অনুবাদ: তাঞ্জানিয়ার সাহিত্যিক নীমা কোম্বা’র গল্প ‘ত্বকের রঙ’

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
17 মিনিটে পড়ুন

সিকিউরিটি গার্ডের ইন্টারভিউ-এ হাতকাটা জেরুজেরু আবার এল কেন! ওদের দৃষ্টিতে অবিশ্বাস, বুঝতে পারছি। সন্দিগ্ধ চোখ গুলোর সামনে নিজেকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলবার সুযোগ হাতছাড়া হতে দেব না। চাকরিটা আমার দরকার। সেই জন্যই তো বহু দূর থেকে আমি এসেছি।
সেরা পোশাকটি পরেছি। সবুজ আর্মি প্যান্টের উপর গাড় নীল পোলো শার্ট। রোদ আটকানো ম্যাচিং টুপি মাথায় চাপিয়ে লাইনে অপেক্ষা করছিলাম।
‘ইওনা কাজাদি,’ রিসেপশনিস্ট ডাকলেন।
আমার বুক কাঁপছে কিন্তু মাথা উঁচু করে ইন্টারভিউ কক্ষে ঢুকলাম। একটা বড় কাঠের টেবিল। তার ওপারে দু’জন লোক এক মহিলার পাশে বসে। তাদের সামনে কাগজের স্তূপ। আমি ওদের স্বাগত জানাতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। মহিলা আমাকে বসতে বললেন। সানগ্লাস এবং রোদ-টুপি খুলে ওদের সামনে কাঠের চেয়ারে বসলাম। শান্ত ঘর। শুধু সিলিং ফ্যানের আওয়াজ। ফ্যানের ব্লেডগুলো ঘরের উত্তাপকে ফালা ফালা করে দিচ্ছিল।
হলুদ হিজাব এবং গাড় নীল লম্বা হাতা পোশাক পরা মহিলাটি নিজের পরিচয় দিলেন। ‘আমি মিরিয়াম। হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজার।’ পুরুষ দু’জন জানালেন, তাঁরা সুপারিনটেন্ডেন্ট। যে ভাবে সবাই আমার দিকে তাকিয়েছিল! বুঝতেই পারছিলাম তারা কেবল একটা জিনিসই জানতে চায়। হাত বিহীন একটা লোক সুরক্ষা প্রহরী হতে চায় কেন!
মহিলাটি বললেন, ‘আপনার নিজের কথা বলুন।’
ওদের সামনে বসে আমি কথা শুরু করলাম।
‘গভীর রাত তখন। পাতলা স্পঞ্জের ডডোমা গদিতে ঘুমিয়ে ছিলাম। মাথার উপর প্লাইউড। ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে ইঁদুর। ওদের শব্দে আমার ঘুম ভেঙে গেল। জোর করে ঘুমাতে চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঘুম আসছিল না। বাবা জোসেফ আমাকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছিলেন। তখন থেকেই আমার ঘুমের সমস্যা। আমার বয়স আঠারো না-হতেই বাবা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, আইনের দৃষ্টিতে আমি সাবালক। প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেরা রাস্তায় বসবাস করবার উপযুক্ত। আমি প্রস্তুত ছিলাম না; তেমন মনের জোরও নেই। বাঁচবো কী করে রাস্তায়! এই শহর এমনই যেখানে আমার মত ছেলেকে সবাই শুধু ঘৃণাই করে।
আমাদের বাড়ির সামনের গেটে মর্চে পরা কব্জাগুলো ভেঙে পড়ার হাল্কা শব্দ কানে এল। মনের ভুলও হতে পারে। সাড়া জীবন আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়াতে হবে! এমন ভাবনা মাথায় ঢুকলে পাগল না-হয়ে উপায় কি! জানালার বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে টানটান শুয়ে রইলাম। কপালে ঘাম। গণহত্যার ছবি ভেসে উঠছে চোখে। শিশু-আশ্রমের ঘরে ত্রিশ জন ঘুমন্ত বাচ্চা খুন হয়ে গেল! আমি, ইওনা কাজাদি তাদের রক্ষা করতে পারলাম না।
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু ঈশ্বর বা ভগবানে আমার বিশ্বাস নেই। যদিও আমার ঠাকুমা, আমাদের অভিভাবক বাবা জোসেফ জোর দিয়ে বলতেন, ঈশ্বর সত্যিই আছেন।
ছোট বেলা থেকেই শুনছি, আমি নাকি ‘শয়তানের বাচ্চা’। লোকেরা বলতো, আমার মা শয়তানের সাথে শুয়েছিল। তাই আমার ত্বক আর চোখ ফ্যাকাশে। আমার চুল ভুট্টা রঙের। পাশ দিয়ে হেঁটে যাবার সময় লোকজন আমার দিকে ইঙ্গিত করত। আমাকে জেরুজেরু, মানে ধবলা বলে ডাকতো। অনেক অশুভ জিনিস নাকি আছে আমার মধ্যে। তার থেকে মুক্তি পেতে কাছাকাছি এলেই মানুষ নিজেদের পোশাকে থুথু ফেলত। আমার জ্বলজ্বল চোখ, মাথায় কাঁপন এসব দেখে তারা ভয় পেয়ে যেত।
তবে সেই রাতে দাদির দেওয়া জপমালাটা আঁকড়ে ধরে প্রার্থনা করছিলাম, ‘ভগবান, তুমি যদি কোথাও থাকো, আমাদের রক্ষা কর।’
একটা পরাজয়ের অনুভূতি হয়েছিল। নিজের দুর্বলতা টের পাচ্ছিলাম। তবে বুঝেছিলাম পুরুষের অন্তরে যে বদমাশ থাকে, তার চেয়েও শক্তিশালী কেউ একজন আছে। এত বছর মহান ঈশ্বর কোথায় ছিলেন যখন আমাদের উপহাস আর হত্যা করা হত? কোথায় ছিল তাঁর শক্তি যখন ভোজালি দিয়ে আমাদের হাত-পা কেটে ফেলত! যখন ভগবান আমাদের মত মানুষ সৃষ্টি করলেন তখন কি তাঁর ভাঁড়ারে মেলানিন কম পরে গেছিল?
‘ডিলি’ অপবাদ দিয়ে আমাদের মত অ্যালবিনোদের অপহরণ ও হত্যা করা শুরু হয়েছিল। ডাইনি চিকিৎসক, মানে উইচরা বলতো ধলাদের হাড় দিয়ে তৈরি পাঁচন মানুষকে বড়লোক বানিয়ে দেয়। আর বাচ্চা ধবলের হাড্ডি পড়লে পাঁচনের শক্তি নাকি আরও বেড়ে যাবে। গুজব যখন ছড়িয়ে পড়ল, আমি সিয়ান্ডায় আমার ঠাকুমার সাথে থাকতে শুরু করলাম। সিয়ান্ডা সমতল ভূমির কাছে এক পাহাড়ি গ্রাম। ওখানে গাছপালায় ঘেরা লাল মাটির একটা বাড়ি ছিল আমাদের। বাড়ির মাথায় খড়ের ছাদ। লাল মাটির সেই গ্রাম গড়িয়ে গড়িয়ে যেন চলে যাচ্ছে আকাশের মেঘের দিকে।
বাড়িতে মুরগি পালতাম। কসোভা চাষ করতাম। সামনের চিলতে জায়গায় বজরা আবাদ হত। উপত্যকার সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল পুরনো পরিত্যক্ত বহু সোনার খনির গর্ত। কিছু দূরে দেখা যেত মুজুংগু খনি, ভিক্টোরিয়ার চকচকে অ্যালুমিনিয়ামের ছাদ। লোকজনকে কাছাকাছি ঘেঁষতে দেওয়া হোত না। তবে মাঝে মধ্যে স্থানীয় লোকেরা লুকিয়ে খনি থেকে সোনা চুরি করতো।
আমি সবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। তখন অ্যালবিনো অপহরণ ও হত্যা ব্যাপক আকার ধারণ করল। প্রধানমন্ত্রী জনগণকে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বহু অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেউ শোনেনি তাঁর কথা।
আমার স্কুলটি ছিল উপত্যকার আরেক দিকে। ওখানে ছিল একটা খ্রিস্টান মিশন আর গির্জা। আমাদের বাড়ি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে স্কুল। প্রতিদিন সকালে বিবি ঘাসিয়া, মানে ঠাকুমা হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন। সূর্যের তাত থেকে বাঁচাতে আমার মাথা একটা খঙ্গা (শরীর জরানোর বস্ত্র) দিয়ে ঢেকে রাখতেন। ঠাকুমার বয়স হলেও শরীর ছিল শক্তপোক্ত। কোমরে একটা পাঙ্গা (ভোজালি) সব সময় গুঁজে রাখতেন। বড় একটা খঙ্গা দিয়ে তাঁর কোমর ঢাকা থাকতো। ঠাকুমার গলায় থাকতো একটা লাল জপমালা। ওঁর কাছে থাকলে আমি খুব নিরাপদ বোধ করতাম। লোকেরা তাকে ভয় পেত; ডাইনিও বলতো। তবে ঠাকুমা আমাকে এসব উপেক্ষা করতে বলেছিলেন। বলতেন, একদিন ওরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আফসোস করবে।
অ্যালবিনো সম্পর্কে কুসংস্কার সিয়ান্ডা গাঁয়ে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। দরিদ্র খনি শ্রমিকরা তক্কে তক্কে থাকতো যাতে আমাকে হত্যা করে শরীরের হাড় জোগাড় করতে পারে।
একদিন সকালে ঠাকুমার সাথে স্কুলে যাচ্ছি। তখন দু’জন লোক রাম-দা ঘোরাতে ঘোরাতে আমাদের সামনে চলে এল। তারপর আমাকে জাপ্টে ধরল। ঠাকুমার চিৎকার আমি শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হলো ঠাকুমা তার পাঙ্গা নিয়ে বদমাশ গুলোর দিকে তেড়ে গেলেন। শরীরের সব শক্তি দিয়ে তাদের হাত থেকে আমাকে ছাড়িয়ে আনবার চেষ্টা করেছিলন ঠাকুমা। তখন একটা ভোঁতা পাঙ্গার জোর আঘাত লাগলো হাতে। মাংস ভেদ করে হাড় কেটে গেল। মনে আছে সে দিনের কথা। প্রবল রক্তপাত, তীব্র ব্যথা। আমাকে জড়িয়ে ধরে ঠাকুমা কাঁপছেন। ঈশ্বর সেদিনও ছিল নীরব।
ঠাকুমা আমাকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা পড়লেন। মিশনের একজন কর্মী আমাকে পরে খুঁজে পেয়েছিল। আমার কাটা হাত তখনও কনুইয়ের সাথে লেগে। মিশনের লোকজন বলেছিল, আমার বেঁচে যাওয়াটা নাকি এক অলৌকিক ঘটনা! আমাকে লুবন্দো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল মিশনের লোকেরা। হাসপাতাল বলেছিল, হাতটা কেটে ফেলতে হবে। তাই-ই হলো। আমাকে পরে কিভুলিনীর আশ্রয়ে নিয়ে গেল ওরা। আমার বয়স তখন নয় বছর।
কিভুলিনী মানে ‘ছায়ার নিচে’। সেরেমার উপকণ্ঠে সেই জায়গাটা। লাল ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আধ একর জমি। ভিতরে বাচ্চাদের থাকবার বড় একটা ছাউনি। মাথায় ভাঙা কাচের ছাদ। কয়েকটি শ্রেণি কক্ষ, মুরগি আর শূকরের ঘর। একটি ছোট বাগান ছিল। বাবা জোসেফের স্ত্রী এবং ছেলেকে একদল লোক হত্যা করেছিল। তার আগে ২০০৭ সালে তিনি এটি তৈরি করেছিলেন। এ-সম্পর্কে তিনি নিজে কিছু বলেন নি। তবে খবরের কাগজে পড়েছিলাম।
আমরা এই ধরনের ঘটনার সাথে পরিচিত। মানুষ-পোচারদের হাত থেকে পালিয়ে বেড়ানো। কখনও কখনও বাবা-মায়ের কাছ থেকেও।
আমি গদি থেকে উঠে পড়লাম। আর শুয়ে থাকতে পারছিলাম না। বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা ঘটতে চলেছে। বাবা সাহেব আমাদের বলতেন, ‘সাহস মানে ভয় না-পাওয়া নয়, ভয় পেয়েও বেঁচে থাকা। সেটা শিখতে হবে।’
আমি ঘরের কোণায় ঘাপটি মেরে বসে রইলাম। সেখানে অনেক রকম অস্ত্র আমি মজুত করে রেখেছিলাম। ওখান থেকে একটি বর্শা হাতে তুলে নিলাম। আমি দরজার কাছে পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলাম। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে সোলেক্স তালার চাবিটা ঘুরিয়ে দিলাম। দরজা খুলে গেল। আমি ঢুকলাম পাশের ঘরে। সব ছেলেরা ঘুমিয়ে তখন। মেয়েদের ছাত্রাবাসটি ছিল প্রাচীরের অন্য দিকে। গুন্ডাগুলো আলাদা দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকেছিল।
মেয়েদের ঘরে থাকতো একমাত্র প্রাপ্তবয়স্ক সোফিয়া। সে অন্য মেয়েদের দেখভাল করত আর রান্নার কাজেও হাত লাগাত।
একবার ভাবলাম ঘাড়ে গোঁজা হুইসেলে ফুঁ দিয়ে বাচ্চাদের এবং বাবা জোসেফকে সতর্ক করে দিই। কিভুলিনির দেওয়ালের ওপারেই ছিল বাবা জোসেফের বাড়ি। পরমুহূর্তেই অন্য রকম ভাবলাম। মনে হলো, মানুষ হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবার এটা একটা বড় সুযোগ। আমি গার্ডের ঘরের দিকে চুপি চুপি পা বাড়ালাম। লোহার গেটের কাছে একটা উঁচু জায়গায় পাহারাদারের ঝুপড়ি। আমাদের প্রহরী সাইমনিকে সেই ঘরে দেখতে পেলাম না। গেট কিছুটা খোলা। গেটের ল্যাচে ঝুলছে খোলা তালাটা। চাবিটাও লাগানো আছে। বুঝলাম, পাহারাদার গুণ্ডাদের ভিতরে ঢুকিয়ছে।
ভয়ে বুক কাঁপছিল আমার। মনে জোর আনলাম। যে করেই হোক ওই রাতে আমাকে বেঁচে থাকতে হবে। আমি গেট বন্ধ করলাম। ল্যাচে ঝোলানো তালা বন্ধ করে চাবি পকেটে ঢুকিয়েছি। তারপরে চারিদিকে নজরদারি শুরু করলাম। কোন মানুষ চোখে পড়ছে না। উজ্জ্বল চাঁদনি রাত। মাটিতে ছায়া পড়েছে বড় বড় গাছের
বাচ্চাদের ক্লাসরুম ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ঘর গুলো তালাবন্ধই ছিল। মুরগি আর শূয়রের ঘরও দেখলাম। প্রাণীগুলোর আচরণে অস্বাভাবিক কিছু নজরে এল না। আবর্জনা ফেলার গর্ত কিম্বা সব্জি বাগানেও কেউ নেই। তখনও কবরস্থান দেখা বাকি ছিল।
লিনা নামে এক বাচ্চা মেয়ে সপ্তাহ খানেক আগে ম্যালেরিয়ায় ভুগে মারা গিয়েছিল। আমরা তাকে কবর দিয়েছিলাম কম্পাউণ্ডের দক্ষিণে। মুরগি-ঘরের পেছনে যে বড় মাকুনগু গাছটা ছিল তার নিচে। বদমাশগুলো কবর খুঁড়ে মৃতদেহটা তুলে শরীরের হাত পা কেটে নিয়ে গেছিল। লিনাকে দু’মাস বয়সে কিভুলিনীতে রেখে গেছিল তার মা। লিনার মত মাত্র কয়েকটি বাচ্চা এখানে ছিল যাদের শরীরের কোন অঙ্গ কাটা পড়েনি। বাইরের লোকদের আক্রমণ থেকে তাকে রক্ষা করেছিল কিভুলিনী কিন্তু মশার কামড় থেকে বাঁচাতে পারেনি।
কবর দেওয়ার সময় লিনার মা সন্তান হারানোর বেদনায় বুক-ফাটা হাহাকার করছিল। লোক-দেখানো কান্না এসব। আমার মায়ের মতো এই মহিলাও তার সন্তানকে ত্যাগ করেছিল। লিনা যে চার বছর আমাদের সাথে কাটিয়েছিল, এই মহিলাটি একবারও তাকে দেখতে আসে নি। লিনার অসুখের সময় সোফিয়া তাকে স্নান করিয়ে দিত। সুস্থ করে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিল। প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে শিশুটিকে সেরেমা হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল সোফিয়া। সেই সোফিয়া, যে বাচ্চাটিকে তার শেষ মুহূর্ত অবধি সেবা করে গেছিল।
শিশুরা লিনার শোকে কান্নাকাটি করেছিল। বাচ্চাদের অনেকেরই মৃত্যু জিনিসটাকে বুঝবার বয়স হয়নি। কেউ কেউ খানিক শোক প্রকাশ করে নিজেদের দৈনন্দিন কাজ শুরু করেছিল। লিনার মৃত্যু আমাকে দুঃখ দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু আমি স্বস্তিও পেয়েছিলাম। কারণ মেয়েটি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছে। আমিও যেন এভাবেই মরতে পারি। গায়ের রঙের কারণে যেন মৃত্যু না-ঘটে।
মাথায় দুশ্চিন্তা ঘুরছে। সাইমনির গেট খুলে দেওয়ার জন্য দুর্ভাবনা। তার সঙ্গে মনে পড়ে গেল অনুপ্রবেশকারীদের লিনার কবর খুঁড়ে হাত-পা কেটে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। আমার পেটে জ্বালা শুরু হলো।
দেখতে পেলাম অনুপ্রবেশকারীকে। এক মহিলা। কোনও শিশুকে কোলে নিয়ে যেন দোল খাওয়াচ্ছে। আর পাশে সায়মনি কবর খুঁড়ছিল। দু’জনকেই তাদের পিছন দিক থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম। কানে এল মহিলাটির কান্না। মুখের ফিসফিস শব্দ। কানে ঢুকতেই আমার মাথা গরম হয়ে গেল। ভাবছিলাম কাকে আগে মারবো? দারোয়ান সাইমন না এই মহিলা! সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না।
অনন্ত কাল ধরে যেন আমি অপেক্ষা করছি। সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছি তখন। সাইমনিকে লক্ষ করে হাতের বল্লমটা ছুঁড়ে দিলাম। সাইমনির পিঠে গিয়ে লাগলো ওটা। মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ল ও। চিৎকার করে উঠল। হাতে ধরা বেলচাটা ফেলে দিয়ে যন্ত্রণায় কাতরাতে লাগলো। মহিলা কোনরকম সাহায্য করতে এগিয়ে গেল না। যেখানে ছিল সেখানেই বসে রইল। তার দু’হাতে ধরা খঙ্গায় মোরা কোন জিনিষ।
আমি ভেবেছিলাম অন্য রকম কোন প্রতিক্রিয়া ঘটবে। অপরাধবোধ বা লজ্জা; এমনকি রাগের বহিঃপ্রকাশ। তেমন কিছুই হলো না। বরঞ্চ দ্বার রক্ষক সিয়ামনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেল। দু’পায়ে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল। মহিলাটি এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই ছিল। আমি রক্তা মাখা অস্ত্রটি হাতে তুলে নিয়ে আবার সাইমনির দিকে ছুঁড়ে দিলাম। কিন্তু আমি তাকে হত্যা করতে পারিনি। আমি বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ঘরের দিকে ছুটে গেলাম।
বাচ্চারা কাঁদতে কাঁদতে ডর্মিটারির এদিক ওদিক ছুটাছুটি করছে। গুণ্ডাদের আক্রমণ ওদের অনেকে আগেও দেখেছে। তাই বাচ্চারা ভেবেছিল শয়তানগুলো আবার হানা দিয়েছে। আমি ওদের ডাইনিং রুমে জমায়েত হতে নির্দেশ দিলাম। সোফিয়া এবং বড় মেয়েরা তাদের উপর নজর রাখছিল। ছেলেরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে পাহারা দিতে লাগলো। বাবা জোসেফ কয়েকজন প্রতিবেশীকে সঙ্গে নিয়ে রাইফেল হাতে ছুটে এলেন। আমি তাদের ভিতরে ঢুকিয়ে নিয়ে গেটে তালা লাগালাম।
আমার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছিল। সাইমনি ও মহিলার অপকর্মের কথা শুনে বাবা জোসেফ পুলিশকে ফোন করেছিলেন। আমি বলেছিলাম, ‘এদের দুজনকে একই জায়গায় পেয়েছি।’ সাইমনি হাঁটু গেড়ে বসে। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠেছে ওর মুখ। বলছিল, ‘দয়া করে আমাদের হত্যা করবেন না; আমার কথা শুনুন আগে।’
পিছনে রাইফেল তাক করে বাবা জোসেফ তাকে কথা বলতে দিলেন। সাইমন বলে যাচ্ছিল, ‘তিন সপ্তাহের ছেলের মরদেহ নিয়ে এই মহিলা কাঞ্জেরা থেকে কুড়ি কিলোমিটার পথ ভেঙে এসেছিল আশ্রয় কেন্দ্রে। নির্বাচনের মরসুম, শিশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গের খুব চাহিদা। মহিলার স্বামী শিশুর লাশটি বিক্রি করতে চেয়েছিল। নার্স তাকে কিভুলিনীর সন্ধান দিয়েছিল। তাই সে মৃত সন্তানকে কোলে নিয়ে রাতের অন্ধকারে চলে আসে এখানে। আমি তাকে শুধু একটু সাহায্য করেছিলাম।’
পুলিশ এসে মৃত শিশুটিকে কবর দিয়ে সাইমনিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। তারপর মহিলার স্বামী আর জাদুকরী ডাক্তারকে গ্রেপ্তার করতে ছোটে।
ভোর চারটার সময় আমরা বাচ্চাদের শুতে পাঠালাম। সবাই ঘুমোতে যাওয়ার পরে আমি গার্ড পোস্টে বসে সূর্যোদয় দেখছিলাম। যদিও সূর্য আমার মত ধলাদের শত্রু তবু প্রতিটি ভোর সব সময় শুভ প্রত্যাশা বয়ে নিয়ে আসে। বাবা জোসেফের কথাই হয়ত ঠিক। সত্যিই সময় এসে গেছে। চার দেওয়ালের সুরক্ষার গণ্ডি ভেঙে বাইরের পৃথিবীতে গিয়ে আমার এখন দাঁড়ানো উচিত।
আমি এক মানুষের কথা শুনেছি যিনি গ্রামে গ্রামে ঘুরে লোকদের তার ত্বক স্পর্শ করতে বলছিলেন। তাঁর কথা, ‘আমি গরীব মানুষ। আমার শরীরের অঙ্গে কোন সম্পদ লুকিয়ে থাকতে পারে কি? আমার দেহে সত্যিই অশুভ কিছু নেই। আমি কোন যাদু জানি না। আমি সূর্যের উজ্জ্বল আলো সহ্য করতে পারি না, তাই ঘন ঘন চোখের পাতা পড়ে। আমি মানুষ। শুধু মাত্র গায়ের চামড়া দেখে আমার বিচার ক’র না।’
এখন বুঝতে পারছি সাহসী হওয়ার মানেটা কী। সাহসী মানে শত্রুর চোখে চোখ রাখা। তারাও যেন দেখতে পায় তোমার মধ্যে থাকা মানুষটাকে।
সকাল বেলা আমি বাবা জোসেফকে বললাম, ‘আমি দার শহরে যেতে চাই। সেই শহর, যেখানে সব কিছুই সম্ভব।’ তিনি বলেছিলেন, ‘যাও। সেখানে এমবাগালে আত্মীয়দের কাছে নিরাপদেই থাকবে।’
ওখানে যাবার সময় বাসের সিটে আমি একজন মাশাই লোকের পাশে বসেছিলাম। লোকটি গার্ডের চাকরি করেন। তিনি বললেন যে শহরে সুরক্ষা কর্মীর প্রচুর কাজ রয়েছে। ওঁর কথায় আমি চাকরির আবেদন করে এখানে আসবার ডাক পেয়েছি।
*
ইন্টারর্ভউ শেষ হ’ল। এমবাগালায় গেলাম। ওখানকার বাস স্টেশন থেকে ডালাডালার বাস ধরবো। চারদিকে ভিড়ভাট্টা, প্রবল চিৎকার-চেঁচামেচি। যান বাহনের কান ফাটানো আওয়াজ। আমি নিজেকে কোলাহল আর আবর্জনার মধ্যেই আবিষ্কার করলাম। আমার দিকে কেউ তাকাচ্ছে না; আমার কাটা হাত কিম্বা ত্বকের দিকে কারও নজর নেই। আমাকে উপেক্ষা করছে সবাই। যেন ম্যাজিক! সাধারণের মধ্যে অসাধারণ কিছু। বাস ভর্তি অপরিচিত লোক। এই প্রথম, জীবনে প্রথম বার, আমি অনুভব করলাম আমি একটা মানুষ।
‘সেকি’ সিকিউরিটি কোম্পানি আমাকে ফোন করতে গোটা একটা মাস লাগিয়ে দিল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমাকে একবার সুযোগ দেবে। আমি ওদের বলেছিলাম, একবার একটা মাত্র সুযোগ। ওটা পাওয়াই তো বড় কথা!

লেখক: তাঞ্জানিয়ার সাহিত্যিক নীমা কোম্বা (Neema Komba)। ২০১৪ সালে বিখ্যাত এটিস্যালাট পুরষ্কার পেয়েছেন লেখিকা।
অনুবাদক: ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, গল্পকার, বিজ্ঞান-প্রবন্ধ লেখক। পূর্বতন বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা সংস্থা, কলকাতা।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!