হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
ভারতবর্ষ তথা বাংলার ইতিহাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর গুরুত্ব বিশেষভাবে অনুধাবনের যোগ্য। এই শতাব্দীতে বাংলার তথা ভারতবর্ষের সমগ্র অধিবাসীর জীবনে, চিন্তায়, মননে, আধ্যাত্মিকতায় এক বিরাট পরিবর্তনের প্রথম পদধ্বনি শোনা গিয়েছিল, বাংলার মাটিতে বিশেষত রাজধানী শহর কলকাতার বুকে। ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর বড় কথা হল পুঁথির যুগের অবসান এবং মুদ্রণের যুগের সূচনা’
(বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিহাস। অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
মুদ্রণ যন্ত্রের প্রভাব যেমন ইউরোপীয় রেনেসাঁকে ত্বরান্বিত করেছিল তেমনি বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্পের প্রকাশের ফলে চিন্তাশীল মানবজ্ঞান যুগপৎ গভীর ও ব্যাপক হল। সরকারি সাহায্যে ভারতবর্ষে ইংরেজি শিক্ষা প্রচলনের সূত্রপাত ঘটে ১৮৩৫ সালে। তখন ওয়ারেন হেস্টিংস ভারতের গভর্নর জেনারেল।
ইংরেজি শিক্ষা ও ইংরেজি ভাষার ভেতর দিয়ে উনিশ শতকের নব্য শিক্ষিত বাঙালির মানস অভিসার ঘটেছিল পাশ্চাত্য ভাবলোকে। বেকন, লক, হিউম, পেইন প্রভৃতি মনীষীদের যুক্তিনিষ্ঠ মতবাদ বাংলার শিক্ষিত সমাজে সংস্কার মুক্তির অভিনব প্রেরণা সঞ্চার করেছিল।
এই সময় অনেক নব সংস্কার আন্দোলন দেখা দিল। অনেক নতুন ধরনের চিন্তার ফসল ফলল। যেমন, বহু প্রাচীন সতীদাহ প্রথার বিলোপ, বহুবিবাহ রোধের জন্য জনমত সংঘটিত হল। স্ত্রী শিক্ষার প্রচলন হল। বালবিধবার ললাটে সিন্দুর বিন্দু এঁকে তাঁর অশ্রুমোচনের চেষ্টা চলতে লাগল।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে শিক্ষিত বাঙালির চিন্তাধারাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করল পাশ্চাত্যের দুইটি বিশিষ্ট মতবাদ। একটি বেন্থাম ও মিলের প্রচারিত উপযোগবাদ (utilitarianism), অপরটি ফরাসি মনীষী আগস্ত কোঁৎয়ের প্রত্যক্ষবাদ (positivism) এবং ফরাসি দার্শনিক রুশোর সাম্যবাদী ধ্যান-ধারণার প্রভাব ও বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়।
এই সময় খ্রিস্টান মিশনারিদের দ্বারা ধর্মান্তকরণ ও হিন্দু বিদ্বেষ একশ্রেণির হিন্দুর মনে ত্রাসের সঞ্চার করল। তারা নিজেদের গোষ্ঠীবদ্ধ করে হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য প্রচারে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। এঁরা প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্যকে পুনঃপ্রবর্তিত করার পক্ষপাতী ছিলেন।
নিজেদের ঐতিহ্য ও নিজেদের ধর্মকে টিকিয়ে রাখার জন্য সমাজের একশ্রেণির বিদ্বান ও জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের এই প্রচেষ্টাকে হিন্দুধর্ম পুনরুত্থানে সূচনা ও কালপর্বকে হিন্দুধর্ম পুনরুত্থানের যুগ বলে চিহ্নিত করা যায়। শিবনাথ শাস্ত্রী ১৮৭০ থেকে ১৮৭৯ এই কালপর্বকে ব্রাহ্মসমাজের প্রভাবের ও হিন্দুধর্মের পুনরুত্থানের সূচনাকাল বলে প্রচার করেছেন।
![হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 38 হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/03/A694360B-9822-4B5F-8C36-08F0DE53EFDD.webp)
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে হিন্দু জাগৃতি ও হিন্দু জাতীয়তাবাদের সহায়ক হয়েছিল, সে দুটি হল— এক) ‘ইলবার্ট বিল’ আর দুই) সামাজিক সংস্কার বিষয়ক আইন ‘সহবাস সম্মতি বিধি’।
পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত ও পাশ্চাত্য চিন্তাধারা ও মননশীলতায় অভ্যস্ত ব্যক্তিরা হিন্দু ধর্মের একটি যুক্তিনিষ্ঠ ব্যাখ্যা প্রচলন করতে উৎসাহিত হলেন।সেই সময়কার সাহিত্য, যেমন নাটক, প্রবন্ধ, সাহিত্য সমালোচনা ইত্যাদির মাধ্যমে তাঁদের মননশীল অভিমত ব্যক্ত করতে লাগলেন। এঁরা হলেন অক্ষয়চন্দ্র সরকার, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। এঁদের এই প্রয়াস জনমানসে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল।
বঙ্কিমচন্দ্রকে হিন্দু পুনরুত্থানের প্রধান বা একজন অগ্রগণ্য পুরোহিত রূপে অভিহিত করা যায়। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাব হল তখন এই আন্দোলন একটি বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। শুধু বাংলায় নয়, ভারতবর্ষে নানা স্থানে হিন্দুত্ববাদী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে। দয়ানন্দ সরস্বতী পশ্চিম ভারতে আর্য সমাজর প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি বেদের মাহাত্ম্য প্রচার করছেন। বেদের যুগে তাঁর দৃষ্টিতে ভারতবাসীর চরম উৎকর্ষের যুগ।
ব্রাহ্মসমাজের আদর্শে মাদ্রাজে বেদ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কলকাতায় শশধর তর্কচূড়ামণি, কৃষ্ণ প্রসন্ন সেন প্রভৃতিরা হিন্দুধর্মের পুনরুজ্জীবনের জন্য এক বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলেন। ব্রাহ্মসমাজে কেশবচন্দ্রের সৃষ্ট উপাসনা, পাশ্চাত্য আদর্শে হিন্দুভাব বিরোধী সংস্কারসমূহ সাধারণ হিন্দুদের ব্রাহ্মসমাজ বিরোধী করে তুলল।
এই পরিস্থিতিতে বঙ্কিমচন্দ্র যখন হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতবাদ নিয়ে এলেন তখন শশধর তর্কচূড়ামণি বা ব্রাহ্মসমাজ কারও সঙ্গেই নিজের মনের মিল খুঁজে পেলেন না। এঁদের কারও সঙ্গেই তাঁর মতবাদের মিল হল না।
তিনি উভয় দল থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং প্রচার পত্রিকায় তাঁর গীতাভাষ্যের ও অনুশীলনধর্মের আলোচনা আরম্ভ করলেন। তাঁর হাত ধরেই শিক্ষিত বাঙালি পুরাতন হিন্দুধর্মের প্রতি আস্থাশীল হলেন।
রাজা রামমোহন রায় যে ব্রাহ্মধর্ম প্রচার করেছিলেন তার ভিত্তি ছিল বেদান্ত। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর একে ঔপনিষদিক ব্রাহ্মধর্মে পরিণত করেন যার ভিত্তিভূমি হল— ‘আত্মপ্রত্যয়সিদ্ধ জ্ঞানোজ্জ্বোলিত বিশুদ্ধ হৃদয়।’
![হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 39 হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/03/469CB510-351E-457A-B2EA-D2F8DD81D92A.png)
আর বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দুধর্মের মধ্যেকার বিভিন্ন বিরোধের অবসান করে একটি সর্বজনগ্রাহ্য যুক্তিনির্ভর হিন্দুধর্মের রূপ প্রকাশ করলেন তার ভিত্তিভূমি হল— শ্রীমৎ ভাগবত গীতা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে শিক্ষিত বাঙালি তার চিন্তাজগতে মিলের ভাবধারাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। এ ছাড়া কোঁৎয়ের প্রত্যক্ষবাদও জনপ্রিয় ছিল। বঙ্কিমচন্দ্রের উপর এদের প্রভাব ছিল। হার্বাট স্পেন্সারের দর্শনের দ্বারাও তিনি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই সব পাশ্চাত্য দার্শনিকদের মতবাদকে ভিত্তি করে তাঁদের বক্তব্যের সঙ্গে ভারতীয় হিন্দু ধর্মকে মিলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা করেছিলেন।
![হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় 40 হিন্দুধর্মের পুনরুত্থান ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়](http://www.samoyiki.com/wp-content/uploads/2023/03/9EBBFDCD-257C-4810-BAF9-05668BEF22A2.png)
পাশ্চাত্য ধর্ম অপেক্ষা হিন্দু ধর্ম কোন অংশ শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে এবং পাশ্চাত্য দর্শনে যে অপূর্ণতা আছে হিন্দু দর্শনে তা কোথায় সম্পূর্ণতা লাভ করেছে সেটাই তিনি বাঙালির কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন । তাঁর ‘ধর্মতত্ত্ব’ ও ‘কৃষ্ণচরিত্র’ এই দুটি গ্রন্থে।
তিনি হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে তাঁর নিজস্ব মতামত প্রকাশ করেছেন। ‘ধর্মতত্ত্বে’ তিনি অনুশীলন ধর্ম কী এবং এটি যে হিন্দুধর্মের সার-স্বরূপ তা প্রকাশ করেছেন। ‘কৃষ্ণচরিত্র’-এ এই অনুশীলন ধর্ম ব্যক্তিমানুষ কৃষ্ণের চরিত্রে কীভাবে সর্বোত্তম উৎকর্ষতা লাভ করেছে তা তুলে ধরেছেন। এক হিসেবে বলা যায় ‘ধর্মতত্ত্ব’ হল ধর্মবিষয়ক তাঁর নিজস্ব অভিমত এবং ‘কৃষ্ণচরিত্র’ হল সেই মতের উদাহরণ স্বরূপ।
বঙ্কিমচন্দ্র গীতার কর্মযোগের উপর তাঁর উপন্যাসগুলোর বিষয়বস্তু সংস্থাপিত করেছেন। ভোগের সঙ্গে ত্যাগের, প্রবৃত্তির সঙ্গে নিবৃত্তির একটা অপূর্ব সমন্বয় সাধন করেছেন। সংসারে থেকে অনুষ্ঠেয় কর্ম করে কীভাবে নিষ্কাম কর্মের অনুশীলন করা যায় তা-ই তিনি এই উপন্যাসগুলোতে তুলে ধরেছেন।
গীতার কর্মযোগকে বর্তমান যুগের উপযোগী করে আনন্দমঠ, দেবী চৌধুরানী ও সীতারাম উপন্যাস ত্রয়ের মাধ্যমে আমাদের কাছে প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়েছেন।
এখানে একটা কথা মনে রাখতে হবে যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যে হিন্দুধর্মের ব্যাখ্যা দিলেন তার ভিত্তি কিন্তু বেদ নয়, এর ভিত্তি হল হিন্দু পুরাণ, হিন্দু মহাকাব্য। এই হিন্দু পুরাণ তথা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ পুরুষ শ্রীকৃষ্ণ তার কাছে আদর্শ মনুষ্যত্বের প্রতীক। তিনি এই শ্রীকৃষ্ণ চরিত্রের প্রেক্ষিতে তৎকালীন হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ আন্দোলনকে বিচার করতে চেয়েছেন।
তিনি শ্রীকৃষ্ণকে বাঙালি জাতির কাছে এক পরিপূর্ণ মানবরূপে তুলে ধরতে চেয়েছেন। মনুষ্যত্বের চরম উৎকর্ষতা এই চরিত্রের মধ্যে বিকাশ লাভ করেছে। তিনি প্রসঙ্গক্রমে খ্রিস্টানদের আদর্শ পুরুষ যিশুর সঙ্গে কৃষ্ণ চরিত্রের তুলনা করেছেন।
শ্রীকৃষ্ণকে বঙ্কিমচন্দ্র দেবতারূপে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি। তিনি দেখিয়েছিলেন যে, সেই সময় যে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী আন্দোলন চলছিল সেই আন্দোলনের সামনে কোনও আদর্শ পুরুষ ছিলেন না, যাঁকে কেন্দ্র করে সমস্ত হিন্দু জাতির ভাবাবেগ বিশ্বাস আবর্তিত হতে পারে। হিন্দুসমাজ বুঝে উঠতে পারছিল না যে, তারা কোন আদর্শকে সামনে রেখে তাদের ধর্মীয় তথা সামাজিক সংস্কারে ব্রতী হবে।
বঙ্কিমচন্দ্র মূলত তাঁর ধর্ম মূলক প্রবন্ধ এবং উপন্যাসের মধ্যে দিয়ে হিন্দু ধর্মের সংস্কার সাধন করে তাকে একটি বৈজ্ঞানিক ও যুক্তিবাদী ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন।
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দার্শনিক মতের তুলনামূলক আলোচনা করে বঙ্কিমচন্দ্র হিন্দু ধর্মের সমুন্নত যে রূপটি আমাদের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন, তা সর্বদাই অমলিন থাকবে এই আশা নিয়ে আজও আমরা দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে পারব।