নিরাপত্তাহীনতায় বাউল মেহেদী হাসান ও তার পরিবার!

টিএম মিলজার হোসেন
টিএম মিলজার হোসেন
6 মিনিটে পড়ুন

বগুড়ার শিবগঞ্জে বাউল গান গাওয়ায় কিশোর বাউল মো. মেহেদী হাসানের মাথা ন্যাড়া করে তাকে শারীরিক নির্যাতন এবং নাস্তিক আখ্যা দিয়ে গ্রাম ছাড়ার হুমকি দিয়েছে এলাকার মণ্ডল (মাতবর) গং। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, কিশোর বাউল মো. মেহেদী হাসান (১৬) জুরিমাঝপাড়া গ্রামের মো. বেল্লাল হোসেনের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। একমাত্র ছেলে বাউল শিল্পী মেহেদী হাসান। ছোটবেলা থেকে দাদা আলম মন্ডলের বাড়িতে থাকতো মেহেদী। অর্থাভাবে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরে আর পড়শোনা করতে পারেনি। ১১/১২ বছর বয়স থেকেই বাউল গান শেখার জন্য শিল্পী মতিয়ার রহমান মতিন বাউলের বাড়ীতে যাতায়াত শুরু করেন। তাকে অনুসরণ করে বড় চুল (বাবরী) রাখে এবং অধিকাংশ সময় সাদা রঙের গামছা, ফতুয়া ও লুঙ্গি পরিধান করে বাউল মেহেদী। গান শেখার জন্য ওস্তাদ মতিন বাউলের সঙ্গে বিভিন্ন স্থানে যায় এবং সেখানে গান পরিবেশন করে। ওইসব অনুষ্ঠানে গান গেয়ে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে মেহেদী। অধিকাংশ সময় সাদা পোশাক পরিধান ও বাউল গান করায় মেহেদী ও বাউলদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করতো আসামিরা।

একসময় বাউল মেহেদী হাসান তাদের এমন আচরণের প্রতিবাদ করায় মাতব্বরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়। এর জেরে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে আসামিরা তার দাদার বাড়িতে প্রবেশ করে। শাফিউল ইসলাম খোকনের নির্দেশে তাহের ও মেজবা তাকে চেপে ধরে এবং তারেক ও ফজলু মেশিন দিয়ে তার মাথা ন্যাড়া করে দেয়। মেহেদী চিৎকার করলে তাকে মারধর করা হয়। এ সময় ফজলু মিয়া বিছানায় বালিশের নিচ থেকে তার দেড় হাজার টাকা চুরি করে। মেহেদীর চিৎকারে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এলে আসামিরা পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে তারা বাউল গান বন্ধ করতে বলে, অন্যথায় তাকে পিটিয়ে গ্রাম ছাড়া করার হুমকি দেয়। এরপর থেকে কিশোর বাউল ও তার ওস্তাদদ্বয় অজ্ঞাতবাস করছেন।

এ ঘটনায় মঙ্গলবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে পাঁচজনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত দুই জনের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করে ওই বাউল। এরপর রাতেই উপজেলার জুরিমাঝপাড়া গ্রামের মাতব্বরসহ তিনজনকে গ্রেফতার করে পুলিশ

গ্রেফতারকৃতরা হলো—স্থানীয় জিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক ও গ্রাম্য মাতব্বর মো. মেজবাউল ইসলাম (৫২), জুড়ি মাঝপাড়া গ্রামের মৃত তোজাম্মেল হোসেন তোতার ছেলে শাফিউল ইসলাম খোকন (৫০) ও মো. বাদশার ছেলে তারেক রহমান (২০)। পলাতক আসামিরা হলো—একই গ্রামের সঞ্চু মিয়ার ছেলে ফজলু মিয়া (৪০) ও মৃত আকবর আলীর ছেলে আবু তাহের (৫৫)।

শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জানান, তাদেরকে বুধবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে বগুড়া জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এখনো এলাকায় পুলিশ মোতায়েন আছে। অপর দুই মাতবরকে গ্রেফতারে এলাকায় অভিযান চলছে।

এদিকে তিনি প্রশাসনের কাছে তার নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা চেয়েছেন নির্যাতনের শিকার বাউল মেহেদী হাসান। তিনি বলেন, ‘সমাজে হেয় করতে এবং কোথাও যাতে যেতে না পারি সে জন্য তারা আমার মাথা ন্যাড়া করে দিয়েছে।’

বাউল মেহেদী হাসান জানান, ছোটবেলা থেকে বাউল গানে আসক্ত ছিলেন তিনি। তাই বাউল গান শেখার জন্য ওস্তাদ মতিয়ার রহমান মতিন বাউল ও হারমনি মাস্টার খলিলুর রহমানের সঙ্গে উঠাবসা এবং ঘনিষ্ঠতা হয়। তাদের অনুসরণ করে বড় চুল রাখেন এবং সাদা রঙের গামছা, ফতুয়া ও লুঙ্গি পরিধান করেন। দুই ওস্তাদের সঙ্গে থেকে মুক্তা সরকার, কাজল দেওয়ান, লতিফ সরকার, আমজাদ সরকার ও শাহ আবদুল করিমের অন্তত ১০০ বাউল মুর্শিদী গান মুখস্থ করেন। ওস্তাদদের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে গান থেকে উপার্জিত অর্থ দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

বাউল মেহেদী জানান, তার সাদা পোশাকে চলাফেরা ও বিভিন্ন এলাকার অনুষ্ঠানে বাউল মুর্শিদী গান পরিবেশন করায় গ্রামের মণ্ডল (মাতবর) শাফিউল ইসলাম খোকন, শিক্ষক মেজবাউল ইসলাম, তারেক রহমান, ফজলু মিয়া, আবু তাহের, মসজিদের ইমাম মোখলেসুর রহমান প্রমুখ ষড়যন্ত্র শুরু করেন। মণ্ডলরা তাকে এবং ওস্তাদদের সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করতেন। প্রতিবাদ করলে মণ্ডলরা তার ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাত ১০টার দিকে তিনি ঘরে জিকির আসগার করছিলেন। এ সময় অতর্কিতভাবে ঘরে ঢুকে মণ্ডলরা তাকে টেনে বের করেন। এরপর জুড়ি মাঝপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মোখলেসুর রহমানের কাছে ফোনে নেওয়া পরামর্শে মেশিন দিয়ে তার মাথা ন্যাড়া করে দেন। এরপর শরীরে জ্বর থাকা অবস্থায় তাকে গোসল করিয়ে কলেমা শাহাদত পাঠ করতে বাধ্য করেন। ফজলু মিয়া নামে এক আসামি বিছানার বালিশের নিচ থেকে দেড় হাজার টাকা চুরি করে নিয়ে যান। যাওয়ার আগে মণ্ডলরা বাউল গান বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। অন্যথায় তাকে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে ওস্তাদ মতিন বাউলের আশ্রয়ে চলে যান।

এদিকে ঘটনার পর থেকে বাউল মেহেদী হাসানের বাবা বেল্লাল হোসেন প্রচারণা চালাচ্ছেন এবং সাংবাদিকদের বলছেন, তার ছেলে বাউল গানের নামে ঘরে মূর্তি পূজা করতেন। তাই তিনি নিজে তার ছেলের মাথা ন্যাড়া করেছেন এবং তাকে কালেমা পড়িয়েছেন। এতে গ্রামের মণ্ডলদের (মাতবর) কোনো দোষ নেই। তার ছেলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে।

এ প্রসঙ্গে নির্যাতিত বাউল মেহেদী জানান, তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় না করলেও ঘরে রাত ১০টা থেকে ফজরের ওয়াক্ত পর্যন্ত আল্লাহ, রসুল এবং তার ওস্তাদের নামে বাতি জ্বালিয়ে জিকির আসগার করেন। এছাড়া তাহাজ্জুদ, ফজর ও রহমতের নামাজ আদায় করেন। রসুলের গুণগান করেন। ঘরে কোনো পূজা করেন না।

তিনি দাবি করেন, মণ্ডলরা মামলা থেকে বাঁচতে তার বাবাকে হুমকি দিয়ে এসব বলতে বাধ্য করছেন।

বাউল মেহেদী জানান, বর্তমানে তার পরিবারের সদস্যরা নিরাপত্তহীনতায় রয়েছেন। তিনি মণ্ডলদের ভয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন; কিন্তু বাড়ীতে ফিরে যেতে পারছেন না। তিনি দুই ওস্তাদের সঙ্গে অজ্ঞাত স্থানে রয়েছেন। মেহেদী প্রশাসনের কাছে তার পরিবার, দুই ওস্তাদ ও নিজের নিরাপত্তা চেয়েছেন।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!