঠিক, এখনও বিজ্ঞানিরা বুঝে উঠতে পারেন নি। তবে সমস্ত তত্ত্বের মধ্যে আইনস্টাইনের সূত্র সব চাইতে সংক্ষিপ্ত এবং নিখুঁত। সবচাইতে এলিগ্যান্ট। অনেক পদার্থবিদ বলেন, এই সূত্র অভ্রান্ত। কারণ এটি খুবই শিল্প সম্মত।

ডাচ রসায়নবিদ ভন্ট হফ একটি সূত্র আবিষ্কার করলেন (১৮৭৪ সালে)। জীবিত প্রাণীর শরীরে ক্রিয়াশীল জটিল অণু গুলির কাজ ব্যখ্যা করা সম্ভব হল এই সূত্র প্রয়োগে। কী এই সূত্র? এক কার্বন পরমাণু চারটে অন্য পরমাণুকে বন্ডের মাধ্যমে ধরে রাখতে পারে। ভ্যান্ট হফ বললেন, কার্বন পরমাণুর যোজ্যতা (valency) চার। আর কার্বন পরমাণু দিয়ে তৈরি অণুর গঠন হয় টেট্রাহেড্রাল। কার্বন পরমাণুর চারদিকে চারটে বন্ড একটা ত্রিমাতৃক টেট্রাহিড্রন তৈরি করে।

এখানেই শেষ নয়। এই আবিস্কারের ফলে অনুর ত্রিমাতৃক গঠন আঁকা সম্ভব হল। সেই সব চিত্র যেমন বৈজ্ঞানিক সত্য তেমনই আবার দৃষ্টি নন্দন। সুদৃশ্য শিল্প। জেমস ওয়াটসন এবং ফ্র্যান্সিস ক্রিক নিউক্লিক অ্যাসিডের ডবল হেলিক্স গঠন প্রমাণ করলেন (১৯৫৩)। নিউক্লিক অ্যাসিড জীব দেহের কোষের প্রধানতম উপাদান।

বিজ্ঞানের বহু বিষয়ের ছবি নিয়ে বই প্রকাশ হয় (Mcgraw-Hill Yearbook of sciene and Technology)। ছবি গুলোতে যেমন বিজ্ঞনের তত্ত্ব প্রকাশ হয় তেমনই আবার ছবি গুলোর শিল্প সুষমা প্রকাশ পায়।

ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপে স্পঞ্জ বা ডায়াটমের ছবি দেখলে আশ্চর্য হতে হয়। বিষ্ময় জাগে মনে, এসব শিল্পকর্ম না বিজ্ঞান? যাই হোক না কেন, এগুলো আদতে একই বিষয়।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!