বিশ্ব ম্যাংগ্রোভ দিবস:
সুন্দরবনের গাছ—গেঁও

ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
ড. সৌমিত্র কুমার চৌধুরী
7 মিনিটে পড়ুন
গেঁও গাছের পাতা।

গেঁও (Gnew, Gneoa) গাছটি লবনাক্ত জলে বেঁচে থাকতে পারে। এ ধরনের অনেক গাছ আছে সুন্দরবন তথা দুনিয়া জুড়ে। সামগ্রিক ভাবে লোনা জলে বেঁচে থাকা এই গাছ গুলোকে বলে ম্যাংগ্রোভ (Mangrove)। এদের উপকারিতা অনেক। উল্লেখযোগ্য দু’একটি, এরা স্থলভূমি বা দ্বীপভূমিকে রক্ষা করে। গাছ-প্রাচির তৈরি করে ডাঙা জমির ক্ষয় আটকায়। মাটিকে ধরে রাখে শক্ত করে, জলের তোড়ে ভেসে যেতে দেয় না। ঝড়ের আঘাত থেকে রক্ষা করে স্থলভূমিকে। যেমন ভয়ঙ্কর সুনামির হাত থেকে (2004) আন্দামানের অনেক দ্বীপ ও তার অধিবাসীদের বাঁচিয়েছিল ম্যাংগ্রোভ অরণ্য-প্রাচির। বিধ্বংসী আইলা ঝড়ের (২০০৯) তাণ্ডব খানিক আটকে দিয়েছিল ম্যাংগ্রোভ অরণ্য। আম্ফান (২০২০), ইয়শ (২০২১)-এর আঘাত প্রশমিত করেছিল ভারত-বাংলাদেশের সুন্দরবনের ম্যাংগ্রোভ অরণ্য।

ম্যাংগ্রোভ শব্দটির বাংলা আভিধানিক অর্থ ‘গরান’, কিন্তু এটি যথার্থ নয়। গরান নামের একটি ম্যাংগ্রোভ বৃক্ষ সুন্দরবন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন জলা-জঙ্গলে, সমুদ্রের ধারে পাওয়া যায়। সুন্দরবনের জলা-জঙ্গলে গেঁও, গরান ছাড়াও বহু উদ্ভিদ– হেতাল, সুন্দরী, গরজন, গোলপাতা ইত্যাদি পাওয়া যায়। অনেক ঐশ্বর্যের মধ্যে এই ধরনের গাছের প্রাচুর্যও সুন্দরবনের এক বড় সম্পদ। পৃথিবী জুড়ে ম্যাংগ্রোভ-গাছ পঞ্চাশ রকমের, শুধু সুন্দরবনে পাওয়া যায় 26 রকম।

এত রকমারি উদ্ভিদের মধ্যে আমাদের আলোচনার বিষয়—গেঁও। কেন? অনেকে বলেন, গাছটি ক্যানসার রোগে কার্যকারী। এর পাতায় ক্যানসার রোগ নিরাময়ের উপাদান আছে। কতদূর সত্যি? সে প্রসঙ্গে যাবার আগে গেঁও সম্পর্কে অন্য কিছু কথা।

এই বৃক্ষ ইউফোরবিয়াসি (Euforbiaceae) পরিবারের অনেক গাছের একটি। গাছের বৈজ্ঞানিক নাম এক্সকোকারিয়া অ্যাগালোছা এল (Excoecaria agallocha L)। বেশ লম্বা গাছ (45 ফুট), নারী-পুরুষ দু’ধরনের হয়। গাছের কাণ্ড শক্ত, শিকড় মাটির অনেক গভীরে পৌঁছায়। কালো রঙের ছোট ছোট ফল ধরে গাছে। আর পাতা বেশ মোটা এবং শক্ত। চাপ দিলেই হাতে এক ধরনের আঠা লেগে যায়। সহজে পরিষ্কার হয় না। জলে দীর্ঘক্ষণ ধুতে হয়। ধুয়ে না ফেললে অর্থাৎ বেশীক্ষণ লেগে থাকলে ত্বকে এক ধরনের ঘা সৃষ্টি হয়। আর গাছের পত্র নির্যাস চোখে লাগলে বিপদের সম্ভাবনা। চোখ জ্বালা শুধু নয়, সাময়িক অন্ধত্ব সৃষ্টি হতে পারে। এ কারণে তৃণভোজী প্রাণী এই গাছ থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে।

বিজ্ঞান অনুসন্ধানের কাজে এই গাছের পাতা সংগ্রহ করতে হয়েছিল। অত্যন্ত সতর্কতায় হাতে গ্লাভস পরে পাতায় হাত দিয়েছিলাম। অবশ্য শুকনো পাতার সংস্পর্শে ক্ষতির কোন সম্ভাবনা নেই।

গেঁও নামের বৃক্ষটির অনেক গুণ। এর গাছ ও পাতার ঠিকঠাক ব্যবহারে বহু অসুখ সারে। মৃগী, কুষ্ঠ (ল্যাপ্রসি), দন্তশূল, ত্বকের রোগ। এ সব আধুনিক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য। ইদানিং কালে দেশ-বিদেশের একাধিক গবেষক জানিয়েছেন, গেঁও পাতায় ক্যানসার নিরময়কারি উপাদান আছে। এ কথা কি সত্যি? ক্যানসার রোগ সারানোর তেমন উপাদান কি গেঁও পাতায় আছে?

আছে। অনেক মুল্যবান উপাদান—ডাইটারপিন, ট্রাইটারপিন, ফ্ল্যাভোন, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট জাতীয় রাসায়নিক উপাদানে ঠাসা গেঁও বৃক্ষের পত্র। এ ছাড়াও আছে অন্য উপাদান। পাতার ভিতরে উপস্থিত কিটোন এবং এনল জাতীয় পদার্থ ক্যানসার নিরাময় করতে পারে। তবে এখন অবধি দুনিয়া জোড়া গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, গেঁও পাতায় ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি প্রতিহত করবার ক্ষমতা থাকলেও তার শক্তি খুব উঁচু মাত্রার নয়।

এই পাতা নিয়ে আমরা কিছু গবেষণা করেছি। আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে সুন্দরবনের গোসাবা অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত গেঁও পাতার ক্যানসার কোষ ধ্বংসের ক্ষমতা থাকলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু নয়। সে কারনে এই বিষয়ে গবেষণায় ইতি টেনেছি। অবশ্য ইতি টেনেছি, এ কথা ঠিক নয়।

অন্য রকম সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছি গেঁও পাতায়। আগে বলা হয়েছে, এর মধ্যে আছে ফ্ল্যাভোন এবং অন্য একাধিক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কী করে? শরীরের ক্ষয় রোধ করে। যেমন ত্বকের উজ্জল্য ধরে রাখে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এই ধরণের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট যৌগ থাকে ফল-সব্জিতে, বহু ক্রিম বডি-লোশন ইত্যাদিতে। রসায়নশাস্ত্র মতে, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আদতে বিজারক (Reducing agent) দ্রব্য। এরা জারণ বা অক্সিডেশন (Oxidaton) ক্রিয়ার বিধ্বংসী আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে। গেঁয়ো পাতার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ধর্মকে কাজে লাগিয়ে আমরা তৈরি করেছি নোতুন আকারের রাসায়নিক পদার্থ — সিলভার অক্সাইড ন্যানোপারটিকল।

ন্যানোপারটিকল অতি ক্ষুদ্র আকারের পদার্থ কনা। কত ক্ষুদ্র? আকারে এক থেকে মাত্র একশ ন্যানোমিটার। এক ন্যানো মিটার মানে এক মিটারের দশ কোটি ভাগের এক ভাগ। ন্যানোপারটিকল ছোট আকারের, তাই কোষের ঝিল্লির (Membrane) ভিতর দিয়ে সহজেই ঢুকে যেতে পারে কোষের অনেক গভীরে। যে কোন ধাতুর ন্যানো পদার্থ কনা তৈরি করা যায়। সিলভার ধাতুর ন্যানোপারটিকল বহু গুণসম্পন্ন। আমরা তৈরি করেছি ন্যানো সিলভার কণা। এই ন্যানো সিলভার তৈরিতে বিজারক পদার্থের দরকার। এখানে বিজারক পদার্থ হিসাবে কাজে লাগিয়েছি আমাদের স্থানীয় সহজলভ্য সস্তা গেঁও পাতাকে। পাতাকে ধুয়ে শুকনো করে তারপর গুঁড়ো করে বিক্রিয়ায় ব্যবহার করা হয়েছে।

উৎপন্ন ন্যানো সিলভার, অনেক কাজের সঙ্গে সঙ্গে ক্যানসার কোষের বৃদ্ধি আটকাতে সক্ষম। আকার অতি ক্ষুদ্র বলে সহজেই ক্যানসার কোষে ঝিল্লির ভিতর দিয়ে ঢুকে যেতে পারে। আমরা নিউক্লিয়াসে এর অবস্থান দেখতে পেয়েছি কনফোকাল মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে। ক্যানসার কোষের অভ্যন্তরে ঢুকে তার মৃত্যু ঘটায় বিশেষ প্রক্রিয়ায়। এই মৃত্যু প্রক্রিয়ার নাম অ্যাপোটোসিস (Apoptosis)। অন্যান্য কেমোথেরাপি ওষুধের মত এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া নেই কারণ অতি দ্রুত এবং অল্প মাত্রায় কাজ করে সিলভার ন্যানো পদার্থ কনা। আমাদের কাজের এ সব তথ্যই বিস্তারিত ভাবে ছাপা হয়েছে জার্মানি থেকে প্রকাশিত অধুনা একটি গবেষণাপত্রে [Chemotherapy 2017;62:279–289, A Novel Approach of Synthesizing and Evaluating the Anticancer Potential of Silver Oxide Nanoparticles in vitro by Kaushik Banerjee, Satyajit Das, Pritha Choudhury, Sarbari Ghosh, Rathindranath Baral, Soumitra Kumar Choudhuri+, Chittaranjan National Cancer Institute, Kolkata , India].

গবেষণা কর্ম অব্যাহত। বহু তথ্য অজানা। তবে কেমন করে গেঁও পাতা সংগ্রহ করলাম, গবেষণা কর্ম কোথায় করা হল, সমস্ত তথ্যই প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক নিবন্ধটিতে চোখে পড়বে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য বিষয়, গেঁও পাতা ব্যবহার করে ন্যানো সিলভার বানানো এবং তার মধ্যে ক্যানসার কোষ ধ্বংসের সম্ভাবনা খুঁজে পাবার কৃতিত্ব কলকাতায় আমাদের সংস্থার পরীক্ষাগারের আমার নেতৃত্বে কয়েকজন বিজ্ঞানীর। প্রকাশিত গবেষণা পত্রে তাদের পরিচয় লেখা আছে।

অত্যন্ত কম খরচে দেশীয় উপাদানে তৈরি করা যেতে পারে ক্যানসারের এই ওষুধ, সিলভার ন্যানো পারটিকল। এই পদার্থটি পার্শ প্রতিক্রিয়া হীন। বর্তমানের এই গবেষণালব্ধ আবিষ্কার ভবিষ্যতের এক বড় সম্ভাবনার ইঙ্গিতবাহি।

গুগল নিউজে সাময়িকীকে অনুসরণ করুন 👉 গুগল নিউজ গুগল নিউজ

এই নিবন্ধটি শেয়ার করুন
ড.সৌমিত্র কুমার চৌধুরী, ভূতপূর্ব বিভাগীয় প্রধান ও এমেরিটাস মেডিক্যাল স্যায়েন্টিস্ট, চিত্তরঞ্জন জাতীয় কর্কট রোগ গবেষণা সংস্থাণ, কলকাতা-700 026. প্রকাশিত গ্রন্থ- বিজ্ঞানের জানা অজানা (কিশোর উপযোগী বিজ্ঞান), আমার বাগান (গল্পগ্রন্থ), এবং বিদেশী সংস্থায় গবেষণা গ্রন্থ: Anticancer Drugs-Nature synthesis and cell (Intech)। পুরষ্কার সমূহ: ‘যোগমায়া স্মৃতি পুরস্কার’ (২০১৫), জ্ঞান ও বিজ্ঞান পত্রিকায় বছরের শ্রেষ্ঠ রচনার জন্য। ‘চৌরঙ্গী নাথ’ পুরস্কার (২০১৮), শৈব ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত উপন্যাসের জন্য। গোপাল চন্দ্র ভট্টাচার্য স্মৃতি পুরষ্কার (2019), পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও জৈবপ্রযুক্তি দফতর থেকে), পঁচিশ বছরের অধিক কাল বাংলা ভাষায় জনপ্রিয় বিজ্ঞান রচনার জন্য)।
একটি মন্তব্য করুন

প্রবেশ করুন

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন?

আপনার অ্যাকাউন্টের ইমেইল বা ইউজারনেম লিখুন, আমরা আপনাকে পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার জন্য একটি লিঙ্ক পাঠাব।

আপনার পাসওয়ার্ড পুনরায় সেট করার লিঙ্কটি অবৈধ বা মেয়াদোত্তীর্ণ বলে মনে হচ্ছে।

প্রবেশ করুন

Privacy Policy

Add to Collection

No Collections

Here you'll find all collections you've created before.

লেখা কপি করার অনুমতি নাই, লিংক শেয়ার করুন ইচ্ছে মতো!