রুস্তম ইব্রাহিমবেকভ এর গল্প: গানের ক্লাস

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
20 মিনিটে পড়ুন
লেখক রুস্তম ইব্রাহিমবেকভ, আজেরবাইজান।

গল্পকার: রুস্তম ইব্রাহিমবেকভ
অনুবাদক: ড. সৌমিত্র চৌধুরী

একজন রোগা, বেঁটেখাটো লোক। বয়স তিরিশের কোঠায়। স্কুল চত্তরে ঢুকে পড়লেন। বাকু শহরের প্রাথমিক বিদ্যালয় সেটি।
লোকটির গায়ে চামড়ার জ্যাকেট। জ্যাকেটের কলার অ্যাসট্রাখান (এক ধরনের ভেরার লোম) দিয়ে তৈরি। বাছুরের চামড়ায় তৈরি তাঁর পায়ের বুট। প্যান্টের নিচের অংশ বুটের মধ্যে ঢুকানো।
লোকটি সিঁড়িতে পা রাখলেন। পাথর দিয়ে তৈরি তিনতলা স্কুল-বাড়ি। স্কুলবাড়িতে লোকটিকে উঠতে দেখেই সিঁড়িতে বসা এক তরুণী উঠে দাঁড়াতে গেলেন। লোকটি দেখতে পেয়েই মত বদলে ফেললেন। ভিতরে না ঢুকে নেমে গেলেন স্কুলের মাঠে। চারদিকে জমে থাকা বরফের মধ্যেই পা টেনে টেনে হাঁটতে লাগলেন।
মহিলাটি ঘরের দরজা সামান্য খুলে মানুষটাকে দেখতে লাগলো। বেশ জোরেই পা চালাচ্ছিলেন লোকটা। ঝোপ-ঝাড় থেকে প্যান্টে, জুতোর উপর ঝরে পড়া বরফের দিকে কোন ভ্রূক্ষেপই নেই তাঁর। মাঝে মাঝে একটু থেমে স্কুলের জানলায় চোখ রাখছেন। কখনও আবার লাফিয়ে জানলার তাক ধরবার চেষ্টা করছেন। লোকটা তো লম্বা ছিল না।

এক তরুণী শিক্ষিকা। খুব সম্ভবত তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ান। তাকে দেখে লোকটির খুব ভালো লেগে গেল। লোকটি শিক্ষিকার দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখ দুটো ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত দেখতেই থাকলেন। তরুণী শিক্ষিকা লোকটির মতলোব টের পেয়ে গেলেন। সকলেই বুঝতে পারলো।
স্কুল বিল্ডিঙের বাইরে মাটিতে পা রাখবার সময়ই ঘর পরিষ্কার করার মহিলাটি তাকে দেখতে পেয়েছিল। ঘরের কোণ থেকে নজর রাখছিল। এবার তার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই লোকটি হাসল। তারপর প্যান্টে জমে থাকা বরফের কণা গুলো পরিস্কার করে স্কুলের চারদিকে নাগাড়ে হাঁটতে লাগলো। মহিলাটি বুঝতে পেরেছিল, লোকটি নিজের উপস্থিতি আর গোপন রাখতে পারবে না। সবাই তাকে দেখতে পেয়ে যাবে। এবার ঐ মহিলা ঘরের কোণ থেকে বেরিয়ে এসে আঙুল তুলে লোকটাকে ধমকাতে লাগাল।
ক্লাশ শেষ হবার ঘণ্টা বাজতেই দরজা খুলে গেল। ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে হাসি ঠাট্টা মজা করতে করতে পিল পিল করে বেরিয়ে আসছে তখন। সাদা বরফ চারদিকে। সেই প্রেক্ষাপটে বাকি সব কিছুই কালো। কিছুক্ষণ আগেই যে স্কুল বাড়িটা নির্জীব হয়ে পড়েছিল, এখন সেটা অন্য রকম। যেন অনেক গুলো কোষ দিয়ে তৈরি কোন প্রাণী। প্রত্যেকটা কোষ জানে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাকে ঠিক কি কি কাজ করতে হবে।
স্কুল বাড়িটার গায়ে হেলান দিয়ে লোকটি দাঁড়ালেন। যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন, তার কাছ দিয়েই শুরু হয়েছে সরু রাস্তা। সেই পথ ধরেই পৌঁছাতে হয় স্কুল বাড়িতে। স্কুল চত্বরে দৌড়াদৌড়ি করছিল ছাত্ররা। লোকটার দিকে কোন ভ্রূক্ষেপ নেই তাদের। বরঞ্চ লোকটাই ক্লাশ রুম থেকে বেরিয়ে আসা বাচ্চাদের দেখছিলেন। তাদের মধ্যে যাকে খুঁজছিলেন, এতক্ষণে তার সন্ধান পেলেন।

প্রথম শ্রেণীর এক ছাত্র। চোখে চশমা। গোলগাল দেখতে। ফিটফাট পোশাক। কোটের সব কটা বোতাম বন্ধ। লোকটি বাচ্চাটিকে ডাকলেন। ক্লাশ ওয়ানের সেই বাচ্চাটা লোকটাকে দেখতে পেয়েই বন্ধুদের ফেলে আনন্দ করতে করতে এগিয়ে এল। ওর দিকে তাকিয়ে লোকটা দাঁত বের করে হাসতে লাগল।

‘ব্যাপার কি? দৌড়ে আসতে পারিস না?’ ছেলেটা কাছে আসতেই লোকটি বলে উঠলেন। তারপর ভালো করে দেখতে লাগলেন। একটু পরে বললেন, ‘তোকে না মাস্টারদের মত দেখতে লাগছে!’

বোঝা গেল না ছেলেটার পোশাকআশাক দেখে লোকটি সত্যিই খুশি হয়েছেন কিনা। বললেন, ‘ক্লাশ রুমের বাইরেও কি চশমা ছাড়া থাকতে পারিস না?’

‘না পারি না। চশমা ছাড়া ভালো করে দেখতেই পাই না।’

‘চশমাটা একটু খোল্‌ তো!’ লোকটা বললেন।
ছেলেটা তাই করল। লোকটা কয়েক পা পিছিয়ে গিয়ে দু’টো আঙুল তুলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বল্‌তো কটা আঙুল?’
‘দু’টো’।
‘এখন কটা।’
‘তিনটে।’
‘ভালোই তো দেখতে পাস তুই।’ লোকটি খুশি হয়ে বললেন, ‘সব সময় চশমা পরে থেকে চোখের নজর নষ্ট করে দিস না।’
‘আমি দূরের জিনিষ দেখতে পাই না তো!’ ছেলেটা বলল।

‘দূরের জিনিষ দেখতে পাস না, ঠিক আছে। তবে কাছের জিনিষ তো ভালোই দেখিস।’ লোকটা বলল।

‘তো কী হয়েছে?’
‘কিছু না! বলতো, ওই লোকটা আমার সম্পর্কে কী বলে? আমাকে গালাগালি দেয় না তো?
‘না’।
‘হ্যাঁ, গালাগালি করে,’ লোকটি জোর দিয়ে বললেন।
‘ও কি বলেছে, তুই ওকে কী বলে ডাকবি?’
“বলেছে। ‘হুসেন চাচা’ বলে ডাকতে।”
“আর কী বলছে?”
“তিনি চান আমি যেন মন দিয়ে পড়াশুনা কর’।”
“ঠিক কথা,” লোকটি সমর্থন করে বলল, “ঠিকই তো পড়াশুনায় মন দেওয়া দরকার…।” লোকটি আরও কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। ক্লাশ শুরু হবার ঘণ্টা বাজল। স্কুল মাঠে বাচ্চাদের শোরগোল হঠাৎ যেমন শুরু হয়েছিল, ঠিক তেমনই বন্ধ হয়ে গেল।
‘এখন তোমার কী ক্লাশ?’
‘গানের ক্লাশ’।
লোকটি একবার স্কুলের বাচ্চাদের দিকে তাকালেন। সবাই এক সাথে ক্লাশের দরজা দিয়ে ঢুকবার চেষ্টা করছিল।
“আমার সাথে এসো”, লোকটি চশমা পরা ছেলেটিকে স্কুলের পিছনের মাঠের দিক দিয়ে যেতে বললেন।
ঘণ্টা বেজে গেছে। ছেলেটি লোকটির কথা মেনে নিয়ে তার পিছন পিছন এগিয়ে গেল। তারা বিল্ডিং এবং বেড়ার মধ্যে একটি সরু ঝাঁপ পেরিয়ে খেলার মাঠে নামল। সেখানে চলছিল নির্মাণ কাজ।
“এখনে বস”, লোকটি খেলার মাঠের পাশে ইটের দুটি গাদা দেখিয়ে ইশারায় বললেন। ছেলেটি অবাক হয়ে বরফ চাপা ইটের দিকে তাকিয়ে রইল।
“কী ব্যাপার?” লোকটি জিজ্ঞাসা করলেন।
“আমি বরফে বসে থাকতে পারবো না,” ছেলেটি বলল।
লোকটি কটাক্ষ করে বললেন “ওঃ এমন ভয় পাচ্ছিস যেন তোর পাছা ঠাণ্ডায় জমে যাবে? বস্‌ তো এখানে!”
ছেলেটি তার মখমলের প্যান্টের দিকে তাকাল কিন্তু মুখে কিছু না বলে ইটের উপরই বসে পড়ল।
“দারুন দারুন!” লোকটি বলল “একজন সাচ্চা মানুষের কোন কিছুকে ভয় পাওয়া উচিত নয়।”
লোকটি বেড়ার কাছাকাছি গিয়ে রাস্তার দিকে পলক তাকিয়ে আবার বালকটির কাছে এসে বসল।
ছেলেটি বেশ সতর্ক ভাবে লোকটির দিকে তাকিয়ে রইল। একজন বয়স্ক চালাক লোক তার বন্ধুটির কাছে নিজের এমন চেহারা দেখাল যেন যে কোনও মুহুর্তে তাকে ঠকিয়ে দিতে পারে।
ছেলেটি লোকটির স্ট্রাইপ শার্টের হেমের দিকে ইঙ্গিত করল। যে রকম সাধারণত কোটের নিচে দেখা যায়। তারপর বলল, “তোমার জামাটা কিন্তু প্যান্টের ভিতর গোঁজা নেই।”
“আমি জানি” লোকটি বললেন, “তোকে খুঁজবার সময় জামাটা বেরিয়ে এসেছিল,” কথাটা বলেই লোকটি জামাটা নিজের প্যান্টের ভিতরে ঢুকিয়ে নিলেন।
দুজনেই কথা বলতে ব্যস্ত ছিল। কেউ লক্ষ করেনি কখন তাদের পেছনে ঘর পরিস্কার করার মহিলাটি এসে দাঁড়িয়েছে।
“ওঃ, আপনি এখানে!” ভদ্রমহিলা লোকটির হাত ধরে খুব মেজাজ দেখিয়ে বলল। তারপর চিৎকার করে উঠল,‘বাচ্চাটার সাথে কি করছেন এখানে?’
লোকটি মহিলার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ঐ মহিলা লোকটির হাত শক্ত করে ধরে রেখেছিল।
“প্রিন্সিপালের অফিসে চলুন,” মহিলা জোর একটা ধমক দিয়ে বলল, “আমি আপনাকে অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি।”
লোকটি এবার মহিলাকে জোর একটা ধাক্কা দিল। গলা উঁচিয়ে বলল, “আপনি এখান থেকে চলে যান তো!”
মহিলা প্রায় মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল, তবুও লোকটির হাত ছাড়েনি।
“তুমি ক্লাসে যাওনি কেন?” মহিলা, ছাত্রটিকে জিজ্ঞাসা করল।
“ইনি আমার বাবা,” ছেলেটি বলল, “ওঁকে একা থাকতে দাও।”
মহিলা অবাক হয়ে লোকটির হাত ছেড়ে দিল। লোকটি মুখ বেঁকিয়ে বলল, ‘শুনলেন তো! আমার কাজে আর মাথা গলাতে আসবেন না’। তারপর রেগে গিয়ে আবার বলল, “এই যে ভদ্রমহিলা, আমার সাথে লাগতে আসবেন না। আপনার মত মানুষদের না, গলা টিপে মারা উচিত! অন্য লোকেরা শান্তিতে থাকতে পারবে।”
“আপনার মত লোককেই শ্বাসরোধ করে মারা উচিত,” মহিলাটি একরাশ রাগ উগড়ে দিয়ে বলল। যদিও বুঝতে পেরেছিল, এরকম একটা লোকের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলা একদমই ঠিক নয়। ভদ্রমিহলা লোকটির কাছ থেকে সরে গিয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে দাঁড়ালেন।

“যান, যান,” লোকটি মহিলাটিকে বললেন, “এবার গিয়ে ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিন। আর শুনুন, এটা আমার ছেলে। আমাদের ব্যাপারে আপানি নাক গলাতে আসবেন না।”

ভদ্রমহিলা লোকটির কথাটা শুনে চলে গেল। ছেলেটার চোখ দিয়ে জল ঝড়তে লাগল।

“আরে, এসব নিয়ে ভাববি না তো! জীবনে এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে।” বাবা তাঁর ছেলেকে শান্ত করতে লাগলেন। তারপর হঠাৎই মনে পড়ে গেল। বললেন,”এই দেখ্‌, আমি তোর জন্য কী এনেছি।”
লোকটি তার জ্যাকেটের ভিতর হাত ঢুকালেন। তারপর ঝাঁকড়া চুলআলা একটা ছোট্ট কুকুরছানা বের করে আনলেন।
“নাও এটা, এর সাথে খেলতে থাকো”
কুকুর ছানাটা দেখে খুশি হল ছেলেটা।
“তুমি এটা নিতে চাও?” তার বাবা বললেন, “ঠিক আছে তুমি এটা নিয়ে নাও। অবসর সময়ে এটা নিয়ে খেলতে পারবে।“
“মা রাজী হবে না,” ছেলেটি কুকুর ছানাটিকে ধাক্কা দিয়ে বলল।
“নিশ্চয়ই হবে।”
“কুকুরছানা ঘরের মেঝে নোংরা করে দেবে যে।”
“ঠিক আছে। তুই পরিষ্কার করে দিবি।”
“আমি যখন স্কুলে থাকবো, তখন কী হবে?”
“কুকুরটাকে উঠোনে রেখে যাবি।”
অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে ছেলেটি তার বাবার দিকে তাকাল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। তবে বুঝে গেল যে তার বাবা রোজ দিনের ছোটখাটো সমস্যাগুলোকে কোন পাত্তাই দেন না। ছেলেটি বাবার সাথে তর্ক করতে চাইল না।
“কুকুরছানা কোন কাজের নয়। বাড়ি পাহারা দিতে পারে না। একে নিয়ে শিকারে যাওয়া যায় না।” ছেলেটির বাবা বললেন।
বাচ্চাদের সঙ্গীত ক্লাশ শুরু হয়ে গেছে। গানের কলি ভেসে আসছে স্কুল মাঠে।
ছেলেটি বলল, “টিচার খুব বকবেন আমাকে।”
“ঠিক আছে,” বাবা ছেলেকে শান্ত করতে লাগলেন। বললেন, “একটা ক্লাস মিস করলে কিছু হবে না। টিচারকে বলবি যে আমি এসেছিলাম।”
তারা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। একটু পরে লোকটি জিজ্ঞেস করলেন, “মাষ্টাররা তোকে মারেনা তো?”
“না,” ছেলেটি জোর দিয়ে বলল।
লোকটি গম্ভীরভাবে বলতে লাগলেন, “ঠিক আছে, নিজে থেকে কিছু করতে যাস না। তবে তারা যদি মারতে আসে, তুই আগেই মেরে দেবি, বুঝলি! তবে চশমাটা খুলে রাখবি। চশমা পরে কখনই মারমারি করতে যাবি না।’
ছেলেটি মাথা নাড়ল।
“যদি প্রথমেই আঘাত হানতে পার, জানবে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে গেল।” তার বাবা বুঝিয়ে বলতে লাগলেন,“বেশীর ভাগ লোকেরই মার খাবার পর বুদ্ধি খোলে, জানিস”!
একটু পরে লোকটি বললেন,”বুঝতে পারি না কেন তোমার চোখের সমস্যা হচ্ছে?” ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে আফসোস করে বললেন,”আমাদের পরিবারে কেউ কখনও চশমা পরেনি। তোমার ঠাকুরদার বয়স পঁচাশি, এখনও শিকার করতে যান।”
“আমার দিদা নিগার তো চশমা পরে,” ছেলেটি বলল।
“হ্যাঁ, তোমার মায়ের পরিবারের অনেকেই চশমা পরে। তবে তুমি কি ওদের মত শান্ত শিষ্ট?”
“না।”
লোকটি আবার উঠে দাঁড়ালেন, বেড়ার কাছাকাছি এসে রাস্তার দিকে ঝুঁকলেন। ব্লকের অন্য প্রান্তে পাইপ ভর্তি একটি বড় ট্রাক জিএএস—৫১২, পার্ক করা ছিল। রাস্তার ওপারে, পেস্ট্রি বিক্রি করা এক লোক তার বাক্সটি ট্রাকের পিছন দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। তার সাদা জ্যাকেটের সামনে একটা বড় তেলচিটে দাগ।
“এই শুনছ,” লোকটি ডাকলেন।
“কি বলছেন?” বিক্রেতার জিজ্ঞাসা।
“আপনার কাছে কোন প্যাস্ট্রি আছে?”
“হ্যাঁ, আছে”
“গোটা দশেক আমাকে দিয়ে যান।”
লোকটি কিছু প্যাস্ট্রি কিনে ছেলেটির কাছে ফিরে এসে বললেন, “কুকুরটাকে খাওয়াও।” এরপর কাগজে জড়ানো প্যাস্ট্রিগুলো বরফে নামিয়ে রাখলেন। “আমার নিজের একটা,” বলে লোকটি প্যাস্ট্রিতে কামড় বসালেন।
ছেলেটি প্যাস্ট্রি খেতে খেতে বলল, “তবে…মা বলেন আমি লড়াই করতে পারি না।”
“তিনি তো মহিলা। মহিলারা লড়াই-যুদ্ধ জিনিসটা ঠিক বুঝতে পারে না। তবে কি নাম যেন!… হ্যাঁ, আঙ্কেল হুসেইন। তিনি কী বলেন?”
“তিনি বলেন, আমার মন দিয়ে পড়াশোনা করা উচিত।”
“সে কথা ঠিক।”
“তুমি জানো তো, শহরে এখন একটা ফ্লু মহামারী শুরু রয়েছে”, ছেলেটি খুব ভয়ে ভয়ে তার বাবার সামনে শব্দগুলি উচ্চারণ করল।
“তুই সব সময় শুধু অসুখ নিয়ে কথা বলিস কেন রে!” বাবা বললেন, “মহামারী হচ্ছে তো তোর কি? আমি যখন তোর বয়সি ছিলাম, শীতের সময় খালি পায়ে হাঁটতাম। ফ্লু কী জিনিষ জানতাম না। তখন একটা যুদ্ধ চলছিল। তুই জানিস, যুদ্ধ কী জিনিষ?”
লোকটি বলতে লাগলেন, “হ্যাঁ আমি দেখেছি। যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন তোমার মত বয়স আমার। তোমার দাদু যুদ্ধ ক্ষেত্রে গেছিলেন। আমরা আট ভাই তখন তোমার ঠাকুমার সঙ্গে। খাবার জোগাড় করতে আমাদের হিমসিম অবস্থা। বাজারে খবরের কাগজ বিক্রি করতাম। ব্রিজের উপর কয়লা লোড করছি। গাড়ি ঠেলেছি। লাইনে জায়গা রেখে পরে বিক্রি করে দিতাম।’

আমরা রাতে একটা বড় দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়াতাম। তারপরে সকালবেলা আমাদের লাইন বিক্রি করে দিতাম। ‘হ্যাঁ, আমরা সব রকম কাজ করেছি, তবে চুরি করিনি’।
হঠাৎ বাবা রেগে গিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা কখনই সেভাবে অর্থ উপার্জন করতে পারিনি। আমি সর্বদা চুরি করার বিপক্ষে ছিলাম। সারা জীবনে কখনই কিছু চুরি করিনি। আমার বাবা – তোমার ঠাকুর্দা – যুদ্ধে যাবার আগে বলে গেছিলেন, আমি যদি কখনও শুনি, আমার বাচ্চারা জীবনে ভুল পথে চলেছে, আমি আর ফিরে আসবো না। হাজিবালার বাচ্চারা চোর হতে পারে না।”
“শুধু আমি না, তোমার চাচারা কেউ কখনও চুরি করেনি। অথচ আমরা খিদেয় প্রচণ্ড কষ্ট পেতাম। সকলেই জানতো সে কথা। সে সময় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছিল। আমাদের কোন এক প্রতিবেশী রামিজের গাড়িতে উঠে বসেছিল। রামিজ তখন ট্রাকটা পিছন দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রতিবেশি লোকটা গাড়ির ড্যাশবোর্ড থেকে সমস্ত কিছু চুরি করে নিয়েছিল। ‘ড্যাশবোর্ড’ কী, তুমি জানো?”
ছেলেটি জানত না।
“এক ধরনের ছোট বাক্স,” বাবা বুঝিয়ে দিলেন। “ড্রাইভারের লাইসেন্স এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস এতে রাখা থাকে।”
ছেলেটি জিজ্ঞাসা করলো, ‘ড্রাইভারের লাইসেন্স কী’? এবারেও তার বাবা বুঝিয়ে দিলেন।
“তারা রামিজের ড্যাশবোর্ড থেকে সমস্ত জিনিস চুরি করে নিয়ে গেছিল। এটা মেনে নিয়ে চুপ করে থাকবে, রামিজ তেমন লোকই নয়। বিনা কারণে সে যে কোন লোককে খুন করে দিতে পারে। (বেচারা রামিজ নিজেই যুদ্ধক্ষেত্রে পরে মারা গেছিল)।
সেদিন হয়েছিল কি, রামিজ বাড়ির কাছে ট্রাকটা পার্ক করে খেতে গিয়েছিল। তখনই একটা লোক ট্রাক থেকে জিনিস গুলো চুরি করেছিল। রামিজ বাসা থেকে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করল, “আমার ট্রাকে কে উঠেছিল?” প্রচণ্ড রাগে কাঁপছিল রামিজ। আমার তখন তোমার মত বয়স। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। তবু আমি স্বীকার করে নিলাম। বললাম,‘ট্রাকে আমি উঠেছিলাম’।
“ওহ, তোমারই কাজ এটা? এখানে এস’, রামিজ বলল। আমি ওর কাছে চলে গেলেম”।
“শুয়ে পড়”, রামিজের আদেশ। আমি রাস্তায় শুয়ে পড়লাম।
রামিজ গাড়িতে উঠে ইঞ্জিন চালু করে সোজা আমার দিকে এগোতে লাগল। ওর এক হাতে স্টিয়ারিং, অন্য হাত দরজায়। ট্রাক এবং আমার মধ্যে কত মিটারের ফাঁক, সেট দেখতে দরজা খুলেছিল। আমি সেখানে রাস্তাতেই শুয়েছিলাম। কোথায় দৌড়ে পালাবো? যেখানেই যাই, লোকটা আমাকে তাড়া করে ঠিক ধরে ফেলত। যাই হোক, আমি শুয়ে ছিলাম আর রামিজ চিৎকার করছিল, “আমার ড্যাশবোর্ড থেকে কারা জিনিসটা চুরি করেছে? যদি আমাকে বলিস তো ভালো। নইলে তোর উপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দেব।”
“আমি জানি না, আমি বলেছিলাম। কী ভাবে জানবো? সত্যি কথা, আমি আপনার ট্রাকে উঠেছিলাম, কিন্তু চুরি করিনি। কে করেছে তাও জানি না।”
“তুই জানিস না? তাহলে এবার মর্‌। লোকটা ট্রাক নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমার ভাগ্য ভালো ছিল। স্থানীয় লোকজন ঘটনাটা রামিজের মাকে জানিয়ে আসে। সেদিন যদি তার মা না আসতো, তবে সত্যিই রামিজ আমার উপর দিয়ে ট্রাক চালিয়ে দিত। কিন্তু দেয়নি তার মায়ের কথা শুনে।
রামিজ লোকটা শুধু তার মায়ের কথা শুনতো। তার মা ছিপছিপে ভদ্রমহিলা। খুব দ্রুত তাঁর চাল চলন। রামিজ কখনও মাতাল হয়ে জোরে ট্রাক চালিয়ে দিত। কিছু লোক দৌড়ে প্রাণ নিয়ে পালাত। এমন জঘন্য কাজ থেকে কেউ রামিজকে বিরত করতে পারেনি। একমাত্র পারতো তার মা। মা এসে দাঁড়ালেই রামিজ কোনও প্রতিবাদ করত না। মা কান ধরে সোজা রামিজকে বাড়িতে টেনে নিয়ে যেত। লোকটা তার মাকে কি যে ভালবাসতো! মায়ের কথা কেউ কি অমান্য করতে পারে? তুমি অবশ্যই তোমার মাকে সব সময় ভালবাসবে। মায়ের চেয়ে আপন আর কে আছে তোমার? তাই না! “
‘ঠিক’। ছেলেটি মাথা নীচু করে উত্তর দিল।
“সাবাশ!” তাঁর বাবা ছেলের প্রশংসা করে নিজের গল্প চালিয়ে যেতে লাগলেন। “হ্যাঁ, তার মাকে ধন্যবাদ; তিনি আমার জীবন বাঁচিয়েছিলেন। কারণ আমি বলতে পারছিলাম না কে রামিজের ট্রাক থেকে জিনিস গুলো চুরি করেছে।”
“তুমি জানতে কে করেছিল কাজটা?”
“অবশ্যই, আমি জানতাম। প্রত্যেকেই জানতো।”
লোকটি চুপ করে থাকলেন। তারপর কুকুর ছানাটির মুখের মধ্যে কিছু প্যাস্ট্রি গুঁজে দিতে দিতে সশব্দে হেসে উঠলেন। খানিক পরে অবাক হয়ে বললেন, “শুধু এই কুকুর ছানাটিকে দেখ!”
‘আমি আর প্যাস্ট্রি খাবো না। তুমি প্যাস্ট্রির ভিতর মাংসের টুকরো না থাকলে খেতে চাও না’।
“আমি খাচ্ছি,” ছেলেটি বলল। আসল কথা, এর মধ্যেই কয়েকটা পেস্ট্রি খাওয়া হয়ে গেছে। তেমন খিদে ছিল না। তবু বাবার সাথে তার প্যাস্ট্রি খেতে ভালো লাগছিল।
বাবা বললেন, “আমার উচিত কিছুটা সময় তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসা। তুমি আমাদের সঙ্গে থাকবে। আমার বাবা মা খুব খুশী হবেন। আমি যেসব জায়গায় খেলতাম — রাস্তাঘাট, পাড়ার মাঠ— সেগুলো তোমাকে দেখাবো। অনেক ছেলে-মেয়ে আছে সেখানে। এখনও রাস্তায় থাকে তারা। তাদের সাথে খেলতে পারবে তুমি।”
“মা কি আমাকে ছাড়বে?”
“হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ছাড়বেন। তুমি আমার সাথে থাকতে চাও কিনা বল?”
“হ্যাঁ, আমি থাকতে চাই, “ছেলেটি তার বাবার দিকে করুন চোখে তাকাল। তারপরে সে স্কুলের জানালার দিকে এক পলক তাকিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। বাচ্চাদের সমবেত কণ্ঠের সঙ্গীত আর শোনা যাচ্ছে না। হঠাৎ ঘণ্টা বেজে উঠল। এর অর্থ গানের ক্লাশ শেষ হয়ে গেল।”
“এটাই কি শেষ ক্লাশ?, “নীরবতা ভঙ্গ করে তার বাবা জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ,” ছেলেটির স্বরে দুঃখ ঝরে পড়ল।
“তোমার ব্যাগ কোথায়?”
“আমি ক্লাসে রেখে দিয়েছি।”
“যাও, এক্ষুনি নিয়ে এসো।”
তারা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর সরু পথ ধরে উঠোনের অপর প্রান্তে চলে গেল। অনেক গুলো বাচ্চা স্কুলের দরজা দিয়ে দৌড়াচ্ছিল। তাদের সবার পিঠে ব্যাগ। লোকটি ছেলেটির পিঠে চাপর মারল। ছেলেটি বাবার কাঁধে মুখ ঘষে দৌড় লাগাল। নিজের ব্যাগটা আনতে অন্য ছেলেদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে এগোতে লাগল। ছেলেটি দরজার কাছে পৌঁছালে তার বাবা উঠে পড়লেন। কুকুর ছানাটা হাতে নিয়ে স্কুলের মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ছেলেটি নিজের ব্যাগটি হাতে নিয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ফিরে এল। কিন্তু তার বাবাকে দেখতে পেল না। সে দেখল তার মা স্কুল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। যথারীতি তার সৎ বাবা, তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে।
লোকটি তাদেরও দেখেতে পাচ্ছিল (সে আদৌ নিজেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেনি। কেবল স্কুলের কোণের দিকে দাঁড়িয়ে ছিল। কারোর চোখ যায় না সে জায়গায়)। ছেলেটির মায়ের গায়ে একটা কালো পশমী কোট। তার সৎ পিতা চশমা পরা, লম্বা মানুষ। মাথায় টুপি।

ছেলেটিকে সাথে নিয়ে তারা চলে গেল। চারপাশে তাকিয়ে লোকটা স্কুলের ফাঁকা মাঠের মাঝখান দিয়ে হাঁটতে লাগল। কুকুরছানাটা তার সামনে দিয়ে দৌড়াচ্ছিল।

লোকটির পেটে একটুও খিদে নেই, তবুও প্যাস্ট্রি চিবিয়ে যাচ্ছিলেন। স্কুলের মাঠ ছেড়ে যাওয়ার পরেই তিনি ব্লকের অন্য প্রান্তে রেখে যাওয়া ট্রাকের কাছে পৌঁছালেন। ট্রাকটির পেছনের অংশটি খোলাই ছিল। সেখান থেকে খান ছয়েক ড্রিল পাইপ ঝুলছিল।
লোকটি ট্রাকের দরজা খুলে কার্পেট মোরা চালকের সিটে বসে পড়লেন। ইঞ্জিন স্টার্ট করার আগে কুকুর ছানাটিকে একটা লোকের হাঁটুর উপর বসিয়ে দিলেন। গোঁফআলা সেই লোক, মাথায় টুপি। ট্রাকের ছোট ঘরটাতে ঘুমোচ্ছিল।
“এত দেরি করলি কেন?” চোখ না খুলেই সেই লোকটা জিজ্ঞেস করল।
“আমরা গল্প করছিলাম।”
“তো, কেমন আছে তোমার ছেলে?”
“ঠিক আছে।”
“কুকুর ছানাটা নেয়নি কেন?”
“তার নেবার দরকার কি?”
“তো, এখন কুকুরের বচ্চাটা নিয়ে আমরা কোথায় যাবো?”
“যেখান থেকে এটাকে কুড়িয়ে এনেছো, সেখানেই আবার ছেড়ে দিয়ে এসো”।
লোকটি ইঞ্জিন চালু করল। গাড়ি কিছুটা এগিয়ে স্কুল চত্বর অতিক্রম করল। এবার তার ট্রাকটি মাল বোঝাই পাইপ দোলাতে দোলাতে এগিয়ে চলল।#

লেখক পরিচিতি:
আজেরবাইজানের লেখক রুস্তম ইব্রাহিমবেকভ (জন্ম ১৯৩৯)। মূলত সিনেমা পরিচালক। বিজ্ঞান নিয়ে অয়েল অ্যাকাডেমিতে পড়াশুনা করেছেন। আকৃষ্ট হয়েছিলেন সাহিত্য ও সিনেমায়। বহু পুরস্কারে সম্মানিত। যেমন, ‘লেনিন কমসমল’ (১৯৭৯), আজেরবাইজান রাজ্য পুরস্কার, রাশিয়ান রাষ্ট্রীয় পুরস্কার (USSR State award, 1981). তাঁর রচিত বারন্ট বাই দি সান’ এর চিত্রনাট্য গ্রাঁপ্রি পুরস্কার পেয়েছিল (১৯৯৪)। সিনেমা জগতের শ্রেষ্ঠ আন্তর্জাতিক ‘অস্কার’ পুরস্কারে সম্মানিত (১৯৯৫) তিনি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!