শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে পথে নামুন, সোচ্চার হোন

আবদুস সোবহান বাচ্চু
আবদুস সোবহান বাচ্চু
18 মিনিটে পড়ুন
আবদুস সোবহান বাচ্চু

কাঙালের কথা বাসি হলে ফলে। হ্যাঁ ফলেছে এবং প্রায় শতভাগ ফলেছে, যা দেখে আমি কাঙাল ভীষণ ভীষণ অবাক। ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে “ডিজিটাল শিক্ষা বাণিজ্য ও আমাদের শিশুদের ভবিষ্যত” শিরোনামে একটি রম্য আর্টিকেল অনলাইন পোর্টালে প্রকাশ হয়েছিল। তবে আজকেরটা কিন্তু রম্য নয়, রুঢ়..!

সে আর্টিকেল থেকে কিছু কপি করছি না, শুধু রি-ক্যাপ এর স্বার্থে শুরুর ভাবনা থেকে একটু আভা নিচ্ছি। শ্রেফ আভা, কপি পেস্ট নয় কিন্তু।

আশি’র দশকে বাংলাদেশের নিবেদিত প্রাণ থিয়েটার কর্মী, জনপ্রিয় অভিনেতা অধ্যাপক মমতাজ উদদীন আহমেদ এর সাড়া জাগানো মঞ্চ নাটক “ক্ষত-বিক্ষত”র চেয়ারম্যানের একটি সংলাপ দিয়ে। যেখানে চরিত্রের স্খলনজনিত কারনে গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়া চেয়ারম্যান সময়ে আবর্তে মন্ত্রী হয়ে গ্রামে ফিরে গ্রামবাসীদের উদ্দেশ্যে ভাষণে বলছেন- ডিক্লিয়ার দিলাম, দ্যাশের যত ইউনিভার্সিটি, সব হয়ে যাবে মুরগির ফার্ম..! খালি খাও আন্ডা যে যত পারো গরম গরম।”

সেই সূত্র ধরে সেই রম্য আর্টিকেলে প্রস্তাবনা ছিল, শুধু ইউনিভার্সিটি নয়, দেশের সকল স্কুল-কলেজ-মাদরাসাও বন্ধ থাকবে। সে ভবনগুলোর কোনটা মুরগীর ফার্ম, কোনটা ডেইরি ফার্ম আবার কোনটা গরীব মানুষের আবাসন হিসাবে ব্যবহৃত হবে। পড়াশুনা সব অনলাইনে হবে। ওয়েব সাইটে ক্লাস- লেকচার, পরীক্ষার রুটিন, ফলাফল ঘোষণার তারিখ, প্রতি বিষয়ের ১০সেট করে প্রশ্নপত্র সব দেয়া থাকবে। শিক্ষার্থীরা যখন ইচ্ছে করবে হাটে, মাঠে, ঘাটে, বাজারে, সিনেমা হলে বা ওয়াশরুমে বসে ক্লাস দেখে নেবে। সময় হলে পরীক্ষার প্রশ্নের উত্তর অনলাইনে সাবমিট করবে। পরীক্ষার নির্ধারিত সময়ে সার্ভার অন হবে এবং সময় শেষ হলে আর উত্তরপত্র আপলোড মানে জমা দেয়া যাবে না এবং ছাত্র-ছাত্রীরাই-পেমেন্টে বেতন প্রদান করবে ইত্যাদি, ইত্যাদি আরো কতো কি হাসি তামাশা..!

আচ্ছা বলুন তো, মাত্র ৬/৭ বছরের মাথায় এসে আজকে আমাদের করোনাকালের অনলাইন পড়াশুনার সাথে কি মিলে যায়নি সে সব আজগুবি ভাবনা..? আজ যা আজগুবি মনে হয়, আগামীকালই তা সত্যি হয়ে ধরা দিতে পারে।

ছোটবেলায় জেমস বন্ডের মুভি দেখে ফ্যান্টাসিতে ভুগেছি বহু..! আহা, হাতে ঘড়ির মধ্যে ফোন, কলমের মধ্যে ক্যামেরা, জুতার মধ্যে চাকু..! আরো কতো কি..!! আজ আমার সিক্সে পড়া মেয়ে সেই জেমস বন্ডের স্বপ্নের ঘড়ির আদলে স্মার্ট ওয়াচ পড়ে মাঠ থেকে ফোন করে জানায়, ‘বাবা আমি বেল পার্কে সাইকেল চালাচ্ছি। স্বপ্ন সত্যি হচ্ছে। রূপকথার হাতিরা সত্যিই আকাশে উড়ছে। সরকারের দাবী অনুসারে আমাদের প্রায় ৯০% ছেলেমেয়েরা প্রায় দু’বছর হতে চলল স্কুলে না গিয়েই টেলিভিশন দেখে বা অনলাইনে ক্লাস করে সব শিখে ফেলে দ্বিগ্বজ হয়ে যাচ্ছে। এ সাফল্যধারাকে সমুন্নত রাখতে সরকার এখন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য আলাদা টেলিভিশন চ্যানেল তৈরির পরিকল্পনা করছে।

যদি তাই হয়, তবে তো সত্যি সত্যিই মমতাজ উদদীন স্যারের কথা অনুসারে স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির এ ভবনগুলোকে ফেলে না রেখে অনায়াসে মুরগির ফার্ম বা গৃহহীনদের আবাস বা অন্য কাজে লাগাতে পারি। এভাবে সারা দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবনগুলো বছরের পর বছর পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলে তো এগুলো সহসাই ব্যবহারের অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।

আমাদের দেশের জনদরদী শাসকগোষ্ঠী শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে সামান্যতম ঝুঁকি নিতেও রাজি নন। করোনা সংক্রামন ৫% এর নিচে নামতে যত বছর লাগবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তত বছর বন্ধ থাকবে। অথবা টিকা দিতে যত বছর লাগবে তত বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। ক্যালকুলেটর নিয়ে বসে হিসাব কষে দেখুন, গত ১৬ মাসে যে হারে কোভিড টেস্ট হয়েছে, এ হারে চললে, আমাদের সবার টেস্ট করতে আরো সাড়ে ৩৩ বছর লাগবে। টেস্ট না হয়ে যদি গয়রহ প্রতিমাসে ২৫ লক্ষ ডোজ টিকা বিরতিহীনভাবে দেয়া যায়, তবে সময় লাগমে আরো ৭ বছর। যদিও আমাদের এই অদক্ষ ও অসৎ স্বাস্থ্যসেবা খাত দিয়ে তা সম্ভব হবে কিনা তা আল্লাহতা’য়ালাই ভালো জানেন। কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বন্ধ নিয়ে এতো হৈ চৈ করার কিছু নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, শিক্ষা কার্যক্রমতো বন্ধ নয়..! টেলিভিশন ও অনলাইনে তো দেদারছে হচ্ছে। বরং আপনার শিক্ষা ব্যয় না থাকায়, সঞ্চয় বাড়ছে। শিক্ষার চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি। আর দুই চার বছর স্কুল কলেজ বন্ধ থাকলে যে কোন জাতি মূর্খ হয়ে যায় না, তার জ্বলন্ত প্রমান আমাদের কাছের রাষ্ট্র চীন।

চীনের স্বাধীনতার পরে দশ বছরের জন্য সেখানকার উচ্চ শিক্ষা বন্ধ রেখেছিল চীন সরকার। তাতে তো তারা মূর্খ হয়ে যায়নি। আজ শিক্ষায়-চিকিৎসায়-জ্ঞান বিজ্ঞানে-অর্থনীতিতে চীন পৃথিবীর সবচেয়ে অগ্রগামী রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ চীন আজ নিজেরা মহাশূন্যে স্পেসস্টেশন করেছে, চাঁদ, মঙ্গল জয় করেছে..! চায়না প্রোডাক্ট না পেলে আমাদের জীবন স্থবির হয়ে যাচ্ছে। নিজের ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখুন, লাইট-ফ্যান-এসি, টিভি, হাতের মোবাইল থেকে শুরু করে সেভ করার রেজার..! কোনটা চায়না প্রডাক্ট নয়..!

কাজেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে হাপিত্যেশ করার কিছু নেই। বরং এই সময়ে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার ব্যাপারে উষ্কানি দেয়, তারা অবশ্যই জাতির শত্রু। করোনা মোকাবেলায় সরকার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যা লাগে কোন কার্পন্য নাই। ২৫০ টাকা সুই ২৫০০০টাকায় কিনেও কাজ চালানো চাই। আর এ নিয়ে যদি কেউ কথা বলার চেষ্টা করে তার নিস্তার নাই। যেহেতু করোনা মোকাবেলায় অনেক সময় ও টাকার দরকার। দ্রব্য মূল্যে দাম যেভাবে হু হু করে বাড়ছে, এই ২০২১ সালেই এক কেজি মুড়ি ১৪ হজার ৮৮০ টাকায় কিনে খাচ্ছেন মানুষ..! আরো সামনের দিন তো আছে পড়ে..! কি হয় তখন কে জানে..!! এখানে আমার একটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আছে। সবাই মিলে বিবেচনা করে দেখতে পারেন।

যেহেতু টেলিভিশন ও অনলাইনেই শিক্ষা কার্যক্রম চলছে, চলবে। তাহলে তো এক বা দুই সেট করে শিক্ষক হলেই চলে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ইউনিভার্সিটি। এই চার স্তরের জন্যে আট সেট শিক্ষক থাকবে। বাকি সব শিক্ষক ছাটাই। রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা বেঁচে যাবে। যা এখন এই শিক্ষকদের বেতন ও প্রশিক্ষণের নামে বিনা কারণে বসিয়ে বসিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই টাকা দিয়েই করোনা মোকাবেলা করা যাবে আছান ভাবে। প্রতি বছর পদ্মাসেতু বা মেট্রো রেলের চেয়েও বড় কোন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে। বুয়েট ও মেডিকেলের স্টুডেন্টরা যেহেতু বেশি মেধাবী তাই ওরা ইউটিউব দেখে শিখে নিতে পারবে সব।

চাকুরী হারা শিক্ষকরা সব ক্ষেত খামারে কাজ করবে বা সবজি বিক্রি করবে বা রিকশা চালাবে। যেমনটি গত ১৭ মাস যাবৎ বেসরকারি ও কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরা করছেন। তখন আমরা সৈয়দ হকের ভাষায় বলতে পারবো, “অন্তত এইটুকু জানা গেলে জুড়ায় পরান। ভালো ভাগ্যে না হই, মন্দ ভাগ্যে সকলেই সমান।”

কথাগুলোকে উপহাস মনে করে ক্ষুব্ধ হবেন না বা কৌতুক মনে করে উড়িয়ে দেবন না। এর আগে আপনাদের যে ১৯ এর গাণিতিক পরিক্রমা শুনিয়েছিলাম তার পরের সময়টা কিন্তু ২০২৮ সাল। ২০১৪ সালের হাস্য রসাত্মক গল্পটি যদি ৭ বছর পরে হাড়ে হাড়ে সত্যি হয়ে যেতে পারে, তবে আজ থেকে ৭ বছর পরে ২০২৮ সালে যে আজকের আশংকা সত্যি হয়ে যাবে না তা কি কেউ হলফ করে বলতে পারেন..? সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ভেবে যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে অংশ নিচ্ছেন না, তারা দায় এড়াতে পারবেন তো..? কর্মহীন হয়ে স্বল্প আয়ের মানুষেরা মুখ থুবড়ে পড়লে রাজস্ব আয়ের ধারা বহাল থাকবে..? তারল্য সংকটে পড়ে কৃচ্ছতা সাধনের অংশ হিসাবে আপনি চাকরী হারা হলে কি করবেন..? হয়তো ভাবছেন, এত কিছু থাকতে শিক্ষকরা চাকুরীহারা হবেন কেন..? সব চললে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও চলবে। নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুনতো, সব কিছু খোলা, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা না কেন তা নিয়ে কখনো প্রশ্ন তুলেছেন আপনি..? এটা কি আপনার দুর্বলতম দিক নয়..! আর আগ্নেয়গিরিরে অগ্ন্যুৎপাত যে ভূপৃষ্ঠের দুর্বল জায়গাতেই ঘটে..!!

কীটনাশকের অত্যাচারে ছারপোকা তার জীবনী শক্তি বৃদ্ধি করেছে প্রায় এক হাজার গুণ। আমরা বেসরকারী বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকরাও কিন্তু গত দু’বছরে বিকল্পভাবে বেঁচে থাকতে টিকে গেছি। কেউ কচু বেচছি, কেউ চা বেচছি, কেউ সবজি বা ফল। আবার কেউ চালাচ্ছি রিকশা। যে মানুষ আমাদের কথার আগে পরে স্যার বলে ডাকতো, আয়হীন ১৭ মাসের অভাবের কারনে সে এখন ভাই বলে ডাকে, টিকা টিপ্পনী কাটে। আমাদের তা গা সহা হয়ে গেছে। মেনে নিতে প্রস্তুত আছি এটাও, যে শিক্ষার্থীরা আমাদের দেখলে সালাম দিত, সেই শিক্ষার্থী হাঁক দিয়ে ডেকে বলবে, “এই মামা রিকশা, যাবে নাকি..?“ আমরা পৌঁছে দিয়ে তাদের কাছ থেকে হাত পেতে ভাড়া নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবো। বউ-বাচ্চা নিয়ে আধপেটা খেয়ে হলেও বাঁচবো। কিন্তু আপনি কি করবেন..? ভেবেছেন কখনো..??

এই যে ১৭টা মাস এই শিক্ষকদের কোন খোঁজ নেননি আপনি, তা কি আপনার বাচ্চারা দেখে নাই..? অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা হিসাবে কি শেখে নাই, উপার্জনের ক্ষমতা কমে গেলে বা হারিয়ে গেলে একদা সম্মানিতদের, পিতৃস্থানীয়দের কিভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়, অবজ্ঞা করতে হয়..? আপনি কি জানেন, উন্নত বিশ্বে শিক্ষকদের বেতন কমিউনিটি দেয়..? আমাদের দেশে মসজিদ-মন্দিরের ইমাম পুরোহিতদের বেতনের মত করে। যে শিক্ষক আপনার পরিবারের সন্তানটিকে আদরে আহ্লাদে অক্ষরজ্ঞান দিয়েছে, লিখতে পড়তে শিখিয়েছে। এই বিপদের দিনে আপনার কোন দায়িত্ব ছিল না তাদের জন্যে..? অর্থ দিয়ে না হোক, নৈতিক সমর্থনটুকু কি দিয়েছেন আপনি..?

পদ-পদবীর লোভে, অবাধ লুটপাটের উচ্ছিষ্ট ভোগের লোভে, নিজের বোধ-বুদ্ধি-বিবেক বন্ধক দিয়ে যে দলকানা জিকির করে যাচ্ছেন, তা আপনার দিকে বুমেরাং হয়ে ফিরে আসতে বেশি সময় লাগবে না কিন্তু। প্রকৃতির একটা নিয়ম আছে। সে কোন জায়গা যেমন ফাঁকা রাখে না, তোমনি সে কাউকে কখনো ক্ষমাও করে না।

আলাওলে কবিতায় পড়েননি, “দ্বিতীয়ে প্রণাম করে মাও বাপ পায়, যান দয়া হস্তে জন্ম হইল বসুধায়..!” কখনো খুঁজে দেখেছেন, মা-বাবাকে দ্বিতীয়ে প্রণাম করলে, প্রথম প্রণাম করবে কাকে..? কে সে..?? সে যে শিক্ষক..!! অথচ আপনারা আজ শিক্ষককে বানিয়েছেন কলম পেষা মজদুর। তাকে রাস্তায় নেমে সাহায্য চাইতে হবে। আর আপনি সেখানে করবেন টিকা টিপ্পনী। তাকে তার ইবাদতখানাসম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবী নিয়ে রাস্তায় নামতে হবে। আর আপনি সেখানে করবেন বিরোধিতা। হে মোর দুর্ভাগা দেশ, যাদের করেছো অপমান। অপমানে হতে হবে তাহাদের সমান। নইলে যে পৃথিবীর নিয়ম মিথ্যা হয়ে যাবে। সূর্য যে আর একদিকই প্রতিদিন উদিত হবে না।

শিক্ষকতা কোন পেশা নয়, এটি একটি দায়িত্ব, একটি দায়বদ্ধতা, দেশ-মাটি ও মানুষের কাছে। কাজেই শিক্ষকের বেতন হয়না, ওটাকে বলে গুরু দক্ষিণা। ভক্তি-শ্রদ্ধাভারে শুদ্ধ টাকাটি গুরুপ্রণামী হিসাবে দিতে হয়। তবেই ছাত্রের তরে শিক্ষাগুরুর আশীর্বাদের ঐশীপরশ আপনা থেকেই বর্ষিত হয়, নইলে নয়।

পৃথিবীতে কোন কাজের জন্যে দেরি বলে কিছু নেই। যে সময় চলে গেছে, গেছে যে স্রোত বয়ে, তাকে তো আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না। কিন্তু আর যাতে নষ্ট না হয় বেলা, তার তো চেষ্টা করতে পারি। মাপা হাসি আর চাপা কান্নায় আমাদের বহু দিন গেছে বেনোজলে ভেসে। আজ কথা বলতে গেলে গোঙ্গানী আসে, চিৎকার করতে গেলে আসে কান্না। অনেক হয়েছে বাবা আর না। এবার ঘুম থেকে উঠুন নয়, জাগুন। নিজে জেগে নূরলদীনের মত করে হাক দিন, “জাগো বাহে কোন্ঠে সবাই…!” সবাই মিলে যে জাতিটাকে বাঁচাতে হবে।

একদিকে আমরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে যতটা দাবী জানাই, যতটুকু যুক্তি উপস্থাপন করি, সরকার ততই শক্তভাবে না খোলার পক্ষে তার সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করে যাচ্ছে। কখনো ছলে, কখনো বলে-কৌশলে। আমাদের সজাগ থাকতে হবে। সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তার সাথে আপনার চারপাশের মিল-অমিল কতটুকু হিসাব করে দেখেছেন..? সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষার্থীদের জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলার দায় নেবে না বলছে। গত ৫০ বছরে কোন সরকার কি কারো কোন দায় নিয়েছে..? গত ৫০ বছরে দেখে আসছি, কোন সরকার দায় নেয় না। সব সরকারই দায় এড়ায় বা অন্যের কাঁধে দায় চাপায়।

কঠোর শাটডাউনে শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা রাখায় এই যে দুর্ঘটনায় এতগুলো তাজা প্রাণ পুড়ে অঙ্গার হ’ল তার দায় কে নেবে..? কে নিয়েছিল, তারজিনে হত্যাকান্ডে দায়..? রানা প্লাজার হত্যাকান্ডের দায়..? আইন সবার জন্যে সমান না হলে তো বিপদ। ১৪ জুলাই মাঝ রাত পর্যন্ত শাটডাউনের মেয়াদ। তারই মধ্যে নব নির্বাচিত ইউপি জনপ্রতিনিধিদের শপথ কেন ১২ ও ১৩ তারিখে পড়ানো লাগলো..? দলবল, চ্যালা চামুন্ডা নিয়ে তারা যে শপথ নিতে এলেন, বিজয় মিছিল করলেন তাতে কি কঠোর শাটডাউনের নিয়ম ভঙ্গ করেননি তারা..? এক দিন পরে নিলে কি হ’ত..? তাদের চেয়ারম্যন পদ খারিজ হয়ে যেত না দেশের বহমান আইনের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হ’ত..! এই নির্বাচনের সময়ে একজন প্রার্থীও কি পাওয়া গেছে যিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘যে করোনার জন্যে প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমি নির্বাচনের জন্য যেতে পারি না।’ এমন যদি হবেন জনপ্রতিনিধি, তবে গণশত্রু দেখতে না জানি কেমন..!

প্রাইমারি থেকে ইউনিভার্সিটি। একজন শিক্ষকও কি পাওয়া গেছে যিনি বলেছেন, ‘ক্লাস না করিয়ে আমি আর বেতন নিতে চাই না..!” আমাদের দেশে এত বিশ্ববিদ্যালয়, একজন ভিসি কি বলতে পেরেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার স্বপক্ষে কোন কথা..? সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্যে নিজের কোন প্রেসক্রিপশন কি দিতে পেরেছেন সরকারকে..? এগুলো আমাদের দুর্ভাগ্য।

আমরা বলছি না, কালকেই খুলে দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। আমরা বিবেচনা করতে বলছি, যখন শিল্প কারখানা খোলা রয়েছে, সেখানের শ্রমিক ভাই-বোনদেরও তো পরিবার আছে। ছেলেমেয়ে আছে। দিন শেষে তারা যখন এক ছাদের নিচে থাকছে, তখন তো করোনা আক্রান্ত হচ্ছে না। তবে স্কুলে গেলে কেন হবে..? যখন গণপরিবহণ চলছে, তখন তো সেই বাবা-মা, ভাই-বোনেরা তাতে চড়ছেন। তখন তো করোনা আক্রান্ত হচ্ছে না। তবে স্কুলে গেলে কেন হবে..? স্কুলের বেঞ্চে তো আলাদা ভ্যারিয়েন্টের হাই প্রোফাইল করোনা থাকে না..!! বিশেষ দিবস উদযাপনে যখন শিক্ষার্থীদের স্কুলে যেতে বাধ্য করা হয়, তখন তো করোনা আক্রান্ত হচ্ছে না। তবে নিয়মিত স্কুলে গেলে কেন হবে..?

যেভাবে অন্যান্য খাত সমূহকে বিশেষ ব্যবস্থায় বা বিশেষ শর্ত সাপেক্ষে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়া হচ্ছে, সেভাবে কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলার অনুমতি দেয়া যাবে না..? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার কথা শুনলেই যাদের মগজে করোনা আক্রমণ শুরু করে তারা কারা..? তাকিয়ে দেখুন, এরা প্রায় সবাই নিজ নিজ পেশায় অসৎ। দুর্নীতিবাজ, লুটেরা বা তাদের দোসর বা উচ্ছিষ্টভোগি। এদের কাছে করোনা এক মহা আশীর্বাদ। এরা চাইবেই এমন অবস্থা বিরাজ থাক অনাদিকাল পর্যন্ত। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে আক্রান্ত এ পরজীবীরা বালিশ, পর্দাসহ কত শত নজির স্থাপন করেছে। সর্বশেষ সর্বগ্রাসী ক্ষুধায় এরা এক কেজি মুড়ি ১৪,৮৮০ টাকায় কিনে খেয়েছেন। করোনার সাথে যুদ্ধ করে দেশের মানুষ টিকে গেলে এত দামের মুড়ি কি এরা খেতে পারবে..? শুধু কি এত উচ্চ মূল্যে মুড়ি খেয়েই খান্ত..! সম্প্রতি ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার দক্ষিন রাজাপুরের ইউসুফ আলী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ফিরোজা মজিদ বিদ্যালয় ও ৩১ দক্ষিন রাজাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামের এই তিন বিদ্যালয়ের খেলার মাঠ চষে পুরোদমে চাষাবাদ শুরু করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। ম্যানেজিং কমিটি ও প্রধান শিক্ষককে ম্যানেজ করে শিক্ষার্থীদের খেলার মাঠে চলছে চাষাবাদ। উপজেলার এ দৃশ্য এখন যে কারো চোখে পড়বে। কাজেই করোনাকে এরা কেন ছাড়বে.! শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললেই যে তাদের বাড়া ভাতে ছাই পড়বে। করোনা ছাড়া যে এদের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা নিবারণ অসম্ভব..!

প্রিয় পাঠক, আপনার সন্তানের প্রতিনিধি আপনি। আপাতত, আপনার কোন প্রতিনিধি নেই এদেশে বা সমাজে। কাজেই ২৯ জুলাই লাগাতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০তম দিনে আপনার মত তুলে ধরুন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে সরকারের অনাহক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের দাবীতে সোচ্চার হোন। নইলে অনাগত ভয়াবহ পরিস্থিতির কাছে আপনাকে বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত হতে হবে।

আপনি হয়তো জানেন, দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্য ৪ কোটি ৮০ লক্ষের উপরে। একটি পদের বিপরীতে হাজার প্রার্থী থাকে। যার সবাইকে ওয়েল এডুকেটেড বলে ধরে নেয়া হয়। কাল যখন কোন প্রতিষ্ঠানের কর্মী দরকার হবে, তখন হাজার প্রার্থীর মধ্য থেকে কেন অটোপাস, এ্যাসাইনমেন্ট পাস বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসের ঊনপাস কার হাফ এডুকেটেড প্রার্থী নেবেন..??

চাকরি না করে উদ্যোক্তা হতে সরকারের গালভরা বুলি যারা আওড়াচ্ছেন, তারা কি দেশের আইন শৃঙ্খলা সম্পর্কে জানেন..? প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে একটি পন্যবাহী যান ঢাকায় আসতে কত জায়গায় তাকে চাঁদা দিতে হয়..! কোথাও কোন কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নিলে কত প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়..! কেন এগুলো হয় তা কি খুঁজে দেখেছেন কখনো..?

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে সোচ্চার না হয়ে যা করেছি ইতোমধ্যে, তাতেই আগামী শতবর্ষ অনাগত প্রজন্ম আমাদের অভিশাপ দেবে। অদূর ভবিষ্যতে এই ছেলেমেয়েরা যখন কোথাও কোন কমপিটিটিভ জায়গায় নিজেকে প্রতিস্থাপন করতে পারবেন না, তখন এদের মানসিক অবস্থা কী হবে..? সমাজ-সংসার-রাষ্ট্রে যে বিশৃংখলা ও অপরাধ প্রবনতা দেখা দেবে- তা রোধ করার মত কোন শক্তি সামর্থ কি আপনার আছে..? আমাদের রাষ্ট্রের কি এ বিষয়ে কোন ভাবনা-পরিকল্পনা আছে..! শুধুমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের হতাশায় গত দেড় বছরে কতজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে আপনি জানেন..? হতাশা আর ব্যর্থতার গ্লানিতে কাল ক্ষিপ্ত হয়ে যখন আপনাকেই প্রতিপক্ষ খাড়া করবে তখন কি করবেন..?

কাজেই, সময় নেই আর সময় নষ্ট করবার। আপনার সন্তানের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবীতে পথে নামুন। সোচ্চার হোন। যেখানে আপনার সন্তানের জন্যে জাতিসংঘ কথা বলে যাচ্ছে, সেখানে আপনি নিশ্চুপ থেকে কি আপনার সন্তানের জন্য ভালো কিছু করছেন..? আয়নার দিকে তাকিয়ে, নিজের চোখে চোখ রেখে ভাবুন..! পথে নামা ছাড়া আমাদের যে আর গত্যন্তর নেই।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
শিক্ষক ও সংগঠক। সেক্রেটারি জেনারেল, বরিশাল কিন্ডারগার্টেন ফোরাম। admin@nipobon.net
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!